পাঠ প্রতিক্রিয়া - রাহুল ঘোষ


বিপথগামী এক প্রতিবেশীর জীবনকাহিনি



■ বিপথগামী এক প্রতিবেশীর জীবনকাহিনি
রাহুল ঘোষ​ ​


প্রতিবেশীকে জানা আসলে নিজেকে জানার মতোই জরুরি। বিশেষ করে, পাশের বাড়িটি যদি এমন হয়, যা কিনা একদা আপনারও ঘর ছিল! তারপরে হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলেন, সেখানে আপনি অবাঞ্ছিত হয়ে গেছেন! সে-ঘরে আপনার প্রবেশ নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত; অথবা দুর্ভাগ্যক্রমে যদি আপনি সেই ঘরেরই আদি বাসিন্দা হয়ে থাকেন, তবে ভয়ে বা অত্যাচারিত হয়ে বিতাড়িত। তারপরে কেমন আছে সেই ঘরের বর্তমান বাসিন্দারা? আপনাকে সরিয়ে দিয়ে তারা খুশি তো? পত্রে-পুষ্পে ভরে উঠেছে তো তাদের যাপন? মূলত এইসব প্রশ্ন থেকেই জরুরি হয়ে ওঠে ভারতীয় পাঠকের পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সংক্রান্ত পাঠ। ভারতীয় বাঙালির কাছে অবশ্য দ্বিতীয়টি সহজসাধ্য, এবং তা শুধু বাংলা ভাষার কারণেই নয়। দু'দিকের বাংলা বইপত্রের আপেক্ষিক সহজলভ্যতা, দু'পারের বাঙালি কবি-লেখক-বুদ্ধিজীবীদের প্রায়শই এপার-ওপার করা তো আছেই। কিন্তু আসল কারণ হলো, রাষ্ট্রীয় স্তরে কিছু মতানৈক্য এবং নিরাপত্তা-বিষয়ক কিছু অসন্তোষ সত্ত্বেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মূল সুরটি মিত্রতার। ইসলামি মৌলবাদীরা সেখানে ১৯৭১-পূর্ববর্তী 'বাঙালি পাকিস্তান'-এর আবহ ফিরিয়ে আনতে চাইলেও সেই মূল সুরটি এখনও বেসুরো হয়নি। কিন্তু পাকিস্তান? মুহাম্মদ আলি জিন্না-র পরে যে-দেশের জনপ্রিয়তম নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো প্রকাশ্যেই ভারতের সঙ্গে হাজার বছরের যুদ্ধ চেয়েছিলেন, সেই পাকিস্তান? বাস্তবিক কারণেই ভারতীয় পাঠকের পাকিস্তান-চর্চা একটু কঠিন। উপযুক্ত বইপত্রের অভাব, যোগাযোগের অভাব, এবং অবশ্যই পাকিস্তানের চিরকালীন ভারত-বিরোধিতা; যা না-থাকলে ওই দেশটির অস্তিত্বই নড়বড়ে হয়ে পড়ে!​ এহেন বিপদজনক অথচ অনস্বীকার্য প্রতিবেশী সম্পর্কে আমরা তাই জানি তাদের ক্রিকেট টিম থেকে, জাহির আব্বাস-ইমরান খান-ওয়াসিম আক্রম প্রমুখের অবিস্মরণীয় প্রতিভা থেকে (পাকিস্তান আরও অনেক অসাধারণ ক্রিকেটার দিয়েছে, কিন্তু আমি নিজের তিনজন প্রিয় ক্রিকেটারের নাম করলাম, এইটুকু পক্ষপাতিত্ব পাঠক ক্ষমা করবেন)। আমাদের কাছে পাকিস্তান মানে নুরজাহান, মেহদি হাসান, গুলাম আলি, আবিদা পারভিন, নুসরত ফতে আলি খান, নাজিয়া হাসান, আতাউল্লা খান, রাহাত ফতে আলি খান প্রমুখের সাঙ্গীতিক ঐশ্বর্য। উর্দু সাহিত্যের (ভারতীয় এবং পাকিস্তানি) খোঁজখবর রাখার অভ্যাস থাকলে আল্লামা ইকবাল, ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, হাফিজ জলন্ধরি, জোশ মালিহাবাদি, কাতিল শিফাই, ফাহমিদা রিয়াজ, মোহসিন নাকভি, পারভিন শাকির প্রমুখের কিছু লেখালিখি। বড়োজোর আমাদের হিন্দি ছবিতে হঠাৎ কাজ করতে আসা এবং সাধারণত ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়া কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী। আর অবশ্যই, ভারতের স্থিতিশীলতাকে নড়বড়ে করার জন্য সদাসক্রিয় আইএসআই, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতভূমির উপরে নানারূপে আঘাত হানতে চাওয়া পাকিস্তান-পোষিত ইসলামি জঙ্গিবাদ। কিন্তু এমন হলো কেন পাকিস্তান? পাকিস্তানের প্রবক্তারা ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য হোমল্যান্ড চেয়েছিলেন; ভারতকে খণ্ডিত করে তা পেয়েওছিলেন। সেই কাঙ্ক্ষিত দেশ পেয়ে যাওয়ার পরে তো সেখানে শান্তিকল্যাণের সুরই বাজা উচিত ছিল! তা না-হয়ে কীভাবে পাকিস্তান হয়ে উঠলো বিশ্ব-সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর? বাবর আয়াজের অকপট ও প্রাঞ্জল লিখনে এইসব প্রশ্নের উত্তর আছে 'হোয়াটস রং উইথ পাকিস্তান?' বইটিতে।

বইটিতে ঠিক কী-কী আছে, তার আলোচনায় যাওয়ার আগে লেখকের সঙ্গে বাঙালি পাঠকদের একটু পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। বাবর আয়াজ পাকিস্তানের একজন প্রবীণ ও সম্মাননীয় লেখক। তিনি ৪৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। সাংবাদিকতা করেছেন 'দ্য সান', পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল ও 'ডন'-এর মতো নামজাদা প্রতিষ্ঠানের হয়ে। কলাম লিখেছেন 'ডেইলি টাইমস', উর্দু দৈনিক 'এক্সপ্রেস' ও সিন্ধি দৈনিক 'আওয়ামি আওয়াজ'-এ। ভারতের 'দ্য হিন্দু' এবং 'ফ্রন্টলাইন'-এর মতো বিখ্যাত পত্রিকায় পাকিস্তান করেসপন্ডেন্টের ভূমিকাও পালন করেছেন।​ তিনি ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক রিলেশন অ্যাসোসিয়েশনের পাকিস্তান চ্যাপ্টারের সভাপতি ছিলেন, এবং​ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সেমিনারে পাকিস্তানের​ রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে সুপরিচিত এক বক্তাও বটে। এহেন একজন মানুষ যখন​ তাঁর দেশকে নিয়ে ঝরঝরে ইংরেজিতে ৩৬৪ পৃষ্ঠার একটি বই লিখে ফেলেন, তখন টানটান হয়ে পুরোটা পড়ে ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ, আপনার পাশের বাড়িটিকে সে-বাড়ির এমন একজন সদস্যই তো সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা করতে পারবেন! 'হোয়াটস রং উইথ পাকিস্তান?'-কে তিনি ছয়টি বিষয়ভিত্তিক অংশে ভাগ করেছেন, যার মোট ৩৪টি অধ্যায়। সেখানে তিনি পাকিস্তানের পটভূমি ও তার জন্ম নিয়ে লিখেছেন। অবশ্য আমাদের ভারতের বিখ্যাত লেখক এম জে আকবরের লেখার মতো বিস্তারিতভাবে তিনি সে-প্রসঙ্গে যাননি। তিনি মূলত​ লিখেছেন দেশভাগের পর থেকে পাকিস্তানের প্রদেশগুলিতে বাড়তে থাকা অসন্তোষ নিয়ে। পাকিস্তানের রাজনীতি ও সমাজে উগ্র ইসলামের প্রভাব যেমন তাঁর আলোচ্য, পাক সেনাবাহিনী ও জিহাদিদের দাপটও তেমন চলে এসেছে সেই আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায়। পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় তিনি যেমন স্পষ্টবাক, তেমনই দারুণ নিরপেক্ষতায় লিখেছেন সে-দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এমন বিষয়বৈচিত্র্য বইটিকে করে তুলেছে আরও আগ্রহজনক।

রাহুল ঘোষ শব্দের মিছিল


বাবর আয়াজ আলোচনা শুরুই করেছেন পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়ার গলদ দিয়ে, যে-কারণে বইটির প্রথম অধ্যায়ের নাম 'দ্য জেনেটিক ডিফেক্ট অফ পাকিস্তান'। অকপট লিখনে তুলে ধরেছেন যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের দাবি ও সৃষ্টি, তার অসারতাকে। বইটির পাঠ যত এগোবে, মনোযোগী পাঠক তত বেশি করে ধরতে পারবেন সেই সত্য। এককালের পূর্ববঙ্গ যখন পূর্ব পাকিস্তান হয়েও আর থাকতে পারলো না সেই 'স্বপ্নের দেশ'-এর মধ্যে, জন্ম হলো বাংলাদেশের, সে-ঘটনাক্রম আমাদের সকলের কম-বেশি জানা। আয়াজ ইতিহাসের সেই পর্বকে ব্যাখ্যা করেছেন 'বাংলাদেশ---আ কলোনি লস্ট' অধ্যায়ে। পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাব্যক্তিদের কাছে যে বঙ্গভূমির পূর্ব অংশটি নেহাতই একটি উপনিবেশের বেশি কিছু ছিল না, তা কি স্পষ্ট হয়ে ওঠে না মাত্র চারটি শব্দের ওই নামকরণেই? লেখকের এমনই অপরিসীম প্রাজ্ঞতার ছবি ছড়িয়ে আছে বইটির পাতায়-পাতায়। সেই মুন্সিয়ানাতেই তিনি ব্যাখ্যা করেছেন বালোচিস্তানের স্বাধীনতার দাবি ও লড়াইয়ের ইতিহাসকে। প্রসঙ্গত, অধিকাংশ বাঙালি পাঠক পাকিস্তানের এই সন্ত্রাসদীর্ণ প্রদেশটিকে বেলুচিস্তান বা বালুচিস্তান নামে জানেন। কিন্তু ঠিক উচ্চারণ 'বালোচিস্তান', এবং সেখানকার অধিবাসী প্রজাতির মানুষেরা বালোচ।​ বালোচিস্তানের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানবেন, প্রতিদিন কী প্রবল হয়ে উঠছে পাকিস্তান থেকে তাদের মুক্ত করার দাবি, ঠিক যেমন ইতিউতি সেই দাবি উঠতে শুরু করেছে সিন্ধ প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে এবং পাকিস্তানের দখল করে রাখা কাশ্মীরের (যার লোকদেখানো নাম 'আজাদ কাশ্মীর') সীমানায় অবস্থিত গিলগিট-বালটিস্তান এলাকায়। অবশ্য বালোচদের তুলনায় তাদের লড়াই এখনও প্রাথমিক স্তরে আছে। বালোচদের স্বাধীন জাতিসত্তা কোনোদিনই পাকিস্তানের মধ্যে নিজেদের ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্তি মেনে নিতে দেয়নি। ১৯৭৩ থেকে সেখানে স্বাধীনতার দাবি উঠতে থাকে। ২০০০ সাল নাগাদ গঠিত বালোচিস্তান লিবারেশন আর্মি কয়েকবছর পর থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। তাদের লড়াই প্রসঙ্গে লেখক এই বইয়ে নিহত বালোচ নেতা হাবিব জালিবের লেখা একটি কবিতার চার লাইন উদ্ধৃত করেছেন :

"মুঝে জঙ্গ-এ-আজাদি কা মাজা মালুম হ্যায়,
বালোচোঁ পর জুল্ম কি ইন্তেহা মালুম হ্যায়,
মুঝে জিন্দেগি ভর পাকিস্তান মে জিনে কি দুয়া না দো,
মুঝে পাকিস্তান মে সাঠ সাল জিনে কি সাজা মালুম হ্যায়।"

শিহরিত করে দেওয়া এই কবিতা থেকে অনুভবী পাঠক খুব দ্রুত কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা এই সংঘর্ষের তীব্রতা ও ভয়াবহতা বুঝে নিতে পারবেন।

দেশভাগের পর কীভাবে পাকিস্তানের নতুন ব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হয়ে উঠলো পাঞ্জাবি মুসলমানেরা, এবং কীভাবে বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকলো সিন্ধি মুসলিম সম্প্রদায়, তার চমৎকার বর্ণনা আছে 'পাঞ্জাব--- দ্য মেজর বেনিফিসিয়ারি' এবং 'সিন্ধ---আ মেজর লুজার' অধ্যায়ে। একইসঙ্গে আছে, ক্ষমতার লড়াইয়ের ওঠাপড়ায় কীভাবে লাভ-ক্ষতির পাল্লায় প্রাধান্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় মেতেছে মোহাজির (সীমানার এপার থেকে প্রার্থিত হোমল্যান্ডে যাওয়া লোকেরা, এককথায় যারা হিন্দুস্তানি মুসলমান) এবং পাখতুন বা পাঠান সম্প্রদায়। বিশেষত, করাচি শহরকে কেন্দ্র করে সিন্ধি-মোহাজির রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ধারাবাহিকতা তুলে ধরেছেন লেখক। এর ফলে বাণিজ্যনগরী করাচি থেকে যেভাবে অনেক প্রতিষ্ঠান লাহোর ও অন্যান্য শহরে নিজেদের ব্যবসা সরিয়ে নিতে থাকলো, ধরা আছে সেকথাও। দেশভাগের পরে সিন্ধের প্রাদেশিক রাজধানী করাচিকে পাকিস্তানের রাজধানী করার জন্য ওই প্রদেশের সরকারকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল হায়দরাবাদে। ১৯৬০-এ ইসলামাবাদে পাকিস্তানের রাজধানী স্থানান্তরিত হলে, সিন্ধ করাচি শহরকে ফিরে পায়। কিন্তু শান্তিপূর্ণ আবহ সেখানে আর ফিরে আসেনি। পাকিস্তানে বাংলা ভাষা ন্যায্য সম্মান না-পাওয়ার বিরুদ্ধে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন ও কালক্রমে সেখান থেকে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস আমরা সবাই জানি। কিন্তু প্রবল প্রতিবাদ সত্ত্বেও​ সিন্ধ প্রদেশের জনজীবনে এবং স্কুলগুলিতে পর্যন্ত সিন্ধি ভাষাকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে যেভাবে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া শুরু হয়েছিল, সেকথা ক'জন জানি? ক্ষমতার মূলস্রোতে থাকার জন্য কীভাবে পাঞ্জাবি মুসলমানেরা অনেকটাই স্বেচ্ছায় পাঞ্জাবি ভাষার বদলে উর্দুকে গ্রহণ ও ব্যবহার করতে থাকে, সেই ইতিহাসও আমরা জানতাম না। বাবর আয়াজ বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিষ্কার করে তুলে ধরেছেন এইসব ঘটনাক্রম। ঠিক যেমন, পাখতুনদের বাসভূমি খাইবার পাখতুনখোওয়া (আগের নাম ছিল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বা এনডব্লিউএফপি)-কেন্দ্রিক রাজনৈতিক ঘনঘটার চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি; যার শুরুতেই আছে ভারতীয় জনমনেও পরিচিত এবং শ্রদ্ধেয় 'সীমান্ত গান্ধী' অর্থাৎ খান আবদুল গফফর খানের কথা, আদর্শগতভাবেই যিনি ছিলেন মুসলিম লিগ ও পাকিস্তান তত্ত্বের বিরোধী। উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের সমান্তরাল শাসনব্যবস্থা, প্রায় আদিম সামাজিক রীতিনীতির কথা উল্লেখ করতেও লেখক ভোলেননি। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা দেশ হিসেবে সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান যে ধর্মীয় ঐক্যকে জাতিচেতনার উপরে নিয়ে যেতে পারেনি, সেই সত্য উঠে আসে এই প্রদেশগুলির রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের উত্তাপে।

অবশ্য শুধুই জাতিচেতনা নয়, ধর্মীয় রীতিনীতিতে পার্থক্যও যে প্রতিদিন পাকিস্তানের জন্মের অসারতাকে প্রমাণ করেছে; তাও বিস্তারিত দেখিয়েছেন বাবর আয়াজ। সুন্নি-প্রধান পাকিস্তানে শিয়া মুসলমানদের উপর হামলা আজও প্রায় নিয়মিত ঘটনা। তার সঙ্গে আছে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার ও তাদের অ-মুসলিম বলে ঘোষণা করা। আয়াজ দেখিয়েছেন, কীভাবে বারবার মৌলবিদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে পাকিস্তানের সরকার আহমদিয়াদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেছে। জেনারেল জিয়াউল হক তো ক্ষমতা দখলের পরে এমন অসংখ্য আইন বানালেন,​ যাতে আহমদিয়াদের লিখিতভাবেই অস্বীকার করা হলো। শুধু তাই নয়, আধুনিক আইনের দিকে এগোনোর বদলে পাকিস্তান পিছিয়ে গেল মধ্যযুগীয় আইনের দিকে। আয়াজের বর্ণনায় এইসব নিয়ে পাকিস্তানি সমাজে দ্বন্দ্ব ও ভয়ের স্পষ্ট ছবি আছে। আর আছে ইসলামের অবমাননার অভিযোগে ক্রমাগত বাড়তে থাকা হত্যার উল্লেখ। এমনকি এই প্রবণতার বিরুদ্ধে শুধু মুখ খোলার জন্য পাঞ্জাবের গভর্নর সলমন তাসির ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিকে খুন হতে হয়। এর মধ্যে তাসিরকে খুন করেছিল তাঁরই নিরাপত্তারক্ষী মুমতাজ কাদরি। এই অপরাধের জন্য কাদরি মৌলবাদী জনতা ও আইনজীবীদের কাছে নায়কের সম্মান পায়। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া বিচারপতিকে প্রাণভয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। এই প্রসঙ্গে মনে পড়লো, পাকিস্তানি কূটনীতিক হুসেইন হাক্কানির লেখা একটি বইয়ে পড়েছিলাম, কাদরির মৃত্যুর পরে তার স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করেছিল মৌলবাদীরা! বাবর আয়াজ দেখিয়েছেন, আধুনিক রাষ্ট্রের দিকে যাওয়ার পরিবর্তে পাকিস্তানের কোণে-কোণে গুরুত্ব পাচ্ছে মসজিদ, মাদ্রাসা আর জিহাদি গোষ্ঠীর বাড়তে থাকা সংখ্যা। ক্রমশ তারাই থাবা বসাচ্ছে সেখানকার ফিল্ম, টিভি ও সংবাদমাধ্যমে। এদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য ২০০৩-২০১৩ সময়কালের মধ্যে খুন হয়েছেন ৪০ জনেরও বেশি লেখক ও সাংবাদিক। এইভাবে নিজের তৈরি ইসলামি উগ্রবাদের জালে কীভাবে নিজেই জড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তান, তার ব্যথিত বর্ণনা দিয়েছেন তিনি।

ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান পার্থক্য হলো, ভারতে সরকার সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর পাকিস্তানে সেনাবাহিনী সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। পাকিস্তানের ৭৩ বছরের ইতিহাসে এই সত্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। 'পাকিস্তান আর্মি হ্যাজ আ নেশন' অধ্যায়ে বাবর আয়াজ এই প্রসঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। ১৯৫৮-য় আয়ুব খান, ১৯৬৯-এ ইয়াহিয়া খান, ১৯৭৭-এ জিয়াউল হক এবং ১৯৯৯-এ পারভেজ মুশাররফ ; এই চারজন জেনারেলের নেতৃত্বে সামরিক অভ্যুত্থান ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল পাকিস্তানের সমাজ ও রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব প্রমাণ করেছে। আয়াজ ব্যাঙ্গাত্মক সুরে লিখেছেন, ভারতের সঙ্গে বারবার যুদ্ধ করেও একবারও জিততে না-পারলেও, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কীভাবে ভারতের জুজু (তাঁর ভাষায় 'ইন্ডিয়া থ্রেট') দেখিয়ে দেশের উপরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ দৃঢ় করেছে। এখানে উঠে এসেছে জিহাদিদের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্বমধুর সম্পর্কের কথাও। পাকিস্তানে জিহাদিদের বাড়বাড়ন্তের জন্য বাবর আয়াজ মুখ্যত জিয়াউল হককেই দায়ী করেছেন : "দ্য লিগ্যাসি অফ জেনারেল জিয়াউল হক টুডে হন্টস পাকিস্তান মোর ভিসিয়াসলি দ্যান ইট ডিড হোয়েন হি ওয়াজ অ্যালাইভ। হি ওয়াজ দ্য ম্যান হু প্লেয়েড আ লিডিং রোল ইন কনভার্টিং পলিটিক্যাল ইসলাম ইনটু মিলিট্যান্ট ইসলাম মোর দ্যান এনিবডি এল্স উইথ দ্য সাপোর্ট অফ ইউএস। হি ওয়েপনাইজড পাকিস্তানি সোসাইটি..." ---এই বর্ণনা থেকে নিশ্চিতভাবে আমরা পাকিস্তানের সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার মূল কারণটি খুঁজে পাবো। 'মিলিটারি'স প্রাইভেট জিহাদিস' অধ্যায়ে উঠে এসেছে ২০০১-এ দিল্লিতে ভারতীয় সংসদে হামলা, ২০০৮-এ মুম্বাইয়ে নাশকতা, কাশ্মীরে ধারাবাহিক হানার পাকিস্তানি সেনা ও ইসলামি জঙ্গিদের যৌথ উদ্যোগের কথা : "নো সিভিলাইজড কান্ট্রি ব্রিডস অ্যান্ড নার্চার্স মিলিট্যান্ট গ্রুপস উইদিন ইটস ওন বাউন্ডারিজ। পাকিস্তান হ্যাজ বিন ডুয়িং ইট অ্যাজ অ্যান এক্সটেনশন অফ ইটস ন্যাশনাল সিকিউরিটি পলিসি।" পাশাপাশি জিহাদি কর্মকাণ্ডের জন্য পাকিস্তানে নেতাদের ও সাধারণ মানুষের মনে সহানুভূতিরও কোনো অভাব নেই। ২০১৩ সালে লেখা এই বইতেই বাবর আয়াজ আজকের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে চিহ্নিত করেছিলেন এই ভাষায় : "মোর রিসেন্টলি অক্সফোর্ড-এডুকেটেড ক্রিকেটার ইমরান খান...টু হ্যাজ জয়েন্ড দ্য তালিবান অ্যাপোলজিস্টস' ক্যাম্প।" এখন ইমরানকে ইসলামি আতঙ্কবাদের হাতের পুতুল হয়ে ভারতের অন্ধ-বিরোধিতা করতে দেখলে, সেই সত্য প্রকট হয়ে ওঠে। ​ ​ ​

এই বইয়ে বাবর আয়াজ একইরকম অকপট পাকিস্তানের বিদেশনীতি প্রসঙ্গেও। সামগ্রিক নীতির সঙ্গে তিনি পৃথকভাবে আলোচনা করেছেন পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকা, ভারত, চিন, সৌদি আরব, ইরান ও আফগানিস্তানের সম্পর্কের কথাও। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আমেরিকা একসময়ে ছিল পাকিস্তানের 'ফাদার ফিগার'। হয়তো ভারতের তৎকালীন সোভিয়েত-নৈকট্য ছিল এর অন্যতম কারণ। কিন্তু কমিউনিস্ট সোভিয়েতের অবক্ষয় ও পতন, সোভিয়েত-আমেরিকা ঠান্ডা যুদ্ধের যুগ শেষ হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা একসময়ে আমেরিকানদের অন্যরকম ভাবতে বাধ্য করে। ক্রমশ ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দৃঢ় হয়ে ওঠে, এবং স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে বাড়ে তিক্ততা। একসময়ে ইসলামি মৌলবাদকে আমেরিকা যথেষ্ট সাহায্য দিয়েছে। কিন্তু যখন থেকে তার বন্দুকের নল ঘুরে গেল আমেরিকারই দিকে, তখন জিহাদিদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে অনিচ্ছুক পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্কের এই অবনতি অনিবার্যই ছিল। বরং চিনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক অনেক বেশি স্থায়ী ও মজবুত বলে প্রমাণিত হয়েছে। চিন হলো পাকিস্তানের 'অল ওয়েদার ফ্রেন্ড'। অনেকেরই ধারণা আছে, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির পরে বোধহয় পাকিস্তান চিনের সঙ্গে নৈকট্য বাড়িয়েছে। ঘটনা যে তা নয়, বরং তার অনেক আগেই সোভিয়েত-চিন সম্পর্কের অবনতি তথা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ব্লকে ফাটল যে চিনকে পাকিস্তানের প্রতি অধিক আগ্রহী করে তোলে, তা আয়াজ দেখিয়েছেন। পাশাপাশি এশিয়ায় ভারতের সম্ভাব্য প্রাধান্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে ব্যবহার করার দায়ও চিনের ছিল। আর পাকিস্তানের ছিল ভারতের বিরুদ্ধে চিরকালীন বিদ্বেষ, যাকে বাবর আয়াজ লিখেছেন 'লিভিং আন্ডার ইন্ডিয়ান ফিয়ার' নামে। 'পাকিস্তান-সৌদি আরাবিয়া---আ সোর্স অফ রাইজিং রিলিজিওসিটি' অধ্যায়ে এসেছে পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় অন্ধতার পিছনে সৌদি-প্রভাবিত গোষ্ঠী ও সংস্থাগুলির ভূমিকা। আয়াজ লিখেছেন, "দ্য ফাইনান্সিং অফ সুন্নি এক্সট্রিমিস্টস বাই সৌদি আরাবিয়া অ্যান্ড শিয়া গ্রুপস বাই ইরান হ্যাজ আনলিশড আ প্রক্সি সেক্টারিয়ান ওয়ার ইন পাকিস্তান।" এই প্রসঙ্গের সূত্র ধরে তিনি এগিয়েছেন পাকিস্তান-ইরান ভারসাম্যের সম্পর্ক ও পাকিস্তান-আফগানিস্তান অবিশ্বাসের সম্পর্ক বর্ণনায়।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বাবর আয়াজ দেখিয়েছেন, কীভাবে একটু ধর্মীয় সহনশীলতা দেখালেই ক্রমশ সংখ্যায় কমে যেতে থাকা বিপন্ন সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ হয়ে উঠতে পারতো পাকিস্তান। এই প্রসঙ্গে বলা থাক, কেউ যদি শুধু 'ভয়েস অফ পাকিস্তান মাইনরিটি' নামক সামাজিক সংস্থাটির ক্রমাগত তুলে ধরতে থাকা খবর, তথ্য, ফটোগ্রাফ, ভিডিও নিয়মিত দেখতে থাকেন; তাহলেই তিনি বুঝবেন যে পাকিস্তানে ঠিক কোন অচিন্তনীয় পরিস্থিতির মধ্যে এখনও অবধি কোনোরকমে টিকে থাকা সামান্য সংখ্যক হিন্দু, শিখ ও খ্রিস্টানদের বসবাস করতে হয়। এদের বাড়ির মেয়েদের ইচ্ছে হলেই তুলে নিয়ে যাওয়া, ধর্ষণ ও জোর-জবরদস্তি ধর্মান্তরিত করার মাধ্যমে পাকিস্তানকে সংখ্যালঘু-শূন্য করার যে-পদ্ধতি ইসলামি মৌলবাদিরা নিয়েছে; তাকে প্রশাসন থেকে শুরু করে আমজনতা হয়ে জিহাদি পর্যন্ত সবাই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদত দেয়। এই বইয়ে সেই ভয়াবহতার কথা খুব প্রচ্ছন্নভাবে হলেও, আছে। সাধারণ মানুষের কথা তো ছেড়েই দিলাম; ঠিক কোন জাদুবলে পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের বিগত ২০ বছরের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ইউসুফ ইওহানা কেরিয়ারের মধ্যপথে এসে খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করে হঠাৎ মোহাম্মদ ইউসুফ হয়ে গেলেন, সে-ঘটনা আমরা অনেকে পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে শাহরিয়ার খানের নিরপেক্ষ আলোচনা বা পিটার ওবোর্ন নামক এক ব্রিটিশ সাহেবের ক্ষমাসুন্দর বিশ্লেষণ থেকে আঁচ করতে পারি। ঠিক যেমন, অনিল দলপৎ নামের এক উইকেটকিপার পাকিস্তানের হয়ে সামান্য কিছুদিন খেলার পর হঠাৎ ক্রিকেট থেকে প্রায় উবে গিয়েছিলেন, অথবা তাঁরই ভাগ্নে এবং পাকিস্তানের হয়ে অনেক বেশি সফল (স্বভাবতই অনেক বেশি পরিচিত) স্পিন বোলার দানিশ কানেরিয়া কেন সম্প্রতি তাঁর এককালীন সতীর্থদের প্রতি ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন, তা অনুভব করতেও আমাদের বাকি থাকে না। তবে অনেক বড়ো প্রেক্ষাপটে আলোচিত এই বইয়ে এমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক ঘটনা আলোচনার তেমন সুযোগ ছিল না বলেই ধরে নেওয়া যায়। সব ধর্মেই উগ্র মতবাদীরা থাকে, তবু সারা পৃথিবীতে কেন শুধু ইসলামি উগ্রপন্থীদেরই সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্নিত করা হয়, এই প্রশ্নের এক অনবদ্য ও অকাট্য জবাব দিয়েছেন বাবর আয়াজ :​ "মুসলিম টেররিস্টস আর মোর ইন নাম্বার, দে আর স্প্রেড অল ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড, আর মোর অর্গানাইজড, মোর ভায়োলেন্ট অ্যান্ড অ্যাবভ অল, দি আল কায়েদা হ্যাজ গিভেন দেম আ গ্লোবাল অ্যাজেন্ডা। আনলাইক আদার্স হু হ্যাভ লোকাল ইস্যুজ, দ্য মুসলিম এক্সট্রিমিস্টস হ্যাভ দি আল কায়েদা ম্যানিফেস্টো টু এস্টাবলিশ ইসলামিক সুপ্রিমেসি ওভার দ্য ওয়ার্ল্ড।" তাহলে কি পাকিস্তানের উত্তরণের কোনো পথই নেই? এভাবেই কি তার ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসদীর্ণ হয়ে থাকবে আমাদের উপমহাদেশ? বাবর আয়াজ এখনই অতটা নিরাশ হতে রাজি নন। 'হ্যাজ ডেমোক্রেসি ডেলিভার্ড ইন পাকিস্তান?' এবং 'ইজ পাকিস্তান আ ফেইল্ড কান্ট্রি?' অধ্যায় দুটিতে যাবতীয় ব্যর্থতার উল্লেখের সঙ্গে সেই আশাবাদের সুর ক্ষীণভাবে হলেও শোনা যায়। পড়ার শেষে আমরাও তাই লেখকের সেই আশাবাদে ভরসা রাখি। কারণ, আমাদের প্রতিবেশীটি সুস্থ মানসিকতা নিয়ে বেঁচে থাকতে শিখলে, আমাদেরও ভালো থাকার সম্ভাবনা বাড়ে। সম্প্রতি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হর্ষ কাকরের একটা লেখা পড়ছিলাম : 'পাকিস্তান'স প্ল্যান টু ওপেন পাঞ্জাব ফ্ল্যাঙ্ক'। লেখাটি পড়লে বোঝা যাবে, কেন ১৯৮০-র দশকে শক্তিহীন হয়ে যাওয়া খালিস্তানপন্থীদের আবার নবউদ্যমে নড়েচড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে! ভারতের পাঞ্জাবে খুব একটা সমর্থন না-পেলেও কানাডা, আমেরিকা ও ব্রিটেনে লুকিয়ে থাকা খালিস্তানি শিখদের উসকানি ও সাহায্য দেওয়ার কাজে আবার জোর দিচ্ছে পাকিস্তান। কারণ, একথা তো জুলফিকার আলি ভুট্টো নিজেই বলেছিলেন : "পাকিস্তান উইল অলসো হ্যাভ আ বাংলাদেশ কার্ভড আউট অফ ইন্ডিয়া, এক্সেপ্ট দ্যাট ইট উইল বি অন পাকিস্তান'স বর্ডার।" অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারতের যে-ভূমিকা ও অবদান, তার প্রতিশোধ পাকিস্তান বহুদিন ধরেই নিতে চায়। জিয়াউল হকের শাসনকালে তাদের এই ইচ্ছা আরও বেড়ে যায়। এই লেখার প্রথমদিকেই আমি হুসেইন হাক্কানির কথা উল্লেখ করেছি। পাকিস্তানি এই কূটনীতিবিদ আমেরিকায় রাষ্ট্রদূতের ভূমিকাও পালন করেছেন। হাক্কানি জানিয়েছেন, এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের আগ্রহের আরও কারণ হলো, পাঞ্জাবকে যদি কোনোভাবে খালিস্তান বানিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে সেটা ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের 'বাফার জোন' হিসেবে কাজ করবে এবং ভারত-পাকিস্তান সরাসরি সীমান্তের দৈর্ঘ্য অনেক কমে যাবে, যা পাকিস্তানের পক্ষে স্বস্তিদায়ক। আরও বড়ো কথা হলো, তাহলে ভারতের বাকি ভূখণ্ডের সঙ্গে কাশ্মীরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যাকে সম্পূর্ণ দখল করা পাকিস্তানের জন্মলগ্নের স্বপ্ন। সুখের কথা, ভারতীয় পাঞ্জাবিদের অধিকাংশই এই পাকিস্তানি চালাকি বোঝেন এবং তাঁরা ধর্মীয় আদর্শগত দিক থেকেই খালিস্তান ধারণাটির বিরোধী। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, প্রতিবেশীটি যদি নিজেদের সংশোধন না-করে, তাহলে আমাদের ঘরেও সুস্থিতি বজায় রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। প্রতিবেশীর এমন হয়ে থাকার কারন  জানার জন্যই তার অতীত-বর্তমানের এইসব কালো দাগগুলোকে জেনে নেওয়া দরকার। বাবর আয়াজের বইটি সে-কাজে আমাদের প্রচুর সাহায্য করতে পারে।

বইটিতে মসজিদের গম্বুজের সিল্যুয়েটে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার নকশায় সজ্জিত এককথায় অসাধারণ প্রচ্ছদটি করেছেন সীমা শেঠি। বইটির প্রকাশক আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা 'হে হাউস', যারা ভারত-সহ সাতটি দেশে কাজ করে। বইয়ের কাগজ, বাঁধাই ও মুদ্রণও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গেই সাযুজ্যপূর্ণ। পাকিস্তান-চর্চায় আগ্রহীদের জন্য এই বই অবশ্যই একটি অমূল্য সংগ্রহ হয়ে থাকবে।​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ