রবি ঠাকুরের একটি গানের কয়েকটি লাইন দিয়ে শুরু করছি অধিকাংশ বাঙালির মতো, কারণ তাঁকে ছাড়া যে কোন ভাবনা যেন দানা বাঁধতে চায়না। তিনি
যে ভাবে এক বিশাল চাঁদোয়া টাঙিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের মাথার উপর, তার নীচে বসে বহুবিধ চর্চা করলেও তার ধরতাই খুঁজে পেতে অসুবিধে হয়না। কিছু দুষ্টু ছেলেপুলে চাঁদোয়ার বাইরে খেলতে চায় বলে মাঝেমধ্যেই লাফঝাঁপ করে, কাদা,কালি ছুঁড়ে চাঁদোয়াটিকে নোংরা করার চেষ্টা করে, ছিঁড়বার মতলবে থাকে সেটিকে। তাতে যে খুব ক্ষতি হয় এমন নয়। আসলে তারা অধৈর্যশীল ও লাইমলাইট লোভী। তাদের বোঝা উচিত ওই চাঁদোয়া এতোটাই উচ্চতায় টাঙানো যে তাদের সাধ্য হবেনা সেটিকে কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার। অধৈর্যশীল বললাম এই কারণে যে কালের নিয়মে চাঁদোয়াটি পুরাতন হলে এমনিই খসে পড়বে। জীর্ণ বস্তুর মতো বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু লাইমলাইটে আসতে চেয়ে ছটফট করে মরা দুষ্টু ছেলেপুলেরা তখন হয়তো পার্থিব মায়ায় বাঁধা থাকবেনা।
যাক সে কথা, যে গানের লাইন দিয়ে আলোচনার শুরুটা করলাম, যাই সেখানে ফিরে। বসন্তোৎসবের দিনে নেচে নেচেগেয়ে চলা গানটার সাথে কার পরিচয় নেই ?
রঙয়ের উৎসবে একান্তভাবে পুরজন চাইছে বসন্ত ঋতুর কাছে রঙ, হৃদয় ভরানোর,ভরিয়ে রঙিন হয়ে ওঠার রঙ। তোমার আপন রাগে, তোমার গোপন রাগে, তোমার তরুণ
হাসির অরুণ রাগে, অশ্রুজলের করুণ রাগে। আহা, মর্মটুকু পরিষ্কার করে দিলেন কবি। প্রতিটি রাগের একটি করে রঙ হয় একথা অনেকেই জানেন, যে রঙ দিয়ে ওই
বিশেষ রাগটিকে ব্যাখ্যা করা যায়। বসন্ত ঋতুর নিজস্ব রাগ আছে, হিন্দোল বা বসন্ত। আবার তার ভিতর আরও অনেক মিশ্ররাগ বা রাগিনী উঠে আসতে পারে যা পারিপার্শিকতাকে বয়ে আনবে। আনন্দ তো সবার মনে একটাই বিশেষ বিন্দু থেকে উঠে আসেনা, আবার সবার মনে আনন্দের অর্থ একরকম নয়। তাই গোপন রাগটির
অবতারণা। তরুণের উদ্দীপ্ত আনন্দ উদযাপন সর্বতোভাবে সমাজের লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুষের অশ্রু মুছে আগামীর আশাভরা চোখে যে উদযাপিত আনন্দ তারা তো সম উচ্চতায় অবস্থান করে না। তাই তার পৃথক উল্লেখ করতেই হয়। আর এর পরেই একটানে প্ল্যাটফর্মটাকে সমান করতেই বলা হলো, রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে। মর্ম যদি একই রঙে রাঙিয়ে ওঠে তবে যে রাগটি বাজবে তা তো একই হবে। একই ধুন যদি সবার মর্মে বা হৃদয় তথা অন্তরে বাজতে থাকে তবে তো সমতা এসেই গেল ভাবনায়।
রাঙিয়ে দিয়ে যাও গানটি পিলু রাগিনীতে দাদরা তালে গাওয়া। বাউলাঙ্গ গানটি কবির ওই প্রকার অন্য অনেক গানের মধ্যে সেরা একটি গান। দিনের তৃতীয় ভাগে পিলু রাগিনী গাওয়া হয়ে থাকে। কবির আর একটি গান, আমি তারেই জানি, তারেই জানি, আমায় যে জন আপন জানে...এই পিলুতে গাওয়া। হাল্কা চাল কিন্তু কবির রচিত কথাগুলি বড় গভীর অর্থবহ। বাউল গানে যেখানে প্রধান বিষয় দেহতত্ত্ব সেখানে কবি সচল এক দেশ কালের সচেতনতার কথা বলেছেন যা কোন অংশেই
দুর্বোধ্য নয়, আচ্ছাদিত নয়। তিনি এমন এক রাগের দুয়ারে হাত পাতলেন যা সকলের প্রথম শোনায় হৃদয়ে ঢেউ তুলবে। কল্যাণ ঠাটে হিন্দোল রাগ যা বসন্ত ঋতুর জন্য নির্দিষ্ট সে পথে না হেঁটে কবি সরাসরি বাউল হয়ে গেলেন। কারণ কবি জানেন বৈঠকী গান নয়, এই মাটিতে সহজিয়া সুরটি পাওয়া যাবে বাউলের একতারায়। আর তাকে গাইতে হবে সবার সাথে পথে পথে।
সন্ধ্যাদীপের আগায় লাগে, গভীর রাতের জাগায় লাগে, যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে। প্রদীপের শিখার উজ্জল গৈরিক বর্ণ কবি বসন্তে ফুটে ওঠা যাবতীয় ফুলের উজ্জলতায় দেখতে পাচ্ছেন, সব রকম উজ্জীবনী শক্তি ও তেজ নিয়ে মিলনের উৎসবে এসেছে তারা। গভীর রাত্রি সানন্দে জাগতে গেলেও ওই দীপশিখার মতো জাগ্রত কোমল সচেতনতার বড় প্রয়োজন। এতো কোন দুশ্চিন্তায় রাতের অন্ধকার হাতড়ানো নয়, এ হলো চেতনার উদযাপন। তবু যদি কিছু মানুষ তখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে, তাই বলা, যাবার আগে যাও গো আমায় জাগিয়ে দিয়ে। কারণ সব কিছুর মতো বসন্তও চিরস্থায়ী নয়। রক্তে তোমার চরণ-দোলা লাগিয়ে দিয়ে। আশা, এই উৎসব আমাদের সামাজিক কর্মে বা এক কথায় দেশের কাজে উদ্বুদ্ধ করবে, আমাদের রক্তে তারুণ্যের ঢেউ উঠবে। একটা ঘুমন্ত জাতি জেগে উঠবে।
আঁধার নিশার বক্ষে যেমন তারা জাগে, পাষাণ গুহার কক্ষে নিঝর-ধারা জাগে, মেঘের বুকে যেমন মেঘের মন্দ্র জাগে, বিশ্ব-নাচের কেন্দ্রে যেমন ছন্দ জাগে। এই উপমাগুলি গাইতে গাইতে আমার বারবার মনে হয়েছে এগুলোর প্রতিটাই তো প্রাকৃতিক তাহলে কি মানুষের অন্তরের জাগরণ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ? মনে হয় তাই। প্রকৃতি আমাদের চেতনায় বোধ ও শুভচিন্তা ভ’রেই
পাঠিয়েছে। বংশপরম্পর ডিএনএ বাহিত এই বোধ বিবর্তনের সাথে সাথে উন্নত হয়েছে। যেখান থেকে আমরা আমাদের বাউল কবিকেও পেয়ে যাই। তাহলে এত দ্বিধা কিসের, দ্বন্দ্ব কোথায় ? আসলে রিপুর তাড়না মানুষকে থাকতে দেয়না মানুষের আয়তে। কিসে মানুষ সন্তুষ্ট তা বোধকরি সে নিজেও জানেনা। কিন্তু ক্ষমতা
প্রয়োগ তার অর্জিত বিদ্যায় রয়েছে। পেশী অথবা বক্রবুদ্ধি বা উভয়ই একত্রে প্রয়োগ করে অন্যকে বঞ্চিত করা যায় ও তাতে কায়েমী ভাণ্ডার গড়া যায় দিনে দিনে। এই অপ্রাকৃতিক বোধ তাকে ছুটিয়ে মারে নিত্যদিন। হয়তো সে নিজেকে প্রতাপশালী ভাবে। অন্যরাও ভাবতে বাধ্য হয় কারণ ততদিনে যে অন্যদের ঘটি-বাটি মায় টিকিটাও বন্ধকে জমা পড়েছে প্রতাপবাবুর কাছে। এসব আবর্জনা সরাতে অনেক হাতের প্রয়োজন, হাঁটতে হবে বহুদূর পথ। দল তৈরী আছে, সঙ্ঘবদ্ধ মানুষ যখন সমচেতনায় উদ্দীপ্ত হয় তখন সে অসম্ভবকে অনায়াস করে তোলে।
প্রতাপশালীরা তাই এদের ডরান, সচেষ্ট থাকেন এদের কোনমতেই সঙ্ঘবদ্ধ না হতে দেওয়ায়। আধুনিক প্রতাপবাবুরা আবার পাল্টা সঙ্ঘ খুলে ফেলেন যাতে মনে হয় এটাও ঠিক। নিজেদের ছদ্ম আবরণে ঢেকে রাখার এটা একটা আধুনিক টেকনিক ছাড়া কিছু নয়। কবি শুধু বিশ্বপিতার কাছে আশীর্বাদ চাইতে পারেন, চাইতে পারেন
অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও এগিয়ে চলার ক্ষমতা। পিছনের টান কাটিয়ে বিশ্বের মাঝে নিজেকে উৎসর্গ করার অন্তর্গত বাধাও প্রচুর। ঘরের টান, আত্মজর টান, মায়া, মোহ, সম্পর্কের বন্ধন সব ছেড়ে বেরিয়ে আসা তো সোজা কথা নয়। সহজ নয় তাই আবার প্রার্থনার মতো করে বলতে হয়, তেমনি আমায় দোল দিয়ে যাও যাবার পথে আগিয়ে দিয়ে, কাঁদন-বাঁধন ভাগিয়ে দিয়ে। কবির সাথে আমরাও জানি অনেক পথ হাঁটতে হবে, অনেক পথ। কবি শুধু সেই যাত্রায় প্রাথমিক
সলতে পাকানোর কাজটুকু করলেন। প্রতি বসন্তোৎসবে দল বেঁধে ছেলে-মেয়েরা পথ পরিক্রমায় গেয়ে উঠলে আজও রক্তে সেই উজ্জীবন আসে। কিন্তু পথচলা যে বাকী ?
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন