■ জয়তী রায় | রাজনীতি এবং দ্রৌপদী

■ জয়তী রায় |  রাজনীতি এবং দ্রৌপদী

■ ১

পাঁচহাজার বছর ধরে জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা মহাভারত রোজ নতুন করে আবিষ্কৃত হচ্ছে। নতুন নতুন ব্যাখ্যা আসছে। তবুও দেখা যাচ্ছে, পাঠকের কৌতূহল বা আগ্রহ ক্রমশঃ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েই চলেছে।​

মহাভারতের দুটি মহল। একটি অন্তরমহল। অপরটি বহির্মহল।​

পারিবারিক কলহ থেকে উদ্ভুত মহাযুদ্ধ হল বহির্মহল। অন্তমহলে আছে গীতা আর দর্শন। রামায়ণ ভক্তিযোগের কথা বলে। মহাভারত ভক্তির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে নিষ্কাম কর্মযোগ। কর্ম করো কিন্তু ফলের আশা করোনা - গীতার সমস্ত উপদেশ আধুনিক মনস্তত্ত্বের বিচারে মানুষের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল সাধন করতে সক্ষম।​

#
মহাভারত নিয়ে যখন কাজ করতে বসি, মনের ভিতর হতে উৎসারিত হয় আনন্দ। যদি বলো কেন? উত্তরে বলি, ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারত, যা অধ্যয়ন করে আমরা তৎকালীন সমাজ ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারি, সেগুলি যেন অজানা কিছু নয়। আজকের যুগে বসেও নিজের সময়ের প্রেক্ষিতে মহাভারতের যুগ চিনে নেওয়া - এটাই আনন্দ দিতে থাকে। বিশেষকরে চরিত্রগুলো। চরিত্রের ভিতর ঢুকলে দেখা যায়, সুখে, দুঃখে , ভালোবাসায়, হিংস্রতায়, চাওয়া পাওয়া সবকিছুতেই তাঁরা আমাদের কাছের মানুষ। এ গেল ভিতর মনের কথা। কেমন ছিল বাইরের জগৎ? ভূমি দখল, চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, প্রেম , কামনা, আধুনিক যৌনতা, সন্তান জন্মে অপারগ হলে, বিকল্প ব্যবস্থা, দেবতা এখানে মানুষের প্রতিবেশীর মত। ঋষিমুনির হোমযজ্ঞ, আর্য অনার্য ভেদাভেদ। প্রশস্ত রাজপথ ধরে ছুটে চলেছে রাজকীয় রথ। শকট। নর্তকীর নুপূর কিঙ্কন বেজে উঠছে অভিজাত মহলে।​

রাজশেখর বসুর মহাভারত সারানুবাদ পড়লে জানা যায়, যে, এই সময় প্রায় সকলেই মাংস আহার করতেন। গোমাংস ভোজন চলত। মহাভারতের যুবতী বিবাহ প্রচলিত ছিল। রাজাদের পত্নী, উপপত্নী,দাসী থাকত। অশ্বমেধ যজ্ঞে বীভৎস বলি হত। উৎসবে শোভাবৃদ্ধির জন্য বেশ্যার দল নিযুক্ত হত।​

সুখের কথা, অতি প্রাচীন ইতিহাস ও রূপকথা সংযোগে উৎপন্ন এই পরিবেশে আমরা যে নরনারীর সাক্ষাৎ পাই তাদের দোষ গুণ সুখদুঃখ আমাদেরই সমান।

 

 মহাভারত একটি রত্ন -সাগর। এতে রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতি সমস্তনীতি আছে। মহাভারতের একটি উল্লেখ্য দিক হল এর রাজনৈতিক কার্যাবলী। অদ্ভুত ব্যাপার, তখনকার রাজনীতির সঙ্গেও এখনকার ভাবধারার প্রচুর মিল খুঁজে পাই। পরিষ্কার স্পষ্ট স্বচ্ছ ভাবে তৎকালীন রাজনৈতিক চিন্তা ভাবনা ধরা দেয় আমাদের কাছে। বিশেষকরে, নারীদের মধ্যেকার আধুনিক চেতনা, জীবন ও রাষ্ট্র সম্পর্কে তাদের পরিষ্কার মতামত দেখলে অবাক হতে হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে দেখব সেই সময়ের রাজ্য রাজনীতিতে দ্রৌপদীর ভূমিকা ঠিক কিরকম ছিল!​

: আগুন হতে জন্ম/ নিজেই যেন আগুন:

সর্বকালের সবচেয়ে আলোচ্য নারী চরিত্র যদি কেউ থেকে থাকে, সে হল দ্রৌপদী।​

হেলেন , ক্লিওপেট্রাকে স্মরণে রেখেই এমন মন্তব্য করছি। রূপ গুণ বিদ্যা বুদ্ধি নিয়ে মহাকাব্যের বহু নায়িকা স্মরণীয় কিন্তু সমগ্র পুরুষ জাতিকে অবহেলায় পায়ের কাছে ফেলে রাখার ক্ষমতা একমাত্র ছিল , দ্রৌপদীর।​

জন্ম কাহিনীই এত অদ্ভুত, যাঁর ব্যাখ্যা করা মুশকিল। সীতাদেবীকে পাওয়া গিয়েছিল কৃষিক্ষেত্রে, যে ঘটনার উপযুক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। কিন্তু, যজ্ঞআগুন হতে উদ্ভুত পূর্ণ বয়স্কা নারী ... এই ছবি মনে করলে , ভেসে আসে আগুনের মত তেজীয়ান কৃষ্ণবর্ণের মেয়ের অপরূপ রূপ।​

যজ্ঞসেনস্য দুহিতা দ্রুপদস্য মহাত্মনঃ।​
বেদিমধ্যাৎ সমুৎপন্না পদ্মপত্রনিভেক্ষণা।।
দর্শনীয়াহনবদ্যাঙ্গী সুকুমারী মনস্বিনী।​
ধৃষ্টদ্যুম্নস্য ভগিনী দ্রোণশত্রোঃ প্রত্যাপিনঃ।।

( আদি: ১৭৭: )

মহাত্মা দ্রুপদ রাজার কন্যা পদ্মনয়না দ্রৌপদী যজ্ঞবেদী থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। তাঁর কোনও অঙ্গই নিন্দনীয় নয়। অতি সুদৃশ্য এবং সুকোমল। দ্রোণশত্রু ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী। যাঁর নীলোৎপল তুল্য দেহের গন্ধ একক্রোশ দূর থেকেও বইতে থাকে।​

এহেন রূপসী কন্যার জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে কাহিনী একটা ব্যাসদেব দিয়েছেন বটে, এবং সে কাহিনীর মধ্যে অবধারিত মিশে আছে রাজনীতি। দ্রোণাচার্যর সঙ্গে দ্রুপদের বিবাদ এবং দ্রোণ হত্যা নিমিত্ত যজ্ঞের বেদী থেকে দ্রৌপদীর উৎপত্তি। যজ্ঞের বেদী বলতে আগুন তো বটেই। ব্যাসদেব বলেছেন : বেদীমধ্যাৎ সমুথিতা।​

এমন একজন নারী, ভবিষ্যতে যাঁর ক্রোধের আগুনে আহুতি হবে গোটা ভারতবর্ষ। যাঁর মান রাখতেই ঝাঁপিয়ে পড়বে পাঁচ ভাই। যাঁকে ঘিরে আবর্তিত হবে গোটা মহাভারত। হাজার হাজার বছর ধরে যাঁর রূপ গুণের বর্ণনা করে শ্রান্ত হবে না মানব। হাজার বছর পরেও যাঁর আকর্ষণ এতটুকু কম হবে না কোনোদিন। পাঁচ পাঁচটি স্বামী, অগুন্তি পুরুষের কামনার আগুন যাঁকে ঘিরে আবর্তিত অথচ তিনি পঞ্চ সতীর এক সতী!

মনে রাখতে হবে, মহাভারতে গল্পের মধ্যে গল্প থাকে। ক্যামোফ্লেজ। উপরের আবরণ সরিয়ে ভিতরের অর্থের গভীরে প্রবেশ করতে হয়। তবে সম্পূর্ণ সৌন্দর্য প্রতিবিম্বিত হবে। দ্রৌপদীর জন্ম যদি সাধারণ হত, তাঁর একটা ছেলেবেলা থাকত ধাপে ধাপে বড় হওয়া দেখান হত, তবে চরিত্রটির প্রতি আকর্ষণ প্রথম থেকেই সৃষ্ট হত না। দ্রৌপদীর আগে এসেছেন সত্যবতী, কুন্তী , গান্ধারী। প্রত্যেকেই ব্যতিক্রমী চরিত্র। কিন্তু , আপোষকামী। কুন্তী অবশ্যই লড়াকু চরিত্র। তবু, কোথায় যেন লকলক আগুন অনুপস্থিত। দ্রৌপদী প্রথম থেকেই দীপ্ত। প্রখর। তীব্র কণ্ঠে ঘোষনা করেন, যে পুরুষ তাঁর চুলে হাত দিয়েছে, তাঁর রক্ত ছাড়া আর চুল কোনোদিন বাঁধবেন না। কীচক থেকে শুরু করে যে যেখানে দ্রৌপদীকে অপমান করেছে, সেখানে আগুন জ্বলেছে। তবু, পুরুষ কামনা করেছে তাঁকে।​

:যাজ্ঞসেন্যা পরামৃদ্ধিয়ং দৃষ্টা প্রজলিতামিবঙ:

দ্রৌপদী যেন জ্বলছে। চলনে বলনে ব্যক্তিত্বে সে যেন এক অধরা নারী। রহস্যময়ী। যা পুরুষের বুকে জ্বালা ধরায়। দ্রৌপদীকে ঘিরে ভারতের রাজাদের লোভ হিংসা কামুকতা__আবর্তিত হয়েছে।​

দ্রৌপদী অর্থ আগুন। সেটাই মহাকবি বলতে চেয়েছেন। প্রধানা নায়িকার প্রবেশ হোক এমনভাবে , যাতে প্রথম আবির্ভাব থেকেই তাঁকে ঘিরে সৃষ্টি হবে চরম কৌতূহল ও আকর্ষণ। অগ্নির পাবক শক্তি সৃষ্টি আর ধ্বংসের প্রতীক। দ্রৌপদী ঠিক তাই। কাজেই , আমার বিচারে, দ্রৌপদীর জন্ম অলৌকিক নয়। প্রতীকী।

■ ২

ভারত রাজ নীতি/ কৃষ্ণ ও দ্রৌপদী

মনে করা হয়, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কাল খ্রী পূর্ব ৩০০০ অব্দের কাছাকাছি এবং তার কিছুকাল পরে মহাভারত রচিত হয়। সেইসময় ছোট ছোট রাজ্যে বিভক্ত ভারত। দলাদলি , রাজনৈতিক ডামাডোল , অরাজকতা , শোষণ ইত্যাদি চলছে।​

তখন ধীরে ধীরে উত্থান হচ্ছে যাদবকুলপতি শ্রী কৃষ্ণের।।​
কৃষ্ণ ছিলেন প্রাজ্ঞপুরুষ। দূরদর্শী। চতুর।​

Extremely clever firmly determined, an expert judge of time and circumstances. স্বপ্ন দেখছেন ভারতবর্ষ হোক এক অখণ্ড ধর্মরাজ্য। এ লক্ষ্যে প্রধান বাধা ছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধ এবং তাঁর অনুগামীর দল। যেমন , কংস, শিশুপাল প্রমুখ। দুর্যোধন সমর্থন করতেন জরাসন্ধকে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির পুরোটাই দখলে ছিল পূর্ব মধ্য ভারতীয়দের দখলে। বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের রাজন্যবৃন্দ পারস্পরিক দ্বন্দ্বে মত্ত থেকে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য প্রয়াসকে করেছিল সুদূর পরাহত। সর্বোত্তম সর্বভারতীয় এক রাষ্ট্র গঠনের মনোভাব বা দূরদর্শিতা তাদের ছিল না। মহাভারতের সময় বিশাল ভারতবর্ষকে রাজনৈতিক ঐক্য ও ধর্ম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভারতে একটি দৃঢ়রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। প্রতিকূল পরিস্থিতি নিজের দিকে নিয়ে আসতে প্রথমেই নিধন করলেন মাতুল কংসকে। এবং , নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন ভারতের সর্বোত্তম নেতা হিসেবে।​

শ্রীকৃষ্ণের স্বপ্ন ছিল ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার। যা হবে অখণ্ড। এক পতাকার ছত্র ছায়া তলে একত্রিত হবে সমগ্র ভারত। সেই রাষ্ট্রের কর্ণধার ঠিক করতে তিনি চললেন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়। কারণ, তাঁর অনুমান ছিল নির্ভুল। জানতেন ওই সভায় পঞ্চপান্ডব যেভাবেই হোক আসবে। তাঁরা তখন অজ্ঞাতবাস পালন করছে। কৃষ্ণ খুঁজে পাননি তাঁদের। আশা ছিল এখানে তাঁরা আসবেই। এবং , কৃষ্ণ মনে মনে ঠিক করেছিলেন, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির হবেন আগামী দিনের কর্ণধার।​

দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভা। ভারতবর্ষের তাবৎ রাজাদের আগমন ঘটেছে সেখানে। তাঁরা প্রত্যেকেই ওই একটিমাত্র নারীকে কামনা করছিল। উপস্থিত ছিল পঞ্চপান্ডব। দ্রৌপদীর রূপে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল তাঁরা সকলেই।

রাজনৈতিক ডামাডোলের সময় দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর খুব গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। রাষ্ট্রের তাবৎ ঋষিকুল সহ শ্রীকৃষ্ণ উপস্থিত ছিলেন সেখানে। এখানে বলে রাখা ভালো, ভরতের পূর্ব - দক্ষিণ শক্তির( জরাসন্ধ প্রমুখ) উপর উত্তর পশ্চিম ভারতের আধিপত্য বিস্তারের জন্য সারা ভারত বর্ষ জুড়ে সে কা লে যে রাজ নৈতিক তথা কূটনৈতিক যুদ্ধ হয়েছিল, সেখানে শ্রী কৃষ্ণের প্রধান সহায় ছিলেন ঋষিকুল তথা ব্রামণকুল। ব্রামণ - ক্ষত্রিয় দ্বিপাক্ষিক চুক্তি জরুরি ছিল।

তথা দহ্তি রাজন্যো ব্রামণেন সমং রিপুম।​

অর্থ:ঋষি কুলের সহায়তা পেলে শত্রু জয় করা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে কিছুই না। উল্লেখ্য যে, যুধিষ্ঠির নিজে ক্ষত্রিয় হলেও, তাবৎ ঋষিকুলের সঙ্গে ধর্ম আলোচনা করতেন। বেদ বেদাঙ্গ নিয়ে গভীর চর্চা করতেন। সেজন্যে আগামী ভারতের নায়ক হিসেবে ঋষি কুলের প্রথম ও একমাত্র পছন্দ ছিলেন যুধিষ্ঠির।

সমস্যা হল, সেই সময় দুর্যোধনে র গুপ্তঘাতকের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পাণ্ডব ছিল অজ্ঞাত বাসে। স্বয়ম্বর সভায় ছদ্ম বেশে এসেছিল। তার পিছনেও কারণ ছিল। সেই সময় পঞ্চাল শক্তিশালী রাজ্য। সেই রাজ্যের একমাত্র কন্যাকে যে ব্যক্তি বিবাহ করতে সমর্থ হবে, পরবর্তী কালে পঞ্চাল তার পাশে থাকবে। সুতরাং, দ্রৌপদীর বিবাহ নিছক বিবাহ ছিল না। তার পিছনেও ছিল গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। দ্রৌপদী কি জানতেন? এই উদ্দেশ্য মূলক বিবাহ সংঘটিত হতে দিতে সায় ছিল কি তাঁর? তথ্য বলে, তিনি অবগত ছিলেন। পিতা দ্রুপদ চেয়েছিলেন,কন্যার বিবাহ হোক অর্জুনের সঙ্গে। অর্জুন মহাবীর। জামাতা হলে সে হবে দ্রুপদের সহায়। নিতে পারবেন প্রার্থিত প্রতিশোধ, কুরুআচার্য ও একদা বন্ধু দ্রোণাচার্যের উপর। সেই জন্যই কঠিনতম শর্ত রাখা হল বিবাহের। যা ভেদ করা অর্জুন ব্যতীত আর কারো পক্ষে সম্ভব হবে না।​

লক্ষ্যভেদ অনুষ্ঠান শেষ হল।​

কি অপূর্ব বিভঙ্গমে , নিখুঁত নিপুনতায় , সংযত ভঙ্গিতে লক্ষ্যভেদ করলেন অর্জুন। প্রশংসার পুষ্পবৃষ্টি হতে লাগল রাজসভা জুড়ে। কৃষ্ণ বুঝে গেলেন, এই নিপুণ ধনুর্ধর আর কেউ নয়। স্বয়ং অর্জুন। এরপর আরো কিছু ঘটনা ঘটল সেখানে। অর্জুনের প্রতি ঈর্ষায় কর্ণ দুর্যোধন শাল্ব শল্য দ্রুনায়নী ক্রথ সুনিথ বক্র শিশুপাল প্রমুখ রাজারা ছদ্মবেশী অর্জুনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তখন ভীম অর্জুনের দাপুটে যুদ্ধ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল উপস্থিত সকলে। কৃষ্ণ নিশ্চিন্ত। পঞ্চ পান্ডব এখানেই আছে। নি :শব্দে বার্তা বিনিময় হল, ঋষিদের সঙ্গে। একটা সঙ্কটের সূচনা নজরে পড়েছে তাঁদের। সেটা কী? অর্জুনের দ্রৌপদী লাভের ফলে ঈর্ষার করাল ছায়া শুধু অন্যান্য রাজাদের আক্রান্ত করেনি, পঞ্চপাণ্ডবের বাকি চার ভাই স্পষ্টত কাম এবং ঈর্ষায় আক্রান্ত। এর ফল হতে পারে ভয়ানক। নাহ। কিছুতেই পঞ্চপান্ডব ঐক্যভঙ্গ করা সম্ভব না।​

তাই, অর্জুন লক্ষ্যভেদ করলেও কুন্তীর আদেশ হল পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে বিবাহ হবে দ্রৌপদীর। নারদ আর ব্যাসদেব বিধান দিলেন , এই ঘটনা দ্রৌপদীর পূর্ব জন্মে ছিল। সুতরাং বাধা কিসের?

আমার বিচারে, এটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কুটিল সিদ্ধান্ত। পূর্বজন্ম কাহিনী সেই সময় পরিকল্পনা করেই বলা। কুন্তী আগেই খবর পেয়ে গিয়েছিলেন যে, কৃষ্ণাকে দেখে তাঁর পাঁচপুত্রই কামে জর্জর। তাহলে? পাঁচ ভাইয়ের যে ঐক্য , যা নিয়ে আগামী দিনে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে হবে,দ্রৌপদীর রূপ সে লক্ষ্যে বাধার সৃষ্টি করবে। ভ্রাতাদের মধ্যেকার ঐক্য বিনষ্ট হলে স্বপ্নভঙ্গ হবে স্বয়ং কৃষ্ণের। সুতরাং, বন্ধকপাটের আড়াল থেকে কুন্তীর আদেশ, নারদ আর ব্যাসদেবের অলৌকিক তত্ত্ব প্রণয়ন ...এবং অর্জুনের প্রেম বুকে নিয়ে বিবাহের পরে প্রথমরাত যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে অতিবাহিত করা। আর একটা কথা বলে রাখা ভালো, উক্ত স্বয়ম্বর সভায় অর্জুনের আগে কর্ণ প্রায় ভেদ করে ফেলেছিলেন ল লক্ষ্য। কিন্তু, সর্ব সমক্ষে সুত পুত্র বলে অপমান করে ফিরিয়ে দেন তাঁকে দ্রৌপদী। এ অপমান সহজে মেনে নেয়নি দুর্যোধন, কর্ণ প্রমুখ। দ্যুতসভায় দ্রৌপদীর চরম অপমান এই উপেক্ষার একপ্রকার প্রতিশোধ বলা যায়।​

রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত সেই নারীর জীবনের প্রতিটি রাত কেমন করে নির্বাহ হত? কেউ জানতে চায়নি কোনোদিন। তবে, আগুন হতে উদ্ভুত কন্যার ভিতরের ক্ষোভ বাইরে প্রকাশ পায়নি , এটা তাঁর চরিত্র মহত্ব। নীরবে নিভৃতে রাত দিন কাটিয়েছেন অর্জুনের প্রতীক্ষায়।​

■ ৩

অরণ্যবাস ও নিষ্ক্রিয় পঞ্চ পাণ্ডবের প্রতি দ্রৌপদীর উষ্মা।

দ্রৌপদীর জীবনে বঞ্চনা এসেছে বারবার। পঞ্চস্বামীর অকাতর সেবা করার পরেও যথোপযুক্ত সম্মান তিনি পেলেন কোথায়? দ্যুতক্রীড়ায় পণ রাখা থেকে শুরু করে প্রকাশ্য সভায়​

বস্ত্র উন্মোচন , অসম্মানের শেষ সীমায় অবস্থিত করেও একবারের জন্য স্বামীদের দোষারোপ করেন নি। বরং তীক্ষ বুদ্ধির এই নারী স্থির মস্তিষ্ক থেকে যুক্তি প্রয়োগ করে দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছেন তাঁদের। প্রখর ছিল তাঁর রাজনীতি বোধ। সাময়িক ভাবে তিনি উপেক্ষা করেছিলেন দুর্যোধন কর্ণ প্রমুখের অপমান। কিন্তু, ভুলে কিছুই যান নি। তখনো প্রস্তুত নন পঞ্চপাণ্ডব। দুর্যোধন অনেক বেশি ক্ষমতাবান। তাই, তিনি রইলেন সঠিক সময়ের অপেক্ষায়।​

এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভালো, বিবাহের পূর্বে দ্রৌপদী আইন শিক্ষা করেছিলেন। একথা মহাভারতের বনপর্বে তিনি নিজ মুখে বলেছেন। এছাড়া, শ্রী নৃসিংহপ্রসাদভাদুড়ি মহাশয়,তার মহাভারতের অষ্টাদশী গ্রন্থের ৪৭৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন," তখনকার দিনে আইনের বই বলতে বৃহষ্পতি সংহিতা,শুক্র সংহিতা এই সব ই ছিল। পণ্ডিতের কাছে বৃহস্পতি নীতির পাঠ নিতেন প্রধানত দ্রুপদ রাজা। কিন্তু আইনের ব্যপারে দ্রৌপদীর এত আগ্রহ ছিল যে ওই পাঠ গ্রহণের সময় তিনি কোন কাজের অছিলায় সেখানে চলে আসতেন। এবং বৃহস্পতি নীতির পাঠ গ্রহণ করতেন। অর্থাৎ আইন পড়তেন। এবং জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁর এই শিক্ষা কাজে লেগেছিল, সন্দেহ নেই। যেমন, এই বনপর্ব।​

দ্বৈতবনে প্রবেশ করলেন পান্ডব। একদিন সেখানে এলেন কৃষ্ণ এবং দ্রৌপদীর পিতৃগৃহের লোকজন। দ্রৌপদী বুঝলেন সময় এসেছে। তিনি এও বুঝেছিলেন,যুধিষ্ঠির নরম স্বভাব। যুদ্ধ বিগ্রহ পছন্দ করেন না। তিনি আর দেরি করলেন না। কৃষ্ণ কে দেখা মাত্র নিজের সমস্ত অভিযোগ তুলে ধরলেন। একটার পর একটা ঘটনা পর পর সাজিয়ে তুলে তুলে বিশ্লেষণ করে দেখিয়ে দিলেন কোথায় কোথায় অন্যায় হয়েছে। বিচার হয় নি। বারংবার বলতে বলতে নয়ন যুগল মার্জনা করে নিশ্বাস ত্যাগ করে রাগতস্বরে কৃষ্ণ কে বললেন:​

: নৈব মে পতয়: সন্তি ন পুত্রা ন চ বা ন্ধবা:।​
ন ভ্রাতরো ন চ পি তা নৈব ত্বং মধুসূদন।।​

মধুসূদন! আমার পতিরা নেই। পুত্রেরা নেই। বান্ধবরা নেই। ভ্রাতারা নেই। পিতা নেই। এমন কি তুমিও নেই।

সত্য। দ্রৌপদী যেন নাথবতী হয়েও অনাথবৎ!

সেই মুহুর্তে পরিবর্তন ঘটে গেল পান্ডবপক্ষে। কৃষ্ণ অর্জুন ভীম প্রত্যেকে দাঁড়িয়ে উঠে প্রতিশ্রুতি দিলেন, যুদ্ধ হবেই।​

যুদ্ধ ঘোষণা করা হল। রচিত হল নতুন ইতিহাস। প্রতিষ্ঠা হল ধর্মরাজ্যের। সফল হল কৃষ্ণের স্বপ্ন। পঞ্চ পাণ্ডবের পরিশ্রম। সমস্ত কিছুর পিছনে রয়ে গেল দ্রৌপদীর অপরিসীম অবদান। ভারতের রাজনীতির একদিকে আছেন কৃষ্ণ। অপরদিকে অবশ্য দ্রৌপদী। এই দুজন না থাকলে, যুধিষ্ঠির হয়ত পাঁচটি গ্রাম উপহার হিসেবে প্রাপ্ত হয়ে সন্তুষ্ট থাকতেন।

তাই, মহাভারতের রাজনৈতিক দিক বুঝতে হলে, দ্রৌপদীর কথা জানতেই হবে। কঠিন ভূমিকা পালন করেছেন এই নারী। আজকের যুগেও তিনি সমান আধুনিক এবং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ