রুমকি রায় দত্ত

 দেওঘর, বৈদ্যনাথ আর আমরা দুজনঃ
আষাঢ় মাসের শেষ চলছে, ঘনঘোর বর্ষা তখন। সালটা ২০০৮, সবে ফেব্রুয়ারিতে সিমলা ঘুরে এসেছি, অপেক্ষায় আছি আগামি ফেব্রুয়ারির, পারি দেব দুজনে অন্য কোথাও। কিন্তু বর্ষা এলেই মন যে পাগল হয়ে ওঠে। ঘরে বেঁধে রাখা যায়না...। রোজ আকাশে দেখি মেঘেদের ভেসে চলা,আমিও ভেসে যায় মনে মনে। মেঘ দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ পড়লো ক্যালেন্ডারের পাতায়। স্বাধীনতা দিবসের হাত ধরে আমিও তো মেলে দিতে পারি পাখা, শনিবার ১৫ই আগস্ট,মানে দু’দিন ছুটি। কোথায় যাবো? 

...কাছাকাছি, হাতের কাছে সাপ্তাহিক বর্তমান, দেখলাম দেওঘরের ছবি দেওয়া। ঠিক করলাম, ওখানেই যাব। ১৪ তারিখ রাতের ট্রেন, ঠিক তিনটের দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম যশিডি স্টেশনে।এখান থেকে অটোতে যেতে হবে দেওঘর। যেহেতু রাত থাকতেই পৌঁছাবো তাই ওই বই দেখে একটা হোটেল আগের থেকেই ঠিক করে রাখা ছিল। তখনও বেশ রাত, আমরা হোটেলে পৌঁছে তো অবাক ...এতো হোটেল নয়, একটা লজ মতো, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। নাহ্‌, কোনো মতেই সেখানে থাকা ঠিক হবে না, কিন্তু উপায় কি? ...অচেনা জায়গা, রাতটুকু কেটে দিনের আলো না ফুটলে তো দ্বিতীয় ভাবনা চিন্তারও কোনো উপায় নেই। হঠাৎ সামনেই দেখলাম একটা হোটেল, আশা নিয়ে সেখানে যেতেই বুঝলাম ঘর পাওয়া সম্ভব নয়,... এহেন যুবক-যুবতিকে কেও ঘর দিতে সাহস করছে না। রাস্তা প্রায় নির্জন, দু’একটা কুকুর ঘুরছে, মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে। গোটা চারেক লোক অদ্ভূত ভঙ্গিতে, চলাফেরা করছে। দামি কিছু সঙ্গে না থাক, প্রাণটাতো আছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটাও তারা নেই। মাথার উপর থমথমে আকাশ, একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের আলোর আঁধারের সাথে লুকোচুরি খেলা। অদ্ভুত একটা অজানা ভয় যেন তখন ক্রমশ গ্রাস করছে, ঠিক তখনই জেগে বসলো এক অটোওয়ালা। জিজ্ঞাসা করলো কোথায় যাব আমরা। হোটেল খুঁজছি জেনে বেশ হতাশ হয়ে জানালো ‘ মিলনা মুশকিল হ্যায়। আভি তো সিজন চলরাহা হ্যায় না’। তারপর কি ভেবে বললো ‘ ঠিক হ্যায় বইঠিয়ে, দেখতে হ্যায়, এক জাগা হ্যায়, শহর সে থোরা দূর’। আমরা বলে উঠলাম, ‘চলেগা’।

এরপর ওই অচেনা অটোওয়ালার উপর ভরসা করে আমরা এক হোটেল থেকে অন্য হোটেল ছুটে বেরাতে লাগলাম, কখন যেন ভোর হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। দিনের আলো ফুটে উঠতেই মনে তখন অনেক সাহস। ঘুরতে ঘুরতে তখন এসে পড়েছি একেবারে শহরের মাঝখানে ‘টাওয়ার চকে’। সামনেই বিশাল বড় হোটেল ‘যাত্রিক’। অবশেষে অনেক কথা খরচের পর একটা আস্তানা জোটায় মনে একরাশ শান্তি। ভোরটুকু একটু সুখ নিদ্রায় কাটিয়ে ঠিক দশটার দিকে বেরোলাম দেওঘরের একটি অন্যতম স্থান ‘ ত্রিকুট পাহাড়’ দেখতে। টাওয়ার চক থেকেই ওই স্থানে যাওয়ার জন্য বিভিন্ন গাড়ি পাওয়া যায়। অটো বা গাড়িতে গেলে কম সময় লাগে...। তবে যাত্রার একটু অন্য আনন্দ নেবো বলে আমরা ৩০০ টাকায় একটা ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করলাম। যদিও প্রায় এক ঘন্টার বেশি সময় নেবে তবুও এ যাত্রার এক অদ্ভূত তৃপ্তি আছে। গাড়ি ছুটে চললো আর আমরা চালক রাম দাসের সাথে কথা বলতে বলতে ছুটে চললাম সেই দূর অজানা পাহাড়ের কাছে। মাঝে শুয়ে কালো পিচের রাস্তা। দু’পাশে আমাদের সাথেই ছুটে চলেছে সবুজ ঘাসের মাঠ, ঝোপঝাড়। কোথাও আবার পাথরের ঢিবির মত,দূর থেকে দেখে মনে হয়, যেন পাহাড়। ঘোড়াগাড়ি ছুটে চলেছে আর আমাদের চোখে যেন এক অদ্ভূত খোঁজ লেগে রয়েছে, এই বুঝি দেখব ত্রিকুট পাহাড়ের চূড়া। দূরপথে এভাবে দৃষ্টি বিছিয়ে যখন আমরা ছুটে চলেছি, হঠাৎই নজরে এলো এবড়োখেবড়ো পাথরের সারি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে চেয়ে।

রাম দাস বললেন, ও-ও দেখিয়ে, ‘তিরিকূত পাহাড়’। মনটা আনন্দের ঝলমল করে উঠলো......


ক্রমশ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ