শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং বাঙালির ভবিষ্যৎ
জাতীয় নাগরিক পঞ্জি ও নাগরিকত্ব আইন কী তা নিয়ে এত আলোচনা হয়েছে যে সেই বিশদে না গিয়ে সরাসরি চলে আসছি তার বিবর্তিত রূপ এবং বর্তমান প্রতিক্রিয়ায়। ২০১৬-র ১৯ জুলাই বিলটি লোকসভায় পেশ হওয়ার পর একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করে ১৯১৬-র ১২ আগস্ট সেখানে পাঠানো হয় এই বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য। সেই কমিটিতে বহুদিন যাবৎ আলোচনা চলার পর রিপোর্ট আসে ২০১৯-এর ৭ জানুয়ারি কোন সংশোধনী প্রস্তাব ছাড়াই। অভিযোগ কমিটিতে বিরোধী দলের সদস্যদের আপত্তি ধোপে টেঁকেনি। বিলটি ২০১৯-এ ৭ জানুয়ারি সংসদে পেশ করার পর শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সৌজন্যে ৮ জানুয়ারি পাসও হয়ে যায়। নির্বাচনের পর লোকসভায় সেটি পাসও হয়েও ঝুলে থাকে ষোড়শ লোকসভা অধিবেশন শেষ হওয়ায়। তখন থেকেই প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে, বিলটিতে শরণার্থী হিসাবে নাগরিকত্ব পেতে হলে এত রকম নথিপত্র দরকার যে কারও পক্ষেই সবকটি জোগাড় করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ থেকে পালিয়ে আসার কারণ হিসাবে ধর্মীয় অত্যাচারের প্রমাণ দাখিলের বিষয়টি সবচেয়ে অবাস্তব বলে সমালোচিত হয়েছে। ফলে কিছু সংশোধনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল এবং বিরোধীদের তরফ থেকেও প্রস্তাবিত ছিল। তবে প্রয়োজন ও প্রস্তাব অনুরূপ ছিল না। প্রসঙ্গত প্রধান বিরোধী শিবিরগুলো থেকে মারাত্মকভাবে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের অভিযোগ আনা সত্ত্বেও ২০১৪ থেকে কেন্দ্রে আসীন শাসকদল ২০১৯-এ পুনরায় ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী প্রচারে এই দুটি বিষয়কে গোপন তো করেইনি, বরং প্রচারের অন্যতম বিন্দু করেছিল। সুতরাং এই দুটি বিষয়ে দেশের জনমত যে সঙ্গে আছে, সে বিষয়ে আর কোনও প্রমাণ দাখিলের প্রশ্ন ওঠে না।

যাইহোক, ইউনিয়ান ক্যাবিনেট ২০১৯-এর ৪ ডিসেম্বর সপ্তদশ লোকসভায় পুনরায় বিলটি উত্থাপন করে এবং ২০১৯-এর ৯ ডিসেম্বর Citizenship Act of 1955 বা নাগরিকত্ব আইন ১৯৫০-এর সংশোধনী হিসাবে Citizenship Amendment Bill (CAB)’ 2019 লোকসভায় পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। টানা সাত ঘণ্টা সদনের সবার তির্যক প্রশ্নের জবাব দিয়ে প্রবল বিতর্কের পর বিলটি ৩১১-৮২ ভোটে লোকসভার বেড়া টপকেও যায়। ১৩ তারিখে বিলটি রাজ্যসভায় পেশ হওয়ার পর দিনভর টানটান অনিশ্চয়তার শেষে রাজ্যসভাও উত্তীর্ণ হয় ৩২৫-৯২ ভোটে। মনে হল আর কোনও দীর্ঘসূত্রী গেরোর ফেরে না পড়ে ১৩-ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা শীতকালীন অধিবেশনেই শরণার্থী ও উদ্বাস্তু সমাস্যার এক বহু প্রতীক্ষিত সমাধান সূত্র পাওয়া গেল। রাজনাথ কোবিন্দ সাক্ষর করার পর তা Citizenship Amendment Law (CAB)’ 2019 হিসাবে সংবিধানের অঙ্গ। তবে আইনের সাফল্য যেহেতু প্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল, তাই সমস্যার সমাধান হল না নতুন সমস্যার সূত্রপাত তা সময় বলবে। বেশ কয়েকটি বিরোধী দল এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মোট ১৫টি মামলা করেছে। লোকসভায় পাস হওয়া ইস্তক উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে লাগাতার প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, অশান্তির বিস্ফোরণ দেখা গেছে। বেশ কয়েকটি বিরোধী দল এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মোট ১৫টি মামলা করেছে। সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের নামে মানুষ সম্প্রদায় বিশেষের যা বিধ্বংসী উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করল, তাতে শুধু শরণার্থী হিন্দু নয়, এদেশে বহু প্রজন্মের বাসীন্দা হিন্দু বাঙালিরও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে তা উদ্ভূদ পরিস্থিতিকে কোন দিকে নিয়ে যায় সেটাই দেখার। আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতের শরণার্থী হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যায় উপকৃত হওয়ার কথা বাঙালি হিন্দুর যদি সম্মিলিত চাপে আইনটি প্রত্যাহৃত না হয়। 

রাজনীতির ঘোলাজলে একটি নির্দিষ্ট সাম্প্রদায়িক অভিমুখ ছাড়া আর কিছু ঠাওর করা যাচ্ছে না। তাই যেটা বোঝা যাচ্ছে, শুধু সেটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করি। অর্থাৎ উত্তরপূর্বের প্রদেশগুলোর অসন্তোষের কারণগুলো সেগুলোই দেখা যাক। 

উত্তরপূর্ব ভারতে CAB-এর প্রতিক্রিয়া

বলা বাহুল্য তুমুল বিক্ষোভে ফেটে পড়েছে উত্তরপূর্বের প্রদেশগুলো যারা শরণার্থী জোয়ারের আশঙ্কায় ভীত এবং নিজেদের প্রাদেশিক সত্ত্বা অক্ষুন্ন রাখতে কোনও শরণার্থীকেই জায়গা দিতে নারাজ। তারা তাদের দাবি একপেশে বিতাড়ন যন্ত্র এনআরসি-তেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।

আসাম: ১৯৮০ সালে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করেই জাতিগত হিংসার চরমে পৌঁছয় আসাম যার ফলশ্রুতিতে আসাম চুক্তি ১৯৮৫ সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ভিত্তিতেই এনআরসি তালিকার প্রস্তুতি, যে তালিকায় ভারতে প্রবেশের ভিত্তি তারিখ নির্ধারিত আছে ১৯৭১-এর ২৪ মার্চ। এর পরে আসা বাংলাদেশীদের সীমান্ত পার করা হবে, আর না করা পর্যন্ত ডি-ভোটার হিসাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে পচানো হবে। ১৯১৪-র ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুপ্রবেশ অনুমোদন করলে চালু এনআরসি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ প্রযোজ্য হবে না। আসু (All Assam Students’ Union), কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতিসহ আসামের ৩০টি গোষ্ঠী রাজ্যজুড়ে জনজাতিগুলির জীবনযাপন বরবাদ হবে বলে প্রবল প্রতিবাদে অশান্তি শুরু করেছে। আসাম গণপরিষদ তো আগে ২০১৬তেই এই বিষয়কে কেন্দ্র করে আসামের বিজেপি সরকারের সঙ্গে নিজেদের গাঁটছড়া খুলে নিয়েছিল। কৃষক মুক্তি সমিতির নেতা অখিল গগৈ ২০১৮-র ২৭ জানুয়ারিই হুমকি দিয়েছিল এই আইন জারি হলে আসাম ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আসু ও কৃষক মুক্তি সমিতির নেতাকর্মীরা ‘জনতা ভবনের সামনে নগ্ন হয়ে বিক্ষোভও দেখায়। মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালও জাতির স্বার্থে পদত্যাগ করার হুমকি দিয়ে রেখেছেন। 

মিজ়োরাম: মিজ়োরামেও ২৩ জানুয়ারি ২০১৯ ৩০,০০০ ছাত্রছাত্রী ও এনজিও প্তিবাদে নেমেছিল বিলে চাকমা বৌদ্ধদেরও নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব থাকায়। দক্ষিণ মিজ়োরামে চাকমারা ইতিমধ্যে বহু সংখ্যক চাকমা উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছে যাদের কর্ণফুলি নদীতে ‘কাপ্তাই’ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বাঁধ’ তৈরির জন্য ১৯৬২ সালেই উচ্ছেদ করেছিল পাকিস্তান সরকার কোনও পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের আয়োজন না করে। তারপরে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই চাকমাদের বাংলাদেশে স্থান দেওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি ধর্ম কোনওটাই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনুরূপ নয়। ষাঠের দশক থেকে লাগাতার উচ্ছেদের অসন্তোষ থেকেই কালক্রমে ১৯৭২ সামে জন্ম নেয় “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি”। নিজেদের “জুমিয়া জাতি”বলে বাংলাদেশে আওয়ামি লীগ সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতিও দাবি করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে স্বায়ত্ব শাসনের চার দফা দাবি পেশ করে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী এই জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা দিয়ে দমন করে আসছে। ফলত ১৯৭৩-এর ৭ জানুয়ারি একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী (Chakma armed resistance) তৈরি করে যার নাম “শান্তি বাহিনী”। বাংলাদেশ সেনা ও “শান্তিবাহিনী”র মধ্যে সহিংস সংঘাত চরমে পৌঁছয় ১৯৭৩ নাগাদ। রাষ্ট্রীয় সেনার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ক্ষধদ্র বাহিনী কতদিন আর টিঁকে থাকবে। চাকমারা বাংলাদেশ থেকে আর এক প্রস্থ উৎখাত হয়ে ভারতে আসতে থাকে এবং মূলত আশ্রয় নেণ অরুণাচল, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরায়। । চাকমারা কিন্তু নিজেদের ভূমিতে বসবাসের অধিকার ছাড়া আর কিছুই দাবি করেনি। তবুও তাদের উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। 

পুনরায় চাকমা আবির্ভাবের সম্ভাবনা দেখা দিতে মিজ়োরামের এনজিও Young Mizo Association সারা রাজ্যজুড়ে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান বয়কট করে। মিজ়োরামের মুখ্যমন্ত্রী জ়োরামথাঙ্গা (Zoramthanga) বিল পাস হলে বিজেপি-র সঙ্গে North-East Democratic Alliance (NEDA) ভেঙে দেবে বলে শাসিয়ে রেখেছে। মিজ়ো ছাত্র ইউনিয়ান Mizo Zirlai Pawl (MZP)-এর নেতার মতে বিল পাস নাকি দেশে একতার পরিপন্থী হবে। এটাও বিচ্ছিন্ন হওয়ার হুমকি বলেই ধরতে হবে।

মেঘালয়: মেঘালয়ের Meghalaya Democratic Alliance (MDA) সরকারও Citizenship (Amendment) Bill, 2016-র বিরোধিতা করবে বলেই রেখেছিল। তাদের আশঙ্কা মেঘালয়ের মতো ক্ষুদ্র রাজ্যে বিলের প্রস্তাবমতো অভিবাসন (immigration) হলে মেঘালয়ের মূল অধিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা (Conrad Sangma) গৃহমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তাঁর যুক্তি নতুবা মেঘঅলয়সহ উত্তরপূর্ব ভারতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিত অবনতি ঘটাবে। শিলং শহরে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ সমবেত হয়ে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এই মর্মে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সাংমাও রাজ্যসভার গণ্ডী পেরোলে বিজেপি-র নেতৃত্বে এনডিএ (NDA) জোট ছেড়ে দেওয়ারই হুমকি দিয়ে রেখেছেন।

নাগাল্যান্ড: নাগাল্যান্ড উপজাতি কাউন্সিল বা The Nagaland Tribes Council (NTC) এবং নাগা ছাত্র সংগঠন Naga Students’ Federation (NSF) উত্তরপূর্বের জনজাতিদের মধ্যে নাগা রাজনৈতিক দলগুলি আঞ্চলিক চরিত্র হারাবে কারণ দেখিয়ে বিলের বিরোধিতা করে আসছে। এছাড়া আসাম থেকে নাগাল্যান্ডে পরিযায়ীদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তো আছেই।

মণিপুর: মণিপুরেও অনুরূপ আশঙ্কা্য় প্রতিবাদ হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হয়ে বলবৎ হলে বিদেশী ও শরণার্থীদের আস্তানা হয়ে উঠবে মণিপুর। ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ইম্ফলে বিজেপি-র রাজ্যসভা সদস্য কে ভগবানানদা সিংহের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচির সময় ৪ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছিল। এমনকি ২৬ জানুয়ারি ইম্ফলে বোমা বিস্ফোরণ পর্যন্ত অশান্তি হয়। মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিং অমিত শাহকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে মণিপুরকে বিলের বাইরে রাখা হয়। 

ত্রিপুরা: ত্রিপুরায় আবার তিনটি আদিবাসী সংগঠনের ডাকা ১২ ঘণ্টা বন্‌ধে হিংসার জেরে অন্তত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করতে হয়। ২০১৬ নাগরিকত্ব বিলটির প্রতিবাদ করে The Tripura Indigenous Tribal Parties Forum সম্মিলিতভাবে। তাদের বক্তব্য ত্রিপুরায় বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমণের কারণে ইতিমধ্যে স্থানীয় কোকবোরোক (Kokborok) জনগোষ্ঠীর জনানুপাত ৮০% থেকে ৩৩% হয়ে গেছে। বস্তুত ত্রিপুরায় হিন্দু বাঙালির পাশাপাশি এসেছে বাস্তুহারা চাকমা শরণার্থীরাও। অনুপ্রবেশের ফলে রাজ্যটির উপজাতিগত জনমানচিত্র আমূল বদলে গেছে। ৮ জানুয়ারি বিক্ষোভ চলাকালে পুলিসের গুলিতে ৬ জন ত্রিপুরী আহত হওয়ার পর দুদিন ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ ছিল। Indigenous Peoples Front of Tripura (IPFT)-ও ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে জোট ছিন্ন করার কথা বলেছে এই বিলের কারণেই।

অরুণাচল প্রদেশ: অরুণাচল প্রদেশের সমস্যাও মিজ়োরামের মতো চাকমা মূলত শরণার্থী। চাকমাদের সঙ্গে মিজ়োদের সংঘাতের ভয়ে চাকমা শরণার্থীদের অরুণাচল প্রদেশে সরানো হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ কার্যকরী হলে অরুণাচল প্রদেশে বসবাসকারী প্রায় ১ লক্ষ চাকমা, তিব্বতি ও হাজং শরণার্থী নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে। ফলে স্থানীয় জনসমর্থনে ৫০০-র বেশি ছাত্রছাত্রী সেখানেও বিলের প্রতিবাদ করে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯-এর নতুনত্ব

পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি ও খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দানের বিষয়টি ২০১৬-র বিলের মতো অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অপরিবর্তিত আছে ১৯৫৫-র আইনানুযায়ী ন্যূনতম ১১ বছর ভারতভূমিতে বসবাসের শর্ত শিথিল করে ন্যূনতম বসবাসের প্রয়োজনীয়তা ৬ বছর করার ব্যাপারটাও। 

তবে একটি বড়সড় পরিবর্তন আনা হয়েছে মূলত উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর দাবি মেনে যাতে সেখানকার জনজাতিগুলির আঞ্চলিক সংখ্যাগুরুত্ব ও ভাষা-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা নিয়ে আশঙ্কার কোনও কারণ না থাকে। সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলভুক্ত (Sixth Schedule to the Constitution ) আসাম, মেঘালয়, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরার জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলগুলো এর আওতায় পড়বে না। এই এলাকাগুলি হল আসামের কার্বি আলং, মেঘালয়ের গারো পাহাড়, মিজ়োরামের চাকমা জেলা ও ত্রিপুরার আদিবাসী এলাকা। এছাড়া অরুণাচল প্রদেশ এবং মিজ়োরাম ও মেঘালয়ের যে সমস্ত অংশে যাতায়াতের জন্য Inner Line Permit দরকার হয়, সেই জায়গাগুলোকেও নাগরিকত্ব দানের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এমনকি ১০ ডিসেম্বর ২০১৯-এ ত্রিপুরাকেও Inner Line Permit নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয় যাতে সেখানে অভিবাসন দেওয়া না যায়। 

নতুন বিলে Overseas Citizenship of India (OCI) রেজিস্ট্রেশন বাতিলের একটা ব্যবস্থা আছে যদি সেই রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছে ধরা পড়ে। সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের ৫ বছরের মধ্যে ধরা পড়লে দেশের সার্বভৌমত্ব ও সুরক্ষার স্বার্থে ২-৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। কেন্দ্র সরকারের আইন অমান্য করলে উপায় কী সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। যেমন রেজিস্ট্রেশন বা পঞ্জিকরণ বাতিল করার আগে OCI নথিভুক্তদের সাফাই পেশ করার সুযোগ থাকবে।

সংসদে এই বিল পেশ করার সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এটাও স্পষ্ট করেছেন, নাগরিকপঞ্জির জন্য নতুন করে মঞ্চ প্রস্তুতির কোনও প্রয়োজন নেই। সারা দেশজুড়েই এনআরসি হবে যেখানে একজন অনুপ্রবেশকারীকেও ছাড়া হবে না। প্রতিবেশী দেশ থেকে কোনও ‘সজ্জন’ মুসলিম ভারতীয় নাগরিকত্বে আবেদন করলেও বিবেচনা করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আসা ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠীকে এই সুবিধা দেওয়া হবে না।

তবু ক্ষোভ কেন?

আসাম ছাড়াও উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির কাছে বিল বিরোধিতার বেশ কিছু যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছিল। জনবিন্যাস বদলানো ছাড়াও কর্ম সংস্থানে সংকটের আশঙ্কা। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমমন্ত্রীর সঙ্গে প্রস্তাবিত ‘ক্যাব’ নিয়ে আলোচনা করেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী সহ উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা। সেখানেই ইনার লাইন পারমিট বৃদ্ধি বা রাজ্যগুলিতে প্রবেশ ও প্রস্থানের ক্ষেত্র পুনর্গঠনের কথা বলা হয়। ক্যাব আইনে পরিণত হলে সেই ওইসব রাজ্যের ক্ষতি হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন অমিত শাহ, এমন দাবি স্বয়ং মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের। 

তাদের দাবিগুলিলে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রেখেই তো নাগরিকত্ব বিল ২০১৯ পাস করা হয়েছে। তারপরেও বিলটি লোকসভা পার করার অব্যবহিত পরেই উত্তরপূর্বের সাত ভগ্নী জুড়ে ১২ ঘণ্টার বন্‌ধ ডেকে যে বিক্ষোভ শুরু হল কেন, কাদের ভুল বোঝানোয় হয়তো অনুমান করা যায়, হয়তো সবটা যায় না। উত্তরপূর্বের দুটি রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করেছে এই বিলের বিরুদ্ধে। বিশাল মশাল মিছিল চলেছে ১০-১১ ডিসেম্বর রাত জুড়ে। এসবের জেরে আসামে ‘বঙ্গাল খেদানো’র নতুন অধ্যায় শুরু হয় কিনা, ত্রিপুরায় জনজাতি রোষ আবার বাঙালিদের ওপর আছড়ে পড়ে কিনা, বা বাকি পাঁচ বোনের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয় সেদিকে সন্ত্রস্ত্র হয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে। অথচ আসাম প্রাচীন যুগ থেকে আদতে হিন্দু বাঙালির বাসভূমি। অহমরাই এসেছে অনেক পরে দ্বাদশ শতাব্দীতে চিনের ইউনান প্রদেশ থেকে। এসে ভারতীয় সংস্কৃতি ও সনাতন ধর্মকে আপন করে নিয়েছে বলে স্বাগত, কিন্তু মূল ভারতীয়দের যদি তারা বহিরাগত বিদেশি প্রমাণের চেষ্টা করে, তাহলে ওদের শিক্ষা দেওয়া দরকার। কিন্তু উগ্র জাতিসত্তাবাদী অহম খিলাঞ্জিয়াদের প্রাদেশিক আবেগকে ধর্মনিরপেক্ষতার খাতিরে ভারতকে ধর্মশালা বানানোর দাবির সঙ্গে যারা গুলিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করতে চায়, তাদের শিক্ষা কোনও কালেই হবে না। 

আপাতত উত্তরপূর্বের প্রাদেশিক প্রশাসন কঠোরভাবে বিক্ষোভ দমন করে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করে কেন্দ্রে সঙ্গে আলোচনায় বসে নিজেদের আরও কিছু জাতিগত দাবি দাওয়া আদায় করে নিতে আগ্রহী। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর কাছে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব, বিভাজন, সংখ্যালঘু বিদ্বেষ জাতীয় অভিযোগের ফাটা রেকর্ড বাজানো ছাড়া কোনওদিনই কোনও অকাট্য যুক্তি ছিল না, এখনও নেই। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদের নামে একতরফা সাম্প্রদায়িক আস্ফালন ও আক্রমণ এবং তাতে প্রত্যাক্ষ সরকারি মদত দেখেও সে রেকর্ড কোন যাদুবলে অক্ষত থাকে, তা সত্যিই বিস্ময়ের। আর সেই বাজনায় নেচে পশ্চিমবঙ্গ যা প্রত্যক্ষ করল এবং বিরামহীনভাবে করে চলেছে তাতে বাঙালির জাতিগত আশা আকাঙ্খা এমনকি অস্তিত্ব রক্ষার ইচ্ছাও আছে কিনা বুঝে ওঠা স্বয়ং বিধাতার কাছেও দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে। 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ