শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

“কী ব্যাপার? কোনওদিন জিনস্ ছাড়া সালোয়ারই পরতে দেখলাম না। আজ শাড়ি?”​ প্রশ্নটা তপতীদির। হোস্টেলের মেস কমিটির সেক্রেটারি।

লজ্জা লজ্জা মুখটা আড়াল করে তনুশ্রী বলল,​ “ব্যাপারের কী আছে? এমনি শখ হল। কেন সেদিন ডিপার্টমেন্টের ফ্রেশারস্-এর দিনও তো পরেছিলাম। আবার আমাদের হোস্টেলেরও নবীনবরণ আসছে, প্র্যাকটিস রাখা দরকার না।”

“তাই এত মাঞ্জা দিয়ে বেরোনো হচ্ছে? কোথায় যাচ্ছিস? সাড়ে আটটায় কিন্তু গেটে তালা পড়ে যাবে”।

ওফ্! কত প্রশ্ন। নিজেরা যে রোজ সাড়ে আটটা পর্যন্ত তারাবাগের ঘাসে বিশেষ বন্ধুদের সঙ্গে বসে থাকে। অবশ্য এইসব দিদিদের অধিকাংশ দাদা বন্ধুই ছাত্র সংসদের কোনও না কোনও খুঁটি। সুতরাং তাদের দেখা সাক্ষাত অনেকটাই রাজনৈতিক, সমাজিক ও সাস্কৃতিক দায়বদ্ধতার মধ্যে পড়ে। প্রেমটাকেও সমাজসেবার অঙ্গ হিসাবে দেখানোর সুযোগ পেয়ে যায়।

নীচ থেকে উচ্চকণ্ঠে হাঁক ভেসে এল,​ “তনুশ্রী মাইতি ভিজিটার”।

“ঐ যে, তোর শাড়ির দর্শক চলে এসেছে”।​ মুখ টিপে হাসল তপতী।

তনুশ্রী চঞ্চল হয়ে উঠল। তার সাজগোজ কিছুই হয়নি। প্রথম দিন, দেরি হলে কী মনে করবে? থাক এমনই বেরিয়ে পড়বে।

“ও কী ওরকম শাড়ি পরে কেউ রাস্তায় বের হয়? মুখটাও ম্লান, চুল উস্কোখুস্কো। প্রথম থেকেই এত ব্যকুলতা দেখালে তো ছেলেরা পেয়ে বসবে। একটু অপেক্ষা করুক না”।​ তপতীই শাড়ির কুঁচি আঁচল ঠিক করে দিল। সংসদের নেত্রী মাটিতে ঝুঁকে শাড়ি ঠিক করছে​ –​ বেশ অস্বস্তি লাগল। তাহলে এরা অতটা ভীতিপ্রদ নয়, যতই হমবিতম্বি করুক।

তপতীর খোঁজে তার রুমমেট অনিতা চলে এল। শাড়ির পর প্রসাধন, চুল, গয়না। দুজনে মিলে​ –এ বলে টিপ পর, ও বলে টিপ মানাচ্ছে না। ওরে বাবারে দেরি হয়ে যাচ্ছে। দিনটা তনুশ্রীর, অথচ হোস্টেলের সিনিয়ার দিদিদের খবরদারিতে আর নিজের থাকছে না।​ “তনুশ্রী মাইতি ভিজিটার”।​ এই রে, অয়নদা রেগে চলে যাবে না তো?

“দেরির জন্য যেটুকু রাগ, তোকে দেখলে সব অনুরাগে পরিণত হবে। যা আর দেরি করিস না”।

সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পথে অন্তত চারজনের কৌতুহলি মুচকি হাসির লক্ষ্য হয়ে একই সাথে মনে একটা শঙ্কা আর খুশি খুশি ভাব। তাহলে তনুশ্রীর জীবনেও​ ‘ব্যাপার’​ ঘটতে পারে। সত্যিই ব্যাপারটা পরিণতি পর্যন্ত গড়াবে তো? একদিন দেখা করে সন্ধ্যেটা কাটাতে চেয়েছে বলেই ভবিষ্যতের রাস্তা তৈরি হয়ে যাওয়া নয়।

মুখের অস্বস্তিকর হাসি যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়ে ফ্যাক করে আবার হেসে ফেলল অয়নকে দেখে। অয়ন দাঁত খিঁচিয়ে বলল,​ “শো শুরু হতে চলল। এখান থেকে কার্জন গেট কি একটুখানি?”

“ডিপার্টমেন্ট থেকে ফিরে এসে গা ধুয়ে তৈরি হতে তো​ –”

“শাড়ি পরতে কে বলেছিল? তোকে লোকে দেখবে না তুই সিনেমা দেখবি? এত সাজুগুজুর কী আছে? মেয়েরা টিপিক্যাল মেয়ে মেয়েই থাকতে ভালোবাসে”।

ধাঁ করে সব আনন্দ রোমাঞ্চ উধাও হয়ে গেল। তনুশ্রী কি লোকে দেখবে বলে সেজেছে? তপতী অনিতাদের ওপর রাগ হল। সং সাজিয়ে তনুশ্রীকে এই বেরসিকটার কাছে খেলো করে দিল।

“আমি যাব না। তুমি একা যাও। আমি সঙ্গে থাকলে হয়তো আরও দেরি হবে। শাড়ি পরে তো দৌড়তে পারব না”।

“তাহলে এই টিকিটদুটো ডাস্টবিনে ফেলে দিই?”

“তোমার যা ইচ্ছা।”
“এই রিক্শা। .. চল ওঠ।”

তনুশ্রী চোখের জল সামলে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অয়ন ধমকের সুরে বলল,​ “সিনক্রিয়েট না করে ওঠ।”

“আরও সিনক্রিয়েট না হয় যাতে তুমি চলে যাও।”

“এই ইয়ার্কি ভালো লাগছে না। আচ্ছা ওঠ। দেরি হয়ে গেছে”।​ অয়ন নিজে রিক্শায় উঠে হাতটা বাড়াল।

সেটা না ধরে তনুশ্রী রাগ চেপে পাশে উঠে বসল। হলে পাশাপাশি বসেও পরস্পরের সঙ্গে একটাও কথা নেই ইন্টারভ্যাল পর্যন্ত। শেষার্ধ্বটা তুলনায় মন দিয়ে দেখছে তনুশ্রী। হঠাৎ পেট আর কোমর বেয়ে ওঠা একটা স্পর্শে চমকে উঠল​ ‘আঁক’​ করে উঠল।

“শশ্শ্শ্..। ওফ্ চেঁচাচ্ছিস কেন? শাড়ির একটা মস্ত অ্যাডভান্টেজ আছে, আগে বুঝিনি, থ্যাংক ইউ।”

“কী হচ্ছে কী? হাত সরাও”।​ প্রথমদিন সিনেমা দেখাতে নিয়ে এসেই এমন করবে অয়নকে এতটা খারাপ ছেলে তো মনে হয়নি।

“উম্ম্​ প্লীজ.!”​ অয়ন তনুশ্রীর কাঁধে মুখ রেখে আলতো করে চেপে ধরল। ডান হাতখানা একটু তুলতেই তাতে নরম উষ্ণ ভীষণ আদুরে এক দলা মাংসপিণ্ড ঝাঁপিয়ে পড়ল। তালু আর কব্জির উল্টো পিঠ দিয়ে ভীরু ভাবে ওম্ নিতে লাগল অয়ন। ক্রমশ হাতটার সাহস বাড়ে, অস্থিরতাও।

“প্লী-জ অয়নদা!​ আমি চেঁচাতে পারব না তুমি জানো।”

“ঠিক আছে স্যরি।”

শরীরে অয়নের স্পর্শে যতটা শিহরণ জেগেছিল তার চেয়ে ঢের বেশি হল​ ‘স্যরি’​ বলে হাত সরিয়ে নেওয়ায়। ঠিক তখনই পাশ থেকে একজন গলা তুলল,​ “অসভ্যতা করতে হয় হোটেলের রুম ভাড়া নাও না।​ এখানে আমরা ফ্যামিলি নিয়ে সিনেমা দেখতে এসেছি। কী সব শিক্ষা! কোন ফ্যামিলির ছেলে কোন পাড়ার মেয়ে নিয়ে আসে কে জানে?”

লজ্জায় অপমানে কান মাথা ঝাঁঝাঁ করে উঠল তনুশ্রীর। অয়ন পাল্টা আক্রমণ করল,​ “ভদ্রভাবে কথা বলুন।​ ফ্যামিলি নিয়ে এসে এই ভাষায় কেউ কথা বলে? এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন কেন?”

“তবে রে! পথে হেগে চোখ রাঙানো? গার্ড গার্ড ..”

তনুশ্রী মুখ তুলে তাকাতে পারছিল না। মৃদু গলায় সাফাই দিতে চাইছিল, তারা এমন কিছুই করেনি। কিন্তু অয়নের কী তেজ! চোরের মা একেই বলে। চুপ করে গেলে হয়তো মিটে যেত। আশপাশ থেকে ততক্ষণে অনেক মরাল পুলিস এগিয়ে এসেছে। চলচ্চিত্রের চেয়ে অনেক আগ্রহোদ্দীপক দৃশ্য বাস্তবে অভিনীত হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত প্রেক্ষগৃহের কর্মী এসে ওদের বার করে দিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কিছু ছাত্রছাত্রী প্রেক্ষাগৃহে ছিল। তারা কেউ কেউ ছাত্রস্বার্থে গলা তুলল। অয়ন চাপা গলায় তনুশ্রীকে ধমকাল,​ “নেকি খুকি! আওয়াজ করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ না করলে চলছিল না?”।

হোস্টেলে যে কী ভাবে ফিরল। মাথাটা ঝাঁঝা, কান গরম। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে পোষাক বদলে হাত পা ধুয়ে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল তনুশ্রী।​ রাতে খেল না।

পরের দিন সকালে ডাইনিং থেকে গরম জল আনতে গিয়ে হঠাৎ প্রশ্নবাণ,​ “কী হয়েছিল কাল? অয়ন সামন্তর সাথে সিনেমা দেখতে গিয়েছিলি?”

তপতী ঘোষ, অসীমা রায়, দেবারতি বসাক​ –​ সংসদের দিদি ও বন্ধুরা ছাত্রিনিবাসের বদনাম, বিভাগের দুর্নাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট নিয়ে খানিক বক্তৃতা করে ভবিষ্যতে সাবধানে থাকার উপদেশ দিল।

তনুশ্রী যতই অভিযোগ নাকচ করুক রটনার পেছনে যে ঘটনাটার সামান্য হলেও ইন্ধন ছিল তা নিজের কাছে তো অস্বীকার করতে পারছে না। কোনও রকমে চাট্টি মুখে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আজ একটা জটিল প্র্যাক্টিকাল শেষ করতেই হবে।

“কাল অয়নদার সঙ্গে কেমন দেখলি পারমিতার একদিন?”​ তিমিরের অতর্কিত প্রশ্নে বিষম খেল তনুশ্রী।

“তোকে কে বলল?”

“একই হোস্টেলে থাকি কথা কানে আসবে না? আরও অনেকেই তো ছিল, তারা তোদের দেখেছে। কী কী করছিলি তার পিক্টোরিয়াল ডেস্ক্রিপশন দিল ছেলেরা। তোরা সিনেমা হল থেকে কোন হোটেলে গিয়েছিলি শুনলাম।​ রাতে হোস্টেলে তো কিছু খাসনি।”

তনুশ্রী হতভম্ভ। তার মানে শুধু তিমিরের হোস্টেলের ছেলেরা নয়, তনুশ্রীর হোস্টেলের মেয়েরাও কম যায় না, না হলে রাতে না খাওয়ার খবর রটল কী করে? খাবার নষ্ট হল শুনিয়েও তাদের গায়ের জ্বালা মেটেনি, হোটেলের গুজব ছড়িয়েছে!

“অয়নদা তাই বলল?”

“অয়নদা আজ ভোরে বাড়ি চলে গেছে। সোমবার নিশ্চই ফিরবে। তখন তোর স্ট্যাটিস্টিক্স্ জানা যাবে।”

ঈশ্বর! এদের ও সহপাঠী বন্ধু বলে? পাশাপাশি বসে তুই-তোকারি সম্বোধন করে ভাবে পরস্পরের লিঙ্গভেদ সম্পর্কে তারা তেমন সচেতন নয়। তিমির তার প্র্যাক্টিকালের পার্টনার, টোপোগ্রফির অংক মেলানোর বদলে বন্ধুর শরীরের মাপজোক জানতে চাই্ছে? আর অয়নদা? টানা তিন মাস ছিয়াবিয়া খেলে সবে নিজের আগ্রহটার একটু ইঙ্গিত দিয়েই এ কোন কাদায় ফেলে দিল? ছি ছি ছি! কয়েক মুহূর্তের আলগা স্পর্শ ভালোলাগার স্মৃতির বদলে পাঁকের প্রলেপ মনে হচ্ছে।

অয়নের সঙ্গে আর দেখাই হচ্ছে না। সে তনুশ্রীকে আর হোস্টেলে ফোন পর্যন্ত করে না। একটা কুৎসা উস্কে দিয়ে হাওয়া? ​ লোকলজ্জার সাথে তীব্র মনোকষ্ট।​ অসহায় রাগের আনচানি, অয়নের ওপর তো বটেই, নিজের ওপর তার চেয়েও বেশি। একবার মনে হচ্ছে ঐ স্বার্থপর ল্যাজ গুটিয়ে পালানো লুচ্চাটার মুখদর্শন করবে না।​ পর মুহূর্তে মনে হচ্ছে এই বিশ্রী পরিস্থিতে মানসিক সাহচর্য পেতে শুধু তাকেই দরকার। না না, অভিযোগ নয়। শুধু চাইছে এই সংকট যার জন্য সে পাশে থাকুক, নিজের দায় মেনে নিয়ে, ভালোবাসার দাবি নিয়েও। ভালোবাসা?! শব্দটা কুৎসিৎ বিদ্রূপ হয়ে গেছে। নতুন করে অপদস্থ হওয়ার ভয়ে অয়নের ডিপার্টেমেন্টে গিয়েও দেখা করতে পারছে না। দূর থেকে গোলাপবাগে বা বর্ধমান স্টেশনে দেখতে পেলেও কথা তো দূর দৃষ্টি বিনিময়ও হয় না।

এমএ পরীক্ষার পর একটা নামকরা কোচিং সেন্টারে বিভিন্ন সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে দিদির বাড়ি কাঁচড়াপাড়া এসেছে। দিদি বনশ্রীও বর্ধমান থেকেই ফিলসফিতে এমএ। এখন শ্বশুরবাড়িতে থেকে কল্যাণীর একটা কলেজে পড়ায়।​ মেদিনীপুরের সিপাইবাজার এলাকায় তনুশ্রীদের বাড়ি। সেখানে কাছাকাছি ভালো কোনও কোচিং সেন্টার নেই। কাঁচড়াপাড়ায় থাকলে সরকারি চাকরির প্রশিক্ষণ আর কলকাতায় বেসরকারি চাকরির চেষ্টা দুটোই চালাতে পারবে।

একটা সফ্টঅয়্যার কোম্পানিতে কাজ লেগেও গেল। ব্যস্। বছর ঘোরার আগেই দিদি মা-মাসিমাদের মতো বিয়ের জন্য পেছনে লেগে পড়ল। মা-বাবার সম্মতি নিয়ে তনুশ্রীকে দিয়েই পাত্র চাই বিজ্ঞাপণের বয়ান লিখিয়ে কাগজে দিল। তনুশ্রীর মনে হচ্ছিল নিজের ক্রুশ নিজে বহন করছে।​ বিজ্ঞাপণের উত্তরে চিঠি মন্দ এল না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কেন্দ্রীয় সরাকারের ক্লাস ওয়ান অফিসার, ভাবার বিজ্ঞানী​ –​ সবার আবেদনপত্র নাকচ হয়ে গেল বনশ্রীর এক দূর সম্পর্কের দেওরের সম্বন্ধ আসায়। শ্বশুরবাড়িতে কৃতিত্ব দেখাতে হবে, মা বাবার কাছেও বড় মেয়ে হিসাবে নিজেকে করিতকর্মা প্রমাণ করতে হবে, আবার বোনের বরের প্রোফাইল নিজের চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট বরের চেয়ে বেশি ভালো হওয়া চলবে না।

মোটের ওপর মিলিয়ে ঐ দেড়েল দেওরটাকে তনুর ঘাড়ে জুতবেই।

একটা সম্পর্ক এত বিশ্রীভাবে শেষ হয়ে গেছে যে তনুশ্রীর প্রেমেই অরুচি জন্মে গেছে। ক্লান্ত হয়ে শেষে বিয়েতে ঘাড় নেড়েছিল।​ দিদি এমন শুরু করল যেন বর খুঁজে দিয়ে বোনকে ধন্য করে দিচ্ছে।​ ফলে দিদির দেওয়া বরটাকে তো পাওয়ার আগেই অরুচিকর বিস্বাদ লাগছে। আর মনে মনে চাইছে সম্বন্ধটা কেঁচে যাক, এমন কারও সাথে আলাপ হোক যাকে দেখে হারানো অনু্ভূতি ফিরে আসবে, আর যার ওপর দিদির বা অন্য কারও কৃতিত্বের ভাগ থাকবে না।​ দিদির দেওর স্নেহাশিস ছেলেটা খারাপ না, বিয়েতে পণ তো দূর খাট বিছানাও নেবে না। কিন্তু কেমন সেকেলে গোছের। এখনও আধিকারিক পদেও পৌঁছয়নি, শুধু শুনেছে পৌঁছনোর পরীক্ষা পাস করা আছে। কবি না হয়েও কাঁধে ঝোলা ব্যাগ আর গায়ে ম্যাড়ম্যাড়ে শার্ট। এমন তো সে চায়নি। এই পদনের জীবনসঙ্গীর জন্য সহোদরার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে? এটা তো আরও দুর্বিষহ!

একদিন স্নেহাশিস ফোন করে বলল,​ “আমাদের আরও আগে দেখা হলে ভালো হোত তাই না? এখনও কি খুব দেরি হয়ে গেছে?”

কথাটার কোনও জবাব দিতে না পেরে চুপ করে রইল তনুশ্রী। দিদির দেওয়া ম্যাড়ম্যাড়ে হবু বরটার কথায় প্রথম বুকে সামান্য মোচড় লাগল।​ স্নেহাশিসের গলার স্বরটা ফোনে ভারি স্নিগ্ধ আর মোহময় লাগে।​ চাপিয়ে দেওয়া সম্বন্ধটা আধা পছন্দের দিকে মোড় নিল।

নিজের দাদা বৌদির উৎসাহে স্নেহাশিস ক্যাবলা ক্যাবলা মুখ করে তনুশ্রীকে শিয়ালদার একটি হলে​ ‘বাড়িউলি’​ দেখাতে নিয়ে গেল। অন্যান্য অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের যেমন প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্রের চেয়ে পরস্পরের প্রতি মগ্নতা বেশি থাকে, তেমনটা হয়নি। মন দিয়ে ছবি দেখে অতীতের অপ্রীতিকর স্মৃতিটা এক রাশ ভালো লাগা দিয়ে ধুয়েমু্ছে গেল।

কল্পনায় ছিল পার্কস্ট্রীট অঞ্চলের কোনও রেস্তোঁরায় আবছা আলোয় বসে কাটবে প্রেমিকের সঙ্গে হৃদয় বিনিময়ের সন্ধ্যে।​ তার বদলে শিয়ালদা স্টেশনের কাছে একটা নোংরা হোটেলে রোলে কামড় দিতে গিয়ে মনে হল মা বাবাকে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করতে গিয়ে আর শ্বশুরবাড়ির গুষ্টির কাছে অগ্রজার মান রাখতে গিয়ে নিজের জীবনটা বলি দিচ্ছে না তো। দাড়ি মুখ, কাঁধে ঝোলা, বাকদত্তার সঙ্গে প্রথম মুহূর্তযাপন এত সস্তায়​ –​ এ তো যাচ্ছেতাই রকম স্বপ্নভঙ্গ!

বাড়ি ফেরা মাত্র বনশ্রী বোমার মতো ফেটে চৌচির। যা-তা ভাষায় আক্রমণ করল ছোট বোনকে। হবু বরের সঙ্গে সিনেমা দেখতে গিয়ে যেন জঘণ্য অপরাধ করে ফেলেছে তনুশ্রী। তনুশ্রীর মনে হল ধরণী দ্বিধা হও। আবার সেই?​ অয়নের সাথে অতিবাহিত সময়টাও পরের নাক গলানোয় বিষ হয়ে গিয়েছিল। প্রেক্ষাগৃহে কোনও ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটানো মানেই কি অন্য উদ্দেশ্য? দিদির জা অনন্যাদি ব্যাপারটা সামাল না দিলে কতদূর গড়াত কে জানে? রাতে খাওয়ার টেবিলে ফাঁস হল, বনশ্রীরও বিয়ের আগে হবুর সঙ্গে কিঞ্চিত ঘোরাফেরা ও রোমান্সের ইচ্ছা ছিল যে সাধটা অপূর্ণ রয়ে গেছে। বনশ্রী বোনের সঙ্গে সহজ গলায় অনেক কিছু বলার চেষ্টা করল।​ কিন্তু তনুশ্রীর পুরো দিনটা বিস্বাদ ও তেতো হয়ে গিয়েছে।

কয়েকদিন স্নেহাশিসের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।​ সম্ভবত দিদির জেঠিমাসুলভ ফতোয়ার জেরে বিয়ের আগে মেলামেশায় ছেদ পড়ল। বনশ্রীর পিসি শ্বাশুড়ি মানে স্নেহাশিসের মাও সেদিন মনে হল খুব শীতল ব্যবহার করলেন ফোনে। স্নেহাশিসকে চাইলে​ ‘নেই’​ বা​ ‘বাথরুমে আছে’​ শুনতে হচ্ছে। ইচ্ছা করেই কি দিচ্ছে না? ওদিকে অফিসের অবস্থাও ভালো নয়। তনুশ্রীদের পোস্টটাই হয়তো তুলে দেবে। তখন নতুন পদে নিযুক্ত হওয়ার বদলে কোম্পানির পে-রোল থেকে বহিস্কৃত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। চাকরিও থাকছে না, আবার​ ‘হতেও পারে’​ শ্বাশুড়িও বেঁকে বসছেন। বরেরও সাড়া শব্দ নেই কয়েকদিন। স্নেহাশিস স্বাবলম্বী বৌই চায়। একে তো বর্তমান বৌদি ওরফে ভবিষ্যৎ শালির বচন, তার ওপর বেকার পাত্রী।​ বিয়েতে রাজি হবে তো? যে মানুষটাকে নিজের আশানুরূপ নয় বলে সারা জীবনের সম্পর্ক গড়ায় দ্বিধা ছিল, তাকেই এখন দুস্প্রাপ্য ও পরম আরাধ্য মনে হচ্ছে।

সকালে ঘুম ভাঙল অনন্যার ডাকে,​ “তনু ওঠ, দেখ কে এসেছে?”

মা বাবার আসার কথা। এত সকালে পৌঁছে গেছে? ঘুম চোখে বসার ঘরে গিয়ে দেখে স্নেহাশিস!​ “গুড মর্নিং অ্যান্ড হ্যাপি বার্থ ডে। আজ জন্মদিন তো?”​ ঝোলা ব্যাগ থকে একটা সুগন্ধীর বোতল আর একটা কার্ড বার করে এগিয়ে দিল।

“সো নাইস! কে বলে দিল, দাদা না বৌদি?”​ তনুশ্রী অভিভূত, কারণ নিজের মনেই ছিল না। জন্ম যারা দিয়েছেন তারাই মেয়ের জন্মদিন মনে রাখেন না বেশির ভাগ সময়। তাঁরা যে বনুর বাড়ি আসছেন সেটা ছেলের বাড়ির সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা বলতে, তনুর জন্মদিন বলে নয়।

“কেন, আমার নিজের মেমারি থাকতে নেই? আজ কি খুব ব্যস্ত?”

“ব্যস্ত মানে অফিসে কাজ আছে।”

“যেতেই হবে?”

“কী করব, সরকারি চাকরি তো নয়, গাল ভরা নাম কর্পোরেট সেক্টর। লিটারালি চাকরগিরি।”

স্নেহাশিস তনুশ্রীরই জন্মদিনে ছুটি নেওয়ার আভাস দিল। কিন্তু তনুশ্রীর উপায় নেই।​ প্রবেশনে আছে, পাকা কর্মী হয়নি। এক দিন না যাওয়া মানে শুধু মাইনে কাটা নয়, ওপরওয়ালার হুড়ো খাওয়া। এক হিংসুটে পুরুষ সহকর্মীও আছে যে কথায় কথায় মেয়েদের সুবিধা পাওয়ার খোঁচা আর সুযোগ পেলে তনুশ্রীর কাজে ব্যাগড়া দেয়। সরকারি চাকরির কথাটা খোঁচা মনে করল না তো স্নেহাশিস? রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকে কাজ তো বলতে গেলে একরকম সরকারি চাকরিই।

“শনিবার বিকেলে সিটি সেন্টারে এলে আমার জন্মদিনের ট্রিটটা দিতে পারি। আমাদেরও শনিবার ছুটি নেই, হাফ ডে। বিকেলটা বেরোতে পারব।”

“শনিবার তো জন্মদিন বাসি হয়ে যাবে। বাসি বিয়ের মতো বাসি জন্মদিন?​ আজই অন্য কেউ ট্রিট দিলে আপত্তি আছে?”

“আমার অফিস কামাই করার উপায় নেই.. মানে আমার কাজটা খুব স্টেবল নয়।”

“তাহলে যেটা স্টেবল সেটার প্রতি একটু মনোযোগ দেওয়া যায় না?”

তনুশ্রী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। একটু থেমে বলল,​ “এখনও পার্মানেন্ট হইনি। কবে হব বা আদৌ হব কিনা জানি না। কম্পনি লার্জ স্কেলে রিট্রেঞ্চ করছে। এই অবস্থায় ম্যানেজমেন্ট ছুতো খুঁজছে। যে কোনও দিন আমার ওপরেও কোপ পড়তে পারে।”

“জানি। কিন্তু তাতেই কি সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে? সব কোম্পানি তো উঠে যাচ্ছে না, আর তোমার বয়সটাও এমন কিছু না। তাছাড়া আমাদের একজনেরটা তো আছে। না হয় সরকারি ব্যাংকের কেরানি, তবু দুজনের চলে যাবে না?”

তনুশ্রী কী অভিব্যক্তি দেবে বুঝে উঠতে পারছিল না।

“তোমার মা বাবা খুব ওয়ারিড। তাঁরা চাইছেন বিয়েটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। আমাদের বাড়িতে গতকাল ফোন করেছিলেন। আমার যদিও ঠিক প্রিপারেশন হয়নি বলে একটু সময় চাইছিলাম, তবু​ –​ মে’র বদলে ফেব্রুয়ারিতে বিয়েটা হলে তোমার আপত্তি আছে?”

আরও কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়ল স্নেহাশিস। ওঠার আগে নিজের মামাতো দাদাকে বলল,​ “বিকেলে তোমার আধি ঘরওয়ালিকে নিয়ে একটু বেরোব; পুরি ঘরওয়ালির আপত্তি নেই তো?”

জীবনের সেরা জন্মদিনটা উপহার দিয়ে স্নেহাশিস চলে যাওয়ার পর মনে হল ওর সঙ্গে গাছতলাতেও থাকা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ