বরাকের তীর ঘেঁষে, চা-বাগানের আলো মেখে, বেণীদুটি দুলিয়ে মুখস্ত করে যেত যে মেয়েটি 'সহজ পাঠ' আর 'আমাদের ছোট নদী...' একটু একটু করে নীলমণিলতা আর অমলতাসের মত দূরন্ত অথচ অপূর্ব কৈশোরে জেগে ওঠে সে। দেখে পড়ার টেবিলে ভূগোল-বিজ্ঞান-গণিত-সমাজবিদ্যার পাঠ্যপুস্তক একপাশে পরে আছে। আর তার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে, ছুটির- ফটিক, ডাকঘরের- অমল, কাবুলিওয়ালা, বিশু আর নন্দিনীরা...
সে টের পায়, তার বুকের মাঝখানে কি যেন এক ব্যথা টনটন করে ওঠে। কি যেন এক আত্মীয়তার বন্ধনে ওরা বড় কাছে টানে। কিন্তু সহসা একদিন, নিরুপমার মত মানহারা মানবীর প্রতিবাদ, তার মানসলোকে ঘটিয়ে যায় নারী চেতনার প্রথম সূত্রপাত।
ভাবতে বসে সে, মেয়েদের মানে কি শুধু পণ দেওয়া আর নেওয়া? মেয়েরা মানে কি শুধু মানিয়ে চলা? মেয়েরা কি শুধু ঘরের একটি কোণা, যাকে ঘিরে তাদের অস্তিত্ব আর ঠিকানা? "স্ত্রীর পত্র" তাকে যেন দিয়ে গেল তার উত্তর।
গল্পের নায়িকা মৃণাল চিঠি লিখেছে তার স্বামীকে শ্রীক্ষেত্র থেকে- "আমি তোমাদের মেজোবউ। আজ পনেরো বছর পর এই সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে জানতে পেরেছি, আমার জগৎ ও জগদীশ্বরের সঙ্গে আমার অন্য সম্বন্ধ আছে। তাই আজ সাহস করে এই চিঠিখানি লিখছি। এ তোমাদের মেজো বউয়ের চিঠি নয়।"
পনেরো বছরের বিবাহিত জীবনে মৃণাল নানাভাবে প্রত্যক্ষ করেছে নারীজীবনের অসম্মানের নানা চিত্র। তার নিজের জীবনে তো বটেই, জায়ের ছোটবোন বিন্দুর জীবনেও। আর তাই রূপহীনা, কালো বিন্দুর তার দিদির বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া থেকে আরম্ভ করে, মৃণালের মায়া-মমতা দিয়ে তাকে বুকের কাছে টেনে নেওয়া, মৃণালের শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দ্বারা বিন্দুকে পাগল স্বামীর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া, বিন্দুর স্বামীর ঘর থেকে পালিয়ে আসা এবং শেষে গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করা... সবকিছুই মৃণালের নারীচেতনায় যেন ঘা দিল। জেগে উঠলো তার নারীচেতনা। মৃণালের মধ্যেই আমরা দেখলাম-
"ঘরপোষা নির্জীব মেয়ে
অন্ধকার কোণ থেকে
বেরিয়ে এল ঘোমটা খসা নারী।"
চিঠি লিখে স্বামীকে জানাল তার সিদ্ধান্ত- " আমি আর তোমাদের সাতাশ নম্বর মাখন বড়ালের গলিতে ফিরব না। আমি বিন্দুকে দেখেছি। সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা যে কি তা আমি পেয়েছি। ... আজ বাইরে এসে দেখি আমার গৌরব রাখার জায়গা নেই।... আমিও বাঁচব। আমি বাঁচলুম।"
মৃণালের চিঠির শেষাংশ যেন নারী জীবনের এক নতুন অধ্যায়। দেখিয়ে দিয়েছে সে, নারীত্বের অবমাননা, বঞ্চনা, লাঞ্ছনা সহ্য করে, স্বামীর পদতললগ্না হয়ে জীবন না কাটিয়ে নিজের আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা যায়। এসবের জন্য আত্মহত্যারও প্রয়োজন নেই। কেননা নারীর নিজের কাছেই আছে তার নিজের ভাগ্য করার অধিকার, সাহস ও ক্ষমতা। সেই বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে মৃণাল যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, আজ এই অত্যাধুনিক যুগেও অনেকে তা ভাবতে পারেননা।
রবীন্দ্রনাথের "স্ত্রীর পত্র" আজও তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়, আমাকে আন্দোলিত করে, নারীত্বের বোধে উদ্বেলিত করে।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন