নানা রঙে সাদা ক্যানভাসে ছবিগুলি স্পষ্ট হচ্ছে ক্রমশ....
ট্রেনের জানলায় মাথা রেখে সুজন দেখছে শিল্পীর দক্ষতায় ব্যস্ত বোলপুর স্টেশনের একটুকরো ছবি কীভাবে চিত্রিত হচ্ছে। এইসব শিল্পীরা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাঝে মাঝে স্টেশন চত্বরে এসে স্টেশন চত্বরের টুকরো টুকরো ছবি অঙ্কন করে। সুজনেরও অনেকদিনের শখ ছবি আঁকার। কিন্তু আর্থিক দুরাবস্থার কারণে তা হয়ে ওঠেনি। পূজার ছুটিতে বাড়ি রওনা হওয়ার সময় স্টেশনের চিত্র তার মনখারাপ করে দিল।
সুজন সুদূর সেহারাবাজার থেকে শান্তিনিকেতনে একটি বেসরকারি বি.এড. কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়ার ইচ্ছা না থাকলেও তার বাবার ইচ্ছা সে শিক্ষকতা করুক। তাই বি.এড. কলেজে তাকে ভর্তি করেছে। তবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার বেহালদশার রঙ সুজনকেও রাঙিয়েছে। ফাঁকি দিয়ে পড়াশোনা করে সে আজ পর্যন্ত পাশ করে এসেছে। এখন বি.এড.-এও সে ফাঁকি দিচ্ছে। কলেজের সময় ছাড়া সারাদিন শান্তিনিকেতন ঘুরে বেড়ানোই তার কাজ। তার মনে হয় যদি সে আঁকতে পারত তাহলে আজ এই শিল্পীদের মতোই সেও বসে রঙে রঙে শূন্য ক্যানভাসকে ভরিয়ে তুলত।
জীবনের এই অপ্রাপ্তির ভাবনায় চোখ ছলছল করে ওঠে। নিজের দক্ষতাকে কখনো যাচাই করে দেখেনি সে। বরং বাবার আর্থিক নিরুপায়তার কথা চিন্তা না করেই বাবার প্রতি রাগ হয়- কেন বাবা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পড়াচ্ছে? গালে হাত রেখে সে আরও ভালো করে দেখে শিল্পীর তুলির টান।
একটা ঝাঁকুনিতে সুজনের আনমনা ভাব কাটল। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসের রেল-ইঞ্জিনটি পরিবর্তন করা হল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছাড়বে। পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে নেয়। ঠিক তখনই একটি কম্পমান আঙুলের স্পর্শে ঘুরে তাকায়- একটি বৃদ্ধ মানুষ হাত বাড়িয়ে ভিক্ষা চাইছে,"একটা পয়সা দেনা, বাবা!"
পকেট থেকে দু'টাকার একটি কয়েন বের করে তার হাতে দেয়। অনাহারে ক্লিষ্টবসেই বৃদ্ধটি লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে পিছনের দিকে এগিয়ে যায়। পূজার আনন্দের মাঝে এই করুণ মুখ প্রচারের বাইরেই রয়ে যায়। ট্রেনের হুইসেল বেজে ওঠে।
"দাদা, কেমন আছেন? আর ক'দিন এভাবে নাতিকে পড়াবেন? মৃত্যুকালে নাতি দেখবে তো? নাতি জানে আপনি ভিক্ষা করেন?"
এইরকম প্রশ্নে সুজন ঘুরে তাকায়। সে দেখে অন্য একটি বৃদ্ধ সেই বৃদ্ধটিকে জিজ্ঞাসা করছে।
মৃদু হেসে বৃদ্ধটি প্রত্যুত্তরে বলে,"আমার কর্তব্য আমি করে যাই!"
"এখন নাতি কীসে পড়ে?"
"ভূগোলে এম.এস.সি.!"
সুজন চমকে ওঠে। গল্প শুনেছে সে। কিন্তু এভাবে কষ্ট করে, ভিক্ষা করে নাতিকে পড়াশোনা করানোর বাস্তব চরিত্র দেখেনি। ত্যাগের এই রূপ দেখে স্থির হয়ে যায়। তুলির রঙকে ফ্যাকাসে করে বৃদ্ধের মুখটি স্পষ্ট হয়।
ট্রেন ছেড়ে দেয়। ধীরে ধীরে স্টেশনের এই টুকরো ছবিগুলিকে অতিক্রান্ত করে ট্রেনের গতি বৃদ্ধি পায়। ক্রমশ দূরত্ব বৃদ্ধি সত্ত্বেও বৃদ্ধটির ঠোঁট
নাড়ার দৃশ্য ঘনিষ্ঠ হয়। তারই পাশে বাবার পরিশ্রান্ত মুখচ্ছবি বারেবারে সুজনকে ঠোকরায়। আর ট্রেনের চাকাগুলি পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়া মূহূর্তগুলিকে কর্কশ শব্দে রেলপাতে পিষে দেয়।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন