যাকে সাড়ে আটমাস রক্তমাংসের জঠরে ধরে রেখেছি,আমারই হাড়-মাসের রসে জারিত হয়ে পলে পলে যার বেড়ে ওঠা, তার হেলদোল, ছটফটানি - শ্বাসপ্রশ্বাসও নিতো কিনা জানিনা তবে ক্ষণেক্ষণে গভীর ভাবে অনুভব করতাম ওর প্রতিটা দুষ্টামি শিহরিত আনন্দে বিহ্বল হয়ে উঠত মন। যখন হালকা লাথি গুলো মারত ভেতর থেকে,শান্তনুর হাতটা এনে রাখতাম পেটের উপর। এক অদ্ভূত খুশিতে রক্তিম হয়ে উঠত ওর মুখটা। ভেতরে যখন আজব কায়দায় পাশ ফিরতো ,আবেগ মথিত কন্ঠে সোল্লাসে বলে উঠতাম -'এই দেখো,এই দেখো, দুষ্টুটা নড়ছে,দুষ্টুটা নড়ছে।'
সেদিন হঠাৎই সারারাত নিশ্চুপ। পরদিনও হেলদোল নেই কোন,নড়াচড়া বন্ধ। সন্ধ্যায় চেক-আপ। অজানা আশংকায় আমার বুকের ভেতর ডঙ্কা বাজতে শুরু করে। ডাক্তার ভীষণ চিন্তিত গলায় তখনই ভর্তি করিয়ে -তাড়াতাড়ি অপারেশনেরও কথা বললেন। কিছু প্রযোজনীয় কাগজপত্রে সই করার পর আমাকে স্ট্রেচারে করে দু'জন ভয়ানক মুখের আকাশী রংয়ের লোক - ও.টি'র দিকে নিয়ে গেল । ও.টি'তে ঢুকে যাবার মূহুর্ত পর্যন্ত দু'হাত চেপে ধরে রেখেছিল শান্তনু । উৎকন্ঠা লুকোতে পারছিলনা কিছুতেই। তবু ছলছল চোখে অভয়ের সুরে বলেছিল- 'আমি আছি, এই বাইরেই আছি। কোন ভয় নেই ।'
সত্যি ভয়ের কিছু ছিলও না,ফুটফুটে শিশুকন্যা সমেত সগর্বে ক'দিন বাদে বাড়ি ফিরে গেছি। খুঁদে খুঁদে চোখে মিটমিট করে তাকাতো। ঘুমাতোই বেশী,যেন কত জাগরণের পর শান্তির বিছানা জুটেছে তার ।
আজ মাত্র সাড়ে তিনহাত দূরে দিব্যি বাবার কোলে বসে আছে ,আমি যেন ওর কেউ না। দিনেদিনে কত বড় হয়ে যাচ্ছে, আমার স্পর্শ ছাড়াই । কোন কিছুতেই আমার অনুমতির দরকার নেই আজ, যেন আপত্তিরও নেই অধিকার । কপালে টিপ পড়বার ছিরি দেখোনা,- আরেকটু নিচে নামিয়ে দেবেটা কে টিপের ফোঁটাটা ? খেয়েছে কি কিছু সকালে ? আজ ভীষণ শুকনো কেন লাগছে ওর মুখ ?
উকিল এবং বাড়ির সবাইমিলে সেদিন বুদ্ধি দিয়েছিল - তোর বয়সটাই বা কী বল ? একটু শক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নে, মেয়ে কাছে থাকলে ভবিষ্যতে অন্য ভাবনাই ভাবতে পারবিনা কোনদিন । কথাগুলো তখন ভালই লেগেছিল । দুঃসময়ে আপন লোকগুলো সব ঝাঁপিয়ে পড়েছিল । কখনোই একা মনে হয়নি।
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎই বেরসিক, অসহ্য একএক যান্ত্রিক সুরে নারী কন্ঠে উচ্চারিত হল নাম দু'টি - সুমিত্রা মিত্র,শান্তনু মিত্র। পর পর দু'বার ডাক পড়ে। ঘোরটা কেটে যায় সুমিত্রার । ঝটপট সপ্রতিভ হয়ে শাড়ীর আঁচলটা যথাসম্ভব ভদ্রস্থ করে টেনে নিয়ে, ঢুকে পড়ে এজলাসে। ফেমিলি কোর্টে উকিলেরা যায়না খুব একটা । একাই মুখোমুখি হতে হয় হাকিমবাবুর । দু'একটা কথার পরই আবারো তারিখ পড়ে দু'মাস বাদের । শান্তনু মেয়েকে নিয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেলেও আজ সুমিত্রার পা যেন আর চলছিলনা।
দোতলার লম্বা বারান্দায় দুদিকে রাখা চেয়ারগুলোর একটায় বসে পড়ে সে । রোদের দিকে আজ তাকানোই যাচ্ছিলনা,জ্বালা ধরে যাচ্ছিল চোখে । আজ প্রায় চার বছর ধরে এই পরিবেশে সে অভ্যস্থ হয়ে গেছে । আশেপাশের মানুষগুলো বেশীর ভাগই মহিলা,এঁয়োতি । কারো কোলে বাচ্চা , কেউবা ওরই মত ঝাড়া হাত-পা । অন্যদিন হলে বেশ গভীর ভাবেই লক্ষ্য করতো সাদামাটা সাজের গম্ভীর মুখগুলোকে । মিথ্যা ভালবাসা আর ভেঙে যাওয়া সংসারের একটা সূক্ষ্ম ছাপ যেন সবাই বয়ে বেড়াচ্ছে । মেয়েলি গুঞ্জন এখানেও হয়, তবে চাপাস্বরে । পুরনো বাংলা গানের রিংটোনটা বেশ বেমানান ভাবে বেজে উঠতেই চমকে উঠে সুমিত্রা। সম্বিত ফিরে পেতেই নিচে নেমে আসে।
অহেতুক কোলাহল, যানজট আর ব্যস্ত মানুষগুলোর ভিড়ে দ্রুত মিশে গিয়ে হাঁটতে থাকে সুমিত্রা। ঠিক এই মোরের মাথাতেই প্রথম আলাপ হয়েছিল ওদের । ক্রমে প্রেম ও অনিবার্য বিয়ে,সময়ে সন্তানও এসেছে পেটে।
যতটা ভালবাসা নিয়ে মানুষ সংসার করে-এরচেয়ে কিছু কম ভালবাসা ছিলনা আমাদের,আবারও আনমনা হয়ে পথ চলতে চলতে নিজের সাথেই যেন কথাগুলো বলতে থাকে সুমিত্রা। সামান্য ব্যাপারে মেজাজ সপ্তমে চড়েছিল সেদিন। ওর মা, আমার মৃত বাবাকে নিয়ে খুবই অপমানজনক কথা বলেছিল, সেসব কথা শান্তনু আদৌ জানতোনা। দুপুরবেলা ঘরে এসেই মেয়েকে খালি গায়ে মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখে ওর সেদিনের চোটপাট শালীনতার সব বাঁধ পেরিয়ে গেছিল। মূহুর্তের উত্তেজনা চরমে উঠে। হিতাহিত ভুলে ছুঁড়ে মারা হাতের বাটিটা সটান গিয়ে লেগেও যায় শান্তনুর মাথায়,ছিঁটকে এসে বাটিটা আবার মেয়ের গায়ে পড়ে। রাগের চোটে শান্তনু সজোরে থাপ্পড় মেরেছিল আমাকে। রাগের মাথায় ভুল না হয় হয়েই ছিল সেদিন, তা'বলে গায়ে হাত তুলবে ? সেই রাতেই বাপের বাড়ি চলে আসা। পরদিন থানায় ডায়রি এবং উকিলের পরামর্শে মামলা। না,এভাবে সংসার হয়না। এর চেয়ে ওকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়াটাই ঠিক।
মা-ছেলে টানা সতেরো দিন হাজতবাসের পর অবস্থা আরো বিগড়ে যায়। পারিবারিক কেচ্ছা আসে কোর্টের দরজায়। 'তোমার মেয়ে তুমিই রাখ ' - বলে যে ভুল সেদিন করেছিলাম, আজ এর হিসাব মেলানো কতটা কষ্টের, কেউ তা বুঝবেনা,কারোর বোঝার দায়ও নেই। তবু আমার জঠরে তিলে তিলে বেড়ে ওঠা আত্মজার জন্য আমার অন্তরাত্মা কঁকিয়ে ওঠে । মা-ডাক শুনতে চায় এই দু'কান বারবার । তবু আজ ফিরে যাবার আর পথ নেই। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না শান্তনু। এরই মধ্যে ওর মা মারা গেছে,মাতৃদশার লক্ষণ নিয়েও কোর্টে এসেছে । কঠিন মুখে ঠিক ঠিক জবাবও দিয়েছে সবকিছুর। বরাবরই সপ্রতিভ ও সুন্দর কথা বলে, এখনো টানটান উচ্চারণে ধ্বনিত হয় ক্রোধ। একটুও ভেঙে পড়া নেই, আবেগ সব যেন নদীর জলে ভাসিয়েই আসে বারবার। সবার সামনেই ওকে জড়িয়ে ধরে যদি বলে দিই একদিন-- 'আমার ভুল হয়েছিল। এ জীবন অসহ্য,আর যে একা একা বইতে পারিনাগো। আর কখনোই ছুঁড়বোনা বাটি,মেয়ে থাকবেনা আদুল গায়ে ,শোবেনা মাটিতে । এতকিছু ঘটে যাবে,তা কি জানতাম আমি ? কেউতো বলেনি কখনো স্বামী -সন্তানহীন জীবন যে কী দুর্বিষহ ! কেউতো বলেনি কোনদিন বিলম্বিত বিচারের অমোঘ যন্ত্রনায় পুড়ে ছারখার হয় দেহ,মন আর নাড়ীর সম্পর্ক ?
অনেকটা পথ চলে এসেছে সুমিত্রা। খেয়ালও করেনি কখন শান্তনুর অফিসের কাছাকাছি চলে এসেছে। নিজেকে যতটা পারা যায় সামলে নিয়ে দ্রুত উল্টো ফুটে চলে আসে। এতক্ষণ ধরে প্রখর রোদে হেঁটে যেন একটু ক্লান্ত লাগছে । একটু জল খেতে পেলে ভাল হয়। গলা শুকিয়ে কাঠ। সামনের চায়ের দোকানটায় এক গ্লাস জল চেয়ে খেতে থাকে। হঠাৎই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে সমস্ত কোলাহলকে ছাপিয়ে নূপুরের আওয়াজ তুলে, দৌড়ে এসে একজোড়া কচি হাত পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মা-বলে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে গ্লাসটা প্রায় ছুঁড়ে ফেলে মেয়েকে কোলে তুলে নেয় সুমিত্রা। পাগলের মত জাগ্রত পরিবেশকে উপেক্ষা করে মুহূর্মুহূ চুমুতে ভরিয়ে দেয় ওর ললাট, চেপে ধরে রাখে বুকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠা কান্নায় মেয়ের বুকে লগ্ন হয়ে থাকে । সুমিত্রার মাতৃত্বের জমাট অহংকার ও অভিমানের বরফ যেন গলে জল হয়ে গেল। উবু হয়ে এবার রাস্তার ধারেই বসে পড়ে। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে চোখবুঝে থাকে সে। জলভরা চোখে সুমিত্রার বিজয়িনীর হাসির ঝিলিক আর অস্ফুটে বলতে থাকে- 'আমার জঠরের রক্তমাংসে তিল তিল করে বেড়ে উঠা, আমার আত্মজা'। চলন্ত গাড়ীগুলো সাঁইসাঁই শব্দ করে বেরিয়ে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। পথ চলতি মানুষগুলোরও চোখ এড়ায়নি ব্যাপারটা ।
দূরে রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়ানো শান্তনুর দিকে চোখ যেতেই নিজেকে আবারও সামলে নেয় সে। আঁচলে মুছে নেয় চোখ। ধীরে ধীরে রাস্তা পেরিয়ে শান্তনুর পায়ের কাছে মেয়েকে মাটিতে নামিয়ে দেবার আগে, কপালের টিপটা ঠিক করে দেয় মেয়ের। কিছু না বলেই সুমিত্রা আবার চলতে শুরু করে। আচমকা এক বিকট শব্দে সুমিত্রা পিছন ফিরেই দেখে মেয়ে তার রাস্তার ঠিক মাঝ খানে পড়ে কাতরাচ্ছে,সবাই দৌড়ে আসছে চারদিক থেকে। কচি মাথাটা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে, বেশ খানিকটা দূরে তখনো পড়ে থাকা মোটর বাইকের চাকাটা ঘুরছে । কম বয়সী চালক ছেলেটাও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
একটা সরকারী গাড়ী দ্রুত কাছাকাছি হাসপাতালে নিয়ে যায় দু'জনকেই। অপারেশন থিয়েটারের সামনে লাল বাতিটার দিকে পাথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুমিত্রা, শান্তনু একটা রেলিংএ মাথা ঠুকে যাচ্ছে অনবরত।
শ্বাসরোধকারী এক চরম মূহুর্ত,একেকটা মিনিট যেন একেকটা ঘন্টা। থম মেরে থাকা নিস্তব্ধতার মধ্যে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল দেয়াল ঘড়িটার টিক্ টিক্ শব্দ,তবুও সময়ের কাটা যেন সরতেই চাইছিলনা। দমবন্ধকারী এমন অবস্থায় প্রায় আধঘণ্টা কাটার পর ডাক্তারবাবু বেরিয়ে এসে বললেন-
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন