অদিতি চক্রবর্তী



বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা একুশটা আঙুলের লোকটাকে রোজই মাছকাটার সময় পইপই বলতে থাকি, " ঠিকঠাক কেটেকুটে দে দেখি। আর হ্যাঁ, বড়ো বড়ো পিস করবি"। একদিন সে বলেই বসলো," হেই বাবু, তুর দেশ কুথায়?" জ্বলজ্বলে চোখ, প্যাকাটে চেহারা,পাংশু ঠোঁট আর ক্ষয়াটে একুশটা আঙুলের লোকটা আমাদের বাঁধাধরা মাছ বিক্রেতা।সে ততোদিনে বুঝে ফেলেছিলো আমার পছন্দসই মাছের তালিকা। ভূগোল থেকে ইতিহাস জানার আগ্রহ কে প্রশ্রয় না দিয়ে বলি, " তোমার দেশই আমার দেশ"। একুশটা গাঁঘরের নাম মুখস্হ বলতে থাকা লোকটার সাথে আমার দেশের নাম কিছুতেই মেলেনা। লোকটা আড়চোখে আমাকে দেখে নিয়ে মাছের ঝুড়ি গুছিয়ে হাসে হেঃ হেঃ হেঃ

প্রথম আলো বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় প্রথম সারির পত্রিকা। পত্রিকার সম্পাদক কোনো এক সূত্র মারফত আমার একটি কবিতা পড়ে পুলকিত হয়ে ফেসবুকেই যোগাযোগ করে ফেললেন। তাঁর কথামতো একটা মিষ্টি প্রেমের কবিতা নির্ধারিত মেল আইডিতে পাঠিয়ে দিলাম।সম্পাদক ফোনে জানতে আাইলেন, " আপু আপনার দেশ কই আছিলো?" সবুজ মাঠের সোনার ধান,শাপলার বিলে গাং-শালিকের আলাপচারীতা,এসব ভূগোল তাঁকে ইতিহাস পাঠে উৎসাহিত করেছে বোঝা গেলো। জানালাম আমার পিতামহ ঢাকা শহরে থাকতেন শুনেছি। দ্বিগুণ উৎসাহিত সম্পাদক গড়গড়িয়ে বলে চললেন ঢাকা শহরের দর্শনীয় স্হান।নাঃ, মেলাতে পারিনি! কাজের অজুহাতে রিসিভার নামিয়ে রাখতে গিয়ে কানে এলো হেঃ হেঃ হেঃ

তিনদিন হলো জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। দুপুরে চুল শুকোতে বারান্দায় পিঠ এলিয়ে দিতেই সই হাজির একবাটি লেবুর আাচার সমেত। কথায় কথায় শুনিয়ে দিলো এবছর ওদের অশৌচ। বরের কাকা রমেশ চক্রবর্তী দিন পনেরো আগে গত হওয়ায় পিঠেপুলি বানানো বন্ধ রাখতে হবে। বালিকা বয়সে পড়া প্রায় মুখস্হ লাইনগুলি ঠোঁটের বাঁধন ছিঁড়ে বেড়িয়ে এলো অনর্গল।

"সৃষ্টির মনের কথা মনে হয় দ্বেষ
সৃষ্টির মনের কথা আমাদেরই আন্তরিকতাতে
আমাদেরই সন্দেহের ছায়াপাত টেনে এনে ব্যথা খুঁজে আনা।"

সই জীবনানন্দ পড়েছে। আমার কাঁধে মাথা রাখল খানিক তারপর চলে গেলো। আমার সই সাবারিনা তিতির ওর পরিবার হারিয়েছিলো মাত্র তিন বছর বয়স যখন। কলকাতার ডাক্তার সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী সেসময় ঢাকায় মামাবাড়ি বেড়াতে গিয়ে দাঙ্গার মুখ থেকে তিন বছরের শিশুটিকে উদ্ধার করে কলকাতায় নিজের পরিবারের হাতে তুলে দেয়।তিতির বিবাহসূত্রে আমার পড়শিনী।

আজ পৌষ সংক্রান্তি। চারিদিকে পিঠে পার্বণ। পাটিসাটপা বানাচ্ছি। সই তিতিরকে দিতে যাবো। ১৯৭১ এর দাঙ্গায় আমার মা ঢাকা শহর থেকে ভূগোলের নদী বেয়ে আসেন শান্তিনিকেতনের সিস্টার নিবেদিতা আশ্রমে। সেখানে আমাকে জন্ম দেবার পরই নিরুদ্দেশ হন। সিস্টার হেনরিয়েটা আমাকে ওতোটুকু ইতিহাস জানিয়েছিলেন। আমি মায়ের মুখ আজ ও মিলিয়ে চলি দেশের মানুষের সাথে। কোন্ দেশ? কোন দেশের ভূগোল আঁকবে আমার ঐতিহাসিক মায়ের সেই পুড়ে যাওয়া মুখের ছবি জানা নেই! তিতিরকে বলিনি আমার মায়ের কথা। ও আমার প্রিয় সই হয়ে থাক। ওকে কিছুটা পাটিসাপটা দিয়ে আসি বরং-- 

তাং -১৪/০১/২০১৬


পরিচিতি


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ