(এক)
স্বর্গরথটি পাখিকে সাথে নিয়ে ধীরে ধীরে পা মেলাচ্ছে শহরের ভিড়ে। ওদিকে তখন সূর্য ডোবার পালা। সারা পাড়া জুড়ে একটা থমথমে ভাব। অল্প কিছুদিন হলেও এই পাড়ার সকলের সাথেই খুব ভাব জমে গিয়েছিলো পাখির। পার্কের এক কোনে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ চোখ মুছতে মুছতে আপন মনেই বিড়বিড় করছে।
-বড্ড ভালো ছিলো মেয়েটা। হঠাৎ করে যে কি হলো কে জানে! কালকেও তো সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কেই বসে ছিলো।অন্যদিনের তুলনায় গতকাল ওকে একটু অন্যরকম লেগেছিলো বটে, একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল পাখি...কি ভাবছিল ও? কথাগুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেলে ওই বৃদ্ধ। পাখিদের ফ্ল্যাট-এর নীচের পার্কটাতে ঝালমুড়ি বিক্রি করে ওই বৃদ্ধ, সবার এবং পাখিরও খুব প্রিয় রামুকাকার ঝালমুড়ি।
পার্কের উল্টো দিকে বড়ো রাস্তার ওপারে আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটেই পাখি বিয়ের পর এসে ওঠে। আর তখন থেকে এটাই পাখির নতুন বাসা। গত এক বছর আগেই পাখি আর বিবেকের বিয়ে হয়েছিলো। শিলিগুড়ির মেয়ে পাখি, বিয়ের পর কলকাতায় প্রথমবার। দুই পরিবারের পছন্দেই খবরের কাগজ দেখে বিয়ে হয়েছে ওদের, বিয়ের আগে মুঠোফোনে কথা হয়েছে বহুবার। ছবিতেও দেখাদেখি হয়েছিলো ওদের। আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে এ আর কি এমন বড়ো ঘটনা। তবে চাক্ষুষ সাক্ষাৎ একেবারেই ছাদনাতলায়। কারন মেয়ে দেখতে বিবেক যায়নি,তখন ও কাজের প্রয়োজনে বিদেশে এবং বিদেশ থেকে ফিরেই বিয়ে। বিবেক কলকাতার একটি নামী বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ পদে কর্মরত। কর্মসূত্রে বেশিরভাগ সময়ই কলকাতার বাইরে এমনকি দেশের বাইরেও যেতে হয়। মা-বাবা আর নতুন বউ পাখিকে নিয়ে বিবেকের এখন খুশির সংসার।
বেশ কাটছে পাখির দিনগুলো। সেজেগুজে, ঘুরে-বেড়িয়ে, আদরে-আবেগে, আনকোরা শাড়ির ভাঁজে, গহনার রুনঝুনে, সোহাগী রাতে, এলো চুলে, জুঁই-গোলাপের গন্ধে, গানের সুরে, চাঁদের আলোয় কলকাতা কে অনেক ভালো লাগছে পাখির, আজ এখানে, কাল ও বাড়ি, নতুন বর, নতুন বাবা-মায়ের সাথে... খুব ভালো আছে ও। দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে কেটে গেল বিয়ে থেকে নিয়ে আজ অবধি বিবেকের অফিস থেকে নেওয়া পঁচিশ দিনের ছুটি। একেবারে ছুটি বললেও ভুল বলা হয়। এর মাঝেও তিন-চার দিন নতুন বৌকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে অফিসে একবার মুখ দেখিয়ে এসেছে বিবেক,রাত জেগে কম্পিউটারে কাজও করেছে। অভিমান হলেও লজ্জায় কিছুই বলতে পারেনি পাখি। অবশ্য বিবেক ঠিক পড়ে নিয়েছিলো প্রতিবারই পাখির অভিমানী চোখ দুটির কথা। না বলা অভিমানের বদলে পাখি পেয়েছে অনেক আদর। কখনও দোতলায় যাওয়ার পথেই বৌয়ের আঁচল টেনে ধরেছে বিবেক।
-ছাড়ো, কেউ দেখে নেবে যে!
মিষ্টি আওয়াজে আবদারের এই সুর বিবেককে ভীষণ পাগল করে। আবার কখনও চায়ের কাপ এগিয়ে দিচ্ছে পাখি আর ঠিক সেই সময় হাতে একটা কুটুস করে চিমটি কেটে মুচকি হেসে চুপ করে বসে আছে বিবেক,বাবা হয়তো পাশেই বসে আছেন পেপারে মগ্ন হয়ে।
-উফ...!
-কি হল, পাখি মা? শ্বশুরের গম্ভীর কণ্ঠস্বর।
-না বাবা, কিছু না। লাজরাঙা হয়ে কোনমতে জবাব দেয় পাখি। কিচেন থেকে শাশুড়ি সব দেখে ফেলেছে,শ্বশুরকে শাসনের সুরে বলেছেন।
-নিজের ঘরে গিয়ে পেপার পড়ো। বলে মুখ টিপে টিপে হাসেন। মনে-মনে হয়তো নিজেদের পুরনো স্মৃতিগুলি উজ্জ্বল হয় বিমলা দেবীর।
নতুন সংসারে বেশ ভালই আছে পাখি।
(দুই)
হঠাৎ, খুব জোরে একটা অ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজে হুঁশ ফেরে রূপসার। সেও শ্মশানযাত্রী স্বর্গরথ অনেক এগিয়ে গেছে। ওদের গাড়ীটি ড্রাইভ করছে রূপসার বর অভিরূপ,পিছনের সিটে সিটিয়ে বসে আছে বিবেক এবং পাখির বাবা। পরপর অনেকগুলো গাড়িতেই শ্মশানযাত্রীরা আছেন।
আমি রূপসা। এই গল্পের কাহিনীকার। এছাড়া তো আর কোনও পরিচয় এই মুহূর্তে মাথায় আসছে না আমার। আমি যে পাখির বাল্যবন্ধু কিংবা বোনও। এটা বলতে বা ভাবতেই পারছি না। আমি আর পাখি এক মায়ের পেটের সন্তান না হলেও তার চেয়ে কোনও অংশে কমও নই। অথচ পাখীর জীবনে কি এমন ঘটল! যার জন্য পাখীকে এতো সুন্দর জীবনটাকে বিসর্জন দিতে হল? একই শহরে থেকেও আমি কিছুই জানতে পারলাম না। ভাবতে ভাবতে আবার এলোমেলো চিন্তাগুলো পিছনে হাটতে শুরু করেছে আমার। পৌঁছে গেছি আমাদের ছেলেবেলায়। যতদূর ছোটবেলা মনে পড়ে,আমি আর পাখি সবসময় একসাথে থাকতাম। আমাদের দু’জনেরই কোনও ভাইবোন নেই। বাবারা একই অফিসে কাজ করতো। পাশাপাশি কোয়ার্টার ছিল আমাদের-একেবারেই এক পাঁচিল। এক স্কুল,এক টিউশন,কখনও আবার পুজোতে একই রকম জামা বানিয়ে দিত কাকিমা-মানে পাখির মা। ভীষণ ন্যাওটা ছিল মেয়েটা। সারাদিন আমাদের বাড়িতেই পড়ে থাকতো, কোনও কোনও দিন একসাথেই ঘুমিয়ে যেতাম আমরা। স্কুল-কলেজ একসাথে একইভাবে, এরপর আমি চলে আসি কলকাতায় পড়তে, তারপর চাকরি পাই,বিয়ে হয়ে যায়, মানে আর ফিরে যাওয়া হয়নি শিলিগুড়ি। আমার বিয়ের বয়স মাত্র তিন। আমার বিয়ের দুই বছর পরই পাখির বিয়ে হয়েছিল। কলকাতায় পাখির বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে আমার সেকি আনন্দ...কাকিমার কাছে আবদার করেই বসলাম।
-পাখির শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার ‘বোন-পুঁটুলি’ চাই কিন্তু। আর তুমিও আমাকে একটা শাড়ি দেবে, একেবারে পাখির মতনই। অন্য শাড়ি দিলে নেবো না। কাকিমা এক গাল হেসে বলেছিল...
-না দিয়ে উপায়!
এবার নামতে হবে। শ্মশান এসে গেছে। পা’দুটো এতো ভারি লাগছে কেন! সারা শরীরটা অসাড়! গাড়ি থেকে নামতেই পারছি না। বাকিরা নেমে গেছে। গাড়িতেই বসে থাকবো,যাব না! ভাবছিলাম হঠাৎ অভিরূপের শব্দ কানে এলো।
-তুমি এখন এখানেই বসে থাকো। এখনও দেরি আছে অনেক। আমি কাকিমাকে এই গাড়িতেই এনে বসাচ্ছি।
গলা দিয়ে আওয়াজ নেই আমার,শব্দ বেরোচ্ছে না যেন কিছুতেই... গলা থেকে কথার বদলে একটা গোঙানি বার বার বেরিয়ে আসতে চাইছে, আমি তাকে জোর করে চেপে রেখেছি। সবাই ভাবে আমি খুব শক্ত মনের মেয়ে। আসলে তা একেবারেই নয়। পাখি আমাকে সবসময় বলতো।
-তুই ভাই আর আমি বোন কেমন। তুই কাঁদবি না,তুই কাঁদতে পারিসই না, ছেলেরা আবার কাঁদে নাকি!
কাকিমাকে এনে অভিরূপ আমাদের গাড়িতে বসিয়ে দিলো। আমি আড়চোখে কাকিমাকে দেখলাম একবার। একভাবে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে কাকিমা। অভিরূপ চা এনে দিলো দুজনকেই। খেলাম, অনিচ্ছায়! সামনের সিটে আমি,পিছনে কাকিমা। এতো কাছে বসে আছি,তবু কোনও কথা নেই! চারিদিক থেকে কিছু কিছু কোলাহল কানে ভেসে আসলেও, গাড়ির ভিতরটা অসম্ভব রকম শান্ত, গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যাতেও যে কেন এতো শীত করছে কে জানে!
-কি হয়েছিল মেয়েটার? কিছুই তো জানালো না আমাদের। হঠাৎ করে এমন একটা কাণ্ড করে বসে রইল। তোর কাকুর দিকে তাকাতে পারছি না রে,মেয়েটাকে বড্ড ভালোবাসতো। দুটো-পাঁচটা তো নয় একটাই। তোকে কিছুই জানায়নি ও?
কাকিমার এই জিজ্ঞাসা গুলোর কোনও উত্তর আপাতত আমার জানা নেই। আর কাকিমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও নেই,তাই চুপ করে শুনছি। সত্যিই কি হয়েছিল পাখির? কাকিমার মতো আমিও সম্পূর্ণ অন্ধকারেই। ওর মতো একটা সহজ-সরল মেয়ে। তার উপর আবার যা ভিতু ছিল পাখি। সে কি না শেষে সুইসাইড করলো! ভাবতে ভাবতে মনটা চলে গেলো আমার পার্সে রাখা ব্রাউন মুখবন্ধ খামটার দিকে। যেটা পাখির মৃত্যুর পর ওর ঘর থেকে পাওয়া গেছিলো। বিবেকদার নামে আর আমার নামে দুটো আলাদা খাম পাওয়া গেছিলো পাখির ড্রেসিংটেবিলে। বিবেকদার খামটি এখন পুলিশের কাছে,যদিও ওটাতে বিশেষ কিছুই লেখা নেই। শুধুই পাখি জানিয়ে গেছে যে ...
-“আমার মৃত্যুর জন্য কেউই দায়ী নয়। পারলে তুমি এবং তোমার পরিবার আমাকে ক্ষমা করো।”
আমার খামটি এখনও খোলা হয়নি। ওটা পড়া হয়ে গেলে পুলিশকে একবার দেখাতে বলেছে থানা থেকে। যদিও মৃত্যুর আগে বিবেকদাকে লেখা পাখির জবানবন্দী, পাখির বাবা-মায়ের বিবেকদা এবং তার পরিবারকে নির্দোষ বলায়, পুলিশরাও খুব বেশী হুটোপুটি করছে না। তবুও চিঠিটা একবার দেখাতে হবে-নিয়ম নাকি ওটাই।
পাখির সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো দিন কুড়ি আগেই। ওর বিবাহবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। সেইসময় কাকু-কাকিমা আসতে পারে নি। কাকুর শারীরটা ভালো ছিল না। তাই পাখির বাপের বাড়ির লোক বলতে ছিলাম আমি,অভিরূপ,আমার মা আর ওর নিজের কাকুর ছেলে,ছেলের বৌ। আমার মা এখন কলকাতায় আমার মেয়ে তিতলির বয়স সবে আড়াই মাস। আমাদের দুজনেরই অফিস। কাজের মেয়েটি ভালো তবুও মাকে এনে রেখেছি কলকাতায়। শিলিগুড়ির বাড়িতে বাবার কাছে তার একমাত্র অবিবাহিত বোন,মানে আমার রানুপিসি তো আছেই। তাই মা’ও নিশ্চিন্তে থাকতে পারছেন নাতনির কাছে। এখন ভাবছি সেদিন তো পাখিকে দেখে তেমন কিছুই বোঝা যায়নি, কিছুই বলেওনি পাখি। হয়তো বলার ছিলো অনেক কিছুই,বলতেও চেয়েছিল ও আমিই বুঝতে পারিনি। এখন মনে পড়ছে কালচে সবুজ বেনারসীতে কি সুন্দরই না লাগছিলো সেদিন পাখিকে।
-আজ শ্মশানে অনেক বডি,বেশ দেরিই হবে মনে হচ্ছে।
কথাটা শুনে মাথাটা যেন কেমন ঘুরে গেলো,চোখের সামনে কিছুটা অন্ধকার অনুভব করলাম। ওই বডিদের দলেই তো পাখিও শুয়ে আছে। আবার বমি পাচ্ছে খুব। কাল রাত থেকে প্রায় না খাওয়া। বারে বারে শুধু চা খাচ্ছি। গতকাল রাত তখন দেড়টা হঠাৎ বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন। ঘুম চোখে ঘড়ি দেখলাম,এতো রাতে কার ফোন! বাবার শরীর ঠিক আছে তো। ভাবতে ভাবতে ফোনটা ধরলাম। ফোনের ওপাশে বিবেকদার শব্দ ভেসে এলো।
-এখুনি একবার সিটি নার্সিংহোমে আসতে হবে রূপসা। এইটুকু বলেই ফোন কেটে দিয়েছিল বিবেকদা।
(তিন)
বাড়ি ফিরতে সেদিন প্রায় দশটা বেজে গেলো। গতকাল রাতের পর আর বাড়ি ফিরিনি। সারারাত নার্সিংহোমেই বসে ছিলাম। ভোর বেলার দিকে কাকু-কাকিমা এসে পৌঁছালো। ওদের নিয়ে গেলাম পাখির শ্বশুরবাড়িতে,সেখান থেকে শ্মশান এরপর সব কাজ শেষ করে একেবারেই বাড়ি ফিরেছি। শরীরের অবস্থা বলার মতো নয়। কিন্তু মনের অবস্থা? আমি লড়ছি নিজের সাথেই। কোনও কথাই বলতে পারছি না। প্রয়োজনে শুধুই হুম-হ্যাঁ-না বলেই সারছি। আমি অনেক কথা বলি, কিন্তু আজ সারাদিন আমি কথা বলিনি। আসলে জীবনে তো কখনও সেইভাবে কোনও আপনকে হারাইনি। খাইনি কিছুই,মানে খেতে পারিনি। স্নান সেরে এক গ্লাস দুধ খেয়ে নিজের বেডরুমের আলো বন্ধ করে শুয়ে পড়েছি। মা আজও তিতলিকে আমার কাছে দেয়নি,মা জানে আমার মনের অবস্থাটা। মায়ের মনটাও ভালো নেই। মাও তো সন্তান হারা হল প্রথমবার। পাখি মায়ের আরেক মেয়েই ছিল। কাকু-কাকিমাকে আজ এখানে আনতে পারিনি। বিবেকদাদের খারাপ লাগতো। কাজের পর ওদের আমার কাছে এনেই রাখবো। এখন শিলিগুড়ি ফিরতে দেবো না কিছুদিন, অভির সাথে কথা হয়ে গেছে আমার। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙলো পাখির কণ্ঠস্বরে।
-কি রে চিঠিটা পড়বি না? এখনও অভিমান করেই থাকবি?
আমি ঘুমের মধ্যে ‘পাখি পাখি’ বলে চমকে উঠলাম। ঘরের নাইটবাল্বের আলোয় যেন পাখিকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমি, সেই বেনারসী শাড়িটা পরে দাঁড়িয়ে আছে আমার বই-পত্রের টেবিলের ঠিক পাশে। এই শাড়িটা পড়েই ওর শেষকৃত্য হলো মাত্র কয়েকঘণ্টা আগেই। মুখটায় ভীষণ বিষণ্ণভাব। আমি বেডসুইচটা অন করি,টিউব জ্বলে ওঠে। কেউ কোথাও নেই। আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। পাশে রাখা জলের বোতল থেকে কয়েকফোঁটা জলে গলা ভেজাই। অভির দিকে তাকিয়ে দেখি ও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি নিজেকে একটু ঠিক করে নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাই টেবিলে রাখা ব্যাগটার দিকে। সেখান থেকে নিয়ে আসি পাখির শেষ চিঠি, ওর জবানবন্দি,ওর মৃত্যুর কারন-যা শুধু ও আমাকেই শোনাতে চেয়েছে।
খামটা হাতে নিয়ে ওলট-পালট করছি। খুলছি না কেন? ভয় পাচ্ছি কি সত্যিটা জানতে! পাখি মৃত-এর থেকে বড়ো সত্যি আর কিই বা হতে পারে? ভাবতে ভাবতে খাটে এসে বসেছি, হঠাৎ করেই খুব শীত লাগতে শুরু করেছে আমার। পাতলা একটা বেডসিট গায়ে দিয়ে খামের মুখটা খুলে চিঠিটা বের করে ফেলেছি। খামের উপরে খুব যত্নে লেখা রূপসা ব্যানার্জী। পাখির হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মতন। চিঠিটা খুললাম। পড়তে শুরু করব এবার। গা ভীষণ গোলাচ্ছে আবার। চিঠির পাতায় চোখ রেখেই ভীষণ কান্না পেলো। মনে মনে বললাম।
-কেন এটা করলি পাখি?
-তুই চিঠিটা পড়,সব বুঝবি রুপু। কেউ যেন পাশ থেকে বলে দিলো কথাগুলো, চমকে উঠলাম। মনে পড়ে গেলো রুপু বলেই ডাকতো আমাকে ও। এবার সোজা চিঠিতে চোখ রাখলাম।
রুপু,
তুই যখন চিঠিটা পড়বি,তখন আমি তোদের সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে ওই নীল আকাশে মেঘেদের রাজ্যে নিজের নতুন সুখকে খুঁজতে পৌঁছে যাব। জানি না রে পাবো কিনা। তবে সুখ ঠিক কি বা কোথায় এটা খুঁজতেই আমার এই সিদ্ধান্ত বলাই যেতে পারে। তোর মনে আছে রুপু? আমি ছোট থেকেই খুব সুখ-পিপাসু। সবসময় আমার আদর চাই,ভালবাসা চাই। বাবা-মায়ের আদর,কাকু-কাকিমার আদর,তোর আদর এমনকি রানু পিসির আদরটাও আমি একটু বেশী বেশীই চাইতাম। তোর অভ্যাস হয়ে গেছিলো, তুই কখনও কিপটেমো করতিস না আমার সাথে। মাসের হিসাবে তুই যে আমার থেকে দু’মাসের বড়ো ছিলিস,তাই তোর একটু দিদি দিদি ভাব ছিল।
আমার এতো মনখারাপের মধ্যেও হাসি ফুটলো মুখে,পাখির চিঠিটা পড়ে।কতো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে পারত মেয়েটা। ভাবতে ভাবতে আবার চিঠিতে নজর গেলো আমার,আমি আর অপেক্ষা করতে পারছিনা।
-আমি জানি রুপু,তুই কি ভাবছিস। ভাবছিস তো পাখি কেন এভাবে আমাকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলো। যে পাখি কোনওদিন কিছুই লুকাত না,লুকাতে পারতই না। তোকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি, পারিনি নি। তোকে বলবো না তাও কি হয়? আসলে কিছুদিন আগেই তিতলি হলো। এরপর তোর অফিসের চাপ,রোজরোজ রাত করে ঘরে ফেরা। কাকিমা না থাকলে কিভাবে কি করতিস কে জানে। কাকিমাকে কাছে এনে রেখে খুব ভালো করেছিস তুই।
বিয়ের পর পর তোকে খুব ফোন করতাম, ধীরে ধীরে বুঝলাম যে তোর কতো কাজের চাপ। আমি বহুবার তোর অফিসেও গেছি,তুই কথাই বলতে পারতিস না ভালো করে। তোরা সবাই ব্যস্ত। তুই,অভি দা,বিবেক সবাই। আর আমি? সারাদিন শুয়ে, বসে,সেজেগুজে, ঘুরে, বেড়িয়ে, টি.ভি. দেখে গান শুনে, শপিং করে,রান্না করে,গল্প করেও কতো সময় বাঁচাতে পারতাম।
বিবেকের বাড়ির লোকজনেরা খুবই ভাল,এখানে সব বিষয়েই অবাধ স্বাধীনতা। কেউ কাউকে কিছুই বলে না। যে যার মতো,যার যার ঘরে। নিজের জগতে ব্যস্ত। আমার কোনও কিছুতেই কোনও বিধিনিষেধ ছিল না। বিবেক বিয়ের পর যখন অফিস ট্যুরে বাইরে গেলো প্রথমবার, খুব কান্না পাচ্ছিলো জনিস। মা বুঝতে পারেন। শ্বশুরমশাইকে দিয়ে সাথে সাথে ট্রেনের টিকিট কাটিয়ে নিজে গিয়ে আমাকে শিলিগুড়িতে রেখে আসেন। এবং বাবা-মাকে বলে আসেন বিবেক না আসা অবদি যেন আমি এখানেই থাকি। ধীরে ধীরে সবটাই অভ্যাস হতে থাকে। আমিও কলকাতাতেই থাকতে লাগলাম। সব ঠিকঠাকই ছিল জানিস। দোষ আমারই, ওই যে সুখ...আরও চাই,আরও অনেক চাই। তবে বড্ড একা কাটত দিন গুলো, তোর কাছে যাওয়ার উপায় ছিল না, কারন তোদের ব্যস্ততা।
আমি চিঠিটা মুড়ে ভাবছি সত্যিই তো। বিয়ের পর মেয়েটার এই নতুন শহরে আসা। নতুন জায়গা,নতুন লোকজন,নতুন পরিবেশ। ভাবিনি তো কখনই কিভাবে মানিয়ে নিচ্ছে পাখি! আসলে পাখি বলেই হয়তো এতো চিন্তা করিনি আমি। মেয়েটার মানিয়ে নেওয়ার একটা ভীষণ বড়ো গুন ছিল ছোটবেলা থেকেই। আর ওর বিয়ের সময়ই বুঝেছিলাম বিবেকদার বাড়ির লোকজনেরা খুবই ভালো। আমি এতো কাছে থেকেও ওকে কখনও নিজের কাছে এনে রাখিনি তো! ভুল করে ফেললাম কি কোথাও? নিজেকেই প্রশ্ন করতে করতে আবার আমার কৌতূহলী দৃষ্টি চলে যায় পাখির চিঠির দিকে। পাখি লিখছে।
-সেদিন সন্ধ্যায় বসে ছিলাম পার্কের বেঞ্চে,রোজই যাই ওখানে বিকালের দিকটায়। বিবেক তখন আউট অফ কলকাতা। হঠাৎ একটা পুরুষ কণ্ঠ কানে এলো।
-আপনি বিবেকদার বৌ না?
তাকালাম ছেলেটির মুখের দিকে,তবে চিনতে পারলাম না।
-হুম, তবে আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না?
-না চেনাই স্বাভাবিক। আমি আপনার প্রতিবেশী,আমার নাম ঋষি।
-ও আচ্ছা,বলুন।
-আপনি বলুন? কেমন লাগছে আমাদের এখানে? আপনি তো শহর কলকাতায় নতুন? এর আগে শিলিগুড়িতে ছিলেন,দুটো শহরের মধ্যে ফারাক অনেক। আপনার কোন জায়গাটা বেশী ভালো লাগছে?
একসাথে ঝড়ের গতিতে বলে যাচ্ছে ছেলেটা। আমি হাঁ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। উত্তর দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই আমার। ও আগে থামুক তবে তো আমি বলব। ছেলেটির বয়স আঠাশ থেকে তিরিশের মধ্যে হবে। দেখতে সুপুরুষ বলাই যেতে পারে। রুপু, তোর মনে নেই? তোর অফিসে একবার আমার সাথে ঋষিও গেছিলো। আমরা একসাথে লাঞ্চও করেছিলাম মনে করে দেখ।
আমি আবার পিছনে ভাবতে শুরু করলাম। মাস তিনেক আগের কথা। একদিন লাঞ্চের আগেই পাখির ফোন।
-আজ তোর সাথে লাঞ্চ করবো রুপু, সময় হবে?
সেদিন একদম সময় ছিল না আমার, অনেকগুলো মিটিং ছিল। তবু যেহেতু পাখির ফোন তাই না করতে পারিনি। কারন ওকে না করে খুব বেশী লাভ হয় না আমি জানি।
-ওকে, চলে আয়। তবে বেশী সময় দিতে পারবোনা আজ। আর কোথাও যেতেও পারবোনা কিন্তু। অফিসের ঠিক নিচেই একটা ভালো চাইনিজ রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানেই চলে আয় তাড়াতাড়ি।
-আচ্ছা আসছি। বলে ফোন কেটে দেয় পাখি।
সেদিন ওর সাথে একটি ছেলেও ছিল, দেখতে শুনতে মন্দ না ছেলেটিকে,আবছা মনে পড়ছে। খুব তাড়াহুড়াতে ছিলাম সেদিন, মিনিট কুড়ি সময়ই সঙ্গে ছিলাম আমরা। বেশী কথা হয়নি।
-আমার নতুন বন্ধু ঋষি।
এই বলে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল পাখি। আমিও নিয়ম মতই অল্প কথা বলেছিলাম। এর পর তো আর পাখিকে কখনও কিছুই জিজ্ঞাসা করিনি আমি! আমি আজকাল অনেক বদলে যাচ্ছি কি? হয়তো কাজের চাপেই এইরকম হচ্ছে আমার। এই অফিসটায় ভীষণ কাজের চাপ, রুপ অনেকবার অন্য চাকরি দেখতে বলেছে আমায়। ভালো সুযোগ পেলেই ছেড়ে দেবো এই অফিসটা। নানারকম ভাবতে ভাবতে চিঠিটা পড়ছি। রাত অনেক। ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই আমি। আকাশটার দিকে তাকিয়ে ভাবি, সত্যি কি মানুষ মৃত্যুর পরে আকাশে চলে যায়! পাখিও কি ওই আকাশেই চলে গেলো!
(চার)
আমাদের ফ্ল্যাটগুলো সতেরো তলায়। ঋষি, আমাদের ফ্ল্যাটের তেরো তলায় থাকত। আমাদের ফ্ল্যাটটা পনেরো তলায় ছিল। ধীরে ধীরে ঋষির সাথে বন্ধুত্ব হচ্ছিলো আমার। না হওয়ার কোনও কারন ছিল না বলেই হয়তো আমাদের বন্ধুত্বটা খবু দ্রুত তৈরি হচ্ছিলো। ফ্ল্যাটের নিচে একটা ছোট বাজার আছে। সেখানে প্রয়োজনের সমস্ত জিনিসই পাওয়া যায়। আর ওখানেই ঋষিদের কনফেকশনারির দোকান। খুব চালু দোকানটা। ঋষিরা দুই ভাই, ঋষি বড়ো। পড়াশুনা শেষ করে বাবার ব্যবসায় যোগ দিয়েছে ও। ভীষণই ভালো ছেলে ঋষি। হাসিখুশি বিনদাস টাইপ। একদম আধুনিক ধ্যানধারণার একটা ছেলে। সহজেই সবার বন্ধু হওয়ার ক্ষমতা ঋষির আছে। আমি ঋষির গল্প বাড়িতে সবার সাথেই করেছি, বিবেক,মা সবাই বলেছে যে ছেলেটা খুব ভালো। আগেও লিখেছি বিবেকের বাড়িতে কোনও বিষয় নিয়েই বাড়তি কোনও ছুঁতমার্গ নেই। তাই আমার আর ঋষির বন্ধুত্ব নিয়েও কোনও অসুবিধা বা বারণ আমাকে শুনতে হয়নি।
সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিলো জানিস রুপু। কিন্তু কোথাও যেন আমি ভীষণ একা হয়ে যাচ্ছিলাম,বিবেকের সময়ই ছিল না আমার জন্য। খালি কাজ আর কাজ। মাসের অর্ধেক দিনই তো কলকাতার বাইরে থাকতো। আর যখন বাড়িতেও থাকত তখনও খালি কম্পিউটারে মুখ গুঁজে থাকাটাই ছিল যেন ওর কাছে সব। রাতগুলো ক্রমশ দূরত্ব বাড়াচ্ছিল বালিশের। শরীরের সাথে সাথে মনেরও। আমি কি বেশী ভাবছি? নিজেকেই বহুবার প্রশ্ন করেও কোনও উত্তর পাইনি। ওর কাছে অভিযোগ করার কোনও মানেই হয়না। ও এতোটাই মগ্ন নিজের কাজের জগতে। হয়তো কখনও খেয়াল হতো ওর। তখন একটু খানি আদর পেতাম। আর কিছু বস্তা পচা একঘেয়ে কথা।
-আজকাল তোমাকে সময় দিতেই পারিনা আমি পাখি। তুমি কিছু মনে কর না তো? তোমার যা ইচ্ছে হয় তুমি তাই করো, যখন যেখানে মন চাইবে সেখানে চলে যেও, ড্রাইভারকে বললেই তো পৌঁছে দেবে। খালি মা’কে একটু জানিয়ে যেও, নাহলে মা আবার চিন্তা করবে। আর তোমার তো এখন এই শহরে দু-দু’টো ভালো বন্ধু। রূপসা তো ছিলই এখন আবার ঋষিও আছে। আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত তোমাকে নিয়ে।
আমি হাঁ করে শুনতাম বিবেকের কথাগুলো। আমার বিয়েটা যেন ওকে বাদ দিয়ে বাকি সকলের সাথেই হয়েছিল। দিনের শেষে রাতের আদরে এইসব কথাগুলো মুখস্থের মতোন বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়তো ক্লান্ত বিবেক। আমি মাঝরাত অবধি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়তাম। সকাল বেলায় যখন ঘুম ভাঙতো আমার তখনও বিবেক ঘুমাচ্ছে। এরপর ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁলেই বিবেকের স্নান,ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসের জন্য রওনা দেওয়ার পালা। যাওয়ার আগে এক ফালি মৃদু হাসি ছুঁড়ে দিত আমার দিকে। আর সারাদিনে বার তিন-চারেক ফোন আসত ওর। তাও খুব নিয়মমাফিক কথাবার্তা। খেয়েছি কিনা, কি করছি এইসব। বাড়ি ফেরার সময় কখনই নির্দিষ্ট ছিল না ওর। এক-দু’বার ভেবেছি বিবেককে বলবো। আমাদের একটা বেবি হলে কেমন হয়। কিন্তু লজ্জায় কি না জানি না। বলতে পারিনি।
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম পাখির চিঠির এই অংশটা। চিঠির এই অংশটা পড়তে পড়তে মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি তৈরি হতে লাগল। মনে হলো মেয়েটা ভীষণই মানসিক কষ্টে ছিল! একাকীত্বে ভুগছিল কি পাখি? পাখির মতন চঞ্চল স্বভাবের মেয়ের পক্ষে এইগুলো মানা সত্যি একটু কষ্টের। তাই বলে সুইসাইড করতে হবে? নাহ,এটা ঠিক মানা যাচ্ছে না। তাহলে কি হয়েছিল পাখির? আবার চোখ গেলো চিঠিতে। পাখির চিঠির প্রতিটা শব্দই খুব স্পষ্ট। খুব ঠাণ্ডা মাথায় চিঠিটা লিখে গেছে পাখি।
সেদিন দুপরবেলায় ফেসবুক-এ চ্যাটিং হচ্ছিল আমার আর ঋষির, এইসময় টা আমাদের আড্ডার সময়। আজ আমার মনটা বিশেষ ভালো ছিল না। তাই কথা বলায় মনও ছিল না। ঋষি বুঝতে পারে।
-কি হয়েছে তোমার পাখি?
-কই না তেমন কিছু হয়নি তো।
-মিথ্যে বলো না আমাকে, বলো কি হয়েছে?
আমি একটু অবাক হলাম। ভাবলাম আমি তো কিছুই বলিনি ঋষিকে,তাহলে ও কিভাবে বুঝল?
গত রাতে বিবেকের সাথে একটু ঝগড়া হয়েছে আমার। ঠিক ঝগড়াও নয়। রাতের খাবার টেবিলে বিবেককে বলে ছিলাম বাবার শরীরটা ভালো নেই। চলো দুদিনের জন্য গিয়ে দেখে আসি বাবাকে। বিবেক এককথায় বলে দিল,
-আমার সময় হবে না। তুমি চলে যেও।
-আমি একা তো যেতেই পারি, অনেকবার গেছিও। তুমি সেই অষ্টমঙ্গলার পরে আর যাওনি। সে কারনেই বলেছি।
হঠাৎ খুব জোড় ধমকে ওঠে বিবেক।
-আমার এতো সময় নেই, তোমার বাবা তুমি গেলেই বেশী খুশি হবেন। যতোসব সস্তা সেন্টিমেন্ট।
রাতের খাবার টেবিলে সবার সামনে প্রথমবার ও আমার সাথে এইভাবে কথা বলল। আর ওর আজকের কথাগুলো ছিলো খুবই তেতো। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল,তাও বললাম না কিছুই। নিজের সমস্ত কাজ সেরে শোবারঘরে চলে গেলাম। বিছানায় শুয়ে শুনতে পেলাম মা বিবেককে কড়া গলায় কিছু একটা বলছেন। কি বলছেন তা শোনা গেলো না। আজ বিছানায় এসে বিবেক একটু বেশী আমার কাছে ঘেঁষতে চাইছিল। ও কি ক্ষমা চাইছে? এইভাবে? আমি কিছু বললাম না ওকে। চুপ করেই শুয়ে থাকলাম শক্ত কাঠ হয়ে। ও আমার শরীর নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঘাঁটল। আমি নির্বিকার। তাতে ওর কিছুই গেলো এলো বলে মনে হয় না আমার। ও যন্ত্রের মতো আমার শরীর ঘেঁটে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়লো। আমার চোখের কোনা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে পড়তে শুকিয়ে গেলো। ভোর রাতের দিকে আজ আবার বিবেক আমাকে বিছানায় খুবলে খেতে লাগলো। আমি যেন কিছুতেই সহজ হতে পারছি না আজ। ব্রেকফাস্ট টেবিলে মা আমাকে বললেন।
-তোমার শ্বশুরকে বলে দিয়েছি, উনি টিকিট কেটে দেবেন তুমি চলে যেও পাখি।
-না আমি যাব না মা। ফোনে খবর নিয়ে নেব। কেন জানি না আজ আমার গলার আওয়াজটা একটু কড়া ছিল। বিবেকের উপর রেগে আছি বলেই হয়তো।
-তুমি মায়ের সাথে মেজাজ নিয়ে কথা বললে কেন? এখুনি ক্ষমা চাও পাখি।
-না বাবু, থাক আমি কিছু মাইন্ড করিনি।
-কি হল পাখি তুমি ক্ষমা চাইবে কি?
একটা অস্বাভাবিক ঝাঁঝালো সুরে কথাগুলো বলল বিবেক। আরও বলল,
-আসলে একটু বেশিই স্বাধীনতা পেয়ে গেছো তুমি।
আমি কেন চুপ করে আছি? ভিতর থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইছে কি! ওটা কি কান্না? না প্রতিবাদ? ঠিক বুঝতে পারছি না, তাই দমবন্ধ করে আছি। এরপর বিবেক বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।এইসব ভাবতে ভাবতে কখন চোখ লেগে গেছে আমার, ঋষির ফোনের রিং-এ ঘুম ভাঙল।
-আজ পার্কে এসো,ঠিক পাঁচটায়। অপেক্ষা করবো আমি।
ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে চারটে বাজে। আরও মিনিট দশ শুয়ে থেকে উঠলাম, রেডি হয়ে নীচে গেলাম। ঋষি বসে আছে পার্কের একদম কোনার দিকের বেঞ্চটাতে। আজ ঋষি ওখানে কেন বসেছে? আমরা তো পার্কে এসে বসিনা কখনও। হাঁটি, আর বসলেও ওই কোনার দিকগুলোতে বসি না কখনই। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম ওইদিকেই ঋষির কাছে গিয়ে বসলাম। আজ ঋষিকে একটু অন্যরকম লাগছে যেন। জিজ্ঞাসা করলাম,
-কি হয়েছে ঋষি?
ও বললো,
-আমি তোমাকে ভালবাসি পাখি।
-হুম জানি তো, এটা আবার বলতে হয় নাকি? সব বন্ধুরাই তার নিজের বন্ধুকে ভালবাসে।
-আমি তোমাকে আমার প্রেমিকার মতন ভালবাসি। আমি জানি তুমি সুখি নও।
-পাগল হয়ে গেলে নাকি তুমি? আমরা শুধুই ভালো বন্ধু ঋষি। আর আমি ভালো নেই তোমাকে একথা কে বলল?
-তোমার ওই চোখ আমাকে সব বলে দেয়। তুমি কতোটা একা এও আমি জানি।
-ও, তাই? বেশ বুঝলাম। কিন্তু আমি একা বলেই যে আমার একজন প্রেমিক দরকার...এটাও কি আমার চোখ দুটো তোমাকে চুপিচুপি বলে দিয়েছে? এই বলে আমি খুব হাসলাম।
-পারোও বটে ঋষি। চলো এখানে আর বসে থেকে লাভ নেই,হাঁটতে চলো। এই বলে আমি উঠে যাচ্ছিলাম। ঋষি আমার হাতটা ধরে টেনে আমাকে ওর খুব কাছে বসিয়ে দিলো। আমার হাতটা চেপে ধরে বলল...
-সত্যিই আমি তোমাকে খুব ভালবাসি পাখি।
আমি আর এক মুহূর্তও ওখানে দাঁড়িয়ে থাকিনি। সোজা নিজের ঘরে গিয়ে ব্যাগ গোছাতে লাগলাম। পরদিন একদম ভোরের বাস ধরে শিলিগুড়ি চলে গেলাম আমি।
(পাঁচ)
পাখির মৃত্যুর কারন তাহলে ঋষি? না বিবেক দা? উফ, এতো কিছু ঘটে গেলো অথচ আমি কিছুই টের পেলাম না! পাখির মৃত্যুর জন্য একটু হলেও আমি দায়ী। দিন পাঁচ আগেই ফোনে পাখি উশখুশ গলায় আমাকে বলেছিল,
-তোর সাথে অনেক কথা রে রুপু, কবে বলতে পারবো জানি না। একদিন ঠিক বলবো, তোকে না বললে যে মরেও শান্তি পাবো না।
তাহলে কি সেদিন থেকেই পাখি নিজেকে মৃত্যুর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করছিলো? সেদিন থেকেই কি পাখির এই চিঠি লেখা শুরু হয়ে গেছিলো। মৃত্যুর সাথে ছাই হয়ে যায় কতো না বলা কথা। মাথার ভিতরে রাখা স্বপ্ন এবং ভাবনাগুলোও ছাই হয়ে যায় মৃতদেহের সাথেই। চিঠিটা পাশে রেখে সোজা হয়ে একটু বসলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তখন আড়াইটা। গতকাল এই সময় আমরা সবাই নার্সিংহোমে। মর্গে শোয়ানো পাখির নিথর দেহ। আমরা সবাই একেবারে চুপ করে বসে আছি। পুলিশ এসেছে পাখির দেহ’র সাথে। সাথে আমার চিঠিটাও। চিঠিটা আমাকে দিয়ে থানার বড়বাবু বললেন।
-চিঠিটা রাখুন। পড়া হয়ে গেলে আমাদের অবশ্যই দেবেন। বিবেক বাবুর চিঠিটাতে লেখা আছে ওনার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। তাই আপাতত আর আপনার চিঠিটা খুললাম না। তবে পড়া হয়ে গেলে আমাদের একবার নিশ্চয়ই দেবেন,ওটা নিয়ম। ভোর রাতের দিকে পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট এলো, অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে পাখির মৃত্যু হয়েছে। ততক্ষণে কাকু-কাকিমাও খবর পেয়ে পৌঁছে গেছেন। ওদের দেখেই বিবেকদার মা ডুকরে কেঁদে উঠলো।
-কাল রাতেও খাবার টেবিলে একসাথে খেতে বসেছিলাম দিদি। যদি জানতাম মেয়েটার মনটা এতটা দুর্বল তাহলে সারারাত মেয়েটাকে কাছ ছাড়াই করতাম না আমি।
-না মা, পাখি রাত ন’টা নাগাদই ওষুধগুলো খেয়েছিল, তোমরা খেয়াল করনি।
-কি করে বুঝলি বাবু?
-ডাক্তার বললেন,আর তাছাড়া আমি কাল বিছানায় শুতে গেছিলাম এগারোটা নাগাদ। পাখির শোয়াটা ভীষণ অদ্ভুত লাগছিলো,ও এতো এলোমেলো ভাবে শোয় না তো! ওকে ঠিক করে শুতে বলব বলে ওর গায়ে হাত দিয়েই আমি চমকে উঠি,ওর সারা শরীর তখন পুরো বরফ। তখনই সব শেষ হয়ে গেছে।
ভীষণ একটা দমকা হাওয়ার মতো মৃত্যু গ্রাস করেছে পাখিকে। অনেকগুলো ওষুধ খেয়েছিল পাখি। এই অবধি ভেবে আবার পাখির চিঠির শেষের দিকটায় চোখ রাখলাম আমি।
শিলিগুড়ি পৌঁছে বেশ ভালো লাগছে। এখানের হাওয়াগুলো আমাকে চেনে তাই ওরা আমাকে ছুঁতে পারে খুব কাছ থেকে। বাবাও আমাকে দেখে বেশ খুশি। মা’র সেই এক কথা ...
-জামাই এলো না? তুই ফোন করে এলি না তো?
-হঠাৎ ঠিক হল মা,তাই আর ফোন করিনি। আর তোমার জামাই’এর কি এতো সময় আছে মা! আমি এসেছি বরং আমাকে নিয়ে খুশি থাকো।
ফ্রেশ হয়ে নিজের ঘরে গিয়ে একটু শুয়েছি। ফোনটা অন করা মাত্রই ঋষির ফোন এলো। ভাবছি ধরবো কি না,কাল রাতেও অনেকবার ফোন করেছিলো ধরিনি আমি। শেষে বাধ্য হয়ে ফোনটা অফ করে দিয়েছিলাম। ফোনটা বেজেই চলেছে। ধরলাম ফোনটা।
-তুমি ফোন ধরছো না কেন পাখি? আজ এখুনি একবার দেখা করতে পারো?
-আমি শিলিগুড়িতে এসেছি ঋষি।
-বাড়িতে! জানাওনি তো!
-হঠাৎ করেই চলে এসেছি।
-আসলে জানাবে না বলেই জানাও নি তুমি। এড়িয়ে গেলে আমাকে?
-কেন এড়িয়ে যাবো?
-আমি তোমাকে ভালবাসি পাখি।
-আবার সেই এক কথা বলবে তুমি? আচ্ছা বেশ,ভালবাস তুমি,আমি বারন করবো না। তবে আমাকে জানানোর কোনও প্রয়োজন নেই।
-কেন জানালে কি তুমিও আমার প্রেমে পড়ে যাবে? ভয় পাচ্ছো তুমি?
-ঋষি,এবার কিন্তু তুমি সীমা অতিক্রম করে ফেলছ। তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু,এর বেশী কিছুই নয়। আমি কারুর বৌ এটা ভুলে যেও না তুমি।
-তুমি ভালো নেই পাখি।
-কে বলল তোমাকে এই কথা! আমি বলেছি তোমায় কখনও?
-সব কিছু কি বলতে হয়?
-আমি ভালো আছি কি নেই সেটা আমার ভীষণই ব্যক্তিগত বিষয়, তোমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার বন্ধুত্ব তোমাকে সে অধিকার দেয়না।
-হয়তো দেয় না ঠিকই। আচ্ছা আমি তোমাকে আর ফোন করবো না। তুমি ভালো থাকো।
ফোন কেটে দেয় ঋষি। আমি বিছানায় শুয়ে ভাবছি হঠাৎ করে কি হলো ছেলেটার! ঋষির একটি গার্লফ্রেন্ড ছিলো। যার সাথে ওর বিয়েও পাকা হয়ে গেছিলো। বিয়ের ঠিক কিছুদিন আগেই একটা অ্যাকসিডেন্টে মেয়েটি মারা যায়। ঋষি আর বিয়ে করবে না সিধান্ত নিয়েছে। আমি অনেক বুঝিয়েও ওকে রাজি করতে পারিনি। ওর বুকের মধ্যে যে যন্ত্রণা লুকান আছে তা সবার বোঝার কথাই নয়। ও কাউকেই তা বুঝতে দেয় না। আমি কি আজ ঋষিকে একটু বেশী বলে ফেললাম? ও যা বলছিল বলতো সারা না দিলেই চুপ করে যেত আপনা থেকেই। এতটা কড়া করে বলার কি কোনও দরকার ছিলো? ভাবছি শুয়ে শুয়ে। মা রাতের খাবার খেতে ডাকছে। উঠে গেলাম। বাবা-মায়ের সাথে একসাথে বসে ভাত খাওয়ার মজাই আলাদা। মায়ের হাতের রান্নার জাদু,আহা।
সেদিনের পর আজ প্রায় দুদিন হলো ঋষির কোনও ফোন আসেনি, ফেসবুকেও ম্যাসেজ করা যাচ্ছে না, প্রোফাইল ডিলিট করে রেখেছে। আমিও করিনি ফোন। কিন্তু আর তো থাকা যাচ্ছে না। ওর সাথে কথা বলাটা এখন আমার অভ্যাস। আমি ফোন করলাম। জাস্ট, একটা রিং হতে না হতেই ফোনটা ধরলো ও।
-পারলে না তো থাকতে?
-না পারলাম না।
-তুমিও আমাকে ভালবেসে ফেলেছো পাখি।
আমি বেশী কথা বারালাম না। এর দুদিন পর কলকাতা ফিরলাম। এবার কলকাতা ফিরে এই বাড়ির সকলের আচরণেই কেমন যেন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব অনুভব করলাম আমি। যদিও এই বাড়িতে আমার শ্বশুরমশাইএর কোনই ভুমিকা নেই,ছেলে মা যা বলে, উনি তাতেই হাঁ কিংবা না বলেন। ধীরে ধীরে বাড়িটা অচেনা হচ্ছে। কিন্তু কেন? তা বোঝার উপায় নেই। প্রশ্ন করে লাভ নেই,এরা কথা বলেই না অথবা বললেও সযত্নে এড়িয়ে যায় প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি। আমি কিছুটা দিশাহীন। বলার মধ্যে এক ঋষিই। বাবা-মা’র বয়স এবং দূরত্বের কথা ভেবে তাদের কখনও কিছুই জানাইনি। তোকেও বলতে পারিনি। একদিকে সংসারে হাওয়া বদল একদিকে ঋষির প্রেমের হাতছানি আমার প্রতিটা দিন কাটছে ভীষণ টানাপড়েনে। কি করবো? দিনদিন ঋষি আমার মানসিক চাহিদা হয়ে উঠছে। ভুল ঠিক ভাবার চেষ্টা বা ইচ্ছে কোনটাই আমার আপাতত নেই। আমি ঋষিকে এখন ডাকি ‘সুখ’ বলে। এইভাবেই কিছুদিন ভালো ছিলাম আমি। হয়ত নতুন কোনও সুখের ঠিকানা পেয়েছিলাম।
অবশেষে এলো সেই দিন যার জন্য আমি নিজেকে কখনই ক্ষমা করতে পারলাম না। আজ আমি বাড়িতে একাই ছিলাম। যথারীতি বিবেক কলকাতার বাইরে গেছে।আর বাবা-মা গেছেন মায়ের ছোট বোনের বাড়িতে বেড়াতে। দুপুরের দিকে আজ একসাথে লাঞ্চ করবো বলে আমি ঋষি ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টি আসায় বেরোনো হল না আমাদের। ঋষি আমাদের বাড়িতেই এল,আমি খিচুরি,ডিম ভাজা বানালাম একসাথে খাওয়া হল।খাওয়ার পর দুজনে সোফায় বসে গল্প করছি,হঠাৎ ঋষি ছেলেমানুষি জেদ শুরু করে বললো।
-আমাকে বিয়ে করবে পাখি? চলো আমরা বিয়ে করি,এভাবে কতদিন? আমি আর তোমাকে ছেড়ে থাকবো না। কিছুতেই না।
-বোকা বোকা কথা বল না, বরং ঘরে গিয়ে ঘুমাও।
-আমি ফালতু কথা বলিনা তুমি সেটা জানো পাখি।
ঋষি আমার অনেক কাছে এসে গেছে কথা বলতে বলতে,আমি চাইলেও ওকে সরাতে পারছি না। ওর মধ্যে একটা অন্যরকম কিছু কাজ করছে বুঝতে পারছি। আমাকে জড়িয়ে ধরেছে ও খুব জোরেই।
-ছাড়ো ঋষি, কি করছো!
প্রথমবার আমরা এতোটা কাছাকাছি। ও কোনও কথাই শুনছেনা। আমিও ক্রমশ অসাড় হয়ে যাচ্ছি যেন। কিছুটা স্বেচ্ছায়,কিছুটা লজ্জায় আমি ওর কাছে সম্পূর্ণভাবেই ধরা দিয়ে ফেললাম। হয়তো আমাদের ভালবাসাকে স্বীকৃতি দিলাম আমরা। এর ঘণ্টাখানেক পর ঋষি বাড়ি ফিরে যায়। আমাকে ও যাওয়ার আগে সরি বলেও গেছিলো সেদিন। আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনি।
আমার ভিতরে একটা ঝড় ওঠে,আমি ঠিক ভুলের হিসাব নিয়ে বসি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমি কাঁদতে থাকি। একটা চরম লজ্জা আমাকে গ্রাস করতে থাকে। আমি খেই হারাই, আমি নিজের তৈরি প্রশ্নের জালে নিজেই জড়াতে থাকি। যখন সেই জাল কেটে আমি বেরলাম তখন সম্পূর্ণ ভাবেই সিধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমি আর কোনওভাবেই ঋষির সাথে কোনওরকম সম্পর্কই রাখবো না। ঋষিকে সেই রাতেই আমার সিধান্ত জানিয়ে দিয়েছিলাম, ও কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। কোনও সাড়া দিতে পারে না।
আমার মনের ভিতরে হাজার হাজার প্রশ্নবাণে আমি জর্জরিত। আমি কি ‘সুখ’ কে কোনোদিন পেলাম! না রে রুপু সুখের সংজ্ঞাটা খুব জটিল। আমার আর সুখের সংজ্ঞা লেখা হলনা। আমি চলে গেলাম তোদের সকলকে ছেড়ে। আসলে বিয়ের পর থেকে নিয়ে আমার সাথে যা যা ঘটেছে তার জন্য আমি নিজেকেই দায়ী করলাম। আমি ক্ষমা করতে পারলাম না নিজেকে। ছোট থেকেই বড্ড লোভী আমি,যা পেয়েছি তাতে সন্তুষ্ট থাকতে পারিনি কোনোদিনই। এটা তোর থেকে ভালো আর কে জানবে বলতে পারিস। আমি চলে গেলাম। আমার মতন লোভী স্বার্থপর মানুষের সংসারে কোনও দরকার নেই। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিস আর একটা অনুরোধ আছে। সম্ভব হলে রাখিস। চিঠিটা কাউকেই পড়াস না। ভালো থাকিস। বাবা-মাকে দেখিস। তুই আছিস তাই নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারলাম ওদের ছেড়ে।
ইতি তোর,
পাখি।
এক বছর পর ...
আমার বাবা-মা, কাকু-কাকিমা সবাই এখন কলকাতায় চলে এসেছে এবং একদম পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট কেনা হয়েছে ওদের জন্য। রানুপিসি আর তিতলিকে নিয়ে ওদের ছয় জনের সংসার। আমি আর অভিরূপ ওই সংসারের অতিথি। খুব কাছে হলেও মাঝেমাঝেই যেতে পারি। তিতলি খুব ভালো আছে তিন দিদা আর দুই দাদুর আদরে।
ওদিকে বিবেকদার পরিবার একমাসের মধ্যেই ওই ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিল্লী চলে গেছে। খবর পেয়েছি বিবেকদার জন্য নাকি আবার পাত্রীর খোঁজ চলছে। আমি পাখির শেষ ইচ্ছেটা রাখতেও সক্ষম হয়েছি। ওর লেখা শেষ চিঠি আমি কাউকেই দেখাইনি। আমার এক পুলিশ বন্ধুর সাহায্যেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
আজ পাখির মৃত্যুবার্ষিকী, বাড়িতে নিজেরাই পূজোর আয়োজন করেছি। বাইরের কাউকেই ডাকিনি। আমরা পূজোতে বসেছি এমন সময় কুরিয়ার থেকে একটা চিঠি দিয়ে গেলো আমার নামে।
ঋষির চিঠি,তাতে লেখা রয়েছে ...
-কেউ না জানুক আপনি সবটাই জানেন পাখির মৃত্যুর জন্য দায়ী ওর ‘সুখ’,মানে আমিই। ও নিজেকে দায়ী ভাবলেও ও যে কোনও কিছুর জন্যই দায়ী নয় সেটা আপনার এবং আমার চেয়ে কে আর বেশী জানবে? আমাকে ‘সুখ’ বলে ডাকলেও আমি ওকে কোনও সুখ দিতে পারিনি। ও আমাকে খুবই ভালবাসতো। কোনোদিনই আমার কাছে আসতে পারবে না এই কথাটা বুঝেই ও চলে গেলো আমাকে ছেড়ে। আর তাই আমি ওর সুখ, চললাম আমার পাখির খোঁজে। পাখির এবং আমার আত্মার শান্তি কামনা করবেন।
আমি পুরো স্তব্ধ! সেদিন বিকালেই পাখিদের শ্বশুরবাড়ির ফ্ল্যাটের নীচে একাই ড্রাইভ করে গেছিলাম। দেখা হলো রামুকাকার সাথে। রামুকাকা আমাকে চিনতে পেরেছে। আমাকে দেখে বলল ...
-আজ পাখি দিদিমণির মৃত্যু দিন না?
-হুম,তোমার মনে ছিল!
-না, কাল ঋষি দাদা বলেছিলো তাই। আর গতকাল রাতেই ওদের তেরো তলার বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মারা গেছে ঋষি দাদা, এইতো একটু আগেই সবাই ঋষি দাদাকে শ্মশানে নিয়ে গেলো। কেউ না জানলেও আমি শুধু জানতাম ঋষি দাদা পাখি দিদিমণিকে কতোটা ভালোবাসতো।
আজও পশ্চিম আকাশের সূর্যটার বিদায়ের রং লাল। ঠিক যেমন প্রেম কিংবা হৃদয়ের রং লাল। তাহলে কি সুখের রংও লালই! খুব আসতে গাড়ি চালিয়ে ফিরছি আমি, মনে হল আকাশ জুড়ে পাখির আদুরে হাসি ছড়ানো। মনে হলো ঋষির প্রেম মরেও জিতে গেলো। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম আমি,আপন মনেই ওই পশ্চিমের চলে যাওয়া সূর্যটার দিকে তাকিয়ে বললাম।
-তোরা ভালো থাকিস পাখি।।
2 মন্তব্যসমূহ
ei golpo bastober. vishon sotto ek jontronar chobi ... valobasha ki ajj ar ek bar janlum ...
উত্তরমুছুনMelancholic emotions..." sukh" is very much apparent in this world... who finds sukh mostly gets sorrows in life.
উত্তরমুছুনExcellent narration!!!
সুচিন্তিত মতামত দিন