রুমকি রায় দত্ত

ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে
বাইরে শ্রাবণধারা, প্রকৃতি সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছে। নুয়ে পড়া গাছের পাতা গুলো একেবারে কাকভেজা! ওদের ভেজা গা গড়িয়ে ঝরে পড়ছে জলধারা। গাছের ডালে ছোট্ট একটা পাতার নিচে ডানায় ঠোঁট গুঁজে বসে, এক নাম না জানা পাখি বা অতি পরিচিত কাক। এমন দিনে শ্বেতশুভ্র টানটান বিছানায় বসে, জানালায় চোখ রাখলে মন গেয়ে উঠতেই পারে—‘ মন হারাবার আজি বেলা/পথ ভুলিবার খেলা।

পথ ভুলে বারবার প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া তারপর আবার পথ খুঁজতে খুঁজতে ফিরে আসা, এরই নাম বুঝি জীবন আর জীবন মানেই ফিরে দেখা। এমন বর্ষণমুখর দিনে মনটা তাই বারবার হারিয়ে যাচ্ছে অতীতের বর্ষা যাপনে। বর্ষা বলতেই মনে পড়ে যাচ্ছে নীলসাদা টিউনিক স্কুল ড্রেসে মাথার দু’পাশে ছোট্ট দুটো ঝুটি বাঁধা আমি দাঁড়িয়ে আছি গেটের সামনে, মাথায় ধরা লাল,নীল,হলুদ,সবুজ ছোট্ট একটা ছাতা। হাতে ধরা স্কুল বাক্স। ভিতরে বই, খাতা ছাড়াও কাগজের পুতুল। আমি তখন ক্লাস ‘টু’। আগে গেলে আগে বসা, মানে সামনের সিটে। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। সেদিন ভোর থেকেই বৃষ্টি। চারিদিক কালো করে আছে আকাশ। সকাল ছটার মধ্যে তৈরি করে দিয়েছে মা, প্যাঁচা মুখে দাঁড়িয়ে ভাবছি এমন বৃষ্টি হোক যেন আমি ভিজে যাই। বাপি তখন আমার স্কুলযান, বাপির সাইকেল নিয়ে প্রস্তুত। গোমড়া মুখে বাক্স হাতে বসলাম সাইকেলের সামনে।বাপি সাইকেলের একটা প্যাডেল ঘুরিয়েছে সবে, দেখি এক সর্প মহারাজ এঁকে বেঁকে চলেছেন এদিক থেকে ওইদিকে। নিমেষে কি যে হলো! দুম্‌... সাইকেল গিয়ে ধাক্কা মারলো বেরার গায়ে আর আমরা দু’জন তখন মাটিতে মানে রাস্তায়। রে রে করে উঠলো মা। ভাবলাম যাক বাঁচা গেল আজ আর স্কুল যেতে হবে না। চিরকালই ভোর বেলার কাঁথামুড়ি দেওয়া ঘুমটা আমার ভীষণ প্রিয়। ওই সময় গুটিয়ে গালের তলায় হাত রেখে একটা ভাঙা ঘুমের শেষে আরেকটা ঘুম আর কল্পনার জগতে ভেসে থাকা ----- কি আনন্দ!

না, সেদিন আর সেই সুযোগ পাই নি। বাক্স হাতে সোজা স্কুল। এরপর একটু বড় হওয়া। বাপিকে ছাড়াই স্কুলে যাওয়া। ভেজার সুযোগ অনেক। কিন্তু, দুঃখের বিষয় বর্ষা দিনে সকাল, দুপুর বৃষ্টি হলেও ঠিক স্কুল টাইম দশটা বাজতেই বেশ একটা হাসিহাসি মুখ করে সূয্যিমামা টা টা করা শুরু করতো। ভীষণ রাগ হতো! না ভিজলে রেইনি ডে হবে কি করে? একটুও যদি হয় তবেই তো বাকি টা ম্যানেজ করা যাবে। ম্যানেজ মানে সোজা কলে গিয়ে স্কার্ট, জুতো-মোজা জল দিয়ে ভিজানো। তুমুল বৃষ্টির আশায় স্কুলে বসেই খাতার পাতা ছিঁড়ে নৌকা বানিয়ে জোড়ো করে রাখা। স্কুলের জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতাম মাঝ দুপুরে আকাশ ঝুলে পড়েছে মেঘের ভারে। মন কি তখন টিকতে পারে ঘরে? আস্তে আস্তে মেঘ ভারি হয়ে ঝরতে শুরু করে পৃথিবীর বুকে, আমার পিপাসাতো মেটেনা! সাদা হয়ে যাওয়া জলধারা মন কেড়ে নেয় বারবার। ক্লাসে তখন হয়তো ভুগোলের দিদিমণি বৃষ্টির উৎসই পড়াচ্ছেন। দেখতে দেখতে ক্লাসের দরজা দিয়ে গড়িয়ে আসতে থাকে জল। ক্লাসের ঘন্টা বাজলে দিদিমণি তখন ব্যজার মুখে শাড়ির কুঁচি হাঁটু সমান তুলে পা টিপে টিপে এগিয়ে চলেন অন্য ক্লাস ঘরের দিকে। বাড়ি ফেরার পথে হিংসে হতো ছেলে গুলোকে দেখে। মাঠের কাদায় জলে চুটিয়ে খেলছে সবাই। আমার তখন ইচ্ছে পূরণ রাস্তার খানাখন্দে জমা জলে ঝপাং লাফ দিয়ে। জমা জল দেখলেই নৌকা ভাসাতে ব্যকুল হয়ে ওঠা আমি অপেক্ষা করতাম ছুটির দিনের একটা তুমুল বৃষ্টি দুপুরের। সামনের বাঁধানো জায়গায় ক্ষণিক জমা জলে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে প্রতিবার কামনা করতাম নৌকার দীর্ঘায়ু। প্রতিবার নেতিয়ে পড়া নৌকা দেখে মন ভেঙে যেত! বর্ষা মানেই মায়ের গোমড়া মুখ। ঘর ভর্তি ভেজা জামা কাপড় নিয়ে মেঘবৃষ্টির সাথে পাল্লা দিতে দিতে অস্থির হয়ে উঠতো মা। বর্ষার মেঘ সরে যেতেই চকচকে ধোওয়া রোদ যখন বাগানে ফুলেদের গায়ে এসে পড়তো, দেখতাম রঙিন জিনিয়ারা একে একে মাথা তুলে পাঁপড়ি মেলতেই ঝাঁকঝাঁক প্রজাপতি আর ফড়িং এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো ফুলের গায়ে। ফড়িং গুলো দোল খেত কাপড় মেলার তারে, আর আমি তাদের মধ্যে খুঁজে বেড়াতেম লাল ফড়িং... সবাই বলতো ওটা নাকি রানী! 

স্রোতের মত বইতে থাকা সময়ের হাত ধরে একদিন পৌঁছে গেলাম বৃহত্তর জগতে, বাঁধন ভাঙার বয়সে। বহরমপুরে জর্জকোর্টের মোড়ে ন’টা বর্ষা কেটেছে দোতলার ছোট্ট ঘরে একটা নিজস্ব জানালার সাথে। সেবার প্রচন্ড বন্যা। ভাগীরথীর জল বিপদ সীমার উপর দিয়ে বইছে। জর্জকোটের মোড় ছাড়া বাকি শহরের বেশির ভাগ জায়গায় রাস্তা হাঁটুজল নিচে। সারাদিন অঝরধারায় ঝরে চলেছে বৃষ্টি। শৈশবের ইচ্ছা পূরণের আর তো কোনো বাঁধা নেই তখন। এক জুনিয়র কে নিয়ে ছাতা মাথায় বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। লালদীঘির জল রাস্তা ছাড়িয়ে গার্লস কলেজের প্রাচীরে ধাক্কা মারছে দেখে এলাম নিজের চোখে, দেখে এলাম ভাগীরথীর লাল জলের চোখ রাঙানি। রাস্তা থাকে হাত দেড়েক নিচ দিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বইছে সে। ভেসে যাচ্ছে কচুরিপানা, মৃত জীবজন্তু, মানুষের মৃতদেহ!

এরপর বৃষ্টি হলেই বেরিয়ে যেতাম ভিজতে ছাতা থাকতো লোককে দেখানোর জন্য। এমনই এক দিনে তুমুল বৃষ্টিতে বেরিয়েছি, ঘুরছি রাস্তায় রাস্তায় পাগোলের মত। কাকভেজা হয়ে ফিরতি পথে দাঁড়িয়ে আছি একটা দোকানের সামনে, বিকট আওয়াজে আকাশ ভেঙে পড়লো...... দেখলাম এক আগুনের গোলা হাত পঁচিশ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছটার গায়ে এসে পড়লো। নিমেষে ঝলসে গেল গাছ।

না, কোনো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞাতা বৃষ্টি থেকে আমাকে দূরে সরাতে পারেনি। বৃষ্টি হলেই ছুটে যেতাম হস্টেলের ছাদে। ভিজতাম আর ভিজতাম...খুব ভিজতাম...কখনও কিন্তু ঠান্ডা লাগেনি, জ্বরেও কাবু হইনি। একেই বলে বুঝি ভালোবাসা। আমার মত বৃষ্টিও বুঝি আমায় ভালো বেসেছে। জীবনের শত কাজের মাঝেও ভুলিনি বাঁচতে। এখনও সময় পেলে বৃষ্টি সকালে একলা বসে থাকতে ভীষণ ভালো লাগে। মেঘলা দুপুরে গোয়েন্দা গল্প হাতে চাদরের তলায় সময় কাটানো আমার বিলাসিতা, যা কখনো কখনো হয়তো পাই। আর ভেজা? আজও একই রকম আছি। এই তো সেদিন, ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে দুপুরে বাড়ি ফিরেই চুপি চুপি দোতলার ছাদে। ভিজলাম আবার ময়ূরের মত পেখমতুলে, নাচলাম, ছুটে বেরালাম ছাদের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে...একা, নিভৃতে আমার নিজের স্বপ্নের জগতে... তারপর একটা সেলফি আর ফেবুতে পোস্ট ...। কিছু আনন্দ যে মাঝে মাঝে ভাগ করে নিতে ভালো লাগে। ছেলেটাও ভিজতে চেয়েছিল, একটু রাগ দেখালো কেন আমি ওকে নিয়ে যায়নি! একদিন ভিজবো, আমি আর আমার ছোট্ট ছানাটা...কথা দিয়েছি ওকে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ