(প্রথমপর্ব)
লালসার একটাই রং --কালো।
আকাশজুড়ে রঙের খেলা। অস্তযাবার আগে নিজেকে উজাড় করে দিচ্ছেন সূর্যদেব। অন্ধকার গ্রাস করার আগে মানুষকে দান করেছেন অপারশান্তি। প্রাসাদের বাতায়নে দন্ডায়মান যে নারীমূর্তি অপলক শূন্য দৃষ্টিতে দেখছিল প্রকৃতির শোভা, তাঁর শরীর যেন ঈশ্বরের আঁকা একখানি অপরূপ ছবি। বিভঙ্গে বিভঙ্গে খেলা করছে রূপের তরঙ্গ। আকাশ স্তব্ধ। স্তব্ধ গোধূলি। এ এমন রূপ যার সামনে স্তব্ধ পৃথিবী। চক্ষু দুটি যেন নীলকান্ত সরোবর। স্বর্ণ বর্ণের নাতিদীর্ঘ শরীরে কোথাও এতটুকু মলিনতা নেই। মেদ নেই। নিখুঁত সুন্দরী সে নারীর শরীরে একটি মাত্র অলংকার। সে হল অনন্ত বিষাদ। নিজে থেকে দর্পণে মুখ দেখে না এই নারী। সহস্র পুরুষের চোখের কামনায় ফুটে ওঠে যে রূপ, তাকে দেখতে চায় না সে। পৃথিবীর কোনো রূপ কোনো রঙ আকর্ষণ করে না তাঁকে। সে ডুবে আছে পুরুষের কামনা আর লালসার গভীর গোপন আধাঁরে। যেখানে খেলা করে একটি মাত্র রঙ __কালো।
বাতায়ন সংলগ্ন কক্ষ মহার্ঘ আসবাবে সজ্জিত। কমে এসেছে আলো। নিঃশব্দে সেখানে প্রবেশ করে আর এক তরুণী। তার নাম বিশাখা। নিঃশব্দেই জ্বালিয়ে দিতে থাকে একটি একটি স্বর্ণ প্রদীপ। অতি সন্তর্পণে, যেন বাতাসের মত লঘু চরণে, শ্বেত বস্ত্র পরিহিতা, কুঞ্চিত দীর্ঘ খোলা কেশ, উন্মুক্ত মসৃণ পৃষ্ঠদেশে স্পর্শ করে নিজের কুণ্ঠিত আঙ্গুল। এই মৌনতা ভঙ্গ করা অমার্জনীয় অপরাধ। কিন্তু উপায় নেই। সে ক্ষীণ স্বরে সম্বোধন করে:
দেবী আম্রপালি। সন্ধ্যা সমাগত। আসুন। আপনাকে সাজিয়ে তুলি।
বিন্দুমাত্র ঢেউ উঠল না স্তব্ধ প্রতিমার শরীর তরঙ্গে।
বিশাখা আবার বলে:
আজ প্রাসাদে আসবেন সার্থবাহ সুদত্ত। বৈশালীর শ্রেষ্ঠ ধনী, শ্রেষ্ঠী সুদত্ত-র জন্য আজকের দিনটির অনুমতি আপনি নিজেই দিয়েছেন দেবী।
অতি কষ্টে যেন জোর করে বাইরের মুক্ত প্রকৃতির থেকে নিজেকে সরিয়ে উত্তর করে আম্রপালি:
সে কি আজকে?
ঢোঁক গিলে বিশাখা বলে:
হ্যাঁ দেবী। আপনি অনুমতি দিলে শৃঙ্গার শুরু করি? প্রাসাদ সজ্জা সম্পূর্ণ। দীপ ফুল মালা চন্দন প্রস্তুত।
: কিন্তু আমি প্রস্তুত নই। আমার ইচ্ছে করে না।
কোমল স্নেহে বিশাখা বলে:
আমি জানি দেবী। আজকাল আপনার মন বড় উদাস। কিন্তু , রাতের জন্য এক লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা দিয়েছেন শ্রেষ্ঠী। এ অবশ্য এমন কিছু না। আপনার শরীরের মধুর সৌরভের ঘ্রাণ মাত্রের জন্য প্রাণ বাজি রাখতে পারে বৈশালীর সমস্ত রাজপুরুষ। অর্থ তো সামান্য।
মৃদু হেসে পরিবেশ লঘু করতে চায় বিশাখা। সে শুধু সখী না। সচিব বটে। শ্রেষ্ঠী যেমন ধনী তেমনি কুটিল। বৈশালী তাঁর হাতের মুঠোয়। স্বয়ং রাজাকে দ্বারস্থ হতে হয় সময় সময়। অর্থ যার, ক্ষমতা তার। এ হেন ব্যক্তিকে নিরাশ করার অর্থ হতে পারে মারাত্মক। গুপ্ত হত্যা অথবা প্রাসাদে আচমকা আগুন লেগে যাওয়া , বিচিত্র কিছু নয়। সে আর দেরী করল না। কক্ষের বাইরে অপেক্ষারত দাসীদের নির্দেশ দিল ভিতরে প্রবেশের। নিজে দ্রুত হাতে বস্ত্র খুলতে লাগল আম্রপালির। নগ্ন শরীরে লাগান হবে গোলাপ মল্লিকা __এমন নানা সুগন্ধি ফুলের নির্যাস। শরীরের খাঁজে খাঁজে থাকবে মৃগনাভির উত্তেজক ঘ্রাণ। বস্ত্র থাকবে রেশম সূক্ষ্ম। যার মধ্যে দিয়ে আরো আকর্ষণীয় হবে সোনার বরণ শরীরটি। আপনমনে হাসেন আম্রপালি। এই সাজের কোনো অর্থ নেই। পুরুষ শুধু দেখে মাংসপিন্ড। তার উপরে কোনো আবরণ সহ্য করে না সে।
*****
আম্রপালির প্রাসাদ তাঁর নিজের রুচিতে সাজান। প্রাসাদ নয়, যেন কোনো মায়ালোক। সেখানে যতক্ষন থাকেন, দেশ বিদেশের রাজপুরষ ,রাজা--তারা ভুলে যান অতীত , ভবিষ্যত। সত্য শুধু বর্তমান। কোনো এক অলৌকিক স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে স্নান করেন সুগন্ধী ভেষজ জলে। বস্ত্র পরিবর্তন করে দেয়, মায়ালোকের পরীর দল। নরম হাতের অলৌকিক স্পর্শ খেলে বেড়াতে থাকে শরীরে। । কোন অদৃশ্য লোক থেকে বীণ বাজে। তার সুর, তার মূর্ছনা শুষে বার করে নেয় বুকের ভিতর জমে থাকা অভিমান রাগ দ্বেষ। সম্পূর্ণ হালকা শরীর মন নিয়ে আরামদায়ক কক্ষে, নরম সুখশয্যায় , স্বপ্নআলোর মধ্যে উপবেশন করলে--পরিবেশিত হয়, আম্রপালির নির্দেশে তৈরী, এক বিশেষ ভেষজ সুরা। পান করলে, শরীর মন দুইই সম্পূর্ণ সুস্থ, সতেজ আনন্দময় মনে হয়। প্রাসাদ, উদ্যান চারিদিকে অপরূপা সুন্দরী নারী, যারা উপযুক্ত শিক্ষিতাও বটে --অতিথি আপ্যায়ণের সমস্ত কৌশল, সেই সঙ্গে বিশেষ শরীরী বিভঙ্গে , নানা কৌতুক , হাসি --ক্রমে ক্রমে ডুবে যায় পুরুষ। মন উজাড় করে বলতে থাকে ,নিজেদের কথা। কোনো অসন্তোষ, কোনো রাজ বিদ্রোহ অথবা আনুগত্য --যাই হোক না কেন--নিঃসন্দেহে , গোপণ আর থাকেনা কিছুই।
আম্রপালির প্রাসাদ তাঁর নিজের রুচিতে সাজান। প্রাসাদ নয়, যেন কোনো মায়ালোক। সেখানে যতক্ষন থাকেন, দেশ বিদেশের রাজপুরষ ,রাজা--তারা ভুলে যান অতীত , ভবিষ্যত। সত্য শুধু বর্তমান। কোনো এক অলৌকিক স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে স্নান করেন সুগন্ধী ভেষজ জলে। বস্ত্র পরিবর্তন করে দেয়, মায়ালোকের পরীর দল। নরম হাতের অলৌকিক স্পর্শ খেলে বেড়াতে থাকে শরীরে। । কোন অদৃশ্য লোক থেকে বীণ বাজে। তার সুর, তার মূর্ছনা শুষে বার করে নেয় বুকের ভিতর জমে থাকা অভিমান রাগ দ্বেষ। সম্পূর্ণ হালকা শরীর মন নিয়ে আরামদায়ক কক্ষে, নরম সুখশয্যায় , স্বপ্নআলোর মধ্যে উপবেশন করলে--পরিবেশিত হয়, আম্রপালির নির্দেশে তৈরী, এক বিশেষ ভেষজ সুরা। পান করলে, শরীর মন দুইই সম্পূর্ণ সুস্থ, সতেজ আনন্দময় মনে হয়। প্রাসাদ, উদ্যান চারিদিকে অপরূপা সুন্দরী নারী, যারা উপযুক্ত শিক্ষিতাও বটে --অতিথি আপ্যায়ণের সমস্ত কৌশল, সেই সঙ্গে বিশেষ শরীরী বিভঙ্গে , নানা কৌতুক , হাসি --ক্রমে ক্রমে ডুবে যায় পুরুষ। মন উজাড় করে বলতে থাকে ,নিজেদের কথা। কোনো অসন্তোষ, কোনো রাজ বিদ্রোহ অথবা আনুগত্য --যাই হোক না কেন--নিঃসন্দেহে , গোপণ আর থাকেনা কিছুই।
আম্রপালি নিছক মনোরঞ্জনকারী বেশ্যা নন, তিনি জনপদবধূ। রাষ্ট্রের কল্যাণে উৎসর্গিত এক মহান প্রাণ। তাঁর ব্যক্তিত্বের বিভায় তুচ্ছ হয়ে যায় ভোগী পুরুষের কামনা।
তবু কেন চোখে জল তাঁর? তবু নিজেকে এত ঘৃণিত মনে হয় কেন? ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয় সোনার শিকল।
কে যেন ডাকে ? কে ডাকে? তাঁর স্বাধীন সত্তা?
তাঁর নিজের ইচ্ছে? কে ডাকে ?
■ আম্রপালি ২
আদিগন্ত বাগান। সারি সারি আম গাছ। বৈশালীতে এত বিশাল উদ্যান আর নেই। উদ্যান না বলে, আম্রবন বলা যেতে পারে। উদ্যান সহ এক মর্মর প্রাসাদ দান করা হয়েছে আম্রপালী-র বসবাস করার জন্য। সেই সঙ্গে, প্রহরী, স্বর্ণ রথ, অজস্র দাস দাসী --
যারা দিন রাত প্রাসাদ এবং বাগিচার সৌন্দর্য রক্ষায় ব্যস্ত। প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। সবুজ উদ্যানের মাঝখান দিয়ে, গেরুয়া বর্ণের পথ চলে গেছে , শ্বেত মর্মর প্রাসাদের দিকে।
ঘর্ঘর শব্দে রথ এসে থামল প্রধান ফটকের সামনে। যন্ত্র চালিত একটি কণ্ঠ পরিচয় জানতে চাইলে, রথের আরোহী যুবা বলল--
আমি ভিনদেশি বণিক। আম্রপালী র সাক্ষাৎ প্রার্থী।
---আপনি বৈশালীর নন , বোঝা যায় পোশাক আর আপনার স্পর্ধা দেখে”--ফটকের বাইরে রাখা যন্ত্রটি বলে উঠল---আপনি জানেন না, তাই বলি, অন্তত একবছর আগে থেকে, নিজের সমস্ত পরিচয় দিয়ে আবেদন জানিয়ে রাখবেন ,ভদ্রে। আপনি বিবেচিত হবেন তখনই, যখন স্বয়ং মহারাজ্ঞী অনুমতি দেবেন।” যন্ত্র নীরব হলে, রথের মধ্যে থেকে একটি গম্ভীর রাজকীয় কন্ঠ ভেসে এল
“ বন্ধু, রথ ঘোরাও। চিন্তা করো না। বিম্বিসার কোনো কাজে অকৃতকার্য হয়না। “
নিঃশব্দ দুপুরের বাতাস সর সর শব্দ করে বয়ে গেল কৌতুকে। একসঙ্গে উদ্যানের পাতা দুলে উঠল আনন্দে। কেন এই আনন্দ? এমন কত রাজপুরুষ তো আসে, তবে ইনি আসতে প্রকৃতি কিসের সূচনা দেয়?
“ ঝড় এলো না কি? ‘ নিজের কক্ষে , প্রিয় সখী বিশাখার সঙ্গে বসে
ছিলেন আম্রপালি। চমকে উঠলেন। কপালে উড়ে আসা চুলের গুচ্ছ, হাত দিয়ে সরিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন তিনি
“ ঝড় এল না কি?
---আসেনি, তবে আসতে কতক্ষণ? বিশাখা বলে--
ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। ঝড় আসতেই পারে। জীবনে না এলেই মঙ্গল।’
প্রশংসার চোখে ,বিশাখার দিকে তাকালেন আম্রপালি। তাঁর সঙ্গে যারা বিশেষ সখী হিসেবে যুক্ত, তারা প্রত্যেকেই বিদগ্ধ, বুদ্ধিমতী এবং দার্শনিক। ব্যক্তিত্ব আর শিক্ষার বিভা ছাড়া রূপ তাঁর পছন্দ না। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ মাত্রেই যেন ধরা পড়ে, এই নারী বিশেষ কেউ।
---বিশাখে, অনাথ শিশু গুলির যথাযথ পরিচর্যা হচ্ছে ত?
দ্রুত সম্মতি জানায় বিশাখা।
---আমি নিজে অনাথ। এই আম বাগানেই কুড়িয়ে পায় আমাকে, আমার পালক পিতা মাতা। যত্নের কোনো ত্রুটি নেই। তবু মনে হয়, নিজের নই বলেই হয়ত আমাকে
নগর নটী করার সিদ্ধান্তে বাধা দেন নি।” ঈষৎ ক্ষোভ ঝরে পড়ে আম্রপালির কথায়।
---এ সত্য নয়। আপনি জানেন ভদ্রে--বলতে গিয়ে থমকাল বিশাখা। আঠের বছরের তরুণী সে। শঙ্খের মত শরীর। অতীব সুন্দরী। যদিও , আম্রপালি-র সামনে সূর্য কিরণ ও ম্লান মনে হয়, তবু, এদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটি করে বিশেষত্ব ধরা পড়ে। বিশাখা খুব স্পষ্টবাদী। সে কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেল, অর্থাৎ কথাটি কোনো কঠিন সত্য।
---বলো বিশাখা, সংকোচ করো না।
--- আপনি জনপদবধূ না হলে, বৈশালীতে বিদ্রোহ অনিবার্য ছিল। কোনো একজনের পত্নী হলে, তাকে হত্যা করা হত। আপনার জীবনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না , ভদ্রে। নারীর ভাগ্য নির্মাণ করে পুরুষ--এই তার নিয়তি।
----বিশাখা ! বড় নির্মম সত্য বললে আজ। তবু আমি হতাশ নই। বুকের ভিতর অনুভব করি এক অমোঘ আহ্বান। অতল জলের নীচে ঘূর্ণি লুকিয়ে থাকে, তার মধ্যে পড়লে নিমেষে টেনে নিয়ে যায় ,ডুবিয়ে দেয়। আমার জীবনেও আসবে অমন ঘূর্ণি স্রোত। বিশাখা, আমি হতাশ নই। মূঢ় পুরুষ ছুঁতে পারবে রক্ত মাংসের এই শরীর। আমার আত্মা থাকবে অধরা। “
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন ভারতশ্রেষ্ঠা সুন্দরী আম্রপালি। কোন সুদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ তাঁর। প্রাসাদের অলিন্দ দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় কে যেন হেঁটে যায়?
মুন্ডিত মস্তক, পদ্ম পাপড়ি যেন দুই চোখ, অসীম শান্তি সর্ব অবয়বে--কে ওই সন্ন্যাসী? কে?
( বৈশালী। আর্যাবর্তের লিচ্ছবি গোষ্ঠীর রাজধানী। সম্পদশালী রাজ্য বলে এখানকার অধিবাসীরা কিঞ্চিৎ অহংকারী। তৃপ্ত। যথেষ্ট কারণ আছে তার। প্রাচীন ভারতে বৈশালীর মত সম্পদশালী নগর খুব কম ছিল। বৈশালী রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল, হিমালয় পর্বতমালা থেকে, আধুনিক বিহার রাজ্যের গাঙ্গেয় উপত্যকা। কাহিনীর সময় কাল খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতক)
তবু কেন চোখে জল তাঁর? তবু নিজেকে এত ঘৃণিত মনে হয় কেন? ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয় সোনার শিকল।
কে যেন ডাকে ? কে ডাকে? তাঁর স্বাধীন সত্তা?
তাঁর নিজের ইচ্ছে? কে ডাকে ?
■ আম্রপালি ২
আদিগন্ত বাগান। সারি সারি আম গাছ। বৈশালীতে এত বিশাল উদ্যান আর নেই। উদ্যান না বলে, আম্রবন বলা যেতে পারে। উদ্যান সহ এক মর্মর প্রাসাদ দান করা হয়েছে আম্রপালী-র বসবাস করার জন্য। সেই সঙ্গে, প্রহরী, স্বর্ণ রথ, অজস্র দাস দাসী --
যারা দিন রাত প্রাসাদ এবং বাগিচার সৌন্দর্য রক্ষায় ব্যস্ত। প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। সবুজ উদ্যানের মাঝখান দিয়ে, গেরুয়া বর্ণের পথ চলে গেছে , শ্বেত মর্মর প্রাসাদের দিকে।
ঘর্ঘর শব্দে রথ এসে থামল প্রধান ফটকের সামনে। যন্ত্র চালিত একটি কণ্ঠ পরিচয় জানতে চাইলে, রথের আরোহী যুবা বলল--
আমি ভিনদেশি বণিক। আম্রপালী র সাক্ষাৎ প্রার্থী।
---আপনি বৈশালীর নন , বোঝা যায় পোশাক আর আপনার স্পর্ধা দেখে”--ফটকের বাইরে রাখা যন্ত্রটি বলে উঠল---আপনি জানেন না, তাই বলি, অন্তত একবছর আগে থেকে, নিজের সমস্ত পরিচয় দিয়ে আবেদন জানিয়ে রাখবেন ,ভদ্রে। আপনি বিবেচিত হবেন তখনই, যখন স্বয়ং মহারাজ্ঞী অনুমতি দেবেন।” যন্ত্র নীরব হলে, রথের মধ্যে থেকে একটি গম্ভীর রাজকীয় কন্ঠ ভেসে এল
“ বন্ধু, রথ ঘোরাও। চিন্তা করো না। বিম্বিসার কোনো কাজে অকৃতকার্য হয়না। “
নিঃশব্দ দুপুরের বাতাস সর সর শব্দ করে বয়ে গেল কৌতুকে। একসঙ্গে উদ্যানের পাতা দুলে উঠল আনন্দে। কেন এই আনন্দ? এমন কত রাজপুরুষ তো আসে, তবে ইনি আসতে প্রকৃতি কিসের সূচনা দেয়?
“ ঝড় এলো না কি? ‘ নিজের কক্ষে , প্রিয় সখী বিশাখার সঙ্গে বসে
ছিলেন আম্রপালি। চমকে উঠলেন। কপালে উড়ে আসা চুলের গুচ্ছ, হাত দিয়ে সরিয়ে আবার প্রশ্ন করলেন তিনি
“ ঝড় এল না কি?
---আসেনি, তবে আসতে কতক্ষণ? বিশাখা বলে--
ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। ঝড় আসতেই পারে। জীবনে না এলেই মঙ্গল।’
প্রশংসার চোখে ,বিশাখার দিকে তাকালেন আম্রপালি। তাঁর সঙ্গে যারা বিশেষ সখী হিসেবে যুক্ত, তারা প্রত্যেকেই বিদগ্ধ, বুদ্ধিমতী এবং দার্শনিক। ব্যক্তিত্ব আর শিক্ষার বিভা ছাড়া রূপ তাঁর পছন্দ না। প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ মাত্রেই যেন ধরা পড়ে, এই নারী বিশেষ কেউ।
---বিশাখে, অনাথ শিশু গুলির যথাযথ পরিচর্যা হচ্ছে ত?
দ্রুত সম্মতি জানায় বিশাখা।
---আমি নিজে অনাথ। এই আম বাগানেই কুড়িয়ে পায় আমাকে, আমার পালক পিতা মাতা। যত্নের কোনো ত্রুটি নেই। তবু মনে হয়, নিজের নই বলেই হয়ত আমাকে
নগর নটী করার সিদ্ধান্তে বাধা দেন নি।” ঈষৎ ক্ষোভ ঝরে পড়ে আম্রপালির কথায়।
---এ সত্য নয়। আপনি জানেন ভদ্রে--বলতে গিয়ে থমকাল বিশাখা। আঠের বছরের তরুণী সে। শঙ্খের মত শরীর। অতীব সুন্দরী। যদিও , আম্রপালি-র সামনে সূর্য কিরণ ও ম্লান মনে হয়, তবু, এদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটি করে বিশেষত্ব ধরা পড়ে। বিশাখা খুব স্পষ্টবাদী। সে কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেল, অর্থাৎ কথাটি কোনো কঠিন সত্য।
---বলো বিশাখা, সংকোচ করো না।
--- আপনি জনপদবধূ না হলে, বৈশালীতে বিদ্রোহ অনিবার্য ছিল। কোনো একজনের পত্নী হলে, তাকে হত্যা করা হত। আপনার জীবনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না , ভদ্রে। নারীর ভাগ্য নির্মাণ করে পুরুষ--এই তার নিয়তি।
----বিশাখা ! বড় নির্মম সত্য বললে আজ। তবু আমি হতাশ নই। বুকের ভিতর অনুভব করি এক অমোঘ আহ্বান। অতল জলের নীচে ঘূর্ণি লুকিয়ে থাকে, তার মধ্যে পড়লে নিমেষে টেনে নিয়ে যায় ,ডুবিয়ে দেয়। আমার জীবনেও আসবে অমন ঘূর্ণি স্রোত। বিশাখা, আমি হতাশ নই। মূঢ় পুরুষ ছুঁতে পারবে রক্ত মাংসের এই শরীর। আমার আত্মা থাকবে অধরা। “
বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন ভারতশ্রেষ্ঠা সুন্দরী আম্রপালি। কোন সুদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ তাঁর। প্রাসাদের অলিন্দ দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। বিকেলের পড়ন্ত আলোয় কে যেন হেঁটে যায়?
মুন্ডিত মস্তক, পদ্ম পাপড়ি যেন দুই চোখ, অসীম শান্তি সর্ব অবয়বে--কে ওই সন্ন্যাসী? কে?
( বৈশালী। আর্যাবর্তের লিচ্ছবি গোষ্ঠীর রাজধানী। সম্পদশালী রাজ্য বলে এখানকার অধিবাসীরা কিঞ্চিৎ অহংকারী। তৃপ্ত। যথেষ্ট কারণ আছে তার। প্রাচীন ভারতে বৈশালীর মত সম্পদশালী নগর খুব কম ছিল। বৈশালী রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল, হিমালয় পর্বতমালা থেকে, আধুনিক বিহার রাজ্যের গাঙ্গেয় উপত্যকা। কাহিনীর সময় কাল খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতক)
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন