ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ নেপুদার ধাক্কায় জেগে উঠে দেখি ডিব্রুগড়ে পৌঁছে গেছি। ট্রেন এসে থেমেছে ২নং প্ল্যাটফর্মে। রাইট টাইম। ভোর ৩-৩০ বাজে। ঘুম জড়ানো চোখে লাগেজ নিয়ে ফ্লাইওভার ক্রস করে চলে এলাম ওয়েটিং রুমে। এই সাত সকালে কোথায় যাবো? ভোরের আলো অন্তত ফুটুক। কিসের ভোর, কিসের আলো? রাত ৪টা থেকেই সঞ্জীব নাথ ( নাম টা পরে জেনেছি) আমাদের পিছনে পড়ে আছে।
-- দাদা গাড়ি লাগব? অটো চাই? ঘুরিবা যাম?
-- আমি বিরক্ত হয়ে উত্তর দেই, না, কোত্থাও যাব না এখন।
ইতিমধ্যে নেপুদা আর বাপীদা ফ্রেশ হতে চলে গেছে টয়লেটে। সুদীপ'দা আর প্রবীর প্ল্যাটফর্মের চায়ের দোকানে চা খেয়ে বাইরে বেরিয়েছে, সিগারেট টানতে। বেচারা....। অনেকক্ষন সিগারেট টানে নি দুজনে। সিগারেটে আমার আস্থা কম। পকেটে গুয়া-পান আছে। আমি বিন্দাস।
অবশেষে প্রশান্তের সাথে কথা বলে ২০০টাকায় সঞ্জীব নাথের অটোটা ঠিক করে ফেলি।
ভোরের আলো ফুটছে তখন। বেশ শীত শীত করছে। ছোট্ট একটা অটোতে অতগুলো লাগেজ নিয়ে আমরা ৬জন। পা রাখার-ও জায়গা পাচ্ছি না। ভাঙ্গাচোরা রাস্তায় অটোটার সাথে আমারা দুলেই চলেছি....। যাচ্ছি অরুণাচল হাউস। মোহনবাড়ি থেকে ইনার লাইন পারমিশন নিতে হবে আজ। তারপর বগিবিল ঘাট পেড়িয়ে শিলাপাথর। ট্রেন থেকে নামার পরেই সব গুলিয়ে গেছে। কিভাবে দিনটা শুরু করবো, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ডিব্রুগড় ছড়ানো শহর। একদিকে স্ট্যান্ড তো অন্যদিকে মোহন বাড়ি। আবার ভগিবিল ঘাট মূল শহর থেকে ১৮ কিমি দূরে।
মোহনবাড়ি যাবার আগে রিজার্ভ গাড়ির খোঁজে বেশকিছুক্ষন বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল সঞ্জীব। প্রায় ১ঘন্টা ধরে একে ওকে তাকে জিজ্ঞেসা করেও যখন গাড়ি রিজার্ভ করতে পারলাম না, তখন বেশ সন্দেহ লাগছিল। অগত্যা দেরী না করে চা - রুটি খেয়ে, সঞ্জীব নাথের অটোটা নিয়েই আবার চললাম উল্টো পথে...। ভারতের আর দশটা ব্যস্ত শহরের মতই ডিব্রুগড়। সকালের ঘুম ভাঙ্গছে ডিব্রুগড়ের.... । সোনালী রোদে আলোঝলমলে নাগরিক ব্যস্ততা। হাত বাড়িয়ে গুয়া-পান এগিয়ে দেই সঞ্জীবের দিকে। একপাটি লাল দাঁত বের করে, হেসে.. স্টার্ট দেয় অটো'তে।
মূল শহর থেকে একটু বাইরের দিকেই মোহনবাড়ি। সকাল ৯টা। মালি ও গার্ড মিলিয়ে সাকুল্যে তিন চার জন ডেপুটি কমিশনারের অফিসের সামনে। অফিস খোলেনি তখনও। আমাদের দেখে লোহার গেট টা খুলে দিল একজন।
ভোটার কার্ডের জেরক্স, দুই কপি ছবি হাতে নিয়ে ফর্মফিলাপ করে বাইরের চত্বরে বসে আছি তো আছিই। দুপুর ১টা নাগাদ একজন এসে খবর দিলেন
--- আপনাদের ডাকছেন অফিসার।
পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই, ইনচার্জ আমাদের অরিজিনাল ভোটার ID দেখে পাস গুলি এগিয়ে দিলেন। হুররে.... পেয়ে গেছি ছাড়পত্র। এবারে গন্তব্য বগিবিল ঘাট। বগিবিল ঘাটে যাবার পথে এ.টি. রোডের সাগর হোটেলে সেরে নিলাম দুপুরের খাওয়া।
যতদূর চোখ যায়... অসীম জলরাশি। বিকেল ৩-৩০। বগিবিল ঘাট থেকে শিলাপাথরে যাওয়ার এটাই শেষ ফেরী। ঘাটবন্দরে যাত্রীদের হাঁক-ডাক,
খাবারের দোকানে ভিড় আর মাঝিদের মাল খালাসের তৎপরতা....
আলং ...
আলং যাওয়ার পথে পড়ল মালিনীথান। ব্রহ্মপুত্র নদীর উপরে মালিনীথান মধ্যযুগের একটি হিন্দু মন্দির। এটি অরুণাচল প্রদেশের একমাত্র পুরাতাত্ত্বিক স্থান। আর্যদের প্রভাবে এই অঞ্চলে গ্রানাইট পাথর দিয়ে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিলো মধ্য যুগের কোন এক সময়ে। শক্তির প্রধান প্রতিমূর্তি হিসেবে দুর্গাই ছিলো এখানকার প্রধান আরাধ্য দেবী। মালিনীথানের পুরাতাত্ত্বিক অঞ্চলটি সিয়াং পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশেই অবস্থিত। লিকাবালি থেকে মালিনীথান ১কিমি পূর্বে অবস্থিত। ২১ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত মালিনীথান থেকে ব্রহ্মপুত্রের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়। স্থানীয় লোক কথা অনুসারে কৃষ্ণ রুক্ষ্মণীকে বিবাহ করার ইচ্ছে প্রকাশ করলে, বিদর্ভের রাজা ভীষ্মক রুক্মীনিকে অপহরণ করেন শিশুপালের সাথে বিবাহ দেবার জন্য। তখন ভীষ্মকনগর থেকে দ্বারকার উদ্দেশ্যে রুক্মীনিকে উদ্ধার করে যাবার পথে কৃষ্ণ এই মালিনীথানে শিব ও দুর্গার আতিথেয়তা গ্রহন করেন। তাদের আতিথেয়তায় সন্তুষ্ট হয়ে কৃষ্ণ দুর্গাকে মালিনী বলে সম্মোধন করেন। (মালিনী কথার অর্থ বাগানের পরিচারিকা)। আর সেই থেকেই এই স্থানের নাম মালিনীথান। পাল রাজাদের একটি তাম্রফলক প্রমান করে যে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরে এই অঞ্চলটিতে আর্য জাতির বসবাস ছিলো। দুর্গা, শিব লিঙ্গ, শিবের মূর্তি ছাড়াও বাসুদেব, সিংহ ও হাতি, নন্দির ষাঁড়, ময়ূর, সূর্য দেবতা, কার্ত্তিক ও গনেশের মূর্তি পাওয়া গেছে এখানে। পুরাতত্ত্ব বিভাগের খনন কার্য এখানে ৮ফিট উচ্চতার একটি খোদাই করা মন্দিরের ভিত্তিভূমির নক্সা খুজে পেয়েছে , যা কিনা ৫৫৪ সাল নাগাদ তৈরি হয়েছিলো বলে অনুমান।
এবারে আমাদের যাত্রাপথের শুরু ...... মানে অরুণাচল প্রদেশের চেক পয়েন্ট লিকাবালিই থেকেই...
অরুণাচলের পশ্চিম সিয়াং জেলার মালিনীথান থেকে ১২ কিমি দূরে আকাশীগঙ্গা। এটি হিন্দুদের আরো একটি তীর্থস্থান। এই অঞ্চলটির নাম উল্লেখ আছে অষ্টম শতাব্দীতে রচিত কালীকা পুরানে। এখান থেকে অনেক নীচে ব্রহ্মপুত্রকে দেখা যায় পাখির চোখের মত দৃষ্টিতে। পুরাণকথা অনুসারে মহাদেব যখন সতীর মৃতদেহ দেখতে পেলেন, তখন তিনি নিজেকে সংযত করতে না পেরে তান্ডব নৃত্য করতে শুরু করলেন। শিবকে বিরত করার জন্য ও ব্রহ্মান্ডকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ টুকরো টুকরো করে দেন। এই সময় পুরাণ কথা অনুসারে সতীর মস্তক পড়েছিলো এই স্থানে। সেই থেকে এই স্থানটি হিন্দুদের কাছে পবিত্র। রাস্তার পাশেই আকাশীগঙ্গার মন্দিরটি । মন্দিরের পাশদিয়ে আঁকাবাঁকা পাকদন্ডি পথ ১০০মিটার নীচে নেমে গেছে। এখানেই রয়েছে দেবীর কুন্ড। এখান থেকে কুন্ডের ভেতরে চকচকে একটা বস্তু দেখা যায়। কিন্তু যতই কাছে যাওয়া যায়। ততই চকচকে সেই বস্তুটি উধাও হয়ে যায়।
আকাশীগঙ্গা থেকে ১১৫ কিমি দূরে
সিপু আর সিয়ম নদীর সংযোগস্থলে আলোং, ছবির মত এক উপত্যকা। এটিই পশ্চিম সিয়াং জেলার সদর শহর। চারিদিকে কমলার বাগান আর সবুজ পাহাড় দিয়ে ঘেরা। এই পথে লিকাবালি অরুণাচলের আরো একটি প্রবেশ পথ। আলং-এ এক দিনেই দেখে নেওয়া যায় রামকৃষ্ণ মিশন, পাতুম ব্রীজ, বাগরা গ্রাম, দোনি-পোলো মন্দির। হাতে সময় থাকলে ২৪ কিমি দূরে কামকি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পও দেখে আসা যায়। এখানে মিথুন প্রতিপালন ও ব্রিডিং এর একটি কেন্দ্রও রয়েছে। এখান থেকে ৭০ কিমি দুরে সেই বিখ্যাত বাঁশের ঝুলন্ত ব্রীজ আরো একটি দেখার মত জায়গা। আলং অরুণাচলের একমাত্র স্বাস্থ্যনিবাস।
মেচুকায় মিথুন ...
AS-22C-3158 নম্বর গাড়ির মিডল রো এর উইন্ডো সাইডে বসে আছি। টাটা সুমোর দুলুনি আর ব্লুটুথ সাউন্ড সিস্টেমের গানে কখন যে চোখ টা বুজে এসেছিল খেয়াল নেই। কাম্পা, কাইয়িং পেরিয়ে গেছি অনেকক্ষন। হঠাৎ একটা হেয়ার পিন বেন্ডে গাড়ি টা বাঁক নিতেই দরজার হাতলে ধাক্কা খেয়ে ঘুমটা গেল ভেঙ্গে।
জলছবির মত দৃশ্যপট। পাম গাছের বাগান, বুনো ঝোপঝাড়, সার সার কলাগাছ, বাড়িঘর, খেতখামার সব পিছিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির গোঁ..ও..ও শব্দ ছাড়া চারিদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। গাড়ির ভেতরেও সবাই নিশ্চুপ। শুধু প্রবীর আর প্রশান্ত কি যেন একটা গুনছে। প্রশান্ত বলে উঠল...
-- সাত
প্রবীর বাধা দিয়ে বলে উঠল, না না। --সাড়ে ছয় হবে। ওটা তো বাচ্চা... তাই সাত হবে না।
মুখে মুখে হিসেব করে প্রশান্ত বললো
--- আরো আড়াইটা লাগবে তাহলে।
কিছুটা সময় যেতেই, ব্যপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হল। ওরা মিথুন গুনছে।
উত্তর পূর্ব হিমালয়ের এই অঞ্চলে মিথুন ও টাকিন দুটি গুরুত্বপূর্ন প্রানী। ১০০০- ৩০০০ মিটার উচ্চতায় মিথুনদের দেখা যায়। জংলী গৌর মিথুনের পূর্বপুরুষ হলেও বর্তমানে অরুণাচলে এই প্রানীদের গৃহপালিত করে প্রতিপালন করা হয়। ২০০৭সালের পশু গণনা অনুসারে ভারতে মোট মিথুনের সংখ্যা ছিল ১৭৬৮৯৩টি যার মধ্যে অরুণাচল প্রদেশেই ছিল ৭০% এর বেশী। উপজাতিদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে মিথুন বলি প্রচলিত সংস্কার। গালো, আদি, আপাতানি, মনপা, তাংসা, মেম্বা প্রভৃতি উপজাতির মানুষরা মিথুন বলি দেয়। মাংস ছাড়াও ভারবহন ও কৃষিকাজে মিথুন ব্যবহার করা হয়। উত্তরপূর্ব ভারত ছাড়াও চীন, মায়ানমার, ভূটান ও বাংলাদেশে এই পশুদের দেখা যায়।
কিন্তু হঠাৎ মিথুন গোনার কারণ কি? নেপুদার দিকে বিস্ময়ের চোখে তাকাতেই, স্বল্পভাষি নেপুদা মুচকি হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে জানালায় চোখ রাখলো আবার। তাতোর ( আলং থেকে ৮৯ কিমি) দিকে গাড়ি যত এগুলো.... ততই আমার কাছে একে একে স্পষ্ট হলো বিষয়টা....।
আজ সকালে দোনি পোল মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, সিয়ম নদীর পাতুম ব্রীজ দেখে গাড়িতে পেট্রল ভরে, চলে এসেছি হিটুম-ডেজিরে। হিটুম ডেজিরে ঢোকার মুখেই ডেজির রেস্টুরেন্ট। স্থানীয় এক গালো দম্পতিই চালায় হোটেলটিকে। পাশেই গালো ট্রাইবদের একটা বসতি। সকালের নাস্তার জন্য টাটা সুমোটা দাঁড়াতেই আমি ক্যামেরা, খাতা, পেন নিয়ে একছুটে চলে এলাম একটা ট্রাইবাল বাড়ির সামনে। একজনের সাথে কথা বলে সোজা ঢুকে গেলাম অন্দরমহলে। গালো ট্রাইবালটি যথেষ্ট শিক্ষিত আর মিশুকে। সুন্দর ইংরাজী বলতে পারে। ঘরের ভেতরে ঢুকে, একে একে আমায় চিনিয়ে দিল-- উজিক( চাল থেকে লোকাল মদ প্রস্তুত করার পাত্র), এবের( মেয়েদের হালকা জিনিসপত্র বহন করার ঝুড়ি), অপো( বাঁশ ও বেত নির্মিত কুলা), ওসি( বাঁশের তৈরি পাত্র), গালে( মেয়েদের স্থানীয় পোশাক), উপো( বাঁশ নির্মিত মাদুর)। অরুণাচলের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে বাঁশ ও বেত। বাঁশকে গালো রা বলে নৈপে(nyope)। অনেক প্রজাতীর বাঁশ পাওয়া গেলেও কাজের নিরিখে এদের তিন ভাগে ভাগ করে গালো'রা। বুনতে কাজে লাগে 'এসো নৈপে'। বাকি ২টি প্রজাতি......'এজো নৈপে' ও ‘এও নৈপে’ --মোটা মোটা খুঁটি খাম্বা প্রস্তুতের কাজে ব্যবহার হয়। প্রতিটি গালো গৃহেই একটা করে 'মিরাম'( ফায়ার প্লেস) থাকে। সেন্ট্রাল রুমের ঠিক মাঝখানে থাকে মিরাম। বাঁশ নির্মিত ধোয়া নির্গমন পথ লাগানো থাকে মিরামের ঠিক উপরে। সেন্ট্রাল রুমের চারদিকেই দরজা থাকে। রান্না হয় মিরামের পাশে কিন্তু খাবার পরিবেশন কিম্বা বসবার ধরণ হয় আলাদা। মিরামের চারদিকে চতুর্ভূজ আকারে বসে পরিবারের সবাই। প্রথমে বয়স্ক মহিলারা, তারপর কমবয়সি ছেলেরা, একই ভাবে তারপরে বয়স্ক পুরুষরা এবং সব শেষ কমবয়সি মেয়েরা। শিকার করা গালোদের প্রিয়। কোন পরিবার কতটা শৌর্যবীর্যের অধিকারি তা বোঝা যায় দেওয়ালে টাঙ্গানো পশুর করোটি দেখে। প্রতিটি বাড়ির দেওয়ালে নুন্যতম দু একটা মিথুনের মাথা দেখা যাবেই।
এদিকে আমি আমার কাজে মগ্ন, আর অন্যদিকে প্রবীর বাপীদা আর প্রশান্ত ধাবার মালকিনের সাথে আড্ডা জমিয়েছে। গালো উপজাতিদের বিবাহ পদ্ধতিই ওদের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু তখন।
গালো ও আদি উপজাতির সমৃদ্ধির প্রতীক মিথুন। বিবাহের সময় বিবাহযোগ্য পুরুষকে কমপক্ষে ৯টা মিথুন প্রদান করতেই হয় বিবাহযোগ্যা নারীর পিতাকে। পিতৃতান্ত্রিক গালো সমাজে মেয়েরা বিবাহযোগ্য হলে গলায় দেওয়া হয় নীল পুঁতির মালা। তখন যদি কোন পুরুষের পছন্দ হয় নারীকে, তাহলে ৯ টা মিথুন হলেই বিবাহ মঞ্জুর।
এতক্ষন ধরে তাই প্রশান্ত আর প্রবীর, বাপীদার জন্য মিথুন গুনে যাচ্ছে।
--- সাড়ে ছয়... সাত... আট.. নয়।
আপাদমস্তক নির্বিবাদি শান্ত স্বভাবের বাপীদা নিরুত্তর। শুধু মাঝে মাঝে মোবাইল খুলে, বৌদিকে খুঁজছে টাওয়ারে। ( মিথুনের ভয়ে কিনা, আমার জানা নেই)
ভোর রাতে ঘুম ভেঙে ...
বন পাহাড়ে নিজের বাড়ি ......
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। প্রশস্ত উপত্যকা। ঠান্ডা বাতাসের দাপট। 'U' আকৃতির চওড়া উপত্যকায় অতীতের হিমবাহের ছাপ।
এখানে সিয়ম নদীর নাম ইয়ার্গাব চু। চু কথার অর্থ নদী। নদী সমান্তরালে একটাই রাস্তা পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। হেরিং-বোন প্যাটার্নের লম্বাটে বসতি। উপত্যকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দৈর্ঘ্য বরাবর ব্যপ্তি প্রায় ৭-৮ কিমি। চার ভাগের তিন ভাগই মিলিটারি আর BRO( বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন) এর দখলে। ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ড থেকে দিনের শেষে ফিরে যাচ্ছে মিলিটারির দীর্ঘ কনভয়। ন্যাড়া পাহাড়, বিক্ষিপ্ত জনবসতি, শোঁ-শোঁ বাতাস, আর একটানা ইয়ার্গাব চু'র জলপ্রবাহের কলতান ... এটাই মেচুকা। তিব্বত ভারত চেকপোস্ট এখান থেকে ২৫ কিমি দূরে। বাজার থেকে আরো ২ কিমি শহরের ভেতরে ঢুকি। উত্তর পশ্চিমের পাকা রাস্তার ধারেই পাসাং গেবু চেনার বাড়ি। আজ এখানেই হোম-স্টে।
ঘরের ভেতরে তখন সিগারেটের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে। ড্রাইভার থাপা দাজুর সাথে আড্ডা জমে উঠেছে। চেয়ারের হেলান দিয়ে থাপা দাজু আমাদের সাথে অরুণাচলের খুঁটিনাটি গল্প করছে। আর আমরা মুখোমুখি দুটো বিছানায় পা ঝুলিয়ে। পাসাং গেবু চেনা, ঘরে ঢুকে জলের বোতল দিয়ে, নিয়ে গেল ডিনারের অর্ডার। গল্প করতে করতেই হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। থাপা দাজু লাইটার দিয়ে টেবিলে রাখা মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিল। আমরা সবাই যে যার মত ফ্রেশ হয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে রাতের শোয়ার ব্যবস্থা করছি। এমন সময় কিচেন থেকে খাওয়ার ডাক এলো। ডাল, ভাত, আলুভাজা, ডিমের কারি আর স্যালাড। নিজে হাতে বানিয়েছে পাসাং আর ওর বউ। তৃপ্তিকরে খেয়ে বাইরে এলাম। উঁচুনীচু বাথরুম - কলপারের অন্ধকারে পা টিপে টিপে হাঁটি। বাইরের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুদ রোমাঞ্চ লাগল মনে। সমস্ত উপত্যকা ভেসে যাচ্ছে মায়াবী জ্যোৎস্নায়। গতকাল পূর্ণিমা ছিল। ঘরে ঢুকে জল খেয়ে বাতিটা নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। উচু পাহাড়ের গায়ে রাত নেমেছে .... চারিদিক নিস্পন্দ নিশ্চুপ.....।
রাতের অন্ধকারে ... বহুদূর থেকে ভেসে এলো দু একটা কুকুরের ডাক।
রাতের ঠান্ডায় কম্বলের ভেতরে দলাপাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ কানে এলো কোঁকোঁর – কোঁক – কোক। মুরগির ডাকে ঘুম ভাঙতেই বাইরে বেরিয়ে এলাম। কাঠের বারান্দা। নক্সা করা কাঠের রেলিং। হাতে ধোয়া ওঠা গরম গ্রীন টি। প্রশান্তর দৌলতে চায়ের একটা অলটারনেটিভ ব্যবস্থা ছিলই আমাদের সাথে। সকালের আলোতে ঘুম ভাংছে মেচুকার। ঘাসের আগায় শিশিরের বিন্দু। রাস্তার পাশে নাম না জানা বুনো গুল্মের ঝোপে সদ্য ফোটা ফুল। উত্তর পূর্ব পাহাড়ের মাথায় সূর্যের প্রথম আলো.... লাল আভায় রক্তিম। বাড়ির পাশে পাইন গাছের তক্তা গুলো সার সার করে সাজিয়ে রাখা। এভাবেই কাঁচা কাঠগুলোকে সিজন করা হয়। অধিক উচ্চতার কারণে মেম্বাদের বাস গৃহ কাঠদিয়েই তৈরি হয়। এত উচ্চতায় এখানে বাঁশ পাওয়া যায় না। উঁচু পাহাড়টার দিকে একমনে তাকিয়ে আছি তো আছিই। ড্রাইভার থাপাদাজু এসে তাড়া লাগায়। আজ অনেকটা পথ ……
লাইন অফ কন্ট্রোল ......
১৮৭৩ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর অরুণাচলের প্রান্ত দিয়ে একটি আউটার লাইন টেনে প্রথম উত্তর পূর্ব ভারতের সীমান্ত টানেন। এর পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সিস ইয়ংহাসবেন্ডের নেতৃত্বে ব্রিটিশরা তিব্বত আক্রমণ করে ১৯০৪ এ। ১৯১০-১২ সালে চীনের QING সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটিশরা পুনরায় নেফার (NEFA) দিকে আগ্রাসনের মাধ্যমে তাদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটায়। ১৯১৩ তে তিব্বতের অবস্থান নিয়ে চিন-ব্রিটেন-তিব্বতের পারস্পরিক বৈঠক বসে সিমলাতে। এই বৈঠকে তিব্বতকে অটোনমাস স্টেট ঘোষনা করা হলেও, চিন চুক্তিপত্রে সাক্ষর থেকে নিজেকে বিরত রাখে। ১৯১৪ সালের ২৪-২৫ শে মার্চ ম্যকমোহন তিব্বতের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলচনার ভিত্তিতে ভারত তিব্বত সীমান্ত টানেন। যা দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত ম্যাকমোহন লাইন নামে পরিচিত। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশরা সরকারি ভাবে ভারতের মানচিত্র ও সিমলা চুক্তি প্রকাশ করেন। এই সালেই ক্যাপ্টেন জি এস লাইটফুট তাওয়াং এ ব্রিটিশ শাসন কায়েম করেন। কিন্ত লাইটফুটের প্রত্যাগমনের কিছু পরে পুনরায় তিব্বত তাওয়াংএর ক্ষমতা দখল করে। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তাওয়াং তিব্বতীদের দখলেই ছিল। ১৯৪৯ এ বেজিং এ কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এলে তিব্বতকে নিজেদের বলে দাবী করতে শুরু করে। পরিস্থিতির উত্তেজনা কমাতে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী নেহেরু ডাক দেয় -- " ইন্দো- চীনি ভাই ভাই"। ১৯৫৪ তে ভারত এই অঞ্চলের নামকরণ করে NEFA.
১৯৫৯ এ ১৪তম দলাই লামা ভারতে এলে ভারত সরকার ম্যাকমোহন লাইনকেই গুরুত্ব দিতে শুরু করে এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস(সংবাদ পত্র) সরাসরি তিব্বতের স্বাধীনতা নিয়ে মুখ খোলে। শুরু হয় দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা। ১৯৫৯ এর অগাস্টে চীন সারি চু নদীর(সুবনসিরির প্রধান উপনদী) ধারে ভারতের মিলিটারি চেকপোস্ট লংজু আক্রমন করে। ১৯৫৯ এ ২৪শে অক্টোবর নেহেরুর কাছে এক চিঠিতে জু-এনলাই প্রস্তাব রাখেন প্রকৃত সীমানা(LAC) থেকে উভয় দেশকেই ২০ কিমি পিছিয়ে যেতে, এবং কিছুদিন পরেই এনলাই ভারতের দিকে পিছিয়ে যাওয়া ২০ কিমি পশ্চাদবর্তী সীমারেখাকেই প্রকৃত ম্যাকমোহন লাইন নামে ব্যাখ্যা করতে থাকেন। ১৯৬১ তে নেহেরুর আগ্রাসন নীতিতে (Forward Policy) এনলাই প্রবর্তিত LAC থেকে ৪৩টি আউটপোস্ট সামনে অগ্রসর হয়। ৮ই অক্টোবর ভারত-চীন যুদ্ধ লেগে যায় চীন একে একে থাংলা শৈলশিরার দক্ষিণে নামকা চু উপত্যকা, ও তাওয়াং এর দক্ষিণে ৬৫ কিমি পর্যন্ত (রুপা ও চৌকা) এবং ওয়ালং এর দিকে ৩০ কিমি পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ইতিমধ্যে ভারতকে সোভিয়েত, আমেরিকা ও ব্রিটেন সামরিক সাহায্য দিলে চীন পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এবং যুদ্ধ বন্দীদের ভারতে প্রত্যার্পণ করে চীন। ১৯৭২ এ এই অঞ্চলের(NEFA) নতুন নামকরণ করা হয় "অরুনাচল প্রদেশ"
নৃতত্ত্বের জাদুঘর ......
জিনতত্ত্ব অনুসারে বহু শতাব্দী পূর্বে এই উপজাতির লোকেরা পূর্ব ভুটান ও তিব্বত থেকে এই উপত্যকায় এসেছিলো। তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা যা কিনা অতীতের সিল্করুটে অবস্থিত ছিল, মেচুকা থেকে অল্পদুরেই অবস্থিত। মনপাদের সাথে জিনগত ভাবে মেম্বাদের কোন মিল নেই। মেম্বাদের লিখিত লিপির নাম "হিকর"। মূলতঃ তিব্বতি লিপি ভেঙ্গেই এই লিপি তৈরি হয়েছে। প্রতিটি গ্রামেই একটি করে বৌদ্ধ গুম্ফা রয়েছে। গুম্ফাগুলির দ্বায়িত্বে থাকেন একজন প্রধান লামা। মেম্বাদের প্রাত্যহিক জীবনে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।
এরা নিংমাপা বুদ্ধবাদ মেনে চলে।
লোসার ও চোসকার মেম্বাদের দুটি প্রধান উৎসব। বৌদ্ধধর্ম মেনে চলা অরুনাচলের ৬টি উপজাতির মধ্যে মেম্বারা তৃতীয় স্থান দখল করে। পাথর আর কাঠ দিয়ে এদের বাসগৃহ তৈরি হয়।
মহিলাদের মধ্যে বহু বিবাহ মেম্বা আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত। অধিকাংশ মেম্বা রমণীর একাধিক স্বামী থাকে। বিয়েতে মেয়েরাই পুরুষ নির্বাচন করে। কৃষিকাজ এদের প্রধান জীবিকা। এছাড়া কার্পেট বোনা, লোহার কাজ ও কাঠের কাজ করেও কিছু লোক জীবিকা নির্বাহ করে। ব্রাহ(brah) এদের প্রধান নৃত্যশিল্প। লোসার উৎসবে বা বিবাহে এই নৃত্য করা হয়। এই নৃত্যে বিশেষ ধরনের পোশাক ও মুখোশ ব্যবহার করা হয়। মেম্বা নারীরা রুপার অলংকার পরে। টিং মোমো এদের একটি জনপ্রিয় খাবার। এছাড়া লোসার উৎসবে মারুখ( এক ধরণের চালের রুটি) আর খাবজের ( আটা থেকে প্রস্তুত একধরণের নোনতা খাবার) -এর প্রচলন আছে। ৮-১০দিন ধরে চলে লোসার উৎসব। এই উৎসবে বৌদ্ধ লামারা গান ও মুখোশ নৃত্য পরিবেশন করে। বছরে ২বার লোসার হয়। একবার ডিসেম্বরে-- চুংনিপা লোসার। আর ফ্রেব্রুয়ারীতে -- ডাংপা লোসার। চুংনিপা লোসার ফসল তোলার উৎসব। অন্যদিকে ডাংপা লোসার নববর্ষের উৎসব।
মেচুকা উপত্যকায় মেম্বাদের প্রধান জনবসতি গুলি হলো-- হিরি, গাপো কারতে,পাউক,চারুং,পাদুসা,লিপাসি পুরিং।
উত্তর -মধ্য অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং নদীকেই মেম্বা উপজাতির লোকেরা ইয়ার্গাব চু ( নদী) বলে ডাকে। উত্তরে উচ্চ হিমালয় শৈলশিরা পার হলেই তিব্বত (অধুনা চীন)। মেম্বা উপজাতিদের সাথে তিব্বতীদের ভাষা ও সংস্কৃতিগত মিল সুস্পষ্ট। মেম্বারা সাংলা আর খামস ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাদুটি তিব্বতী উপভাষা। পশ্চিম সিয়াং জেলার মেচুকা উপত্যকায় মেম্বাদের সংখ্যা হাতে গোনা ( ৪০০০-৫০০০)। মেম্বারা মূলতঃ কৃষিজীবি। উপত্যকার ঢালে এরা ধাপ কেটে ধান, ভুট্টা, আলু, গম ও অন্যান্য দানা শস্য চাষ করে। শীতকালে মেচুকা উপত্যকা বরফে ঢেকে যায়। উষ্ণতা নেমে যায় হিমাঙ্কের নীচে। সারা বছর উষ্ণতা কমই থাকে। চারিদিকে ঘন পাইনের জঙ্গল। আর ইয়ার্গাব চু এর ধারে মেম্বাদের আদিম বসতি.......
ঘর- গৃহস্থালি
উপত্যকা জুড়ে হাওয়া বয় শন শন...
১৯৬২ র যুদ্ধের যন্ত্রনার শব্দ এখনো বয়ে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়।
পাতারা কাঁপে......
মেচুকা--তিব্বত সীমান্ত -- ২৫কিমি
মেচুকা -- আলং -- ১৮০কিমি
মেচুকা -- ডিব্রুগড় -- ৩৮৫কিমি
মেচুকা -- ইটানগর -- ৫০০কিমি
মেচুকা -- গৌহাটি -- ৮০০কিমি
সঙ্গম ...
আজ যাচ্ছি ইংকিয়ং। আলং থেকে ইংকিয়ং যাবার পথে পড়ল সিয়াং আর সিয়মের সঙ্গম। ঘোলা সিয়াং এর জলে মিশে যাচ্ছে সিয়মের স্বচ্ছ কাঁচের মত সবুজ জল। এই জায়গাটাই সঙ্গম। লোহার ব্রীজ পেড়িয়ে চলে এলাম পাহাড়ের বিপরীত ঢালে। বেশ কিছুটা চলার পর এলো ৬৫। হ্যাঁ, হোটেল মালিক কে জিজ্ঞাসা করেই এই নামই(সিক্সটি ফাইভ) জানতে পারলাম। এটা পথ চলতি ছোট্ট একটা ধাবা। এখান থেকে সামান্য দূরেই অবস্থিত দিতেদিমে একটি বড় আদি-বসতি। দুপুরের খাবার ডাল-ভাত- সবজি- ওমলেট-আর লঙ্কার ঝাল চাটনি। কিছুটা পথ পাড় করতেই এলো, গেকু। বর্ধিষ্ণু গ্রাম, মূলতঃ কৃষি নির্ভর। কৃষি নির্ভর স্বয়ং সম্পূর্ণ জীবন জীবিকা।পাহাড়ের ঢালে ছড়ানো ধাপ-চাষ। ধান -ভুট্টা - আনারস আর কমলার বাগান। হঠাৎ-ই রাস্তায় আলাপ 'অনি মংকুর' সাথে। বাইকের পেছনে অনেকগুলি কমলা। কথায় কথায় আমরা কমলা বাগানে যেতে চাইলে অনি রাজি হয়ে গেলো ---- আমরা চললাম কমলাবাগানে। নিজে হাতে পেড়ে খেলাম মিস্টি কমলা.... এখনো পুরোপুরি পাকে নি। তবে বিনে পয়সায় সবই মিষ্টি লাগে.... মংকুর বাইকের পেছনে বসেছিল ওর স্ত্রী। বাইক থেকে নেমে পাহাড়ের গা বেয়ে মংকুর স্ত্রী ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতেই..... মংকুর ধারালো অস্ত্রটা নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম একে অপরের দিকে....
না.... ভয়ের কিছু নেই। আমরা এখন সেল্ফি-জুলফি তুলতেই ব্যস্ত।
এভাবেই ধারালো অস্ত্র নিয়ে এ বন-পাহাড়ের দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আদিম আদি রা..... কোন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে....
তারিখ বার সবই ভুলতে বসেছি, তবুও মনে হচ্ছে আজ ১৯শে অক্টোবর ২০১৬......
টুটিং , কল্পনার সাংগ্রি-লা ......
এবড়ো-খেবড়ো ছালবাকলা ওঠা সুদীর্ঘ ১৬০কিমি পথ অতিক্রম করে আমরা যখন টুটিং এ এসে পৌঁছলাম, ততক্ষনে সূর্য ঢাকা পড়েছে পশ্চিমের শৈলশিরার আড়ালে। আপার সিয়াং জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রান্তিক শহর টুটিং। এখানথেকে উত্তরে সামান্য এগোলেই তিব্বত। আজকের যাত্রাপথে একে একে ছেড়ে এসেছি কারকো, কোসাং, রামসিং, বমডো, মসিং, মিগিং ও প্যাংগো। জনবিরল এপথে শুধুই আর্মির দীর্ঘ কনভয়। সর্পিল পথে স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে থাপা দাজু গাড়ি পিছায়। হাতের ঈশারাই মিলিটারি ট্রাকের জওয়ান জানান দেয় গাড়ির সংখ্যা। যতদূর চোখ যায় নিবিড় অরণ্য আর ঝোপ-গুল্ম। এপথে পাহাড়ের ঢাল খুব কম, তাই উপত্যকার দুপাশেই চাষ হচ্ছে ধান আর ভুট্টা। জনবসতির পাশদিয়েই বেত, কলা, কমলা আর পাম গাছের বাগান। সুন্দর গোছানো বাড়িঘর আদিম সংস্কৃতির ছাপ বহন করে চলেছে। মিগিং এর কিছু আগেই যাত্রা বিরতি। মধ্যাহ্ন গড়িয়েছে অনেকক্ষণ। ঘড়ির কাঁট বেলা একটা ছুঁই ছুঁই করছে। রাস্তার একধারে ড্রাইভার থাপা দাজু গাড়িটা পার্ক করতেই পথচলতি ছোট্ট ধাবাটাতে সকলে মিলে প্রবেশ করলাম। প্রশান্ত খাওয়ার অর্ডার করল। ডাল-ভাত- সবজি- পাঁপড় ভাজা - ওমলেট- আচার। খাওয়াদাওয়া করে একে একে বেরিয়ে এলাম বাঁশের চাটাইয়ের দরজা ঠেলে। নদী উপত্যকায় তখন উড়ে বেড়াচ্ছে রং-বেরং এর প্রজাপতি। থাপা দাজুর খাওয়া তখনও শেষ হয় নি। সেই ফাঁকে নেপুদা আবার নেমে গেল নদীর বেডে। ক্যামেরা জুম করেই ফোকাস। তারপর সাটার টেপা। একটার পর একটা ক্লিক। ফ্রেমবন্দী কত চেনা-অচেনা প্রজাপতি। শুকনো মড়া পাতার মত ডানা, এমনি এক প্রজাপতিকে চিনিয়ে দিল নেপুদা। এই প্রজাপতিটা ডানা বন্ধ করে থাকলে অবিকল শুকনো মড়া পাতার মত। কি অদ্ভুত অভিযোজন। এ কয়দিন নেপুদা আত্মমগ্ন হয়ে ছবি তুলছে শুধুই প্রজাপতির। রাস্তায় প্রজাপতি দেখলেই গাড়ি থামিয়ে ভারি ক্যামেরাটা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়েছে সামনের দিকে।
পাহাড় মানেই একটা টান...... এই টান এক এক জনের কাছে এক এক রকম।
সন্ধ্যে নেমেছে টুটিং এর বৌদ্ধ গুম্ফার চূড়ায়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা মেঘের গায়ে বিচ্ছুরিত সন্ধ্যার শেষ আলো নিংড়ে ফটো ফ্রেমে বন্দী করছি টুটিং এর মনাস্ট্রি, ছাত্রাবাস আর আকাশ..... নেপুদা আর প্রবীর ঘুরে ঘুরে আলোছায়ার ফ্রেমে বন্দী করছে উত্তরের পর্বতমালা আর বৌদ্ধ লামাদের। বাপীদা যথারীতি সেলফি তুলতেই ব্যস্ত।
টিম লিডার প্রশান্তর কথা মত জেলিং থেকে বিসিং পর্যন্ত একটা ট্রেক রুট আছে। টুটিং থেকে জেলিং ঘন্টা খানেকের গাড়ির পথ। বিসিং চাংলা উপজাতি অধ্যুষিত ছোট্ট একটি পাহাড়ি জনপদ। উত্তর অরুণাচলের তিব্বত সীমান্ত লাগোয়া যে জাতি গুলির বাস, তাদের মধ্যে মেম্বা, চাংলা, খাম্বা এই তিনটিই প্রধান। সুদূর অতীতে এই জাতিগুলি তিব্বত থেকেই ভারতে এসেছিল। এরা তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের অনুগামী। এছাড়া এদের ভাষার সাথেও তিব্বতী ভাষার মিল রয়েছে যথেষ্ট। শান্ত স্বভাব, অতিথি-বৎসল, শিক্ষিত এই জাতির এক প্রতিনিধি দর্জি ছয়ডার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন টুটিং গুম্ফার প্রৌঢ় এক লামা।
টুটিং এ আসার পর থেকেই আমি মনে মনে খুঁজে যাচ্ছি, ম্যাকমোহন লাইন। যেখান থেকে দেখতে পাব তিব্বতের বিজন - অনুর্বর ট্রান্স হিমালয়ান প্রান্তদেশ। ট্রেক পথে বিসিং পৌঁছে আবার খাড়া চড়াই.... উচু একটা ডাঁরা( শৈলশিরা) থেকে দেখা যায় তিব্বতের ধু-ধু প্রান্তর।
ম্যাকমোহন লাইন একটা স্ট্র্যাটেজিক ও টেকনিক্যাল লাইন। এই কারণেই ১৯৬১ র যুদ্ধে চীন পিছু হঠতে বাধ্য হয় । গ্রেটার হিমালয় পেরিয়ে এসে NEFA কে কব্জায় রাখা চীনের পক্ষে অসম্ভব ছিল। এই সীমারেখায় হিমালয় নিজেই ভারতের অতন্দ্র প্রহরী। দর্জি ছয়ডাকে জিজ্ঞেসা করে জানতে পারলাম জেলিং এ পৌঁছে বিসিং হয়ে হিলটপ পর্যন্ত যাওয়া আসা, সব মিলিয়ে পুরো একটা দিন। এদিকে দলের মধ্যে সবার শারীরিক সক্ষমতা ঠিকঠাক নেই। Innerline permission এর চক্করে ইতিমধ্যেই ডিব্রুগড়ে একটা দিন নষ্ট হয়েছে। তাই এ যাত্রায় বিসিং বাতিলই থেকে গেল।
দর্জি ছয়ডার সাথে গল্পে গল্পে আমরা নেমে এসেছি টুটিং বাজারে। পথ-চলতি চায়ের দোকানে চা আর গরম গরম চপের অর্ডার দিয়েছে সুদীপ দা। বাঁশের বেঞ্চে পা দুলিয়ে দুলিয়ে চা খেতে খেতে ততক্ষণে নেপুদা ছয়ডার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে টুটিং থেকে অন্য ট্রেক রুট গুলির খুঁটিনাটি তথ্য।
ইতিমধ্যে রাত্রি নেমেছে। উত্তরে দৈত্যাকার কালো পর্বতের মাথাগুলি উপত্যকাকে ঘিরে রেখেছে বেষ্টনির বন্ধনে। সিয়াং উপত্যকায় একটা দুটো করে জ্বলে উঠেছে বাতি স্তম্ভের আলো। ড্রাইভার থাপা দাজু গাড়িতে স্টার্ট দিতেই আমরা একে একে গাড়িতে বসি। আজকের আস্তানা টুটিং ইন্সপেকশন বাংলো।..... এবারে ফ্রেশ হবার পালা।
যে সেতু জুড়েছে মন আর মানুষ ..........
২০তারিখে আচমকাই এক বিপত্তি ঘটলো। সেদিন টুটিং থেকে ফেরার পথে পড়লো মৈয়িং। তখন বিকেল। ভারতের পূর্বদিকে অবস্থিত হওয়ায় তাড়াতাড়িই সন্ধ্যে লাগে অরুণাচলে। টুটিং এ যাবার পথে আমাদের পূর্ব পরিচিত মৈয়িং এর ভাইজান হোটেলে চা খেয়ে রাস্তা পাল্টালাম.....
সিমঙ্গ হয়ে মৈয়িং থেকে পাকা রাস্তায় ইংকিয়ং ৪০ কিমি'র বেশী। অন্যদিকে মৈয়িং থেকে বাঁশ ও বেতের ঝোলানো গান্ধীসেতু পার হয়ে
ইংকিয়ং বড়জোর ৪-৫ কিমি। আমি, প্রশান্ত আর নেপুদা আগে থেকেই ঝোলানো ব্রীজ পেড়িয়ে ইংকিয়ং-এ যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। বাপীদাও পরে আমাদের সাথে রাজি হয়ে গেলে, আমরা গান্ধীসেতুর পশ্চিম পারে আমাদের ড্রাইভারের ভরসায় প্রবীর আর সুদীপ'দা কে ছেড়ে দিলাম। সিয়াং এর গভীর গিরিখাতের উপর তখন দেশীয় মানুষদের সৃষ্ট বাঁশের সাঁকোটা জাস্ট দুলছে.... বাঁশের সাঁকোর টানেই পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি ---- সেই ব্রীজ, যা জুড়ে রেখেছে আত্মার সম্পর্ক আর সংস্কৃতিকে। দুপাশে টান করে বাঁধা রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। ক্যামেরার লেন্সের দিকে গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি.... বাঁশের দলুনিতে পা কাঁপে, হাত কাঁপে..... দুএকটা জায়গায় নরম কাঠ। কোথাও কোথাও ফাঁকা..... আর কিছু বছর পরে এই ব্রীজটা আর থাকবে না। ঝোলানো সেতুর পাশেই পাতা হয়েছে লোহার নতুন খুঁটি খাম্বা। আর কিছুদিন পর এখানে লোহার সেতু হয়ে যাবে। বাস রাস্তা পাল্টে দেবে যোগাযোগের মানচিত্র।
আস্তে আস্তে ধীর পায়ে চলে এলাম নদীর বিপরীতে। সন্ধ্যার মৃয়মাণ আলোতে পায়ে পায়ে হেঁটে যখন ইংকিয়ং এ ঢুকলাম তখন রাত নেমেছে। পাহাড়ের আলোক মালায় সুসজ্জিত ইংকিয়ং। ইন্সপেকশন বাংলোতে গিয়ে জানতে পারলাম, পুরো বাংলোই বুকিং আছে। অগত্যা একে একে লিবাং, হিলটপ, বব হোটেল ঘুরে শেষমেশ পালজার হোটেলে মাথা গোঁজার জায়গা পেলাম। ইতিমধ্যে ২ ঘন্টা কেটে গেছে। মোবাইলে ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রবীর আর সুদীপ'দা কে। কিছুতেই কাউকে লাইনে পাচ্ছি না। টুটিং থেকে ইংকিয়ং এ ফেরার সময় গাড়ি রিজার্ভে পড়েছিলো মৈয়িং এ ঢোকার কিছু আগে। গিয়ারেরও কিছু প্রবলেম হয়েছিলো রাস্তায়। মাথার মধ্যে তখন শুধু উল্টো পাল্টা চিন্তা ঘুরছে। হঠাৎ প্রবীবের গলা শুনে... নিশ্চিন্ত হলাম। গাড়ি ফিরেছে, সাথে ওরা দুজন। M.S Brispati Bazar, Silapathar এর ড্রাইভার Nanug Thapa কে আমি বিশ্বাস করি। ভরসাও করি। ও না থাকলে এপথ এত নিশ্চিন্তে পাড়ি দিতে পারতাম না.......
মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
এবারে ফেরার পালা .........
আজ সকালে উঠেই কথা ছিল ওরিয়ম ঘাট পাড় হয়ে সোজা ডিব্রুগড়। প্ল্যানটা গতকালকেই করা ছিল। কিন্তু পথের ব্যপার-স্যাপার তো আর ঘড়ির কাঁটা ধরে প্ল্যান মোতাবেক চলে না। তাই যথারীতি সকাল ৮-৩০ ওরিয়ম ঘাটে গিয়ে জানতে পারলাম পাসিঘাট(ওরিয়ম ঘাট) ও ডিব্রুগড়ের ফেরী সার্ভিস একদিন বাদে বাদে চলে..... ফেরার দিন সমস্ত প্ল্যান যখন বাতিল হয় হয় ঠিক তক্ষুনি ঘাটের এক মাঝিকে পাকড়াও করে পাড়ি দিলাম উত্তাল ব্রহ্মপুত্র, ছোট্ট এক ডিঙ্গি নৌকায়। একে একে ২ টা দ্বীপে। সবাই মিলে কাটালাম ঘন্টা তিনেক.....
তারপর শিলাপাথর - বগিবিল হয়ে এখন ডিব্রুগড়ে ব্রহ্মপুত্র মেইল এর অপেক্ষায়।
এই লেখা পড়ে যারা যারা মনে মনে অরুণাচলে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তাদের জন্য কিছু সংযোজন
ড্রাইভার -
Nanug Thapa
M.S. Brispati Bazar
contact --- 8730873781
Alternative Driver
Asim Majumdar
Tinsukia
Contact -- 9957019506
মৈয়িং এ থাকা-খাওয়া
Hotel Bhaijan
contact -- 9402786599
মেচুকায় থাকার জায়গা
Pasang Gebu Chena
Bazashree Homestay
Mechuka
contact--- 9402004087, 9402461368
টুটিং এ থাকার জন্য
Dorjee Choida
contact -- 9436666944
Dchoida@gmail.com
Tuting
ইংকিয়ং
Paljar Hotel
N. Wangmo
Contact 9402820009
শিলাপাথর
Pradip Hotel
Silapathar Main Road
আলং
আলং এ থাকার জন্য একাধিক হোটেল রয়েছে।
Circuit House - 222232
Hotel Magsang -- 222434
Anchal Bhaban -- 222643
Hotel Yomgo ---- 224641
Karbok Hotel ---- 222446
STD -- 03783
টুটিং থেকে অনেকগুলি ট্রেক রুট আছে
1. Titapuri
2. Riotala
3. Pemaseri
4. Nyukong
সত্যি বলতে কি ট্রেক না করলে টুটিং এ আসার কোন যুক্তিই নেই।
Important places to Visit
মালিনীথান,আকাশি গঙ্গা,আলং,সিয়ম ঝোলানো ব্রীজ,দনি-পোল মন্দির,পাতুম ব্রীজ,সিকো-ডিডো জলপ্রপাত,মেচুকা উপত্যকা,মেচুকা গুম্ফা,মৌলিং ন্যাশানাল পার্ক,ইংকিয়ং এর গান্ধী সেঁতু,টুটিং উপত্যকা,টুটিং বৌদ্ধ মনস্ট্রি,ব্রহ্মপুত্রে অবস্যই লঞ্চে সাফারি।
বন পাহাড়ে নিজের বাড়ি ......
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। প্রশস্ত উপত্যকা। ঠান্ডা বাতাসের দাপট। 'U' আকৃতির চওড়া উপত্যকায় অতীতের হিমবাহের ছাপ।এখানে সিয়ম নদীর নাম ইয়ার্গাব চু। চু কথার অর্থ নদী। নদী সমান্তরালে একটাই রাস্তা পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত। হেরিং-বোন প্যাটার্নের লম্বাটে বসতি। উপত্যকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তের দৈর্ঘ্য বরাবর ব্যপ্তি প্রায় ৭-৮ কিমি। চার ভাগের তিন ভাগই মিলিটারি আর BRO( বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন) এর দখলে। ক্যাম্পিং গ্রাউণ্ড থেকে দিনের শেষে ফিরে যাচ্ছে মিলিটারির দীর্ঘ কনভয়। ন্যাড়া পাহাড়, বিক্ষিপ্ত জনবসতি, শোঁ-শোঁ বাতাস, আর একটানা ইয়ার্গাব চু'র জলপ্রবাহের কলতান ... এটাই মেচুকা। তিব্বত ভারত চেকপোস্ট এখান থেকে ২৫ কিমি দূরে। বাজার থেকে আরো ২ কিমি শহরের ভেতরে ঢুকি। উত্তর পশ্চিমের পাকা রাস্তার ধারেই পাসাং গেবু চেনার বাড়ি। আজ এখানেই হোম-স্টে।
ঘরের ভেতরে তখন সিগারেটের ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে। ড্রাইভার থাপা দাজুর সাথে আড্ডা জমে উঠেছে। চেয়ারের হেলান দিয়ে থাপা দাজু আমাদের সাথে অরুণাচলের খুঁটিনাটি গল্প করছে। আর আমরা মুখোমুখি দুটো বিছানায় পা ঝুলিয়ে। পাসাং গেবু চেনা, ঘরে ঢুকে জলের বোতল দিয়ে, নিয়ে গেল ডিনারের অর্ডার। গল্প করতে করতেই হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। থাপা দাজু লাইটার দিয়ে টেবিলে রাখা মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দিল। আমরা সবাই যে যার মত ফ্রেশ হয়ে, ব্যাগ গুছিয়ে রাতের শোয়ার ব্যবস্থা করছি। এমন সময় কিচেন থেকে খাওয়ার ডাক এলো। ডাল, ভাত, আলুভাজা, ডিমের কারি আর স্যালাড। নিজে হাতে বানিয়েছে পাসাং আর ওর বউ। তৃপ্তিকরে খেয়ে বাইরে এলাম। উঁচুনীচু বাথরুম - কলপারের অন্ধকারে পা টিপে টিপে হাঁটি। বাইরের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুদ রোমাঞ্চ লাগল মনে। সমস্ত উপত্যকা ভেসে যাচ্ছে মায়াবী জ্যোৎস্নায়। গতকাল পূর্ণিমা ছিল। ঘরে ঢুকে জল খেয়ে বাতিটা নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। উচু পাহাড়ের গায়ে রাত নেমেছে .... চারিদিক নিস্পন্দ নিশ্চুপ.....।
রাতের অন্ধকারে ... বহুদূর থেকে ভেসে এলো দু একটা কুকুরের ডাক।
রাতের ঠান্ডায় কম্বলের ভেতরে দলাপাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ কানে এলো কোঁকোঁর – কোঁক – কোক। মুরগির ডাকে ঘুম ভাঙতেই বাইরে বেরিয়ে এলাম। কাঠের বারান্দা। নক্সা করা কাঠের রেলিং। হাতে ধোয়া ওঠা গরম গ্রীন টি। প্রশান্তর দৌলতে চায়ের একটা অলটারনেটিভ ব্যবস্থা ছিলই আমাদের সাথে। সকালের আলোতে ঘুম ভাংছে মেচুকার। ঘাসের আগায় শিশিরের বিন্দু। রাস্তার পাশে নাম না জানা বুনো গুল্মের ঝোপে সদ্য ফোটা ফুল। উত্তর পূর্ব পাহাড়ের মাথায় সূর্যের প্রথম আলো.... লাল আভায় রক্তিম। বাড়ির পাশে পাইন গাছের তক্তা গুলো সার সার করে সাজিয়ে রাখা। এভাবেই কাঁচা কাঠগুলোকে সিজন করা হয়। অধিক উচ্চতার কারণে মেম্বাদের বাস গৃহ কাঠদিয়েই তৈরি হয়। এত উচ্চতায় এখানে বাঁশ পাওয়া যায় না। উঁচু পাহাড়টার দিকে একমনে তাকিয়ে আছি তো আছিই। ড্রাইভার থাপাদাজু এসে তাড়া লাগায়। আজ অনেকটা পথ ……
লাইন অফ কন্ট্রোল ......
১৮৭৩ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর অরুণাচলের প্রান্ত দিয়ে একটি আউটার লাইন টেনে প্রথম উত্তর পূর্ব ভারতের সীমান্ত টানেন। এর পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সিস ইয়ংহাসবেন্ডের নেতৃত্বে ব্রিটিশরা তিব্বত আক্রমণ করে ১৯০৪ এ। ১৯১০-১২ সালে চীনের QING সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্রিটিশরা পুনরায় নেফার (NEFA) দিকে আগ্রাসনের মাধ্যমে তাদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটায়। ১৯১৩ তে তিব্বতের অবস্থান নিয়ে চিন-ব্রিটেন-তিব্বতের পারস্পরিক বৈঠক বসে সিমলাতে। এই বৈঠকে তিব্বতকে অটোনমাস স্টেট ঘোষনা করা হলেও, চিন চুক্তিপত্রে সাক্ষর থেকে নিজেকে বিরত রাখে। ১৯১৪ সালের ২৪-২৫ শে মার্চ ম্যকমোহন তিব্বতের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলচনার ভিত্তিতে ভারত তিব্বত সীমান্ত টানেন। যা দক্ষিণ এশিয়ার বিখ্যাত ম্যাকমোহন লাইন নামে পরিচিত। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশরা সরকারি ভাবে ভারতের মানচিত্র ও সিমলা চুক্তি প্রকাশ করেন। এই সালেই ক্যাপ্টেন জি এস লাইটফুট তাওয়াং এ ব্রিটিশ শাসন কায়েম করেন। কিন্ত লাইটফুটের প্রত্যাগমনের কিছু পরে পুনরায় তিব্বত তাওয়াংএর ক্ষমতা দখল করে। ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তাওয়াং তিব্বতীদের দখলেই ছিল। ১৯৪৯ এ বেজিং এ কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতায় এলে তিব্বতকে নিজেদের বলে দাবী করতে শুরু করে। পরিস্থিতির উত্তেজনা কমাতে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধান মন্ত্রী নেহেরু ডাক দেয় -- " ইন্দো- চীনি ভাই ভাই"। ১৯৫৪ তে ভারত এই অঞ্চলের নামকরণ করে NEFA.
১৯৫৯ এ ১৪তম দলাই লামা ভারতে এলে ভারত সরকার ম্যাকমোহন লাইনকেই গুরুত্ব দিতে শুরু করে এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস(সংবাদ পত্র) সরাসরি তিব্বতের স্বাধীনতা নিয়ে মুখ খোলে। শুরু হয় দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনা। ১৯৫৯ এর অগাস্টে চীন সারি চু নদীর(সুবনসিরির প্রধান উপনদী) ধারে ভারতের মিলিটারি চেকপোস্ট লংজু আক্রমন করে। ১৯৫৯ এ ২৪শে অক্টোবর নেহেরুর কাছে এক চিঠিতে জু-এনলাই প্রস্তাব রাখেন প্রকৃত সীমানা(LAC) থেকে উভয় দেশকেই ২০ কিমি পিছিয়ে যেতে, এবং কিছুদিন পরেই এনলাই ভারতের দিকে পিছিয়ে যাওয়া ২০ কিমি পশ্চাদবর্তী সীমারেখাকেই প্রকৃত ম্যাকমোহন লাইন নামে ব্যাখ্যা করতে থাকেন। ১৯৬১ তে নেহেরুর আগ্রাসন নীতিতে (Forward Policy) এনলাই প্রবর্তিত LAC থেকে ৪৩টি আউটপোস্ট সামনে অগ্রসর হয়। ৮ই অক্টোবর ভারত-চীন যুদ্ধ লেগে যায় চীন একে একে থাংলা শৈলশিরার দক্ষিণে নামকা চু উপত্যকা, ও তাওয়াং এর দক্ষিণে ৬৫ কিমি পর্যন্ত (রুপা ও চৌকা) এবং ওয়ালং এর দিকে ৩০ কিমি পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ইতিমধ্যে ভারতকে সোভিয়েত, আমেরিকা ও ব্রিটেন সামরিক সাহায্য দিলে চীন পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এবং যুদ্ধ বন্দীদের ভারতে প্রত্যার্পণ করে চীন। ১৯৭২ এ এই অঞ্চলের(NEFA) নতুন নামকরণ করা হয় "অরুনাচল প্রদেশ"
নৃতত্ত্বের জাদুঘর ......
জিনতত্ত্ব অনুসারে বহু শতাব্দী পূর্বে এই উপজাতির লোকেরা পূর্ব ভুটান ও তিব্বত থেকে এই উপত্যকায় এসেছিলো। তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা যা কিনা অতীতের সিল্করুটে অবস্থিত ছিল, মেচুকা থেকে অল্পদুরেই অবস্থিত। মনপাদের সাথে জিনগত ভাবে মেম্বাদের কোন মিল নেই। মেম্বাদের লিখিত লিপির নাম "হিকর"। মূলতঃ তিব্বতি লিপি ভেঙ্গেই এই লিপি তৈরি হয়েছে। প্রতিটি গ্রামেই একটি করে বৌদ্ধ গুম্ফা রয়েছে। গুম্ফাগুলির দ্বায়িত্বে থাকেন একজন প্রধান লামা। মেম্বাদের প্রাত্যহিক জীবনে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।
এরা নিংমাপা বুদ্ধবাদ মেনে চলে।
লোসার ও চোসকার মেম্বাদের দুটি প্রধান উৎসব। বৌদ্ধধর্ম মেনে চলা অরুনাচলের ৬টি উপজাতির মধ্যে মেম্বারা তৃতীয় স্থান দখল করে। পাথর আর কাঠ দিয়ে এদের বাসগৃহ তৈরি হয়।
মহিলাদের মধ্যে বহু বিবাহ মেম্বা আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত। অধিকাংশ মেম্বা রমণীর একাধিক স্বামী থাকে। বিয়েতে মেয়েরাই পুরুষ নির্বাচন করে। কৃষিকাজ এদের প্রধান জীবিকা। এছাড়া কার্পেট বোনা, লোহার কাজ ও কাঠের কাজ করেও কিছু লোক জীবিকা নির্বাহ করে। ব্রাহ(brah) এদের প্রধান নৃত্যশিল্প। লোসার উৎসবে বা বিবাহে এই নৃত্য করা হয়। এই নৃত্যে বিশেষ ধরনের পোশাক ও মুখোশ ব্যবহার করা হয়। মেম্বা নারীরা রুপার অলংকার পরে। টিং মোমো এদের একটি জনপ্রিয় খাবার। এছাড়া লোসার উৎসবে মারুখ( এক ধরণের চালের রুটি) আর খাবজের ( আটা থেকে প্রস্তুত একধরণের নোনতা খাবার) -এর প্রচলন আছে। ৮-১০দিন ধরে চলে লোসার উৎসব। এই উৎসবে বৌদ্ধ লামারা গান ও মুখোশ নৃত্য পরিবেশন করে। বছরে ২বার লোসার হয়। একবার ডিসেম্বরে-- চুংনিপা লোসার। আর ফ্রেব্রুয়ারীতে -- ডাংপা লোসার। চুংনিপা লোসার ফসল তোলার উৎসব। অন্যদিকে ডাংপা লোসার নববর্ষের উৎসব।
মেচুকা উপত্যকায় মেম্বাদের প্রধান জনবসতি গুলি হলো-- হিরি, গাপো কারতে,পাউক,চারুং,পাদুসা,লিপাসি পুরিং।
উত্তর -মধ্য অরুণাচল প্রদেশের সিয়াং নদীকেই মেম্বা উপজাতির লোকেরা ইয়ার্গাব চু ( নদী) বলে ডাকে। উত্তরে উচ্চ হিমালয় শৈলশিরা পার হলেই তিব্বত (অধুনা চীন)। মেম্বা উপজাতিদের সাথে তিব্বতীদের ভাষা ও সংস্কৃতিগত মিল সুস্পষ্ট। মেম্বারা সাংলা আর খামস ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাদুটি তিব্বতী উপভাষা। পশ্চিম সিয়াং জেলার মেচুকা উপত্যকায় মেম্বাদের সংখ্যা হাতে গোনা ( ৪০০০-৫০০০)। মেম্বারা মূলতঃ কৃষিজীবি। উপত্যকার ঢালে এরা ধাপ কেটে ধান, ভুট্টা, আলু, গম ও অন্যান্য দানা শস্য চাষ করে। শীতকালে মেচুকা উপত্যকা বরফে ঢেকে যায়। উষ্ণতা নেমে যায় হিমাঙ্কের নীচে। সারা বছর উষ্ণতা কমই থাকে। চারিদিকে ঘন পাইনের জঙ্গল। আর ইয়ার্গাব চু এর ধারে মেম্বাদের আদিম বসতি.......
ঘর- গৃহস্থালি
উপত্যকা জুড়ে হাওয়া বয় শন শন...
১৯৬২ র যুদ্ধের যন্ত্রনার শব্দ এখনো বয়ে যায় হাওয়ায় হাওয়ায়।
পাতারা কাঁপে......
মেচুকা--তিব্বত সীমান্ত -- ২৫কিমি
মেচুকা -- আলং -- ১৮০কিমি
মেচুকা -- ডিব্রুগড় -- ৩৮৫কিমি
মেচুকা -- ইটানগর -- ৫০০কিমি
মেচুকা -- গৌহাটি -- ৮০০কিমি
সঙ্গম ...
আজ যাচ্ছি ইংকিয়ং। আলং থেকে ইংকিয়ং যাবার পথে পড়ল সিয়াং আর সিয়মের সঙ্গম। ঘোলা সিয়াং এর জলে মিশে যাচ্ছে সিয়মের স্বচ্ছ কাঁচের মত সবুজ জল। এই জায়গাটাই সঙ্গম। লোহার ব্রীজ পেড়িয়ে চলে এলাম পাহাড়ের বিপরীত ঢালে। বেশ কিছুটা চলার পর এলো ৬৫। হ্যাঁ, হোটেল মালিক কে জিজ্ঞাসা করেই এই নামই(সিক্সটি ফাইভ) জানতে পারলাম। এটা পথ চলতি ছোট্ট একটা ধাবা। এখান থেকে সামান্য দূরেই অবস্থিত দিতেদিমে একটি বড় আদি-বসতি। দুপুরের খাবার ডাল-ভাত- সবজি- ওমলেট-আর লঙ্কার ঝাল চাটনি। কিছুটা পথ পাড় করতেই এলো, গেকু। বর্ধিষ্ণু গ্রাম, মূলতঃ কৃষি নির্ভর। কৃষি নির্ভর স্বয়ং সম্পূর্ণ জীবন জীবিকা।পাহাড়ের ঢালে ছড়ানো ধাপ-চাষ। ধান -ভুট্টা - আনারস আর কমলার বাগান। হঠাৎ-ই রাস্তায় আলাপ 'অনি মংকুর' সাথে। বাইকের পেছনে অনেকগুলি কমলা। কথায় কথায় আমরা কমলা বাগানে যেতে চাইলে অনি রাজি হয়ে গেলো ---- আমরা চললাম কমলাবাগানে। নিজে হাতে পেড়ে খেলাম মিস্টি কমলা.... এখনো পুরোপুরি পাকে নি। তবে বিনে পয়সায় সবই মিষ্টি লাগে.... মংকুর বাইকের পেছনে বসেছিল ওর স্ত্রী। বাইক থেকে নেমে পাহাড়ের গা বেয়ে মংকুর স্ত্রী ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতেই..... মংকুর ধারালো অস্ত্রটা নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম একে অপরের দিকে....
না.... ভয়ের কিছু নেই। আমরা এখন সেল্ফি-জুলফি তুলতেই ব্যস্ত।
এভাবেই ধারালো অস্ত্র নিয়ে এ বন-পাহাড়ের দেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আদিম আদি রা..... কোন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে....
তারিখ বার সবই ভুলতে বসেছি, তবুও মনে হচ্ছে আজ ১৯শে অক্টোবর ২০১৬......
টুটিং , কল্পনার সাংগ্রি-লা ......
এবড়ো-খেবড়ো ছালবাকলা ওঠা সুদীর্ঘ ১৬০কিমি পথ অতিক্রম করে আমরা যখন টুটিং এ এসে পৌঁছলাম, ততক্ষনে সূর্য ঢাকা পড়েছে পশ্চিমের শৈলশিরার আড়ালে। আপার সিয়াং জেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রান্তিক শহর টুটিং। এখানথেকে উত্তরে সামান্য এগোলেই তিব্বত। আজকের যাত্রাপথে একে একে ছেড়ে এসেছি কারকো, কোসাং, রামসিং, বমডো, মসিং, মিগিং ও প্যাংগো। জনবিরল এপথে শুধুই আর্মির দীর্ঘ কনভয়। সর্পিল পথে স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে থাপা দাজু গাড়ি পিছায়। হাতের ঈশারাই মিলিটারি ট্রাকের জওয়ান জানান দেয় গাড়ির সংখ্যা। যতদূর চোখ যায় নিবিড় অরণ্য আর ঝোপ-গুল্ম। এপথে পাহাড়ের ঢাল খুব কম, তাই উপত্যকার দুপাশেই চাষ হচ্ছে ধান আর ভুট্টা। জনবসতির পাশদিয়েই বেত, কলা, কমলা আর পাম গাছের বাগান। সুন্দর গোছানো বাড়িঘর আদিম সংস্কৃতির ছাপ বহন করে চলেছে। মিগিং এর কিছু আগেই যাত্রা বিরতি। মধ্যাহ্ন গড়িয়েছে অনেকক্ষণ। ঘড়ির কাঁট বেলা একটা ছুঁই ছুঁই করছে। রাস্তার একধারে ড্রাইভার থাপা দাজু গাড়িটা পার্ক করতেই পথচলতি ছোট্ট ধাবাটাতে সকলে মিলে প্রবেশ করলাম। প্রশান্ত খাওয়ার অর্ডার করল। ডাল-ভাত- সবজি- পাঁপড় ভাজা - ওমলেট- আচার। খাওয়াদাওয়া করে একে একে বেরিয়ে এলাম বাঁশের চাটাইয়ের দরজা ঠেলে। নদী উপত্যকায় তখন উড়ে বেড়াচ্ছে রং-বেরং এর প্রজাপতি। থাপা দাজুর খাওয়া তখনও শেষ হয় নি। সেই ফাঁকে নেপুদা আবার নেমে গেল নদীর বেডে। ক্যামেরা জুম করেই ফোকাস। তারপর সাটার টেপা। একটার পর একটা ক্লিক। ফ্রেমবন্দী কত চেনা-অচেনা প্রজাপতি। শুকনো মড়া পাতার মত ডানা, এমনি এক প্রজাপতিকে চিনিয়ে দিল নেপুদা। এই প্রজাপতিটা ডানা বন্ধ করে থাকলে অবিকল শুকনো মড়া পাতার মত। কি অদ্ভুত অভিযোজন। এ কয়দিন নেপুদা আত্মমগ্ন হয়ে ছবি তুলছে শুধুই প্রজাপতির। রাস্তায় প্রজাপতি দেখলেই গাড়ি থামিয়ে ভারি ক্যামেরাটা নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়েছে সামনের দিকে।
পাহাড় মানেই একটা টান...... এই টান এক এক জনের কাছে এক এক রকম।
সন্ধ্যে নেমেছে টুটিং এর বৌদ্ধ গুম্ফার চূড়ায়। ভাঙ্গা ভাঙ্গা মেঘের গায়ে বিচ্ছুরিত সন্ধ্যার শেষ আলো নিংড়ে ফটো ফ্রেমে বন্দী করছি টুটিং এর মনাস্ট্রি, ছাত্রাবাস আর আকাশ..... নেপুদা আর প্রবীর ঘুরে ঘুরে আলোছায়ার ফ্রেমে বন্দী করছে উত্তরের পর্বতমালা আর বৌদ্ধ লামাদের। বাপীদা যথারীতি সেলফি তুলতেই ব্যস্ত।
টিম লিডার প্রশান্তর কথা মত জেলিং থেকে বিসিং পর্যন্ত একটা ট্রেক রুট আছে। টুটিং থেকে জেলিং ঘন্টা খানেকের গাড়ির পথ। বিসিং চাংলা উপজাতি অধ্যুষিত ছোট্ট একটি পাহাড়ি জনপদ। উত্তর অরুণাচলের তিব্বত সীমান্ত লাগোয়া যে জাতি গুলির বাস, তাদের মধ্যে মেম্বা, চাংলা, খাম্বা এই তিনটিই প্রধান। সুদূর অতীতে এই জাতিগুলি তিব্বত থেকেই ভারতে এসেছিল। এরা তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের অনুগামী। এছাড়া এদের ভাষার সাথেও তিব্বতী ভাষার মিল রয়েছে যথেষ্ট। শান্ত স্বভাব, অতিথি-বৎসল, শিক্ষিত এই জাতির এক প্রতিনিধি দর্জি ছয়ডার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন টুটিং গুম্ফার প্রৌঢ় এক লামা।
টুটিং এ আসার পর থেকেই আমি মনে মনে খুঁজে যাচ্ছি, ম্যাকমোহন লাইন। যেখান থেকে দেখতে পাব তিব্বতের বিজন - অনুর্বর ট্রান্স হিমালয়ান প্রান্তদেশ। ট্রেক পথে বিসিং পৌঁছে আবার খাড়া চড়াই.... উচু একটা ডাঁরা( শৈলশিরা) থেকে দেখা যায় তিব্বতের ধু-ধু প্রান্তর।
ম্যাকমোহন লাইন একটা স্ট্র্যাটেজিক ও টেকনিক্যাল লাইন। এই কারণেই ১৯৬১ র যুদ্ধে চীন পিছু হঠতে বাধ্য হয় । গ্রেটার হিমালয় পেরিয়ে এসে NEFA কে কব্জায় রাখা চীনের পক্ষে অসম্ভব ছিল। এই সীমারেখায় হিমালয় নিজেই ভারতের অতন্দ্র প্রহরী। দর্জি ছয়ডাকে জিজ্ঞেসা করে জানতে পারলাম জেলিং এ পৌঁছে বিসিং হয়ে হিলটপ পর্যন্ত যাওয়া আসা, সব মিলিয়ে পুরো একটা দিন। এদিকে দলের মধ্যে সবার শারীরিক সক্ষমতা ঠিকঠাক নেই। Innerline permission এর চক্করে ইতিমধ্যেই ডিব্রুগড়ে একটা দিন নষ্ট হয়েছে। তাই এ যাত্রায় বিসিং বাতিলই থেকে গেল।
দর্জি ছয়ডার সাথে গল্পে গল্পে আমরা নেমে এসেছি টুটিং বাজারে। পথ-চলতি চায়ের দোকানে চা আর গরম গরম চপের অর্ডার দিয়েছে সুদীপ দা। বাঁশের বেঞ্চে পা দুলিয়ে দুলিয়ে চা খেতে খেতে ততক্ষণে নেপুদা ছয়ডার কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে টুটিং থেকে অন্য ট্রেক রুট গুলির খুঁটিনাটি তথ্য।
ইতিমধ্যে রাত্রি নেমেছে। উত্তরে দৈত্যাকার কালো পর্বতের মাথাগুলি উপত্যকাকে ঘিরে রেখেছে বেষ্টনির বন্ধনে। সিয়াং উপত্যকায় একটা দুটো করে জ্বলে উঠেছে বাতি স্তম্ভের আলো। ড্রাইভার থাপা দাজু গাড়িতে স্টার্ট দিতেই আমরা একে একে গাড়িতে বসি। আজকের আস্তানা টুটিং ইন্সপেকশন বাংলো।..... এবারে ফ্রেশ হবার পালা।
যে সেতু জুড়েছে মন আর মানুষ ..........
২০তারিখে আচমকাই এক বিপত্তি ঘটলো। সেদিন টুটিং থেকে ফেরার পথে পড়লো মৈয়িং। তখন বিকেল। ভারতের পূর্বদিকে অবস্থিত হওয়ায় তাড়াতাড়িই সন্ধ্যে লাগে অরুণাচলে। টুটিং এ যাবার পথে আমাদের পূর্ব পরিচিত মৈয়িং এর ভাইজান হোটেলে চা খেয়ে রাস্তা পাল্টালাম.....
সিমঙ্গ হয়ে মৈয়িং থেকে পাকা রাস্তায় ইংকিয়ং ৪০ কিমি'র বেশী। অন্যদিকে মৈয়িং থেকে বাঁশ ও বেতের ঝোলানো গান্ধীসেতু পার হয়ে ইংকিয়ং বড়জোর ৪-৫ কিমি। আমি, প্রশান্ত আর নেপুদা আগে থেকেই ঝোলানো ব্রীজ পেড়িয়ে ইংকিয়ং-এ যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। বাপীদাও পরে আমাদের সাথে রাজি হয়ে গেলে, আমরা গান্ধীসেতুর পশ্চিম পারে আমাদের ড্রাইভারের ভরসায় প্রবীর আর সুদীপ'দা কে ছেড়ে দিলাম। সিয়াং এর গভীর গিরিখাতের উপর তখন দেশীয় মানুষদের সৃষ্ট বাঁশের সাঁকোটা জাস্ট দুলছে.... বাঁশের সাঁকোর টানেই পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছি ---- সেই ব্রীজ, যা জুড়ে রেখেছে আত্মার সম্পর্ক আর সংস্কৃতিকে। দুপাশে টান করে বাঁধা রয়েছে পাহাড়ের গায়ে। ক্যামেরার লেন্সের দিকে গভীর বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি.... বাঁশের দলুনিতে পা কাঁপে, হাত কাঁপে..... দুএকটা জায়গায় নরম কাঠ। কোথাও কোথাও ফাঁকা..... আর কিছু বছর পরে এই ব্রীজটা আর থাকবে না। ঝোলানো সেতুর পাশেই পাতা হয়েছে লোহার নতুন খুঁটি খাম্বা। আর কিছুদিন পর এখানে লোহার সেতু হয়ে যাবে। বাস রাস্তা পাল্টে দেবে যোগাযোগের মানচিত্র।
আস্তে আস্তে ধীর পায়ে চলে এলাম নদীর বিপরীতে। সন্ধ্যার মৃয়মাণ আলোতে পায়ে পায়ে হেঁটে যখন ইংকিয়ং এ ঢুকলাম তখন রাত নেমেছে। পাহাড়ের আলোক মালায় সুসজ্জিত ইংকিয়ং। ইন্সপেকশন বাংলোতে গিয়ে জানতে পারলাম, পুরো বাংলোই বুকিং আছে। অগত্যা একে একে লিবাং, হিলটপ, বব হোটেল ঘুরে শেষমেশ পালজার হোটেলে মাথা গোঁজার জায়গা পেলাম। ইতিমধ্যে ২ ঘন্টা কেটে গেছে। মোবাইলে ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রবীর আর সুদীপ'দা কে। কিছুতেই কাউকে লাইনে পাচ্ছি না। টুটিং থেকে ইংকিয়ং এ ফেরার সময় গাড়ি রিজার্ভে পড়েছিলো মৈয়িং এ ঢোকার কিছু আগে। গিয়ারেরও কিছু প্রবলেম হয়েছিলো রাস্তায়। মাথার মধ্যে তখন শুধু উল্টো পাল্টা চিন্তা ঘুরছে। হঠাৎ প্রবীবের গলা শুনে... নিশ্চিন্ত হলাম। গাড়ি ফিরেছে, সাথে ওরা দুজন। M.S Brispati Bazar, Silapathar এর ড্রাইভার Nanug Thapa কে আমি বিশ্বাস করি। ভরসাও করি। ও না থাকলে এপথ এত নিশ্চিন্তে পাড়ি দিতে পারতাম না.......
মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
এবারে ফেরার পালা .........
আজ সকালে উঠেই কথা ছিল ওরিয়ম ঘাট পাড় হয়ে সোজা ডিব্রুগড়। প্ল্যানটা গতকালকেই করা ছিল। কিন্তু পথের ব্যপার-স্যাপার তো আর ঘড়ির কাঁটা ধরে প্ল্যান মোতাবেক চলে না। তাই যথারীতি সকাল ৮-৩০ ওরিয়ম ঘাটে গিয়ে জানতে পারলাম পাসিঘাট(ওরিয়ম ঘাট) ও ডিব্রুগড়ের ফেরী সার্ভিস একদিন বাদে বাদে চলে..... ফেরার দিন সমস্ত প্ল্যান যখন বাতিল হয় হয় ঠিক তক্ষুনি ঘাটের এক মাঝিকে পাকড়াও করে পাড়ি দিলাম উত্তাল ব্রহ্মপুত্র, ছোট্ট এক ডিঙ্গি নৌকায়। একে একে ২ টা দ্বীপে। সবাই মিলে কাটালাম ঘন্টা তিনেক.....
তারপর শিলাপাথর - বগিবিল হয়ে এখন ডিব্রুগড়ে ব্রহ্মপুত্র মেইল এর অপেক্ষায়।
এই লেখা পড়ে যারা যারা মনে মনে অরুণাচলে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। তাদের জন্য কিছু সংযোজন
ড্রাইভার -
Nanug Thapa
M.S. Brispati Bazar
contact --- 8730873781
Alternative Driver
Asim Majumdar
Tinsukia
Contact -- 9957019506
মৈয়িং এ থাকা-খাওয়া
Hotel Bhaijan
contact -- 9402786599
মেচুকায় থাকার জায়গা
Pasang Gebu Chena
Bazashree Homestay
Mechuka
contact--- 9402004087, 9402461368
টুটিং এ থাকার জন্য
Dorjee Choida
contact -- 9436666944
Dchoida@gmail.com
Tuting
ইংকিয়ং
Paljar Hotel
N. Wangmo
Contact 9402820009
শিলাপাথর
Pradip Hotel
Silapathar Main Road
আলং
আলং এ থাকার জন্য একাধিক হোটেল রয়েছে।
Circuit House - 222232
Hotel Magsang -- 222434
Anchal Bhaban -- 222643
Hotel Yomgo ---- 224641
Karbok Hotel ---- 222446
STD -- 03783
টুটিং থেকে অনেকগুলি ট্রেক রুট আছে
1. Titapuri
2. Riotala
3. Pemaseri
4. Nyukong
সত্যি বলতে কি ট্রেক না করলে টুটিং এ আসার কোন যুক্তিই নেই।
Important places to Visit
মালিনীথান,আকাশি গঙ্গা,আলং,সিয়ম ঝোলানো ব্রীজ,দনি-পোল মন্দির,পাতুম ব্রীজ,সিকো-ডিডো জলপ্রপাত,মেচুকা উপত্যকা,মেচুকা গুম্ফা,মৌলিং ন্যাশানাল পার্ক,ইংকিয়ং এর গান্ধী সেঁতু,টুটিং উপত্যকা,টুটিং বৌদ্ধ মনস্ট্রি,ব্রহ্মপুত্রে অবস্যই লঞ্চে সাফারি।
তুষার দত্ত
Reviewed by Pd
on
জুলাই ৩১, ২০১৭
Rating:
Reviewed by Pd
on
জুলাই ৩১, ২০১৭
Rating:




কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন