বিদিশা চক্রবর্তী

লালন ও মানবতাবাদ

ঠিক এই মূহুর্তে জলসংকট কিম্বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নয়, বরং সভ্যতার সবচেয়ে বড়ো সংকট হলো ধর্ম। ধারণ করার বদলে যা আমাদের হিংসার ললিত বাণীর সহজপাঠ শেখাচ্ছে। কেউ বা দিচ্ছে ওপেন চ্যালেঞ্জ, কেউ নিজেকে আড়ালে রেখে শেখাচ্ছেন কচুকাটা করার ব্যকরণ। এই অঘোষিত বিশ্বযুদ্ধে না চাইতেই সামিল আমরা সবাই।

চারিদিকে এত বিশৃঙ্খলা, হিংসা আর মারামারির মধ্যে বসে আমরা ভুলেই যেতে বসেছি মানুষ হিসাবে আমাদের প্রথম আত্মপ্রকাশ এর কথা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ হিসাবে আমাদের অবস্থান।

জীবনবিজ্ঞানে পড়েছিলাম, জীবকূল দুভাগে বিভক্ত - উদ্ভিদ ও প্রাণী। মানুষ, গরু ও শূকর ঐ একই শ্রেণীতে পড়ে। তারপর বড় হয়ে জানলাম মানুষ দুরকম, হিন্দু আর মুসলিম। কেউ কেউ বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ইত্যাদিও আছে। তারপর সংবাদপত্র খুলতেই অনেক রক্ত পেলাম। নিজেকে শুধু একটা প্রাণী হিসাবে কল্পনা করলে এসব রক্তের কারনগুলো বড্ড অবাক করে। আরো বেশি বেশি উপলব্ধি হয় ধর্মের অসাড়তা আর মানবতাবাদের প্রয়োজনীয়তা।

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাক-সক্রেটীয় দার্শনিক থেলিস এবং ক্সোনোফানিজ প্রথম উপলব্ধি করেন ধর্মের গোঁড়ামির বদলে মানবতাবাদের প্রয়োজনীয়তার কথা। তাঁরা দুজনেই পুরাণ (গ্রীক) ও প্রথার সাহায্য ছাড়া স্রেফ যুক্তি দিয়ে বস্তুজগৎ কে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস নেন। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে মানবতাবাদের শুরু তখন থেকেই। থেলিস নরাত্মারূপী ঈশ্বরের ধারণাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন এবং ফানিজ তাঁর সময়কার ঈশ্বরদের প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

মানবতাবাদের প্রধান লক্ষ্য হল মানুষের মানবিকতার পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে অন্যসব অনুভবক্ষম প্রাণী তথা জগতের মংগল করা। নিজের মধ্যে মানবিকতাবোধ জাগ্রত না হলে মানবতাবাদ উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। যে নিজকে মানুষ হিসাবে চেনে না সে অন্যের বাহ্যিক আবরণ ও আভরণ দিয়েই মানুষের জাতবিচার করবে এটাই স্বাভাবিক।

রাষ্ট্র বা সমাজের বেঁধে দেওয়া ছক অনুসারে যারা আচরণ করতে পারেনা,তাদের আমরা 'সমাজবিরোধী', 'অসামাজিক' কখনো কখনো 'লোকটা বেশি ভাও খায়' আখ্যা দিয়ে থাকি। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় পৃথিবীর সকল মহাপুরুষকেই তাঁর প্রচেষ্টার জন্য সমাজের তীব্র বিরোধ, অসহযোগীতা, সমালোচনা এমনকি প্রাণনাশের হুমকির সামনেও পড়তে হয়েছিল। তেমনি লালন নামে এই মহাপুরুষের দেখা আমরা পেয়েছিলাম রবীন্দ্রোত্তর যুগে। যিনি অকুতোভয়ে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মানবতাবাদের প্রথম পাঠ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বাউল ফকিরের বেশে।

বাংলার বাউল সংস্কৃতি হল, লোকগানের মধ্যে দিয়ে কাব্যিক অভিব্যক্তিসহ দেহের অভ্যন্তরে বাসকারী পরমাত্মা ( সৃষ্টিকর্তা) কে জানা ও তাঁর মধ্যে লীন হওয়ার আকুতি প্রকাশের সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতির সবচেয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সন্দেহাতীতভাবে লালন ফকির, যিনি একাধারে একজন আধ্যাত্মিক বাউল সাধক, মানবতাবাদী, সমাজসংস্কারক, দার্শনিক, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক তো বটেই।

আমেরিকার সংগীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক ব্যঞ্জনা সৃষ্টির জন্য সম্প্রতি নোবেল পেলেন রবার্ট জিমারম্যান ( বব ডিলান নামেই সমধিক পরিচিত)। আমেরিকার লোকসংগীতের কাব্যময় উপস্থাপনাই শুধু নয়, বিগত কয়েক দশকের প্রাচীণ অলিখিত লোকসংস্কৃতির ইতিহাস এবং আমাদের সমাজের মৌলিক ভাবনার বিষয়গুলো আবার নতুন করে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। মানুষকে আবার ভাবার প্রেরণা জুগিয়েছে লোকগান আর লোকগাথার মর্মকথা সম্পর্কে। ডিলানের নোবেলপ্রাপ্তি আবারও মানবতাবাদী লালনের প্রাসঙ্গিকতা স্মরণ করিয়ে দিল।

লালনের জীবনী সম্পর্কে বলতে যাওয়া বোধহয় বাতুলতা মাত্র। লালনের গানগুলো ছিল- আধ্যাত্মিক ( মিলন হবে কত দিনে), সামাজিক ( বিষয় বিষে চঞ্চল মন দিবা রজনী), এবং রাজনৈতিক (এসব দেখি কানার হাটবাজার) বৈশিষ্টমন্ডিত। তিনিই সম্ভবত এক ও একমাত্র মহাপুরুষ (মহান পুরুষ অর্থে) যাঁর অনুপ্রেরণা তিনি নিজেই অর্থাৎ তাঁর জীবনাচরণ থেকেই তিনি নিজের আদর্শ খুঁজে নিয়েছেন। জীবনকেই বানিয়েছেন তাঁর দর্শন।

ভাবতে অবাক লাগে, তিনশো বছর আগে এক লোক আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন, এমন একটা দিন আসা উচিৎ যেদিন হিন্দু-মুসলিম বলে কিছু থাকবে না।

" এমন মানবসমাজ কবে হবে গো সৃজন..."

এমন একজন লোক যাঁকে জীবদ্দশায় কখোনো ধর্মাচরণ করতে দেখা যায় নি অথচ মুসলিম ও হিন্দু শাস্ত্রে ছিল তাঁর সমান জ্ঞান।

" অনাদির আদি শ্রীকৃষ্ণ নিধি..."
"ইবলিশের সেজদার ঠাঁই ছেড়ে..."

তিনি বিশ্বাস করতেন, সকল মানুষের মাঝে বাস করে এক মনের মানুষ ( আত্নার মধ্যে পরমাত্মার অবস্থান)। যে মনের মানুষের ধর্ম-বর্ণ-জাত-লিংগ-কূল নেই। 

" বাড়ির কাছে আরশিনগর,
সেথা এক পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখলাম তারে..."

এই অদৃশ্য মনের মানুষের সাথে দৃশ্যমান মানুষের মিলনের আকুতি আদি ও অনন্ত।

"মিলন হবে কত দিনে..."
" আমি কোন সাধনে তারে পাই..."
"আমি চরণ পাবো কোনদিনে..."

লালনের এই ভাবধারাকে কোনো ধর্মীয় আদর্শের ছাঁচেই ফেলা সম্ভব নয়। তাঁর সমসাময়িক গ্রামীণ সমাজ যেমন একদিকে জাতপাত, শ্রেণীবৈষম্য, অশিক্ষা-কুশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আকুপাকু করছিল; অন্যদিকে জমিদারী শাসন শোষণে জর্জরিত সমাজে ক্রমবর্ধমান সামাজিক পীড়ণ পুরো সমাজটাকে বিষিয়ে তুলেছিল। এই রকম একটা ক্রান্তিলগ্নে সাম্যবাদের পতাকা হাতে এবং মানবতার জয়গান কণ্ঠে আবির্ভাব হয়েছিল লালনের।

তিনি একজন তথাকথিত ফকির সন্ন্যাসীর মত সমাজ-সংসারবিমুখ ছিলেন না; বরং আমরা তাঁকে পাই রীতিমতো সচেতন একজন সমাজকর্মী হিসাবে। সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষেরা যখন জাতপাতের করাল গ্রাসে পড়ে মুক্তির আশায় প্রহর গুনছিল তখন লালন শাহ তাঁদের দিকে আলিঙ্গনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই স্বভাবতই তাঁর জীবনদর্শন জুড়ে শুধুই মানুষের জয়গান, মানবমুক্তির আকুতি।

" মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
নইলে পরে ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি..."
" মানুষ ছাড়া মন রে আমার 
দেখবি সব অন্ধকার..."

মানুষের জয়গান গাইতে গিয়ে তিনি মানুষ ও ঈশ্বরকে একাকার করে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের 'দেবতারে প্রিয় করি,প্রিয়েরে দেবতা' এর মতো। লালনের মতে, ঈশ্বর যদি থেকেই থাকে তবে এই মানুষের মধ্যেই আছে। কোনো দেবস্থানে বা ধর্মগ্রন্থে নয়।

"এই মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষরতন
লালন বলে পেয়ে সে ধন
না পাই চিনিতে।।"

আজ যখন মানুষে মানুষে বিভেদের কঠিন প্রাচীরে ধর্মীয় রিচুয়ালস এর পলেস্তারা লাগাতে ব্যস্ত আধুনিক মানুষ, কি হিন্দু কি মুসলিম উভয় সমাজেই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ভেদাভেদের সীমারেখা টেনে বিস্তৃত করার নোংরা প্রতিযোগীতায় ব্যস্ত ধর্মের শীর্ষস্থানীয়রা তখন এই পুরাতন ফকিরটির দৃপ্তকণ্ঠ, তাঁর গানের কলিগুলি কি কিছুই ভাবায় না?? 

সমাজের অসম শ্রেণীবৈষম্যকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে মানবতার মহামন্ত্র নিয়ে এই একা লোকটির তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ একটুও কি লজ্জায় ফেলে না আমাদের?? 

"আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে।
কি জাত হবা যাবার কালে
সেই কথা ভেবে বলো না।।

ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি
এক জলে সব হয় গো শুচি।
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না।।

গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়।"
"যদি সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীর তরে কি হয় বিধান
ব্রাহ্মণ চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনী চিনি কি রূপে..."

জাতপাতের নামে এই শ্রেণীবৈষম্যকে তিনি এতটাই ঘৃণা করতেন যে, তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন-

"জাত না গেলে পাইনে হরি
কি ছার জাতের গৌরব হরি
ছুঁসনে বলিয়ে;
লালন কয় জাত হাতে পেলে
পোড়াতাম আগুন দিয়ে..."

হিন্দু কি যবন বলে জাতের বিচার নাই।।

ভক্ত কবির জেতে জোলা
শুদ্ধ ভক্তি মাতোয়ালা।
ধরেছে সেই ব্রজের কালা
দিয়ে সর্বস্ব ধন তাই।।

রামদাস মুচি ভবের পরে
ভক্তির বল সদাই করে।
সেবায় স্বর্গে ঘণ্টা পড়ে
সাধুর মুখে শুনতে পাই।।

এক চাঁদে হয় জগৎ আলো
এক বীজে সব জন্ম হলো।
লালন বলে মিছে কলহ
ভবে দেখতে পাই।।

পৃথিবীর সব ধর্মই মানবতার কথা বলে। পুরাণ-বাইবেল-কোরাণে যেটুকু অনৈক্য তা শুধুই মানুষের উদ্দ্যেশ্যপ্রণোদিত ব্যাখ্যা। যেটুকু বিরোধ তা সমাজের মাথাদের সৃষ্টি। তাই তো তিনি বলেন-

"যদি একই আল্লার হয় রচনা
তাতে তো ভিন্ন থাকেনা
মানুষের সকল রচনা
তাইতে ভিন্ন হয়।

এক এক দেশের এক এক বাণী
পাঠান কি সাঁই গুণমণি
মানুষের রচিত জানি
লালন ফকির কয়।।

লালনের এই প্রগতিবাদী সমাজচিন্তা তাঁর সময়ের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকার প্রমাণ। তাঁর কালজয়ী চিন্তাভাবনা শোষিত ও বঞ্চিত মানবজাতির মনে নতুন প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাদের আত্মবিশ্বাস অনেকাংশে বাড়িয়ে তুলেছিল। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বহু মানুষ তাঁর অনুগামী হয়েছিলেন এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। শোনা যায় তাঁর শিষ্যের সংখ্যা দশ হাজার ছাড়িয়েছিল।

তাঁর এই তুমুল জনপ্রিয়তা স্বভাবতই কিছু মানুষের ভালো লাগেনি। শুরু হয় লেখনীর মাধ্যমে তাঁকে আক্রমণ ও তাঁর চরিত্র কলংকিত করার নোংরা প্রয়াস। কিন্তু যে মানুষ পরকালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করার ক্ষমতা রাখেন তিনি কি স্বর্গপ্রাপ্তির লোভ দেখানো সমাজপতি, ধর্মব্যবসায়ীদের বিদ্রুপের কাছে মাথা নোয়ান?

" মলে পাব বেহেস্তখানা
তা শুনে তো মন মানে না
বাকির লোভে নগদ পাওনা
কে ছাড়ে ভুবনে..."

লালন শুধু বাউল সম্রাটই নন,তিনি উনিশ শতকের মানবতাবাদের অগ্রদূতও বটে। মনের খেয়ালে সুর বা গান রচনা করাই নয়, তিনি যে সাহসিকতার সংগে তৎকালীন সমাজের অবক্ষয় ও কুসংস্কার গুলির বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন তা ভাবতেও অবাক লাগে। আরআজ আধুনিক ছেলেমেয়েরা লালনের কীর্তিকলাপ গুলি সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াশোনা ও গবেষণা করছে।

পরিশেষে আবারো গুরুদেবের শরণাপন্ন হই-

"লালন ফকির নামে একজন বাউল সাধক হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন ধর্মের সমন্বয় করে কি যেন একটা বলতে চেয়েছেন- আমাদের সবারই সেদিকে মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।"




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ