বিমলেন্দু রায়


লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও শিল্পীজীবনী
ভাওয়াইয়া গান বাংলা লোকসংগীত তথা বাংলা সংগীতের একটি বিশিষ্ট ধারা। এই গান বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর জেলা, পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি ও পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার ও আসামের গোয়ালপাড়া অঞ্চলের মাটি ও মানুষের হৃদয়ের গভীর থেকে স্পন্দিত প্রাণের সংগীত। ভাওয়াইয়া গানে আঞ্চলিক জন-জীবনচিত্র, প্রকৃতি, পরিবেশ ও ভাষার নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। এই লোকসংগীতই পৃথিবীর সকল দেশের সকল ভাষার সংগীতের আদি উৎস রূপ। সংগীত গবেষকদের মতে ভারতবর্ষে সংগীত চর্চার ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় প্রায় চার হাজার বছর পূর্বের বৈদিক যুগ থেকে। আর বাংলা সংগীতের চর্চার ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায় হাজার বছর পূর্বে বাংলা সাহিত্যের সূচনালগ্ন থেকে। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ এর প্রমাণ। তেইশ জন কবির রচিত একান্নটি কবিতা বা পদগুলো সংগীত হিসেবে গাওয়ার জন্যই রচিত হয়েছিল। এগুলি মূলতঃ ছিল বৌদ্ধদের তান্ত্রিক গান। বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিসীমার মধ্যে প্রচলিত লোকসংগীতগুলোকে বিচার করলে এগুলোর মধ্যে সুরের দিক থেকে প্রধানতঃ তিনটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। এগুলো হচ্ছে- (১) ভাওয়াইয়া (২) ভাটিয়ালী এবং (৩) বাউল। অঞ্চলভেদে এই তিনটি ধারা বিস্তৃতি লাভ করেছে আবহমান কাল থেকে। এর মধ্যে ভাওয়াইয়া অঞ্চলগতভাবে উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত।

আমার আলোচ্য সুশান্ত কুমার রায় এর “লোকসংগীত ভাওয়াইয়া ও শিল্পীজীবনী” গ্রন্থটি উত্তর জনপদের লোকসংস্কৃতির এক সত্য ভাষণ। এই গ্রন্থে লেখক আমাদের সত্তাকে শেকড়ের সন্ধানের মুখোমুখি করার চেষ্টা করেছেন। লেখকের বুদ্ধিদীপ্ত একশত সাইত্রিশ পৃষ্টার ঝকঝকে ছাপানো বইটির লেখা তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। (১) প্রথম অংশে ভাওয়াইয়া সম্পর্কে নির্বাচিত প্রবন্ধ ও নিবন্ধ (২) দ্বিতীয় অংশে ভাওয়াইয়া গানের মানুষ- ঊনিশজন স্বনামধন্য ভাওয়াইয়া শিল্পীদের জীবনকথা (৩) তৃতীয় অংশে শিল্পীদের ছবি সম্বলিত এ্যালবাম সন্নিবেশিত করে লেখক স্মৃতির পাতায় এক জীবন্ত রূপ দান করেছেন। বইটির গ্রন্থস্বত্বে রয়েছেন লেখকের সহধর্মিনী শিউলি রাণী রায়। বইটি প্রকাশ করেছেন শব্দ প্রকাশনার স্বত্বাধিকারী ও দেশবরেণ্য কবি সরোজ দেব। প্রচ্ছদ এঁকেছেন চিত্রশিল্পী কিংশুক ভট্টাচার্য। মূল্য দুইশত পঞ্চাশ টাকা। ভাওয়াইয়া গানের প্রধান অনুষঙ্গ গরুরগাড়ি, বাঁশি ও দোতরা। আর সেই গরুরগাড়ি, বাঁশি ও দোতরা প্রচ্ছদে সন্নিবেশিত করায় বইটিতে প্রথমেই তৈরি হয়েছে শেকড়ের আবহ । তাঁর প্রজ্ঞাবান লেখার মাধ্যমে উত্তর জনপদের এইসব শিল্পীর জীবনকথা, তাঁদের গান, তাঁদের স্মৃতি অবয়ব চিত্রের সাথে পরিচিত হতে পেরে আমরা ধন্য। সব লেখক আমাদের শেকড়কে নিয়ে লেখেন না। শেকড় নিয়ে লেখার জন্য লেখকের আলাদা সত্তার প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন হয় মাটি মানুষকে জানার, চেনার মতো মনের। এক্ষেত্রে সুশান্ত কুমার রায় নিঃসন্দেহে একজন সংস্কৃতিবান উচু মনের মানুষ।

প্রথমেই ধরা যাক উত্তরবঙ্গের খ্যাতিমান লোকসংগীত শিল্পী এবং ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে। এই ভাওয়াইয়া গানকে তিনি শুধু উত্তরবঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের বাইরে তথা বিদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিয়েছেন অবলীলায়। তাই তাঁকে ভাওয়াইয়া গানের অনন্য পুরোধা পুরুষ বলা হয়। ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই হাকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে’...,॥ ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে’...,॥ ‘কি ও বন্ধু কাজল ভোমরারে’...,॥ ‘আগা নাওয়ে ডুবু ডুবু পাছা নাওয়ে বইসো’...,॥ ‘কিসের মোর রাধন কিসের মোর বাড়ন’...,॥ ‘তোরষা নদী উতাল পাতাল কারবা চলে নাও’...,॥ ‘নদীর কূল নাই কিনারা নাইরে’..., ॥‘ও কি একবার আসিয়া সোনার চান্দ মোর যাও দেখিয়ারে’... ॥

এসব কালজয়ী গানের মধ্যে বেঁচে আছেন আব্বাস উদ্দিন এবং আমাদেরকে মাটি ও মানুষের কাছে নিয়ে গিয়ে পূর্ব পুরুষদের সাথে পরম্পরার যোগসূত্র গড়ে তুলেছেন। লোকসংগীতের আরেক কিংবদন্তীর নাম মহেশ চন্দ্র রায়। নীলফামারীর এই প্রয়াত শিল্পীর অনেক ভাওয়াইয়া গান আমাদেরকে অতীতে ফিরে নিয়ে যায়। আমাদের ফিরে নিয়ে যায় মা-মাটির আর্দ্র মায়ার গভীরে। তিনি গেয়েছেন- ‘আবো তুই মরিয়া গেইলে / এ নাইওর মোক কাঁয় নিগাইবে / নারু চিড়া মুড়কির ভোকনা / কাঁয় পঠে দিবে’...॥ ‘ধীরে বোলাও গাড়ীরে গাড়িয়াল / আস্তে বোলাও গরু’...॥ ‘কানিচাত গাড়িনু আকাশি আকালী / আকালী ঝুমঝুম করে / আরো ফেলানু চহুরী বতুয়া / বতুয়া হলফল করে রে বন্দুয়া’...॥ ‘ও তুই জাগেক নানী / মোক থুইয়্যা আয় অ্যালায় / আজ ক্যানে মোক থাকিব্যার না মনায় / আইত দুপুরে পানু স্বপন / স্বপন মিছা নয়’...॥ ‘ঢেঁকিয়্যার আগাল নড়েছে / খোশোর মোশোর করেছে / ঢুলকি দেখোং উইয়্যারে ভিতর / নুকিয়া আছে ভাবের বন্ধুয়া’... ॥ মহেশ চন্দ্র রায় একাধারে একজন গীতিকার, সুরকার, সংগঠক, সংগ্রাহক, কবি এবং অভিনেতাও ছিলেন। আরেক খ্যাতিমান লোকসংগীত শিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী। ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের সুযোগ্যপুত্র মুস্তাফা জামান আব্বাসী একজন দেশবরেণ্য সংগীতশিল্পী। বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সংগীত ও সংস্কৃতিভূবনে যাঁর বিচরণ অবারিতভাবে। তিনি একজন মেধাবী লোকসংগীত শিল্পী ও গবেষক। ‘কি ও বন্ধু কাজল ভোমরারে’...,॥ ‘আগা নাওয়ে ডুবু ডুবু পাছা নাওয়ে বইসো’...,॥‘কিসের মোর রাধন কিসের মোর বাড়ন’...,॥ ‘তোরষা নদী উতাল পাতাল কারবা চলে নাও’...,॥ ‘নদীর কূল নাই কিনারা নাইরে’...,॥ ‘ও কি একবার আসিয়া সোনার চান্দ মোর যাও দেখিয়ারে’...॥ ইত্যাদি গানে তিনি তিনি মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করেছেন। তাঁর বোন ফেরদৌসী রহমানও একজন দেশবরেণ্য সংগীত শিল্পী। তিনি নজরুলগীতি, আধুনিক, পল্লীগীতি, খেয়াল, গজলে তাঁর জাদুকরী কন্ঠ দর্শকদেরকে মুগ্ধ করে বার বার। অর্থাৎ আব্বাস উদ্দিনের পুরো পরিবারটি ছিল সংগীত তথা সংস্কৃতি চর্চার আবাসস্থল। কুড়িগ্রামের অসাধারণ প্রতিভাবান ভাওয়াইয়া শিল্পী প্রয়াত কছিম উদ্দিন লোকসংগীত ভাওয়াইয়াকে সাধারণের মাঝে সমানতালে পরিবেশন করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। ‘জয় বাংলা জয় বাংলা বইলারে / কারার ঐ লৌহ কপাট’...॥ ‘আমার সোনার বাংলা / আমি তোমায় ভালবাসি’...॥‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানোএকুশে ফেব্রয়ারি’...॥‘শত স্বপ্নের আঁকা / জন্ম ভুমি তোমায় নিয়ে কত যে ছবি আঁকি’...॥ ‘ও হো ও হো হো / এই যে ছোট বাপোই বড় বাপোই / মাঝলে বাপোই ওহো হো হো হো / এইযে নয়া ডারা দিয়ে মাছ উজাইছে বাপোই / হ্যাংগা পাথেয়া থো’...॥ ‘ক্যানে বউ ঝগড়া করিস / যাইসে ক্যানে আন্দোন ঘরে’...॥ ‘জামাই আইসাছে শ্বশুর বাড়িতে / নানা রকম পায়েস পোলাও / নানান জাতের পিঠা কইরাছে / জামাই আইসাছে শ্বশুর বাড়িতে’...॥ ‘গড়তে মোদের সোনার বাংলা / জীবন করবো দান’...॥ 

‘বয়স কালের কামাইরে দিয়া / তোক সুন্দরী করচং বিয়াও রে / ওকি সুন্দরী বাইর হও সুন্দরী’...॥ তাঁর গান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একাত্তর সালে পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস ও মনোবল যুগিয়েছিলেন তিনি। আলোচ্য গ্রন্থে লেখক অনেক প্রথিতযশা শিল্পী, গীতিকার এবং তাঁদের জীবনচরিত সন্নিবেশিত করে আমাদেরকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁদের মধ্যে উত্তরজনপদের মো. সিরাজ উদ্দিন, কুড়িগ্রামের নুরুল ইসলাম জাহিদ, রবীন্দ্রনাথ মিশ্র, দোতরার যাদুকর দোতরা বাদক নমর উদ্দিন, বেগম সুরাইয়া বেলী, সুভাষ চন্দ্র রায়, অনন্ত কুমার দেব, ভূপতি ভূষণ বর্মা, নির্মল কুমার দে, বিশ্বনাথ মহন্ত, রণজিৎ কুমার রায়, কে. এম. শাহানুর রহমান, ভবতরণ, বিষাদ চন্দ্র বর্মণ উল্লেখযোগ্য।

অতি আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা আমাদের এসব সোনালী অতীতকে ভুলতে বসেছি। অতীতের সে সময়ের কথাবার্তা, প্রেমকাহিনী, লৌকিকতা, ভালোবাসা, পরিবারতন্ত্রের সত্যভাষণগুলি আমরা ভাওয়াইয়া গানের মধ্যে পাই। তখন আমরা ফিরে যাই সুদূর অতীতে আমাদের অগ্রজদের কাছে। তাঁদেরকে জানার, বোঝার, শোনার আকুতি আমাদের বেড়ে যায়। এইসব গানের মধ্যে আমাদের সেই সময়কার সমাজ- সংস্কৃতির কথায় আমরা পরিচিত হই। যেমন- আবো, বতুয়া, নিগইিবে, নুকিয়া আছে ভাবের বন্ধুয়া, কানিচাত গাড়িনু আকাশি আকালী, ঝরি পড়ে টাপুর টুপুর, দ্যাওয়ায় করিলে ম্যাঘ ম্যাঘালী, কাঁইয়ো নিলোং কুলা ডালি,কাঁইয়ো নিলোং ছালা, আবো তুই মরিয়া গেইলে-এ নাইওর মোর কাঁই নিগাইবে, সকালে গেছিনুং নদীর ঘাটে, যামো হামরা সোনা বন্ধুর বাড়ি- এই কথাগুলোতে আমাদের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হওয়ার আমরা সুযোগ পাই। কাজেই এগুলি আমাদের শেকড়ের অংশ। আমাদের শেকড়ের বন্ধন। এগুলি ভুলে গেলে বা অবহেলা করলে আমাদের শেকড়কে অবহেলা করা হয়। আমাদের জীবনের ভিত্তিকে অস্বীকার করা হয়। আমাদের দেশের উত্তর জনপদের সহজ, সরল, মানুষের মনের খোরাক সংস্কৃতি চর্চা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে কাজ করার পর তাঁরা রাতে সংস্কৃতি চর্চায় মনোযোগী হয়। গান বাজনা, পুঁথি পড়া, যাত্রা গান শোনা, জারি, সারি ও ভাওয়াইয়া গান শোনা, ঝুমুর যাত্রা দেখা ইত্যাদি ছিল তাঁদের নিত্য দিনের অনুষঙ্গ। কিন্তু দিনের পরিবর্তনে এসব সংস্কৃতির অস্তিত্ব এখন বিপন্নের পথে। নতুন প্রজন্মের কাছে এখন এগুলি জাদুঘরে স্থির চিত্রের চিহ্ন- রঙ তুলির আঁচড়। অথচ এগুলিই আমাদের শেকড়। আমাদের বেড়ে ওঠা জীবনের উত্তরাধিকার কাহিনী। সংস্কৃতিবান লেখক তাঁর অনুসন্ধানী মন নিয়ে সমাজের বিভিন্ন স্তরের সংস্কৃতি নিয়ে লেখা পাঠক সমাজে আরো বেশি বেশি করে উপহার দিবেন এ প্রত্যাশাই করি। সেই সাথে বইটি পাঠক প্রিয়তা লাভ করুক সেই শুভকামনাই রইলো।

কবি ও প্রাবন্ধিক
Email-bimalenduroy51@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* মন্তব্য করতে পেজটি রিফ্রেশ করুন .