রুমকি রায় দত্ত

সাক্ষাৎকার






আলোকপর্ণার ঘুম লাগা চোখটা সামান্য কুঁচকে গেল। সরানো পর্দার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলোটা এসে পড়েছে ওর মুখের উপর। মুখে একটা উমম্‌ শব্দ করে পাশ ফিরে শুলো,হাঁটু দুটো গুটিয়ে উঠে এলো বুকের কাছে।চোখটা সামান্য ফাঁক করে,পিটপিট করে দেখলো পাশে শুয়ে থাকা অগ্নিপ্রভকে। সদ্য চল্লিশে পা রাখা এই মানুষটা যে রাতের অন্ধকারে সাতাশের যুবক হয়ে উঠতে পারে দেখলে মনে হয় না। ব্যক্তিত্বে ভরপুর এই মানুষটাকে দেখে ভীষণ দাম্ভিক মনে হয়।কিন্তু আলোকপর্ণা জানে ওর মধ্যে কতটা শৈশব লুকিয়ে আছে। আস্তে আস্তে ছোটো চোখের ফাঁকটা বড় হতে লাগলো। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে—ঠিক সরল,নিষ্পাপ শিশুটির মত লাগছে। ঘুমোলে ওকেও কি এমন স্নিগ্ধ দেখায়? —ভাবতে ভাবতে পাশে রাখা হাউজকোর্টটা গায়ে চাপায়।বিছানা থেকে নেমে স্লিপার পায়ে গলিয়ে ঘুরে আসে অগ্নিপ্রভর দিকে।কিসের টানে এই মানুষটাকে এত ভালোবাসে আলোকপর্ণা নিজেও জানে না। পায়ের কাছে জড়ো হয়ে থাকা চাদরটা দিয়ে ঢেকে দেয় অগ্নিপ্রভর অনাবৃত দেহটাকে।সামান্য ঝুঁকে ঠোঁট দুটো এগিয়ে আনে অগ্নিপ্রভর ঠোঁটের কাছে।কি ভেবে থেমে গিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায় ওর কপালে,চাদরের ফাঁক থেকে সামান্য বেড়িয়ে থাকা ওর আঙুলে।

বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে উপর-নিচ করে দাঁত ব্রাশ করতে করতে চোখ পড়ে সামনে টাঙানো আয়নাতে।সামান্য এগিয়ে এসে হাত বোলায় ঠোঁটে,চোয়ালের পিছনে কানের লতির নিচে। অগ্নিপ্রভর ভালোবাসার চিহ্ন।ব্যাথা নয়,গর্ব অনুভব করে আলোকপর্ণা।ওর মত সামান্য একজন সাংবাদিকের শরীরে অগ্নিপ্রভর মত সেলিব্রীটির আদরের দাগ বহন করার মধ্যেও একটা আলাদা তৃপ্তি রয়েছে। আবার আয়নার দিকে তাকায়,চোখ মেলায় নিজের প্রতিবম্বের চোখের সাথে।নিজেকেই নিজের হিংসা করতে ইচ্ছা করে। এমন কপাল ক’জনের হয়?—যাকে এক ঝলক দেখার জন্য লোক হত্যে দিয়ে বসে থাকে,যার স্বপ্ন বুকে নিয়ে কত মেয়ে রাত কাটায় সেই অগ্নিপ্রভর মনের অলিগলি শরীরের প্রতিটি খাঁজ,প্রতিটি ইঞ্চির পরিমাপ জানে এই আলোকপর্ণা মুখার্জি। দি গ্রেট জার্নালিস্ট আলোকপর্ণা---এখন মিসেস অগ্নিপ্রভ। আনন্দে লাফিয়ে ওঠে আলোকপর্ণা।ঈশ্বর শুধু ওকেই এমন সৌভাগ্য দিয়েছেন তা নয়,আরও একজন আছে, কিন্তু সে পারেনি ধরে রাখতে সৌভাগ্যকে।ওর এত রূপ-যৌবন কোনো কিছু দিয়েই সে অগ্নিপ্রভকে ধরে রাখতে পারেনি। আলোকপর্ণা জানে না কেন অগ্নিপ্রভ ওর কাছে আশ্রয় চেয়ে ছিল,কোনদিন জানতেও চায় নি।ওর জীবনের এখন একটায় সত্য অগ্নিপ্রভর অকৃত্রিম ভালবাসা। ভালবাসা ছিনিয়ে নেওয়ার যে তৃপ্তি,যে জয়ের আগুন আলোকপর্ণার চোখে জ্বলে উঠেছিল,যেন দপ্‌ করে নিমেষের মধ্যে সেটা নিভে গেল।কোথাও যেন মনে হয় আজও ঋতুর কাছে ও হেরে আছে। অগ্নির শরীরের গোপনীয়তার একমাত্র অধিকারিণী ও কোনো দিন ও হতে পারবে না।হতে পারবে না সেই নারী যে, প্রথম অগ্নিপ্রভকে নারী সঙ্গমের আস্বাদ দিয়েছিল।সারা জীবন দ্বিতীয়া হয়েই থেকে যাবে,অদ্বিতীয়া হয়ে ওঠা হবে না।

সুন্দর সকালটা হঠাৎ যেন কেমন ফিকে হতে থাকে।অগ্নির জন্য আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করে না। রান্না ঘরে গিয়ে বানিয়ে নেয় নিজের জন্য এককাপ কড়া লিকারের চা।ড্রইং রুমের দিকে পা বাড়াতেই বেজে ওঠে দরজার ঘন্টি। নিউজ পেপারটা হাতে নিয়ে এসে বসে সোফায়। চায়ের কাপে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে চলে যায় একেবারে শেষ পাতায়। দু’দিন আগের খেলার রিভিউটা আজ আবার দিয়েছে।ক্রিকেট ব্যাট হাতে অগ্নিপ্রভর একটা দুর্দান্ত ছবি। –মনে মনে বলে আমার অগ্নিপ্রভ,আলতো হাত বোলায় ছবিটাতে। টেনে নেয় শনিবারের বিশেষ পাতাটি। পাতার প্রথম অংশের প্রায় অর্ধেকটা জুড়ে জ্বলজ্বল করছে বিখ্যাত অভিনেত্রী অমিয়া দেবীর ছবি।তাঁর আশি বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে।

অমিয়া দেবীর জীবন কাহিনী প্রায় সকলেরই জানা। তবুও আলোকপর্ণা উৎসাহী হয়ে পড়তে লাগলো—

পত্রিকাঃ আজ আপনার আশি বছর পূর্ণ হলো,এখনও বেশ ইয়াং দেখায় আপনাকে। –এর পিছনে রহস্যটা কি বলবেন?

অমিয়া দেবীঃ ইয়াং--?—হা-হা-হা। এটা কিন্তু তোমাদের বাড়াবাড়ি। কোনো রহস্য নেই। আমি কিন্তু কোনো এন্টি এজিং ক্রিম মাখি না। রোজ সকালে খালি পেটে পরিমাণ মত জল খাওয়া,সামান্য হাঁটা আর যোগাসন। তবে, সত্যিই যদি তোমাদের আমাকে ইয়াং মনে হয় তাহলে বলবো সমস্ত কৃতিত্ব তোমাদের দাদার। মানুষটা চলে গেছে দীর্ঘ সময় হয়ে গেল কিন্তু আজও তাঁর স্মৃতি আমাকে প্রাণ শক্তি যোগায়।

পত্রিকাঃ দাদার প্রসঙ্গই যখন তুললেন তখন একটা কথা ভীষণ জানতে ইচ্ছা করছে। অভয় দেন তো প্রশ্নটা করি?

অমিয়া দেবীঃ হ্যাঁ, করো তবে। আজ আর কোনো কথা লুকানোর ইচ্ছা নেই।মন খুলে কথা বলবো বলেই তো তোমাদের সময় দিলাম।

পত্রিকাঃ তাহলে বলেই ফেলি।---আচ্ছা, সর্বজয় ব্যানার্জীর মত এত বড় মাপের মানুষ ও পরিচালক আপনার প্রেমের বাঁধনে বাঁধা পড়ল কি করে? —মানে গল্পটা যদি বলেন।

অমিয়া দেবীঃ প্রথমেই আমি তোমাদের একটু সংশোধন করে দিতে চাই।আমি তাকে বাঁধিনি, সে ধরা দিয়েছিল আমার কাছে। যদিও প্রশ্নটা ব্যক্তিগত,তবুও আমি বলছি শোনো।

পত্রিকাঃ কিছু মনে করবেন না,আমরা ঠিক সে ভাবে বলতে চাই নি। মানে আমরা শুধু আপনাদের প্রেমর কাহিনিটা জানতে চেয়ে ছিলাম।

অমিয়া দেবীঃ ঠিক আছে ঠিক আছে আমি কিছু মনে করিনি। –শোনো সে এক ঘটনা। তখন আমি চলচিত্র জগতে নবাগতা।সামান্য একটা অতিথি শিল্পী চরিত্র দিয়ে চলচিত্র জগতে আমার প্রবেশ।সর্বজয় তখন পরিচালক হিসাবে সফলতার শীর্ষে।আমার অভিনয় দক্ষতা তার চোখ এড়ালো না। আমি চান্স পেয়ে গেলাম তার নতুন ছবি “অজয় নদীর বাঁধ” সিনামায়,একে বারে কেন্দ্রীয় চরিত্র। রাশভারি,গম্ভীর মানুষটিকে সবাই ভীষণ ভয় পেত।কিন্তু স্যুটিং করতে করতে আমি টের পেয়েছিলাম,মানুষটা আসলে নারকেল,বাইরেই অমন শক্ত।ওঁর অন্তরে শিশু বাস করতো। প্রায় মাস খানেক ধরে দিনে রাতে শ্যুটিং চলছে। সবাই ভীষণ ক্লান্ত। স্যুটিং প্রায় শেষের দিকে,একদিন উনি স্যুটিং বন্ধ রেখে সবাই কে ছুটি দিলেন। আমরা সবাই সারাদিন মজা করে সন্ধ্যে বেলায় সবে বিশ্রাম নিচ্ছি,এমন সময় উনি এসে জানালেন,সেই মুহূর্তে স্যুটিং শুরু হবে। সবাই রেগে গেলেও মুখে কেউ কিছুই বলতে পারলো না। আমিও না। কিন্তু অনিচ্ছার প্রভাব পড়ল কাজে। উনি রেগে আমাকে সেট থেকে বার করে দিলেন। রাগে,অপমানে আমি তো তখন আগ্নেয়গিরির মত ফুঁসছি।

পরের দু’দিন আমাদের স্যুটিং বন্ধ থাকলো।সর্বজয়ের অসুস্থতার কারনে।ফুসফুসে ইনফেক্‌শন। সন্ধ্যে বেলায় দেখি বাংলোর লনে বসে স্ক্রিপ্ট দেখছে আর মুখে একটা সিগারেট ধরে সেটা লাইটার দিয়ে জ্বালানোর চেষ্টা করছে। দেখে ভীষণ রাগ হলো। মনে ভাবলাম,নিজের নিয়ম মানবে না অথচ সবাইকে দিয়ে নয়ম মানাবে। দু’দিন আগের অপমানের জ্বালাটা তখনও রয়েছে। জানি না কেমন করে মনে ভীষণ জোড় পেয়ে গেলাম। ছুটতে ছুটতে গিয়ে দাঁড়ালাম তাঁর সামনে।টান মেড়ে সিগারেটটা নিয়ে ফেলে দিয়ে বললাম, “আপনি ভীষণ গোঁয়ার। কারোর কথা শোনেন না,অথচ সবাই কে আপনার কথা শুনতে হবে। না হলে অপমান করবেন,তাড়িয়ে দেবেন। সব অধিকার কি শুধু আপনার? —আমরাও আপনার সহকর্মী,আপনাকেও আমাদের কথা শুনতে হবে”।

পত্রিকাঃ তারপর—তারপর কি হলো? —দারুণ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো।

অমিয়া দেবীঃ তারপর আর কি। আমি তো বলেই ভয়ে কাঁটা। ভাবলাম,কাজটা বুঝি গেল।কিন্তু উনি আমাকে আর্শ্চয্য করে অপলক নয়নে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার মুখের দিকে।তারপর উঠে চলে গেলেন নিজের ঘরে।

সেই শুরু বোধ হয়। এর পর কখন,কেমন করে উনি আমার জীবনে প্রবেশ করলেন টেরই পেলাম না।

পত্রিকাঃ তাহলে কি আপনার এই অধিকার বোধই তাঁকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছিল?

অমিয়া দেবীঃ জানি না, জানতেও চাই নি কখনও। তবে মাঝে মাঝে ইচ্ছা হত জানতে, কেন তিনি ঘর-পরিবার,নিজের স্ত্রী-সন্তানদের ত্যাগ করে চির তরে আমার কাছে চলে এসেছিলেন।পারিনি জিজ্ঞাসা করতে,পাছে তাকে দুঃখ দিয়ে ফেলি তাই নিজের ইচ্ছাকে দমন করেছি বারবার। তার সাথে চিরতরে চলে গেছে সে প্রশ্নের উত্তর।তবে অনুভব করেছিলাম মানুষটা ভিতর থেকে ভীষণ একা ছিল।

পত্রিকাঃ আচ্ছা,আপনার জীবনের সব থেকে আনন্দের মুহূর্ত কোনটি?

অমিয়া দেবীঃ যেদিন উনি আমাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েছিলেন।

পত্রিকাঃ আচ্ছা,এমন একটা কথা লোক মুখে শোনা যায় যে,সর্বজয় বাবু নাকি কোনো দিনই আপনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নি। তাহলে আপনি বলছেন এটা সম্পূর্ণ একটা মিথ্যা প্রচার?

অমিয়া দেবীঃ হ্যাঁ,অবশ্যই মিথ্যা। –কে বলেছে এসব বাজে কথা। –আমরা আমাদের কয়েকজন পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের সামনে বিয়েটা করেছিলাম।

পত্রিকাঃ সর্বজয় বাবুর প্রথম স্ত্রী জানতেন?

অমিয়া দেবীঃ হ্যাঁ, জানতেন।তাকে জানিয়েই আমরা বিয়ে করি।

পত্রিকাঃ এই বয়সেও যে এতক্ষণ আমাদের সাথে বসে কথা বললেন,এর জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। শুধু একটা শেষ প্রশ্ন। জানতে ভীষণ ইচ্ছা করছে।আপনার জীবনের সবথেকে আনন্দের মুহূর্ত তো জানলাম।এমন কিছু কি আছে ,যা আপনাকে আজও পীড়িত করে? 

অমিয়া দেবীঃ যখন কেউ বলে আমি সর্বজয়ের ঘর ভেঙেছি। ---আসলে কি জান—‘মানুষটার ঘর ভাঙায় ছিল। আমি শুধু তাকে আমার ঘরে আশ্রয় দিয়েছিলাম’।

[২]

সাক্ষাৎকার কখন ফুরিয়ে গেছে। আলোকপর্ণা চেয়ে আছে অমিয়া দেবীর ছবিটার দিকে। কোথায় যেন একটা একাত্মতা অনুভব করছে।নিজের অজান্তেই যেন মিলিয়ে দেখতে শুরু করেছে নিজেকে। সব আলোকপর্ণা-অমিয়াদের বোধ হয় এখানেই মিল। সাত বছর হয়ে গেছে অগ্নিপ্রভর সঙ্গে সংসার করছে। কখনও সত্যটা জানার চেষ্টা করেনি।এলো মেলো ভাবনা গুলো চেপে বসার আগেই উঠে পড়ে সোফা থেকে। দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে বাইরে।নভেম্বরের শেষ,শিশির ভেজা ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করে। যত্ন করে সাজানো বাগান। অগ্নিপ্রভর সঙ্গে সংসারটা এই বাংলো থেকেই শুরু। অযত্ন লালিত এই বাংলোটা আগের মালিক বেশ সস্তায় বিক্রি করে ছিল।একদিন যে বাংলো মাথায় ছাদের নিশ্চয়তা দিয়েছিল, দিয়েছিল একবুক আনন্দ সেই বাংলো ছেড়ে তার আগের মালিক কেন চলে গেল সে প্রশ্নের উত্তর কেউ খোঁজে না।কেউ সেটা নিয়ে নিন্দে করে না।যত কাটা ছেঁড়া ওদের মত অমিয়াদের নিয়েই।এই দ্বিতীয়া চরিত্ররা সারাজীবন সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানের চোখে অপরাধী হয়েই থেকে গেল।সাত-পাঁচ ভাবনার মাঝেই শুনতে পেল ঘর থেকে ভেসে আসছে জগজিৎ সিং এর গজল—আলোকপর্ণার প্রিয় সেই গান—“কিসকা চেহেরা দেঁখু তেরা চেহেরা দেখকর/মেরি আঁখো নে ঢুন্ডা হ্যায় তুঝকো দুনিয়া দেখকর”। অন্যদিন হলে ছুটে গিয়ে অগ্নিকে জড়িয়ে ধরতো।আজ ধীর পায়ে ঘরে ঢোকে। সবে বাইরের ম্যাচটা শেষ করে কাল রাতেই ঘরে ফিরেছে অগ্নিপ্রভ। দীর্ঘদিন বাড়িতে না থাকার পর অগ্নিপ্রভ বাড়ি ফিরলে আলোকপর্ণা ছুটি নেয়,দুজনে এক সঙ্গে সময় কাটায়। আজ ওর মনটা অন্য রকম কিছু চাইছে। সোফায় আধশোয়া হয়ে শুয়ে থাকা অগ্নির চুলে আঙুল চালায়।অগ্নির জন্য গরম এককাপ কফি এনে বাথরুমের দিকে পা বাড়াতেই হাতটা টেনে ধরে অগ্নি।বলে-‘ পর্ণা, আজ ছুটি নাওনি? —আমি বাড়ি এলাম আর তুমি অফিস যাচ্ছ’?

আলোকপর্ণা হাল্কা করে হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে বলে, ‘আজ ভীষণ জরুরী কাজ আছে অফিসে,প্লিজ মনখারাপ করো না।তাড়াতাড়ি চলে আসবো’।এর আগে কোনো দিনও অগ্নিকে মিথ্যা বলেনি।কিন্তু আজ বলল। ওই অমিয়া দেবী যেন আজ ওর মনের সব শান্তি হরণ করে নিয়েছে। একটা সাক্ষাৎকার তোলপাড় তুলেছে ওর মন জুড়ে,যার উত্তর শুধু দিতে পারে অগ্নি। অগ্নি কেন এসেছিল ওর কাছে? --- মন জুড়ে হাজার প্রশ্ন উড়ে বেড়াচ্ছে। এলোমেলো ভাবনা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। সেলিব্রীটির বৌ হয়েও নিজেকে সাধারণ রাখতেই ভালোবাসে আলোকপর্ণা।ওর প্রফেশনও সেটাই ডিমান্ড করে। তবে কি ওর অবচেতন মন লুকাতে চায় সমাজের চোখ থেকে। আজ এত সব প্রশ্ন কেন উঁকি দিচ্ছে ভাবতে ভাবতে উঠে বসে বাসে। এখানেও নিস্তার নেই। অমিয়া দেবীর সাক্ষাৎকার পড়তে পড়তে পাশে বসা লোকটা ওর দিকে তাকাতেই কেমন যেন শিরশির করে ওর লোমকুপের গোঁড়া। যেন মনে হয় লোকটার চোখে ওর জন্যে করুণা,মনে সেই এক প্রশ্ন। লোকটা কি অমিয়া দেবীর মত ওকেও অগ্নিপ্রভর ঘর ভাঙারা জন্য দায়ী মনে করছে! লোকটা মাথা ঘুরিয়ে নিতেই যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিতে চেষ্টা করলো। অগ্নির কাছে জানতেই হবে কেন ঋতুকে ছেড়ে ওর কাছে এসেছিল।এটা ওর নিজের জন্য জানা প্রয়োজন। প্রথম প্রথম যে অপরাধ বোধটা কাজ করতো সেটা,যেন আবার জেগে উঠছে। ও অমিয়া দেবীর মত সারাজীবন ঘর ভাঙার দায় বহন করতে পারবেনা।এই দিনটা আসার আগেই একটা যোগ্য জবাব খুঁজে নিতে হবে ওকে। সমাজের জন্য না হোক নিজের জন্য। অমিয়া দেবী যতই আজ গলা ফাটিয়ে বলুন না কেন ঘর ভাঙা মানুষটাকে তিনি শুধু আশ্রয় দিয়েছিলেন,আসল কারণটা অজানা বলে কেউ তা মন থেকে মেনে নেবে না।নিজের চোখে ছোটো হয়ে ও কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারবেনা। কেন অগ্নি ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কটা আজও সম্পূর্ণ ছিন্ন করতে পারলো না? সর্বজয় ব্যানার্জি ও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার প্রথমা স্ত্রীর সাথে সম্পর্কটা খাতায় কলমে শেষ করতে পারেন নি। পারেন নি না চান নি সে কথা কেউ জানে না।বাস থেকে নেমেই ঢুকে পড়ে অফিসে। কাঁচের দরজার বাইরে থেকেই দেখতে পায় ভিতরে সবাই একজোটে ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছে। দরজা খুলে ঢুকতেই কেমন যেন আড়ষ্ঠ লাগে ওর। এদিক-ওদিক ঝুঁকে বোঝার চেষ্টা করে শনিবারের পাতা কিনা। কারোর সাথে চোখাচোখি হওয়ার আগেই দ্রুত পা চালায় নিজের কেবিনে। নিজের ডেস্কে বসে।

—মনে পরে অগ্নির সাথে প্রথম দেখার কথাটা।অগ্নির বাংলোর পাঁচিল টপকে ঢুকে পড়েছিল সাংবাদিক আলোকপর্ণা। সামনে বড় হওয়ার স্বপ্ন।ছোট্ট একটা সদ্য গজিয়ে ওঠা সংবাদ পত্রের সাংবাদিক যে, সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য বিবেচ্য হবেনা,এটা জেনেই আলোকপর্ণা বেঁছে নিয়েছিল এইপথ।ছোট্ট একটা পাঁচ লাইনের সাক্ষৎকার বদলে দিয়েছিল আলোকপর্ণার জীবন পথ। অফিসে পদোন্নতি আর সেখান থেকেই বোধ হয় শুরু অগ্নির জীবনে প্রবেশ। সারাদিন এক অদ্ভূত অস্থিরতার স্রোত বুকে বয়ে ক্লান্ত লাগে আলোকপর্ণার। পশ্চিমের জানালা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে লাল আলো।খানিক বাদেই জেগে উঠবে অন্ধকারের রূপকথারা। আলোকপর্ণা বেড়িয়ে পড়ে অফিস থেকে। শ্লথ-ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে বসে ঝিলপাড়ে। টলটলে জলে চাঁদের আলো,আলোকপর্ণা এমন ভাবে তাকায় যেন এতদিন চোখেই পড়েনি কলঙ্কের দাগ গুলো। নিভৃত-নির্জন যেন মনে করায় সব উত্তর লুকিয়ে আছে নিজের কাছে, প্রয়োজন একটা একান্ত সাক্ষাৎকার। আলোকপর্ণা নিজের মনকে খনন করতে করতে ঝুঁকে পড়ে দেখতে থাকে জলের উপর তিরতির করে কাঁপতে থাকা নিজের আধো-আলো প্রতিবিম্বকে। চলতে থাকে এক একান্ত সাক্ষাৎকার সাংবাদিক আলোকপর্ণার সাথে মিসেস অগ্নিপ্রভ আলোকপর্নার।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ