ই-জিন, ওয়েবজিন, ব্লগজিন ইত্যাকার নানান অভিধায় অজস্র ওয়েব পত্রিকায় কবিতা, গল্প, মননশীল প্রবন্ধ, ভ্রমণ প্রভৃতি সাহিত্যের সবকটি শাখারই বৈচিত্রপূর্ণ সমাবেশ আজ আমরা দেখছি। তাঁর সংশয় নেই, এই বিপুল সাহিত্য-সমারোহের একটা প্রধান কেন্দ্র অন্তর্জালের অনন্য সামাজিক পরিসর ‘ফেসবুক’। তর্কের কোন যায়গা নেই যে এখন বাঙালির সামাজিক জীবনে তার সৃজনশীল মননে ‘ফেসবুক’এর প্রভাব অপ্রতিরোধ্য ও সর্বগ্রাসী। মানুষের সঙ্গে ভাবনা বিনিময়ের দিগন্তবিস্তারী পরিসর আর কবেই বা এমন উন্মুক্ত হয়েছে ! ফেসবুককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কত সাহিত্যগোষ্ঠী, প্রকাশিত হচ্ছে কত ওয়েব ভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকা, ফেসবুক ব্যবহারকারীরাই যার টার্গেট পাঠক। এমনকি বেশ কয়েকটি পুস্তক প্রকাশনা সংস্থাও গড়ে উঠেছে। অনেক ‘ফেসবুক গ্রুপ’ ও ওয়েব পত্রিকার মুদ্রিত সংখ্যাও প্রকাশিত হচ্ছে যার লেখকরা উঠে আসছেন ফেসবুক থেকেই। ফেসবুক হয়ে উঠেছে অনেক ছোট মুদ্রিত পত্রিকার সাপ্লাই লাইন। এতদসত্তেও থেকে তিনি অন্তত মনে করেন না অন্তর্জাল সাহিত্য-চর্চার বিপুল উন্মাদনা লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতাকে বিপন্ন করতে পারে। একুশ শতকের শুরুতেই দশ/বারো বছরের মধ্যে ‘ব্লগ-বিপ্লব’ ঘটে গেছে এটা সত্য। তাঁর ইচ্ছা ওয়েব মাধ্যম মুদ্রিত মাধ্যমের পরিপুরক হয়ে উঠুক।
তাঁর কথায় - অন্তর্জালের সামাজিক পরিসরে প্রচুর লেখা হচ্ছে এবং তারমধ্যে প্রচুর আজেবাজে লেখা হচ্ছে সত্য। এক্ষেত্রে সম্ভবত ফেসবুক নামক সামাজিক পরিসরে কবিতার প্রাচুর্যের কথাই তিনি বলতে চেয়েছেন। তিনি মনে করেন অন্তর্জালের সামাজিক পরিসরগুলি লেখককুলের শ্রেণী বৈষম্য মিটিয়ে দিয়েছে। এখানে ‘আকবর বাদশার সঙ্গে হরিপদ কেরাণীর কোন ভেদ নেই’। সেটাই যে একমাত্র চিন্তার বিষয় এমন তিনি মনে করেন না। তাঁর চিন্তার বিষয় বাংলা সাহিত্যের সামগ্রিক অধোগামিতা। তার সমাজ ও সময় বিচ্ছিন্নতা এবং সর্বোপরি তার ভাষার সঙ্গে অনাত্মীয়তাই চিন্তার বিষয়। সাহিত্য তো সবটাই ভাষানির্ভর। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সেই বাংলা ভাষাটার ব্যবহারিক প্রয়োগ এখন কতটা চিন্তাজনক সে সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। বিশ্বায়ন ও পণ্যায়ন আমাদের দিয়েছে অনেক, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও সযত্নে লালিত সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের শিকড়টাকেই আলগা করে দিয়েছে। তাই যদি কেউ মনে করেন অন্তর্জাল সাহিত্যপ্রাচুর্যের মধ্যে শিকড়হীন সাহিত্যেরও যথেষ্ট চাষ-আবাদ হচ্ছে সেটাই বা মিথ্যা বলি কি করে ? সে সাহিত্যে এলোমেলো বিষয়ভাবনায় থাকছে না ভাষার সৌকর্য, ব্যকরণের অনুশাসন ও ভাবনার সমৃদ্ধি। একেই বোধয় বলা যায় ‘সাহিত্যক্ষেত্রের নিরক্ষরতা’। ভাষা ও সাহিত্যকে বিন্দুমাত্র জানার চেষ্টা না করা, পূর্বসুরিদের লেখা না পড়া এবং সমকালীন সমাজ ও সময়কে না জানাকেই তাঁর মতামতে ‘সাহিত্যে ক্ষেত্রে নিরক্ষরতা’।
তবে সবটাই ‘না-সাহিত্য’ বা কিছুই হচ্ছে না বলে হতাশা প্রকাশে তিনি রাজি নন। অভিজ্ঞতা বলছে ওয়েব পত্রিকাগুলি থেকে যে বিপুল সংখ্যক কবি, গল্পকার উঠে আসছেন তার গুরুত্ব তো অসীম।
সমাজ যেমন, তার সাহিত্যও তেমন। আমাদের মূল স্রোতের সাহিত্য এখন আর জীবন ও জগৎ সম্পর্কে প্রগাঢ় সমবেদনার শব্দ শোনায় না, মানুষের বেদনার কেন্দ্রে হাত রাখে না, নতুনতর জীবনবোধের স্বপ্ন দেখায় না। শোনায় শুধুই সুখী সুখী মানুষের নিজের জন্য, আজকের জন্য বাঁচার কথা। শুধু সাহিত্যই বা কেন ? আমাদের চলচ্চিত্র, সংগীত, নাটক সবগুলি ক্ষেত্রেই তো পণ্যায়নজাত ভোগবাদী ভাবনার অনিবার্য জয়ধ্বনি। ‘রক্তকরবী’ নাটকে অধ্যাপক ও নন্দিনীর কথোপকথনের অংশ মনে পড়ে। অধ্যাপক নন্দিনীকে বলছেন “ আমরা যে মরা ধনের শবসাধনা করি। তার প্রেতকে বশ করতে চাই। সোনার তালের তাল-বেতালকে বাঁধতে পারলে পৃথিবীকে পাব মুঠোর মধ্যে”। এখন পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় পেয়েছি। এখন প্রেম, ভালোবাসা, সমবেদনা আর বিশ্বাস – সবই বিকোচ্ছে, আর ‘বাজার’ বন্দী আমাদের সৃজনভূমির সর্ব-অঙ্গ। আমরা জানি না এই দম বন্ধ করা অবস্থাই আমাদের আগত অনন্তকালের ভবিতব্য কি না !
যদিও তেমন সংকেত নেই এখনও, তবুও তাঁর আশাবাদী হতে ইচ্ছে হয় যে বিশ্বাসের একটা ভিত্তিভূমির নির্মাণ হবে, যেখানে দাঁড়িয়ে সমাজ ও জীবনের প্রতি প্রগাঢ় সমবেদনার প্রতিভাষ দেখতে পারবেন আমাদের সৃজনভূমির সর্ব অঙ্গে।
সেই তরুণ বয়স থেকেই অনেকের মত তাঁকেও পত্রিকা করার নেশা তাড়িয়ে বেড়াতো। দুহাজার দুইএ চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত নানা সময়ে অন্তত ১৫/২০টি পত্র-পত্রিকার সংগঠন, সম্পাদনা, প্রকাশনা, সাংবাদিকতা, প্রতিবেদক - এইসব নানাভাবে যুক্ত থেকেছেন। মাসিক, সাপ্তাহিক, সাহিত্য পত্রিকা, সংবাদ সাময়িকি, নাট্যপত্র, ট্যাবলয়েড সব। চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পরে রেলের প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে পেনশন আর মাগগিভাতার হিসাব করে সময় কাটানো পরিহার করে ঢুকে গেলেন অন্তর্জালের আশ্চর্য জগতে, চেষ্টা করলেন তাকে জানতে। গুগল ঘাঁটাঘাঁটি করে ব্লগ বানানোর কায়দাটা শিখে নিলেন। আর সত্তরছোঁয়া বয়সে প্রকাশ করে ফেললেন দুটি জনপ্রিয় ওয়েব পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘অন্যনিষাদ’ ও পাক্ষিক ‘গল্পগুচ্ছ’।
তাঁর কথায় - অন্তর্জালের বিশাল ভুবনের অতি সামান্যই মাত্র স্পর্শ করতে পেরেছি, তাতেই পেয়েছি এক বিস্ময়কর তৃপ্তি, সৃজনের আনন্দ। সে আনন্দ প্রকাশের কোন ভাষা হয় না। অন্তর্জাল প্রযুক্তির জন্যই অসংখ্য মানুষের সঙ্গে ভাবনার বিনিময়। পড়ছি কত বিচিত্র সব লেখা। এ কি আগে কোনদিন ভাবতে পেরেছি । অন্তর্জালের অতলান্ত সৃজনভান্ডারে আমারও অতি ক্ষুদ্র অংশ রয়েছে, জীবনের উপান্তে পৌছে এ আমার বড় প্রাপ্তি, অসীম তৃপ্তির সঞ্চয়।
প্রায় শূন্য প্রযুক্তি জ্ঞান নিয়ে, বর্ষীয়ান এই মানুষটি শূন্য থেকে শুরু করে দুটো ওয়েব পত্রিকায় বিগত পাঁচ বছরে সাড়ে পাঁচহাজার এর অধিক কবিতা আর সহস্রাধিক গল্প অন্তর্জালে ছড়িয়ে দিতে পেড়েছেন। অনেক তরুণ লেখক যারা সবেমাত্র কবিতার জন্য কলম ধরেছেন, প্রতিষ্ঠিত কবিদের লেখার সঙ্গে তাদের তুলনামূলকভাবে অপটু লেখাও প্রকাশ করেছেন , আগামীর উজ্জ্বল মুখের সন্ধানে।
আধুনিক বঙ্গসংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও প্রসারের উদ্দীপনায় একলব্যের ন্যায় যিনি আজও নিরলস সাধনা করে চলেছেন, তিনি আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়। আজ তাঁর ৭৮তম জন্মদিন। একাধারে সমাজকর্মী, রাজনৈতিক আন্দোলনের বীর সেনা আবার আজীবনশিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সেবক!, নাট্যব্যক্তিত্ব থেকে প্রাবন্ধিক; কবি থেকে প্রকাশক; কত বিভিন্ন পরিসরে তাহার অবাধ চলাচল আমাদের বিমোহিত করে। বিগত শতকের সেই ষাটের দশক থেকে এই অন্তর্জাল শতকের আধুনিক দিগদর্শনের নতুন যুগেও তিনি চির যৌবনেরদূত! এয়ুগের যৌবন বাউলও তার স্বরসঙ্গতির সহযাত্রী হতে পারে অন্তর সৌকর্যে। আর সেখানেই তিনি সকল কালেই স্থাপন করেছেন আপন আসন। তিনি একজন সফল ব্লগার। খুব কম ব্যক্তিত্বই এই উৎকর্ষতায় উত্তীর্ণ হতে পারেন নিজনিজ জীবন সাধনায়!
আজ জন্মদিনে, তাঁর আজীবন জীবনসাধনাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই।
শব্দের মিছিল।
০৪/০৩/২০১৯
1 মন্তব্যসমূহ
শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়কে-- তাঁর শুভ জন্মদিনে।
উত্তরমুছুনসুচিন্তিত মতামত দিন