বরুণকে দেখেছি। নিঃস্বার্থ ভাবনা ভরা ছিল তার বুকে। আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভরপুর এক যুবক ছিল বরুণ। সবার দুঃখ তার মনকে নাড়া দিয়ে যেত। গ্রামের লোক বরুণকে ভালো তো বাসত কিন্তু সে সঙ্গে তাদের মনে এক উপেক্ষার ভাবও ফুটে উঠত। অনেকের মুখে তা প্রকাশ হয়ে পড়ত, বরুণ তো একটা বোকা ছেলে--নিজের ভালো মন্দ যে বোঝে না তাকে তো বোকাই বলে !
সময়ের সঙ্গে চলা, যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সামনে এগিয়ে চলাই তো স্বাভাবিক ধর্ম ! কিন্তু বরুণ নিজের কথা ভুলে যেত যখন দেখত রাস্তায় কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে। লোকের ভিড় জমায়েত হয়েছে, কিন্তু যন্ত্রণায় ছটফট করা মানুষটির দিকে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। বরুণ নির্দ্বিধায় এগিয়ে যায়। সবাইকে ডাক দেয়, আসুন ওকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।
ভিড়ের মাঝ থেকে এক আধজন হয় তো ধীর দ্বিধা পায়ে এগিয়ে আসে। বাকি কেউ এ ঝামেলায় জড়াতে চায় না--ওরা জানে এর ভবিষ্যৎ জের কত আগে পর্যন্ত যেতে পারে। পুলিশ, কোর্ট-কাচারি আরও কত রকম যে হ্যাপা ! বরুণ ভাবে আগে মানুষটাকে বাঁচাতে হবে ! সাময়িক ঝামেলা থেকে একটা মানুষের প্রাণের মূল্য যে অনেক বেশী ! এমনি কত ঘটনায় যে সে এগিয়ে এসেছে, কত দুখী আতুরের সহায়তায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সে হিসাব ক’জনে রাখে!
সেদিনই ঘটে গেল ঘটনাটা। দুই গ্রামের মারপিট চলছিল। গ্রামের জমি দখলের লড়াই চলছিল। লাঠি-শোঁটা চলছিল। হুঙ্কার, চেঁচামেচি শুনে বরুণ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। সে ছুটে গেল আশু মীমাংসায়। বরুণ দেখল পাশের গ্রামের কানাই চাচা মাটিতে লুটিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কানাই চাচা তো অন্য গ্রামের লোক ছিল। এ বিবাদে বরুণদের গ্রামের শত্রু ছিল। কিন্তু তা হলে কি হবে দোষগুণ বিচারের সময় এখন কোথায় ? বরুণ প্রথমে চীৎকার করে মারপিট থামাতে চেষ্টা করল।
মারপিট দাঙ্গায় লিপ্ত মানুষের মেজাজ এমনিতেই বড় তিরিক্ষি থাকে। আর তাতে হেরে যাওয়া আর যুদ্ধে পরাজিত হওয়া তো একই কথা না ! তাই কেউ বরুণের কথা কানে নিলো না, বরং একজন বলে উঠলো, এই হারামজাদা, তুই দূরে থাক--
বরুণ জোর গলায় বলে উঠলো কানাই চাচা মরছে, আর তোমরা এখন মারামারি করে মরছ ?
--এই উপদেশ নিজের গ্রামের মোড়লকে গিয়ে দে না--
ঝগড়া থামার বদলে আরও যেন দ্বিগুণ আকার নিলো। বরুণ আর কথা না বাড়িয়ে কানাই চাচার কাছে এগিয়ে গেল।
কানাই চাচা যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। তাঁর মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছিল। তিনি ধীরে ধীরে সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন। তারই মধ্যে তিনি বরুণের দিকে এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর চোখে তখন শূন্য দৃষ্টি, রাগ হিংসা সব কিছুই বুঝি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন! তাঁর একটা হাত বরুণের মাথায় দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। কানাই চাচা কি মৃত্যুর আগে বরুণের দিকে তাঁর আশীর্বাদী হাত ছোঁয়াবার চেষ্টা করে ছিলেন ?
বরুণ দাঁড়িয়ে চীৎকার করে উঠলো, কানাই চাচা মারা যাচ্ছেন, শীগগির এস তোমরা!
সবার কানেই সে চীৎকার পৌঁছল। ওরা সবাই থমকে তাকাল বরুণের দিকে--লড়াই নিয়ে অনেকে এমন ব্যস্ত ছল যে কানাই চাচার খবর ওদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে ছিল। প্রায় সবাই দেখল কানাই সামন্ত জ্ঞান হারিয়েছেন। তখনও উত্তেজনার কিছু বুঝি বাকি ছিল। ওদের মধ্যে একজন বলে উঠলো, এই বরুণই কানাই সামন্তকে মেরেছে!
আর একজন বলে উঠলো, হ্যাঁ--তাই তাই--
ভিড়ের মাঝখান থেকে অন্য গ্রামের একজন বলে উঠলো, বেশ করেছে--
ব্যাস আবার লড়াইয়ের লাঠি সক্রিয় হয়ে উঠলো। আর তার মধ্যেই একটা লাঠি এসে পড়ল বরুণের ঠিক মাথার মাঝখানে। একটা চীৎকার, মৃত্যুর একমাত্র চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গে বরুণ ঢলে পড়ল মাটিতে। সবাই এবার থেমে গেল, বরুণের কাছে এগিয়ে গেল। ওর মাথা, মুখ রক্তাক্ত হয়ে আছে। ওর দেহ স্থির হয়ে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।
এবার সবার টনক নড়ল। কানাই সামন্ত আর বরুণের মৃতদেহ ওদের সামনে পড়ে আছে। উপস্থিত সবার উত্তেজনা স্তিমিত হয়ে গেছে, অসুর মনোবৃত্তিগুলি সরে গিয়ে এখন সবাই চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। রাগ-দ্বেষ উত্তেজনার উন্মাদনায় কি ঘটে গেছে তা তারা নিজেরাই যেন জানে না !
সে দিন বরুণের মৃত্যু আশপাশের সব গ্রামগুলিকে সজাগ করে দিয়ে গেল। আজ তাই সে সব গ্রামগুলি থেকে বেরিয়ে এসেছে মতাদর্শের তরুণ দলেরা। ওরা নিজের প্রাণসংশয়ের ভাবনা না ভেবে মানুষের দুঃখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পিছু পা হয় না।
পরিচিতি
পরিচিতি
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন