ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

মৃণাল সেন – সেলুলয়েডে প্রতিবাদী যৌবনের রূপকার
০১৮র শেষ মাসটা যেন নক্ষত্র পতনের মাস,আমাদের মনন-জগৎকে, বাঙলার সারস্বতভূমিকে রিক্ত করার মাস । এমাদের আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত জগতে তিন মহীরুহ চলে গেলেন – দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী আর মৃণাল সেন । তাঁদের স্থান পূরণ হবে না এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট । তবুও এটাই সত্য শিল্প-স্রষ্টার মৃত্যু হয় না, তারা বেঁচে থাকেন তাদের সৃষ্টি মধ্যে । সেলুলয়েডে প্রতিবাদী যৌবনের রূপকার মৃণাল সেনও বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্যে । যতদিন আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্র সম্পর্কে আলোচনা করবো ততদিন মৃণাল সেনকে মনে রাখতেই হবে 

চলচ্চিত্র নির্মাণে ঋত্বিক, সত্যজিতের সমকালেই এসেছিলেন মৃণাল সেন । ঋত্বিকের মতই মৃণাল সেনের শিল্পীমানসের নির্মাণ হয়েছিল কমিউনিষ্ট পার্টি নিয়ন্ত্রিত ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রভাবে ও শিক্ষায় । মৃণাল সেন তাঁর আত্মজীবনী তে বলেওছেন, যে গণনাট্যই তাকে ছবি করতে বার বার অনুপ্রাণিত করেছে ৷ বলেছেন গণনাট্যের জন্যই দেশের মাটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন ৷ মৃণাল গণনাট্যের জন্যই দেশের মাটিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন ৷ গ্রাম-গঞ্জের ভিতরে ঢুকে আসল জীবনকে দেখেছেন, দেখেছেন মানুষের লড়াইকে ৷ আর এই অভিজ্ঞতাই তাঁর ছবি তৈরির অন্যতম উপাদান ৷ 

স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল আবহে কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর । জন্ম ১৯২৩ সনের ১৪ই মে, ফরিদপুরে । পিতা ছিলেন খ্যাতিমান উকিল । বিপ্লবী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য আদালতে আইনী লড়াই চালাতেন । সেইসূত্রে ফরিদপুরে তাঁদের বাড়িতে বিপিন পাল, পূর্ণদাস প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যাতায়াত লেগে থাকতো, সুভাসচন্দ্র বসুও আসতেন । স্কুল শিক্ষা শেষ করে আইএসসি পড়লেন ফরিদপুরে । তারপর বিএসসি পড়ার জন্য চলে এলেন পাকাপাকিভাবে কলকাতায় । স্কটিশ চার্চ কলেজে পদার্থ বিদ্যায় অনার্স নিয়ে পড়াশোনা, মেসে থাকা । মৃণাল সেনের আত্মকথন থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দেবো, যা থেকে তাঁর মানস গঠনের স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাবে । লিখছেন “মেসে ডাল ভাত, কলেজে ছাত্র ইউনিয়ন । ইউনিয়ন নিয়ে মেতে উঠলাম এস এফ আই । পোলিটিকাল লীডাররা আসতেন । বক্তৃতা দিতেন, ক্লাস করাতেন ...। পদার্থ বিদ্যার পাশে কবিতা, কবিতার পাশে রাজনীতি, বোঝা যাচ্ছিল ‘প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ । কমিউনিষ্ট পার্টি ছাড়া কিছু জানি না, আমার মাথার ওপর উত্তর কোলকাতার আকাশও লাল হয়ে উঠছে, ছোট ছোট গোপন মিটিং মানুষের মুক্তি দেখছে, তবু জানি, কালের গলিত গর্ভ থেকে বিপ্লবের ধাত্রী / যুগে যুগে নতুন জন্ম আনে / তবু জানি, জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে চূর্ণ হবে ভষ্ম হবে / আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে / ততদিন / ততদিন নারী ধর্ষণের ইতিহাস / পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া / অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মত / ততদিন গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে / বণিকের মানদন্ডের পিঙ্গল প্রহার ।

১৯৪১এ একবার মেশ থেকে গ্রেপ্তার হলাম । তখন কমিউনিষ্ট পার্টি বে-আইনি । বোধহয় ৭দিন ছিলাম লালবাজারে” ।

(‘ছবি করার আগের দিনগুলি’ – মৃণাল সেন / প্রলয় সূর সম্পাদিত মৃনাল সেন গ্রন্থ)

দু একটা টিউশানি, পত্রপত্রিকায় লেখালেখির সূত্রে সামান্য কিছূ আয় মাঝে মধ্যে আর ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে বইএর মধ্যে ডুবে থাকা । ১৯৪৬এ অনুবাদ করলেন বিখ্যাত চেক নাট্যকার ও সমাজবিজ্ঞানী ক্যারল চাপেকের ‘দ্য চিট’ । ঐ বছরেই সিনেমা বিষয়ক প্রথম লেখা ‘সিনেমা এন্ড দি পিপল’ । ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে জড়িয়ে থেকে বিদেশের ধ্রুপদি ছবি দেখা, সমমনাদের সঙ্গে আলোচনা আর কালিঘাট দমকলের কাছে প্যারাডাইস কাফের চায়ের টেবিলে আড্ডা । সেই আড্ডায় থাকতেন ঋত্বিক ঘটক, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, হৃষিকেশ মুখার্জী, রাজেন তরফদার, তাপস সেন, সলিল চৌধুরীরা । মৃণালের স্মৃতিচারণে”আমাদের দিনরাত্তির এই আড্ডায় কি ছিল না, লেনিন, স্টালিন, গণসঙ্গীত, চ্যাপলিন, আইজেনস্টাইন, রাজশেখর বসু, কমিউনিস্ট পার্টি, পাবলো নেরুদা, পুদফকিন, ফিল্ম সোসাইটি, লাল পতাকা, সমর সেন, ধর্মঘট, ডি-সিকা, রোজেলিনি, পিকাসো, নিও রিয়ালিজম, নবজীবনের গান, ফেড ইন আর ফেড আউট” (‘ছবি করার আগের দিনগুলি’ – মৃণাল সেন / প্রলয় সূর সম্পাদিত মৃনাল সেন গ্রন্থ) । ১৯৫০এ মেডিকেল রিপ্রেসেন্টেটিভের চাকরি নিয়ে চলে গেলেন কানপুর । ছমাস কানপুর আর ছমাস কলকাতায় ওষুধ বিক্রির কাজ করে আবার বেকার । দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই আর ভেতরে ভেতরে সিনেমা নির্মাণ করার জন্য ছটপটানি ।

ইতিমধ্যে বন্ধু বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে চলচ্চিত্র স্টুডিওতে যাতায়াত করছেন, কলকাতায় ফরাসি চিত্রপরিচালক জাঁ রেনোয়ার ‘দ্য রিভার’ সুটিংএর খুঁটিনাটি টিনাটি, অন্য পরিচালকের জন্য চিত্রনাট্য লিখেছেন, দুটি ছবিতে সহকারি পরিচালকের কাজ করে চলচ্চিত্র নির্মাণের অভিজ্ঞতাও সঞ্চয় করলেন । এই সময় সে কালের যশশ্বী অভিনেত্রী তাঁর প্রযোজিত ছবির পরিচালনার জন্য আহ্বান জানালেন মৃণালকে । নির্মিত হল তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘রাতভোর’ ১৯৫৫তে । মৃণাল সেন নিজে তাঁর এই প্রথম সিনেমাটিকে নিজের চলচ্চিত্র কেরিয়ারে ধর্তব্যের মধ্যে রাখেন না। বলেছিলেন “ সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি, পৃথিবী কাঁপানো ছবি, আর আমার ছবি আমাকেই কাঁপিয়ে দিয়েছে” । দ্বিতীয় ছবির প্রযোজক পেলেন সনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে । মহাদেবী বর্মার কাহিনী নিয়ে নির্মাণ করলেন ‘নীল আকাশের নীচে’, ১৯৫৯এ । এটিকেও মৃণাল সেন হিসাবের মধ্যে রাখেন না । তাঁর চলচ্চিত্র কীর্তি সম্পর্কিত কোন লেখায় তিনি ‘নীল আকাশের নীচে’র উল্লেখ করেন না’ । সেই সময়ের চিন-ভারত মৈত্রী সম্পর্কে আগ্রহ, সংবেদনশীল কাহিনী এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের নেপথ্য সঙ্গীতের কারণে ছবিটি খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল এবং অর্থকরি সাফল্য পেয়েছিল । ছবিটি নির্মাণে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং এটি কখনোই পরিচালকের ছবি হয়ে ওঠেনি বলেই মনে করেছিলেন মৃণাল । তথাপি অস্বীকার করা যাবে না যে ‘নীল আকাশের নীচে’র অর্থকরি সাফল্যই তাঁকে চলচ্চিত্র নির্মাণ জগতে টিকে থাকার ছাড়পত্র দিয়েছিল এবং তাঁর পরের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র ‘বাইশে শ্রাবণ’ নির্মাণ সহজ করে দিয়েছিল । বাইশে শ্রাবণ তাঁর তৃতীয় ছবি ।

তাঁর দীর্ঘ চলচ্চিত্র জীবনে মৃণাল সেনের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি ২৭টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনীচিত্র, ১৪টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের এবং ৪টি তথ্যচিত্র । বাংলা ও হিন্দি ছাড়া তেলেগু ও ওড়িয়া ভাষায় একটি করে ছবি করেছেন । মৃণাল সেনের ছবিতে বরাবর গুরুত্ব পেয়েছে সমাজ বাস্তবতা । তাঁর ছবিতে সত্তর দশকের ঝোড়ো সময়ের কথা এসেছে, নকশাল আন্দোলন যেমন এসেছে, এসেছে শ্রেণীদ্বন্দ্ব, এসেছে দরিদ্র আদিবাসীদের কথাও। তাঁর কলকাতা নিয়ে মৃণালের তিনটি ছবি ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ ও পদাতিক’এ সত্তর দশকের ঝোড় সময়ের অস্থির যৌবনকে ধরেছেন । মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে মৃণাল সেন তুলে ধরেন এক দিন প্রতিদিন ও খারিজ ছবিদুটিতে । 

সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন – ভারতীয় চলচ্চিত্রের তিনটি পৃথক ঘরানা । সত্যজিৎ রায় বাস্তবের চলচ্চিত্রভাষ্য নির্মাণ করেন সাহিত্যকে আশ্রয় করে, ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় দেশ বিভাগের যন্ত্রণা, ক্রোধ আর মৃণাল সেনের সিনেমায় কঠোর বাস্তবের সঙ্গে যৌবনের স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নকে নিংড়ে নেওয়া চিত্রভাষ্য, আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানুষের সংকটময় রূপের বিশ্লেষণ । জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের সঙ্গে সিনেমার আর্টের সমস্ত দিকগুলির সংমিশ্রণ মৃণাল সেনের সিনেমায়, ছবির গল্পের তলে আর এক স্তরের গল্প বলেছেন যেন তাঁর সিনেমায়। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যাগুলি বুঝতে চেয়েছেন নিজের মত করে আর ধরে রেখেছেন তাঁর সিনেমায় 

ঋত্বিক ঘটক চলে গেছেন ১৯৭৬এ, সত্যজিৎ রায় ১৯৯২ আর ৯৫ বছরে পা দিয়ে মৃণাল সেন এখনও ছিলেন আমাদের মধ্যে । শেষ ছবি করেছেন ‘আমার ভুবন’ ২০০২এ । জীবন ও শিল্পের অবিরাম প্রবাহ বয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে । সেইঅবিরাম শিল্পপ্রবাহকে অনন্তকাল সমৃদ্ধ করবে মৃণাল সেনের সৃষ্টি । তাঁর শুভ্র পরিধানের মতই নির্মল ছিল তাঁর মনন । কোনদিন আপোষ করলেন না ঋজু মেরুদন্ডের মানুষটি – মৃত্যুর আগেও নয় পরেও নয় । শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন যে তাঁর শবদেহ শেষ যাত্রায় যায় সাধারণ আর পাঁচজনের মত । সরকারি বা বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির পুষ্পার্ঘ্য নয়, শায়িত থাকবে না নন্দন বা রবীন্দ্র সদনে । আমরা দূর থেকেই প্রণাম জানাই বাংলা চলচ্চিত্রের শেষ মহীরুহ মৃণাল সেনকে ।



phalgunimu@gmail.com


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ