শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

বইমেলার ভাড়াবাড়ি
মানুষ তো আদিতে যাযাবরই ছিল। বাস্তু পাওয়ার পর উদ্বাস্তুও হয়ে যায় কত প্রকৃতিক ও মানবিক বিপর্যয়ে। আর উদ্বাস্তু কী আর তার কী জ্বালা, তা এই রাজ্যের ভূমিসন্তান ও শরণার্থী দু পক্ষই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে। ইতিহাসে দেখা গেছে উদ্বাস্তু আর তার পুনর্বাসন যে শুধু দুর্যোগের জন্য হয় তা নয়, অনেক সময় পরিকল্পিতভাবে স্থানান্তরণ করা হয় ভালোতর ভাবে বেঁচে থাকার উপায় বা কৌশল হিসেবে। এই জন্যই কোনও রাজ্যের বা সাম্রাজ্যের বারবার রাজধানী বদলে যায়, দপ্তর স্থানান্তরিত হয় ইত্যাদি। আমাদের কলকাতা থেকেই বাঙালিদের রাজনীতি সচেতনতা ও জাতীয় চেতনার ভয়ে ইংরেজরা ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লীতে উঠিয়ে নিয়ে যায় ১৯১১-র ডিসেম্বরে। ঠিক শতবর্ষ পূর্তিতে ২০১১-র অক্টোবরে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনিক ভরকেন্দ্রটিও মধ্য কলকাতা থেকে হাওড়ায় স্থানান্তরিত হয়।

তা এইসব হল রাজকীয় হাওয়া বদল। কিন্তু কিছু ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান আবার ভাড়ার টাকা চোকাতে না পেরে বা বাড়িওয়ালার শয়তানিতে হুড়ো খেয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি, এই মাঠ সেই মাঠ করে বেড়ায়। আমি ছোটবেলায় মাত্র এক বছর একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ি। তার নাম সেন্ট জুডাস। তা সেই স্কুলটি মাঝে মাঝেই বন্ধ হয়ে যেত। খোলে কি খোলে না কিছুদিন সেই অনিশ্চয়তার পর নতুন কোনও বাড়িতে আবার ব্যাগ পিঠে যাওয়া আসা শুরু হোত। যাই হোক নাগালের মধ্যে কোনও বড় ইংরেজি স্কুল না পেয়ে অতঃপর আমাকে তেপান্তরের মাঠওয়ালা কিন্তু বারান্দার মেঝেতে ক্লাস নেওয়া অম্বিকা চরণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছিল যার ডাকনাম ছিল মহাদেব স্যারের স্কুল, কারণ স্কুলটায় যতই গরিব-গুর্বোরা পড়ুক অন্তত উঠে যাওয়ার ভয় নেই।

এতসব ভণিতা করার কারণ আমার দেখা বেশ কিছু বইমেলা দু-তিন বছর অন্তর নিজেদের শিবির বদল করে। না, এটা তাদের শখের হাওয়া বদল নয়, আমার সেই হতশ্রী নার্সারি স্কুলটির মতো হুড়ো খেয়ে উদ্বাস্তু হয় আর কি। জেলামেলা ও ছোটখাটো স্থানীয় বইমেলার কথা তো বাদই দিলাম আমাদের কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার বাৎসরিক ঠিকানাটাও তো পাকাপোক্ত হল না। ময়দান ছেড়ে মিলনমেলা প্রাঙ্গন করা নিয়ে প্রতিবাদ ধোপে টেঁকেনি। সেনার অধীনে থাকা ময়দান বলে কথা, বছরে শতাধিক রাজনৈতিক সমাবেশের খুচখাচ মঞ্চ নির্মাণের অনুমতি মিললেও, একবার টানা দু-তিন সপ্তাহ ধরে বইমেলা নৈব নৈব চ। তা মিলনমেলা শব্দটা মেলার সঙ্গে যায় ভালো। কিন্তু শব্দটা মিললেও জায়গাটা গতবারেও মেলেনি, এবারেও আর মিলল না। সেখানে অবশ্য তার পাকা ঘর তৈরির প্রস্তুতি চলছে। তাই এই বছর অথবা বছর কয়েকের জন্য তাকে ঘরছাড়া হয়ে অন্যত্র সংসার পাততে হবে। বিস্তর জল্পনা কল্পনার পর আপাতত লবণহ্রদের নগরকেন্দ্রে জায়গা মনোনীত করেছে বা পেয়েছে গিল্ড। 

বাধ্যতামূলক পাঠ্যপুস্তক ছাড়া বই পাঠ করার পাট তো উঠে যাচ্ছে ক্রমশ। তাই মাইকে গগন বিদারণ করতে হয় “বই ডাকছে বই..”। এবার বইমেলার বাঁধা বাসা নিয়েও যদি টানটানি চলে তাহলে বেচারা বলে কি ভুল করলাম? জানি মেলার নিজস্ব বাড়িঘর থাকে না, কিন্তু নির্দিষ্ট মাঠ বা চত্তর তো থাকে। ভাবা যায় গঙ্গাসাগর মেলা, কুম্ভমেলা, কি পীরমেলার স্থানান্তরণ হচ্ছে? যায় না, কারণ সেগুলো আমাদের ধর্মবিশ্বাস ও লোকসংস্কৃতির অঙ্গ। কিন্তু বাণিজ্যমেলাগুলোর হতেই পারে। তাহলে কি ব্যাপারটা এটাই দাঁড়াচ্ছে বাণিজ্যমেলা, শিল্পমেলা এগুলোর মতোই বইমেলাও আমাদের অথনীতি ও শখ শৌখিনতার অঙ্গ রয়ে গেছে, সংস্কৃতির হতে পারেনি?


sriparna405@gmail.com

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ