যে কোন রাজনৈতিক দলই হোক না কেন। যে কোন ধরণের মতাদর্শই হোক। এই গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর সুযোগ ও সুবিধা গ্রহণ করেই রাজনীতিতে এগিয়ে চলায় বিশ্বাসী। ফলে কোন রাজনৈতিক দলই সমাজকে শিক্ষিত করে তুলতে নারাজ। একটি শিক্ষিত সমাজকে রাজনৈতিক স্বার্থে বলির পাঁঠা বানিয়ে রাখা সহজ সাধ্য নয়। বরং প্রায় অসম্ভব। করতে গেলে সম্পূর্ণ ফ্যাসিস্ট শক্তির নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ছাড়া সেটি করাও সম্ভব হয় না। ফলে, উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক দলগুলির রাজনৈতিক কর্মসূচীর কোথাও সমাজকে শিক্ষিত করে তোলার মতো কোন দিশা, পরিকল্পনা কিংবা কার্যক্রম রাখা হয় না। অত্যন্ত সচেতন ভাবেই। উল্টে বিশেষ করে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শিবিরগুলি অশিক্ষার বিস্তারকে কায়েমী করে রাখার জন্যই ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতাকে সমাজের সর্বস্তরে সবসময় শক্তিশালী করে রাখার চেষ্টা করে থাকে। এদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটা বড়ো সময়ই এই কাজে ব্যায় করা হয়। আর এই কারণেই দেখা যায়, এই দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির নেতানেত্রীরা মন্দির মসজিদে ঘন ঘন ঢুঁ মারে। এবং বিশেষ করে নির্বাচনের প্রাক্কালে তাদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের গতি বৃদ্ধি হয় সবিশেষ। কে কত বড়ো ধার্মিক সেইটি প্রমাণ করার ধুম পড়ে যায়। এবং সাধারণ মানুষের ভিতরে বেশ একটা সাড়াও পড়ে যায়। নেতানেত্রীদের ধর্মীয় কার্যক্রমে ভক্তবৃন্দের উৎসাহ উদ্দীপনাও বৃদ্ধি পায় চতুর্গুণ। যার ছায়াপাত ঘটে ভোটের হিসাবে।
এই যে, দেশের বেশির ভাগ মানুষকে কার্যত অশিক্ষায় আপাদমস্তক মুড়ে রাখার রাজনীতি, এই রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে সমাজ ও জাতি, দেশ ও রাষ্ট্রকে উদ্ধার করতে গেলে পথ একটাই। এবং সেই পথ সমাজ বিপ্লবের পথ। না, সমাজ বিপ্লব মানেই গুলি বোমা বন্দুকের কারবার নয়। সমাজ বিপ্লব মানেই গৃহযুদ্ধ নয়। সমাজ বিপ্লব মানে সমাজসংস্কার। আগা থেকে গোড়া অব্দি সমাজ সংস্কার। বিভিন্ন দেশের ইতিহাসের থেকে শিক্ষা নিয়ে সঠিক দিশার হদিশ খুঁজে বের করতে হবে। কিভাবে একটি ক্লীব পঙ্গু সমাজকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো যায়। কিভাবে সমাজের প্রতিটি মানুষকে শিক্ষার সুযোগের আওতায় নিয়ে আসা যায়। কিভাবে শিক্ষার অধিকারকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে সমাজ বাস্তবতায় সত্য করে তোলা যায়। মানুষের ভিতর শিক্ষার প্রসার যত বেশি ও ব্যাপক হবে, মানুষের অবরুদ্ধ চেতনা তত বেশি মুক্ত হতে থাকবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার ধারা ও উপধারাগুলি সম্বন্ধে মানুষ তত বেশি সচেতন হয়ে উঠবে। মানুষকে নিয়ে রাজনীতি করার যে উপায় গুলি, সেইগুলি তত বেশি কমজোরি হয়ে পড়তে থাকবে। এবং ধর্মের আফিম ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষচর্চার সংস্কৃতি দিয়েও মানুষকে ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে উঠতে থাকবে। শিক্ষার প্রসারের সাথে সাথেই মানুষের আর্থিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠাও সমাজের সর্বস্তরে প্রসারিত হবে। দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে এর কোন বিকল্প নাই। মানবসম্পদের উন্নয়নের হাত ধরেই একটি জাতির উত্থান সম্ভব হয়। অন্য কোন পথে সেই উত্থান সম্ভব হয় না। জাতির উত্থান প্রতিটি মানুষের ভাগ্য খুলে দিতে সক্ষম হয়। মানুষকে অনুন্নত জীবনযাপন থেকে তুলে নিয়ে আসতে গেলে জাতির উত্থান ছাড়া কোন পথ নাই।
কিন্তু দুঃখের বিষয় কাঁটাতারের দুই পারে পড়ে থাকা বাংলার সমাজ এই সত্য উপলব্ধি করতে প্রয়াসীও নয়। সমাজের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, নিজের আখের গুছিয়ে নিতেই ব্যস্ত। দেশের গোটা সমাজ নিয়ে তাদের ভিতরে প্রকৃত কোন সমবেদনা নাই। তার আসল কারণ, আমাদের দুই বাংলাতেই বাঙালি জাতীয়তাবোধের কোন উন্মেষ ঘটেনি আজও। একটি জাতির ভিতরে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ না ঘটলে সমগ্র জাতি সম্বন্ধে কারুর ভিতরেই প্রকৃত কোন সমবেদনা জেগে ওঠে না। দুর্ভাগ্যের বিষয় দুই বাংলার বাঙালিই এই বিষয়ে তুল্যমূল্য অবস্থানে আটকিয়ে। আজও অনেকের ভিতরেই জাতীয়তাবোধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীবোধের সমার্থক ও সমতুল। এবং অধিকাংশ বাঙালির চেতনার গভীরেই এই একটি অন্ধকার বদ্ধমূল হয়ে গেঁথে রয়েছে। গেঁথে রয়েছে বংশপরম্পরায়। গেঁথে রয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। গেঁথে রয়েছে সামাজিক ও পারিবারিক ঐতিহ্যে। আর দুই বাংলার রাজনীতি সেই ঐতিহ্যকেই প্রতিদিন নিয়ম করে তা দেওয়ার কাজে নিষ্ঠার সাথে কর্মব্যস্ত। ফলে যে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর কর্তব্য ছিল, সমাজকে সঠিক পথ দেখানোর। সেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সমাজকে ভুল পথে চালিত করতেই ব্যস্ত থেকেছে। রাজনীতির সাথে গাঁটছাড় বেঁধে। কিংবা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে। এই দুই ভাবেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সমাজকে কার্যত ভুল পথে ঠেলে দিয়েছে। যার সম্পূর্ণ ফয়দা তুলেছে প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী রাজনীতিই।
এবং একথাও সত্য, একটি সমাজ তার বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর প্রকৃতির উপর অনেক অংশেই নির্ভরশীল। দুই বাংলাই তার বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর বর্তমান ক্লীবতা ও নীচতার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত। বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর ফেলে রাখা ফাঁকা মাঠটা দখল করে নিয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্বেরা। দেশসেবকের মুখোশ পড়ে সমাজটাকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দেওয়া কাগজের ঠোঙার মতো অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলেছে। আর দুইবেলা দুর্নীতির পথটিকে একমাত্র পথে পরিণত করে নিয়ন্ত্রণ করছে সমাজ থেকে দেশ। রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তিপরিসর। ফলে মানুষের হাতে অন্য কোন রকম বিকল্প আর অবশিষ্ট নাই। মানুষ প্রায় ক্রীতদাসের মতো সবসময় সময়ের সাথে ও অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য বিধান করে নিতে বাধ্য হচ্ছে। শুধুমাত্র অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। আর এই দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতির অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্যই হলো সাধারণ মানু্ষকে এমন ভাবেই ঠেলতে থাকা, যাতে খাদে পড়ে যাওয়ার থেকে বাঁচার জন্যে প্রয়োজনে আগাছা আঁকড়িয়ে ধরে হলেও সে টিকে থাকার চেষ্টা করে। আজকের দুই বাংলার রাজনীতি সেই আগাছায় পরিণত হয়েছে, যাকে আঁকড়িয়ে ধরেই নিরন্তর টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত আমজনতা।
ঠিক এই রকম পরিস্থিতি থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে জমাট বাঁধা শুরু করতে হবে। স্বল্প সংখ্যক হলেও, মূল পরিস্থিতি সম্যক উপলব্ধিতে সক্ষম, হাতে গোনা কয়েকজন হলেও পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নাই। পরস্পরের হাত ধরতে হবে। কাছাকাছি আসতে হবে। সমাজ সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিরন্তর চেতনার আদান প্রদানের সকল দরজা জানলাগুলি হাট করে খুলে রাখতে হবে। হবেই। চিন্তা ভাবনার আদান প্রদান ছাড়া কোন দিশা খুঁজে পওয়া সম্ভব নয়। তাই পরস্পর পরস্পরের কাছে স্পষ্ট হতে হবে। সেখান থেকে যৌথশক্তিতে উঠে আসতে হবে, আপন গৃহের নিভৃত অন্তঃপুর থেকে। এই ভাবে একে একে বার হয়ে আসতে শুরু করলে, বাকিদেরও সাহস বৃদ্ধি পাবে। এবং দেখা যাবে, ক্রমেই একটি সদর্থক শক্তি জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। এইটি না হলে সমাজ সংস্কারের পথ তৈরী করা সম্ভব হবে না কোনদিনই। দুই বাংলার সমাজ সংস্কারের ফেলে রাখা কাজ শুরু না করতে পারলে, সমাজ বদলের দিন এগিয়ে আসবেই বা কি করে? আর সমাজ বদলের দিনকে এগিয়ে আনার সামগ্রিক প্রক্রিয়াই সেই সমাজ বিপ্লব। না, গোলাগুলি বোমা বন্দুক। গেরিলা বাহিনী ছাড়াও সমাজ বিপ্লবের এই এক পথ। বাংলা ও বাঙালির যদি কোন ভবিষ্যৎ থেকে থাকে তবে সেই ভবিষ্যতের চাবি একমাত্র এই সমাজ বিপ্লবের পথেই মিলবে। অন্য সব পথই গোলকধাঁধার পথ।
২০শে ডিসেম্বর’ ২০২০
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন