দেবশ্রী চক্রবর্ত্তী

debashree







বাংলা সাহিত্যের জ্যোতির্মণ্ডলের উজ্জ্বল জ্যোতীরথ দ্বয় হলেন রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল । একজন যদি অব্জিনীনাথ হন তবে অন্যজন অংশুমালিলী । যেন একই পর্নলে দুইটি প্রসূন । বাংলা সাহিত্যে তাঁদের উজ্জ্বল উপস্থিতির মতনই তাদের সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের উজ্জ্বল উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই । সারা বিশ্বে আজ সাম্প্রদায়িক বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি যখন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে তখন এই দুই বঙ্গ সন্তানকে সামনে রেখে কলম তুললাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির তথা হিন্দু মুসলমানের ঐক্যকে বজায় রাখার আমার একান্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা হিসেবে ।রবীন্দ্রনাথের অসাম্প্রদায়িক চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্বকবির অসাম্প্রদায়িক দর্শন দিয়েই উগ্র জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।রবীন্দ্রনাথের ‘মহাভারত’ চিন্তা বঙ্কিমচন্দ্রের হিন্দু ভারত থেকে ভিন্ন। রবীন্দ্রভারতে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, এমনকি ইংরেজ ও আমন্ত্রিত - তারা সবাই মিলে দেশ গড়বে এমন বিশ্বাস নিয়ে কথাগুলো লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কারণ ইউরোপীয় রেনেসাঁসের ভক্ত রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন : ‘য়ুরোপের প্রদীপের মুখে শিখা জ্বলিতেছে। সেই শিখা হইতে আমাদের প্রদীপ জ্বালাইয়া লইয়া আমাদিগকে কালের পথে আর একবার যাত্রা করিয়া বাহির হইতে হইবে।’

রবীন্দ্রনাথ গভীর আবেগ নিয়ে বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে একাধিক বন্ধুসহ যোগ দেন। রচনা করেন স্বদেশবন্দনা ও প্রতিবাদী চরিত্রের কবিতাগুচ্ছ - যেগুলোর অন্যতম ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘সার্থক জনম আমার’, ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’ ইত্যাদি।

এ আন্দোলন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তাই ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’য় তিনি বলেন : ‘আমরা হিন্দু মুসলমান, ধনীদরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, স্ত্রীলোক ও পুরুষ সকলেই বাঙালি বলিয়া যে এক বাংলার বেদনা অনুভব করিতে পারিয়াছি - আঘাতের কারণ দূর হইলেই ... সেই ঐক্যের চেতনা যদি দূর হইয়া যায় তবে আমাদের মতো দুর্ভাগা আর কেহ নাই। এখন হইতে আমাদের ঐক্যকে নানা উপলক্ষে নানা আকারে স্বীকার করিতে হইবে।...

‘এই অভিপ্রায়টি মনে রাখিয়া দেশের কর্মশক্তিকে একটি বিশেষ কর্তৃসভার মধ্যে বদ্ধ করিতে হইবে। অন্তত একজন হিন্দু ও একজন মুসলমানকে আমরা এই সভার অধিনায়ক করিব।’ সাম্প্রদায়িক ঐক্য রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক ভাবনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল বলে তিনি সেই ঐক্য বাস্তবায়িত করতে চেয়েছেন জাতীয় জীবনের নানা খাতে। চেষ্টাও কম করেননি তাঁর লেখায় ও কাজে।

যেমন গ্রামের স্বকীয় শাসন ব্যবস্থায়, জীবিকার সমবায়ভিত্তিক নানামুখী ক্ষেত্রে, তেমনি সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায়। এমনকি ‘এই উপলক্ষ্যে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদকে বাংলার ঐক্য সাধন যজ্ঞে বিশেষভাবে আহবান’ জানান। পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর একাধিক রচনায় বাংলাদেশের জেলায় জেলায় মেলা অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও জাতীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক মিলনের আহবান জানান। তাঁর মতে, ‘চিন্তার ঐক্য, ভাবের ঐক্য, ভাষার ঐক্য, সাহিত্যের ঐক্য’ সাধনের মধ্য দিয়ে বাঙালির জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ প্রস্তাবিত রাখিবন্ধন অনুষ্ঠান ও সে-বিষয়ে তাঁর তৎপরতা উল্লেখযোগ্য।

প্রসঙ্গত, স্মর্তব্য সর্বজনীন বাঙালি ঐক্যের আবেগপ্রসূত রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ বক্তব্য ও গান (বাংলার মাটি, বাংলার জল) যা তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করেছিল। বাঙালির এ মহামিলনে কিন্তু ইংরেজের প্রতি আহবান নেই, থাকার কথাও নয়। বরং স্বনির্ভর জাতীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া উপলক্ষে ছাত্রদের ওপর সংঘটিত রাজনৈতিক হয়রানির বিরুদ্ধে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায় (অক্টোবর, ১৯০৫) সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন : ‘আমাদের দেশে শিক্ষার ভার যাহাদের উপর ন্যস্ত আছে তাহাদের স্বার্থের সঙ্গে ছাত্রদের স্বার্থের বিরোধ।... তাই আমাদের শিক্ষার ভার নিজেদের হাতে রাখিতেই হইবে।’ (রবি জীবনী, পঞ্চম, পৃ ২৭২)।

এরপর সরকারবিরোধী তৎপরতায় রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা ও ভাষণ। অন্তত মাস দুই একনাগাড়ে। মূল বক্তব্য দুটো : জাতীয় পর্যায়ে স্বনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার পত্তন এবং আন্দোলনে নিঃস্বার্থ হিন্দু-মুসলমান ঐক্য প্রচেষ্টা। এ-প্রসঙ্গে দুবছর পর লেখা ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধের বক্তব্য ছিল যেমন বাস্তবতাসম্মত, তেমনি সময়ানুগ ও দূরদর্শী। কিন্তু হিন্দু-মুসলমান বিরোধের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের স্বদেশভাবনার গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকগণ আমলে নেননি।

হয়তো তাই ওই আন্দোলনের চরিত্র অনুধাবন করে রবীন্দ্রনাথের মনে এ-সম্পর্কে হতাশা জন্ম নিতে থাকে। কারণ ইতোমধ্যে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে তৃণমূল স্তরে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যে ফাটল দেখা দিতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ তাই সমস্যার মূল চিহ্নিত করে পূর্বোক্ত প্রবন্ধে লেখেন : ‘হিন্দু মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে,... আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নহে। আমরা বিরুদ্ধ।... আমাদের পাপই ইংরেজের প্রধান বল। ইংরেজ আমাদের ব্যাধির একটা লক্ষণ মাত্র।’

এ-প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন : ‘লক্ষণের দ্বারা ব্যাধির পরিচয় পাইয়া ঠিকমত প্রতিকার করিতে না পারিলে গায়ের জোরে অথবা বন্দেমাতরম মন্ত্র পড়িয়া সন্নিপাতের হাত এড়াইবার কোনো সহজ পথ নাই।’ এমন এক বাস্তববোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে রবীন্দ্রনাথ এরপরও হিন্দু-মুসলমান বিরোধের মূল বিন্দুগুলো চিহ্নিত করেছেন নানা দিক বিচারে। এ-বিষয়ে লিখেছেন আমৃত্যু। বলেছেন এমন কথাও যে, ‘হিন্দু সমাজে আচার নিয়েছে ধর্মের নাম’ যেজন্য মুসলমান হিন্দুর কাছে অস্পৃশ্য ইত্যাদি। চেয়েছেন শিক্ষা এবং ‘পদমানমর্যাদায়’ মুসলমান হিন্দুর সমকক্ষ হয়ে উঠুক এবং হিন্দু যেন তা প্রসন্নচিত্তে মেনে নেয়।

সাম্প্রদায়িক অনৈক্য বা সমস্যা ছাড়াও পূর্বোক্ত আন্দোলনে আরো যে-সমস্যা রবীন্দ্রনাথের নজরে এসেছে তা ছিল গ্রাম-নগরের ব্যবধান, শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য। তাঁর বিচারে ‘গ্রাম পড়ে আছে মধ্যযুগে আর শহর আধুনিক যুগে।’ এ ব্যবধান দূর করতে গ্রামোন্নয়ন ও পল্লিপুনর্গঠন তাঁর কাছে প্রধান করণীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। শহর-গ্রাম তথা শিক্ষিত-অশিক্ষিতের আর্থ-সামাজিক ব্যবধানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রবীন্দ্রনাথ লেখেন : ‘আমরা শিক্ষিত কয়েকজন এবং আমাদের দেশের বহুকোটি লোকের মাঝখানে একটা মহাসমুদ্রের ব্যবধান।’

এ ব্যবধান দূর করতে রবীন্দ্রনাথ যে-পথ অবলম্বন করেন অর্থাৎ অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বনির্ভর পল্লিসমাজ গঠন তা ছিল সীমাবদ্ধ বৃত্তে, কবির ভাষায় সমগ্র দেশের জন্য ছোট একটি মডেল হিসেবে পরীক্ষা। এর মূল ভিত্তি ছিল জীবিকাভিত্তিক সমবায়নীতি, কুটিরশিল্প ও ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা (কৃষি ব্যাংক বা ‘সামাজিক ব্যবসা’ ছিল না)। চরিত্র বিচারে এটা সংস্কারবাদী ব্যবস্থা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন, এ পন্থায় গ্রামীণ অর্থনীতির পুরুজ্জীবন সম্ভব। সম্ভব গ্রামের আধুনিকায়ন এবং আদর্শ পল্লিসমাজ গড়ে তোলা।

বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে নিহিত রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, শিক্ষিত ‘ভদ্রলোক শ্রেণীর’ স্বার্থ তথা নগর স্বার্থের প্রাধান্য, গ্রামীণ জনস্বার্থের প্রতি অবহেলা ইত্যাদি কারণে আন্দোলন থেকে সরে আসার ফলে জাতীয়তাবাদী মহলে নিন্দিত হন। যেমন হন ‘বিলেতি বর্জন’ উপলক্ষে পরবর্তীকালে গরিব মুসলমান জনতার ওপর অসহযোগীদের জবরদস্তির সমালোচনা করে, যে-জবরদস্তি শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সংঘাতে পরিণত হয়। ঘরে বাইরে উপন্যাসে এ-ঘটনার কিছুটা পরিচয় মিলবে।

আমাদের জানা থাকা দরকার ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদার হয়ে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে আসেন তখন সেখানকার পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথই প্রথম হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভেদাভেদ তুলে দেন । রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দারকানাথের আমল থেকে পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে সম্ভ্রম ও জাতিবর্ণ অনুযায়ী বসার বন্দোবস্ত থাকত । হিন্দুরা চাদরঢাকা সতরঞ্জির উপর একধারে , তার মধ্যে আবার ব্রাহ্মণের স্থান আলাদা এবং চাদর ছাড়া সতরঞ্জির উপর মুসলমান প্রজারা বসত অন্যধারে । সদর ও অন্য কাছারির কর্মচারীরাও নিজ নিজ পদ মর্যাদা মত বসতো পৃথক আসনে । আর বাবু সাহেবের জন্য ছিল ভেলভেটমোড়া সিংহাসন । বরণের পর রবীন্দ্রনাথ সিংহাসনে বসার কথা কিন্তু তিনি বসলেন না । তিনি নায়েবকে জিজ্ঞাসা করলেন : নায়েব মশাই পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে এমন পৃথক পৃথক ব্যবস্থা কেন ? নায়ব বললেন : বরাবরই এই নিয়ম চলে আসছে । রবীন্দ্রনাথ বললেন না শুভ অনুষ্ঠানে এই নিয়ম চলবে না । সব আসন তুলে দিয়ে হিন্দু-মুসলমান , ব্রাহ্মণ-চাঁড়াল সবাইকে একইভাবে একই আসনে বসতে হবে । নায়েব মশাই সেটা করতে অপরাগতা প্রকাশ করলেন । তখন রবীন্দ্রনাথ নির্দেশ দিলেন : আমি বলছি তুলে দিতে হবে । এ রাজ দরবার নয় , মিলনানুষ্ঠান । নায়েবের একই জবাব : অসম্ভব, নিয়ম ভাঙা চলবে না । নায়েব রবীন্দ্রনাথকে আবার অনুরোধ করলেন আসনে বসার জন্য কিন্তু তিনি বসলেন না এবং স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন , আসনে জাতিভেদ দূর না করলে তিনি কিছুতেই বসবেন না, সাধারণ দরিদ্র প্রজার অপমান তিনি কিছুতেই সহ্য করবেন না। সদর নায়েব জমিদারের হুকুম অমান্য করায় রবীন্দ্রনাথ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন : “ প্রাচীন প্রথা আমি বুঝি না, সবার একাসন করতে হবে । জমিদার হিসেবে এই আমার প্রথম হুকুম । ”জমিদারি সম্ভ্রম আর প্রাচীন প্রথায় আস্থাবান সদর নায়েব এবং অন্যান্য সব হিন্দু আমলারা এক সঙ্গে হঠাৎ ঘোষণা করে বসলেন প্রথার পরিবর্তন হলে তারা সবাই একযোগে পদত্যাগ করবেন । রবীন্দ্রনাথ এতেও বিচলিত হলেন না । তিনি বরং প্রজাদের বললেন; প্রিয় প্রজারা তোমরা সব পৃথক আসন পৃথক ব্যবস্থা সরিয়ে দিয়ে এক সঙ্গে বসো । আমিও বসব । আমি তোমাদেরই লোক । অপমানিত নায়েব গোমস্তারা দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন সব প্রজারা নিচে বসেছে আর রবীন্দ্রনাথ তাদের মাঝখানে; এ এক অপরুপ দৃশ্য । তারপর রবীন্দ্রনাথ প্রজাদের পাঠালেন নায়েব গোমস্তাদের ধরে আনার জন্য । তারা আসলেন রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে পদত্যাগ পত্র পত্যাহার করার অনুরোধ করলেন । উঠে গেল জাত-পাতের প্রথা । ঐ দিনই রবীদ্রনাথ ঘোষণা করলেন “ সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাঁচাতে হবে । এটাই আমার সর্বপ্রধান কাজ ।” আমরা সবাই জানি সাহা হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায় আর শেখ হল মুসলিম । রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের অত্যাচার থেকে মুসলমানদের বাঁচানোটাকে তাঁর সর্বপ্রধান কাজ বলে মনে করেছেন। 

রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প পড়লেই ঐ সব সমালোচক তাদের উত্তর পেয়ে যাবেন । অথবা ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ থেকে ‘শেষ লেখ’ পর্যন্ত কাব্য গ্রন্থ গুলো পড়লেও সেসব সমালোচকদের মুখে ছাই পড়বে । রবীন্দ্রনাথকে ছাড়া হিন্দুমুসলিম ঐক্য নিয়ে আলোচনা করা যায় না । অখন্ড ভারতের শিরোমনি তিনি ।

‘নজরুল একদিকে ইসলামি গান লিখেছেন, অন্যদিকে ভজন-কীর্তন ও শ্যামাসংগীত রচনা করেছেন। বিশ্বজুড়ে এখন অস্থিরতা। সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এ সময় নজরুল আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন।’অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদে প্রবলভাবে আস্থাশীল এই মহৎ কবির আরাধ্য ছিল সত্য শিব ও সুন্দর৷ প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম৷ যে কূলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব৷ আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি৷ সুনির্দিষ্ট কোনো ধর্ম, দর্শন কিংবা জীবন চর্যায় তিনি দীর্ঘকাল স্থির থাকতে পারেননি; তবুও সকল ধর্মের সার্বজনীন মূল্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রগাঢ় আস্থা৷ আর এই আস্থা তাঁকে হিন্দু কিংবা মুসলমানের কবি না করে, করেছে বাংলা ও বাঙালির কবি৷ তাই তো মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রামে এবং পরমত সহিষ্ণুতা প্রতিষ্ঠা ও ধর্মীয় সম্প্রীতি সাধনায় তাঁর কবিতা ও গান বাঙালিকে যোগায় অনিঃশেষ প্রেরণা ।অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্যবাদী আদর্শ তিনি লালন করেছেন সারাজীবন। তাই ১৯৪১ সালের এপ্রিলে তাঁর অসুস্থতা প্রকাশ পাবার কয়েকমাস আগে কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র রজতজয়ন্তী উৎসবে সভাপতি রূপে ‘যদি আর বাঁশী না বাজে’ শীর্ষক জীবনের শেষ অভিভাষণে কবি তাঁর জীবনের লক্ষ্যের কথা ঘোষণা করলেন এই ভাষায়—

‘হিন্দু-মুসলমানের দিনরাত হানাহানি, জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, মানুষের জীবনে একদিকে কঠোর দারিদ্র্য, ঋণ, অভাব— অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাঙ্কে কোটি কোটি টাকা পাষাণস্তূপের মত জমা হয়ে আছে। এ অসাম্য ভেদজ্ঞান দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্যে সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ ও সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাই না, খ্যাতি চাই না, প্রতিষ্ঠা চাই না, নেতৃত্ব চাই না। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান-বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে। সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।’

হিন্দু-মুসলিমের হানাহানি বন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম সচেতন উদ্যোগ নিয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন তুমুল সোচ্চার। তাঁর কবিতা, তাঁর ভাষণ, তাঁর জীবনাচরণের মধ্যে তার প্রকাশ ছিল সুস্পষ্ট।

নজরুলের পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম কবিতার নাম ‘মুক্তি’। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র মুখপত্র ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্যপত্রিকা’য় এটি ছাপা হয় ১৯১৮ সালে। তখন রুশ বিপ্লবের ঢেউ সারা বিশ্বে প্রবাহিত। রুশ বিপ্লবে সর্বহারার রাষ্ট্র গঠনের সংবাদে নজরুলের উচ্ছ্বাস প্রকাশিত হয় এই কবিতায়— ‘সিন্ধুপারের সিংহদ্বারে ধমক হেনে ভাঙল আগল।’ নজরুলের জীবনে ও কবিতায় সাম্যবাদী চেতনার উন্মেষ এই কবিতার মাধ্যমেই। তিনি মানুষকে দেখেছেন এক বৃহত্তর দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে। ধর্মীয় বিভাজন তার সেই দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। নিজ দেশের হিন্দু-মুসলমান, ভিন্ন ভিন্ন বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন বাস্তবতার অনুভূতি প্রকাশই নজরুলের এ বিপরীতমুখী দুই ধারার সৃজনকর্মের রহস্য। কোনো স্ববিরোধিতা নয়, সাম্প্রদায়িকতা নয়ই। নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনচর্চাই তার প্রমাণ। ব্যক্তিগত জীবনাচরণ থেকে কোনো প্রথাগত ধর্মানুশীলনে তার আস্থা ছিল এমনটি মনে করা দুরূহ। আসলে তার সৃষ্টিকর্ম গভীর ও উচ্চতর সংস্কৃতিবোধেরই শিল্পরূপ। নজরুলের সাহিত্য এবং গানে দুকূল প্লাবী মানবীয় প্রেমের আবেগময় প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তার প্রেম নিতান্তই রক্ত-মাংসের মানুষের মানবিক প্রেম। সেখানে অতিলৌকিকতার কোনো স্থান নেই। নজরুল ভালোবেসেছিলেন মর্ত্যের মাটি আর মানুষকে। এই মর্ত্যের মাটি-মানুষের প্রতি গভীর প্রেমকে ঘিরেই নজরুলের সারা জীবনের সব আয়োজন আবর্তিত।

কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বিদ্রোহ নয়, প্রেমই তার মানসচৈতন্যের মৌল প্রবণতা। প্রতিকূল সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পরিবেশই তার প্রেমিক সত্তাকে বিদ্রোহী সত্তায় রূপান্তরিত করেছে। আসলে নজরুলের প্রেমসত্তারই বিকশিত রূপ তার বিদ্রোহীসত্তা। কারণ মানুষের প্রতি গভীর প্রেমবোধই তার সব বিদ্রোহের উত্স। তাই দেখা যায়, নজরুলের অনেক কবিতা-গানে বিদ্রোহের বাণী ধ্বনিত হলেও তার প্রেমবিষয়ক কবিতা এবং গানও সংখ্যায় কম নয়। বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিতি পেলেও তিনি কখনো তার মৌলসত্তা প্রেম থেকে বিচ্যুত হননি। শিল্পগুণ বিচারে নজরুলের প্রেমের গান এবং কবিতাই শ্রেষ্ঠতর। জীবনের সর্বশেষ অভিভাষণে অভিমান ক্ষুুব্ধ নজরুল ঘোষণা করেছেন, ‘বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি। আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম— সে প্রেম পেলাম না বলে আমি এই প্রেমহীন নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।’ দ্বিধাহীনভাবেই তাই বলা যায় বিদ্রোহ নয়, প্রেমসত্তাই নজরুল মানসের মূল ভিত্তি।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ