শ্রী শাম্ব

shree



মুখবন্ধঃ ‘মন্তাজ’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ- ‘একত্রীকরণ’। একসময় কলকারখানায় ব্যবহৃত হ’ত এই শব্দ। এরপর সিনেমা শিল্প একে কাছে টেনে নেয়। 

কর্মসূত্রে একবছর কাটিয়ে ছিলাম পুরুলিয়ায়। বেশকিছু গ্রাম, বন, পাহাড়ে কারণে অকারণে ঘুরেছি সেসময়। রবিবার অথবা কোন ছুটির দিনে একাএকা বেড়িয়ে পড়তাম। এভাবেই মানভূমের আদিম খেলাধুলোর সাথে পরিচিত হয়েছি।  ট্রাভেলগ স্কেচবুকে এইসব স্মৃতিদের জুড়তে গিয়ে দেখি অদ্ভুত লাগছে। সারবদ্ধ ঘটনার ভ্রমণআখ্যান জন্ম নিচ্ছে। অদ্ভুত সংযোগ আর সংঘাত। ঠিক যেমন মন্তাজের গঠন নিয়ে বলতে গিয়ে আইজেনস্টাইন আর পুদভকিন পারস্পরিক বিপ্রতীপ অবস্থান নিয়েছিলেন।


অযোধ্যা পাহাড় থেকে নেমে আসতে দুপুর দু’টো বাজল। অযোধ্যা মোড়ে একটা সস্তার হোটেলে  খাওয়া দাওয়া সেরে দেখি বেলা তিনটা বাজে। একটা ছোট সমস্যা দেখা দিল। আহারান্তে ধুম্রসেবনের বদ অভ্যাসটা তখনও ছিল। সাথে পরিমলদা আর সৌরভদা। অতএব নিরালা খুঁজতে হ’ল। পূর্ণাভ দা বরাবরই শান্ত প্রকৃতির বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর জীব। ভেবেচিন্তে সুন্দর একখানা উপায় বের করেছে। সৌরভদা’কে বলল, রাতের জন্য একটা মরটিন কিনতে হবে। এই এক্সকিউজটা কাজ করে গেল। কিন্তু শীতকালে সেরকম মশার উৎপাত না থাকারই কথা! 
আমরা যখন লোয়াকুই পৌঁছুলাম, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হ’ব-হ’ব করছে। দুয়ারসেনি মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরে গাড়ি সোজা জঙ্গলে প্রবেশ করল।চাকরিসূত্রে এদিকটায় ভালো পরিচিতি আছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যাবার সময় প্রতিবারই আমি শিঙ বোঙ্গার থানের দিকে তাকাই। খুব বড় একটা অশ্বত্থ গাছের নীচেই শিঙ বোঙ্গার থান। ততক্ষণে আশেপাশের দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। সারবদ্ধ শাল গাছের জঙ্গলে অদ্ভুত প্রশান্তি। মৃদু একটা শব্দ ভেসে আসছে। সেটা বাতাসের ছোঁয়ায় পাতার মর্মর ধ্বনি কিনা বুঝতে পারছিনা। কেননা, একেকটা নীরবতা’র পাহাড়কে গুড়িয়ে দিয়ে সশব্দে ছুটে চলেছে আমাদের স্করপিও।


যেখানে জঙ্গল হালকা হয়ে আসে, সেখানে মাথা তুলে উঁকি দেয় ‘পাখি পাহাড়’।  জঙ্গল শেষ হয়ে আসছে। একটা সরু মেঠো পথ দিয়ে আমাদের গাড়ি চলছে। ড্রাইভার ঘোষণা করল, ‘এবার হেঁটে যেতে হবে’। অতএব ‘শুরু হ’ল পথ চলা’। বেশিদূর হাঁটতে হলনা। লোয়াকুই’র মুখে দেখা হ’ল বুড়ো মঙ্গল সিং মুড়া’র সাথে। বয়সে প্রাচীন এই মানুষটি লোয়াকুই’র মোড়ল। যখনই দেখা হ’ত, অজস্র কথা বলত। ওদের কথা, এই গ্রামের কথা।

মঙ্গল সিং কখনো কর্মহীন ভাবে বসে থাকে না। আশি বছরের এই তরুণ মানুষটিকে আমি খুব পছন্দ করতাম। বুড়োও আমাকে খুব স্নেহ করত। শহুরে মানুষদের ‘ছ্যার’ বলার রেওয়াজটা হয়ত আদিবাসীদের মজ্জাগত। আসলে এ হেন আচরণের শেকড় লুকিয়ে আছে ওদের সমাজের অনেক গভীরে। যেভাবে আমরা ঠাণ্ডা ঘরে বসে ‘উন্নয়নের সূচক’ নির্মাণ করি, সেভাবেই তৈরি করি আমাদের সাথে এই দেহাতি মানুষজনের সম্পর্কের সুচক।  এসব নিয়ে অন্য একদিন কথা হবে। হাঁটা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী করছেন’? 
- এই, আপনাদের আসার অপেক্ষা হইন্তেছিল। অযোধ্যা কেমন ঘুইরলেন, ছ্যার! 
- ভালো। সব কিছু রেডি? 
- সহদেব চড়িদা গেইনছে। ছৌ-এর ডেস ভাড়া কইরতে। 
এখানে বলে রাখা দরকার, চড়িদা একটা গ্রামের নাম। লোয়াকুই থেকে মিনিট কুড়ির বাস জার্নি করতে হয়। এই গ্রাম ছৌ নাচের মুখোশ তৈরির জন্য বিখ্যাত। 
পূর্ণাভ দা আর পরিমল দা হনহন করে এগিয়ে চলেছে। পেছনে আমি আর সৌরভ দা। গাছের পাতা থেকে শীত ঝরে পড়ছে। পাখি পাহাড়ের মাথায় কুয়াশা জমছে। সারবদ্ধ মাটির ঘরের দেয়াল জুড়ে আলপনা। পরিমল দা তন্ময় হয়ে দেখছে, বোধহয় ‘ড্যাঞ্চিনামা – ২য় খণ্ড’-এর বীজ বপনের কাজ চলছে। ‘ড্যাঞ্চিনামা’ – আসলে পরিমল দা’র লেখা একটা বইয়ের নাম। বইটা সম্পর্কে প্রকাশকের অভিমত প্রণিধানযোগ্য- 
''গিটার, ক্যামেরা আর রুকস্যাকে রামের বোতল নিয়ে বাংলার পশ্চিমপ্রদেশে যাত্রা করেছিল তিন যুবক। তাদের এজমালি স্মৃতি, এক রহস্যময় ডায়েরি, পুরনো দিনের ফোটোগ্রাফ, আত্মজীবনী ও প্রতিবেদনের মধ্যে দিয়ে এ এক বিস্তৃত সময়কালের প্রত্নখনন - যেখানে মন্বন্তর, দেশভাগ, সত্তরের জ্বলন্ত দশক, ঔপনিবেশিক বাঙ্গালির আত্মপরিচয় নির্মাণের কাল উন্মোচিত হয়েছে থরে থরে, খুলে এসেছে আশ্চর্য সব সুড়ঙ্গ আর সিঁড়ি, শোনা গিয়েছে অনেকগুলি কণ্ঠস্বর। কিম্বা হয়তো একটিই স্বর - এক হারিয়ে যাওয়া, ফিরে ফিরে আসা সময়ের।
স্মৃতিকথা? আখ্যান? আঞ্চলিক ইতিহাস? হয়তো এই লেখাটির সঙ্গে তুলনা চলে মিশ্রমাধ্যম ইনস্টলেশান শিল্পের”।  বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে ছোট্ট জনপদ এই ‘লোয়াকুই’, পঁচিশ ঘর মানুষের আবাস। এরা সক্কলে ভূমিজ। নৃতত্ত্ববীদরা বলেন, এরা প্রোটো-অস্ট্রালয়েড শ্রেণীর আদিবাসী। ব্রিটিশ আমলে ‘গঙ্গা নারায়ণী বিপ্লব’ সংঘটিত করেছিল এই ভূমিজ সম্প্রদায়ের লোকেরা। ক্রমে সন্ধ্যা নেমে আসছে। শীতকালে এই এক সমস্যা। সন্ধ্যা নামে বড় তাড়াতাড়ি।

নাকে ভেসে আসছিল তীব্র বনজ গন্ধ।কতগুলো বনটিয়া কলকল করতে করতে উড়ে এসে জুড়ে বসল বুড়ো বটগাছে। প্রাচীন বট গাছটার মগডালে ওরা বসা বেঁধেছে।দূর থেকে মনে হয় যেন হাজার পাতার কলতান। সবুজে সবুজ মিশে যায়। কিন্তু পাতার ফাঁকে ফাঁকে কিচিরমিচির। বটের ছায়া আরও ঘন হয়ে আসে।‘আরণ্যক’-এ বিভূতিভূষণ বলেছিলেন, ‘সেদিকেই নীল নীল পাহাড় হাত ধরাধরি করিয়া ছোট ছেলেমেয়েদের মত মণ্ডলাকারে দাঁড়াইয়া। ... তখন আমার মনে এই সুবৃহৎ বৃক্ষতলের নিবিড় শান্তি ও গৃহস্বামী’র (আমাদের ক্ষেত্রে ‘লোকজনের’) অনুদ্বিগ্ন, নিঃস্পৃহ, ধীর জীবনযাত্রা ধীরেধীরে কেমন একটা প্রভাব বিস্তার করিত। ছুটাছুটি করিয়া বেড়াইয়া লাভ কি? এই সুন্দর ছায়া এই শ্যাম বংশী-বটের, কেমন মন্থর যমুনা জল, অতীতের শত শতাব্দী পায়ে পায়ে পার হইয়া সময়ের উজানে চলিয়া যাওয়া কি আরামের’। 

...মাঠা ফরেস্ট রেঞ্জ।বেশ গাঢ় জঙ্গল এখানে। অনেকদিন আগে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘এই ঐশ্বরিক জঙ্গলের মাটি ও পাতার যৌথ রূপ উপভোগ করতে করতে মানুষ বড় একলা হয়ে যায়’।

ততক্ষণে সন্ধ্যার ছায়া নেমে এসেছে পাখি পাহাড়ের টঙে। আকাশে ঘন অন্ধকার জমে গেল। এই রাতে জোছনা স্নান করা যায়। জঙ্গলের ধারে দাঁড়িয়ে স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছে পূর্ণাভ দা।চোখ তুলে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে সে। অজস্র নীল রঙ গুলে কে যেন আকাশ রাঙিয়ে তুলেছে। আরও কয়েক পরত নীল রঙ গুলে দিলে রাতটা আরও অন্ধকার হয়ে আসবে। তারপর, রূপোলী আলোর পাতলা চাদর মুড়ে দিলেই জোছনা ভেজা রাত তৈরি হবে। 
কিছুক্ষণের অধীর অপেক্ষা। মনটা ছটফট করছে। পূর্ণাভ দা চোখ বুজে নেয়। এখন মনকে শান্ত রাখতে হবে। অশান্ত মনে জোছনা স্নান হয় না। 
ঝিরিঝিরি জোছনা ঝরে চলেছে অবিরাম। পূর্ণাভ দা চোখ খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু বিন্দু বিন্দু জছনার ধারা চোখের পাতায় ঝরে পড়ছে। পূর্ণাভ দা’র চোখ মুদে  আসে। সারা গায়ে এখন জোছনার জল। 
- কী  করছ এখানে? 
আমার ডাকে পূর্ণাভ দা চমকে ওঠে। অভিমানের সুরে বলে, ‘ দিলি তো জোছনা স্নানটা চটকে?’  আগেই বলেছি, পূর্ণাভ দা একজন বিরল শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী। কবিতা না লিখেও কবি হবার সমস্ত গুণই আছে এর মধ্যে। পরিমল দা এখন শান্তি দি’র বাড়িতে। ওখানেই আমাদের রাতের খাবার তৈরির কাজ চলছে। কৃষ্ণ সিং বনমোরগ জোগাড় করেছে। বন মোরগের ঝোল আর গরম ভাত- এই শীত জমে ক্ষীর!সাথে উপরি পাওনা হিসেবে থাকছে বেগুন ভাঁজা।চারদিকে কেমন একটা নেশা নেশা গন্ধ লেগে আছে, মনে হয় পুরোন মহুয়া! সৌরভ দা’কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। পূর্ণাভ দা’কে কথাটা বলতেই স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে মুচকি হাসল।

এ গ্রামেই একটা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কাজ করে। তাঁদের একটা পাকা দালান আছে। রাতের খাওয়া ওখানেই হবে। পূর্ণাভদা ওদিকে রওনা দিল। আমিও চলেছি পিছুপিছু। টিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চমকে উঠল সৌরভদা। ‘ও তোরা!!! মানুষ তো একটা নক করে ঢোকে!’ মানুষ অপ্রস্তুত হয়ে গেলে ধাতস্ত হতে একটু সময় লাগে। খুব কম সময় হলেও লাগে। সে সময় মানুষের মুখের অভিব্যাক্তি লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আড় চোখে আমার দিকে চাইল সৌরভ দা। তারপর বোকার মত একবার হাসল। গলা খাকড়ি দিয়ে বলল, ‘এবার চল জঙ্গলে, একটু মঙ্গল করে আসি!’ 
রীতিমত আঁতকে ওঠার মত প্রস্তাব! এই রাতে জঙ্গলে? সরু রেখার মত একটা মেঠো পথ শাল বনের বুক চিঁড়ে গেছে। একটা লোক সাইকেল নিয়ে আসছে। কাছে আসতেই বুঝলাম, কৃষ্ণ সিং মুড়া। 
-   এইখানে কি কইরতেছেন? 
-   ঘুরছি। 
-   এই রাইতে জঙ্গলে ঘুইরতে মানা কইরে নি মঙ্গল সর্দার?
-   উনি জানেন না। তা তুমি কোত্থেকে? 
-   আলু শট পইরেছিল... দুয়ারসেনি বাজারে গেইছিলাম। 
শাল বনের ভেতর সাইকেলওয়ালা মিলিয়ে গেল। কৃষ্ণ এই গ্রামের নেতা। যখন মাওবাদী রাজত্ব শুরু হল, তখনও কেউ ওর ... ছিঁড়তে পারেনি। একদিন গর্বের সাথে ঘোষণা করেছিল কৃষ্ণ। আরেকদিন সহজ গ্রাম্য সারল্যে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ শহর থাকতে এই জঙ্গলে কি মারাইতে কাজ নিলেন।এখানে বাইর বাইর কারেন্ট যায়। আপনাদের কলকাতায় তো এছি আছে’। আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, এ সি’র হাওয়া ভালো নয়। বাতের ব্যথা হয়। বনের হাওয়া এক্কেবারে পিওর।ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল কৃষ্ণ। ‘ ও কথা বইলবেক লাই, ছ্যার! শাল বনের হাওয়ায় আমাদের গায়ের রঙ কেমন... দেখেন লা। আপনার গায়ের রঙটা একবার দেইখবেন!’ সাদা চামড়ার প্রতি এই অমোঘ আকর্ষণ কি আমাদের মজ্জাগত! না এটাও অ্যাকালচারেশন ! কে জানে! 
শালপাতার কথা যখন উঠল, তখন একটা জিনিষ জানিয়ে রাখা দরকার।এ গ্রামের মেয়েরা বন থেকে শালপাতা কুড়িয়ে আনে। তারপর শালপাতা জুড়ে জুড়ে থালা বানায়। আজ হ্যান্ড মেড পাত্তালেই আমরা ডিনার সারব। 

এদিকে হয়েছে মহাঝামেলা! সহদেব বরাবরই কার্তিক সাজে। ছৌ পার্টির বাকিরা সাজগোজ শুরু করেছে কিন্তু সহদেব বেপাত্তা।বিস্তর ঝামেলা অতিক্রম করে বাবুর দর্শন পাওয়া গেল! হাঁড়িয়া’র নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। আমাকে দেখেই বাজে বকা শুরু করল। মুখ থেকে ভসভস করে হাঁড়িয়ার গন্ধ বেরোচ্ছে। ঝাঁঝালো গন্ধে শ্বাসনালী ভরে আসে। পেটের ভেতর কী যেন একটা দলা পাকাচ্ছে! হটাৎ খুব বমি পেল। 
সব শেষে ঠিক হল, শান্তি দি’র বড় ছেলে রাসু কার্তিকের পার্ট করবে।

ছৌ নাচের সাজগোজ চলছে জোরকদমে। শিল্পীরা পায়ে, হাঁটুতে, কুনুইয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধছে। এটা একরকম প্রটেকশন। কেননা রুক্ষ মাটিতে হাত-পা ছড়ে যাবার একটা চান্স থাকে। ছৌ নাচের ইতিহাস নিয়ে অনেক রকম মতামত আছে। মুখোশের ব্যবহার নিয়েও অনেক গল্প/ তত্ত্ব/ তথ্য আছে। বলা হয়, আদিবাসীরা যেহেতু কৃষ্ণবর্ণের এবং তথাকথিত ‘ভদ্র’ (?) সমাজের দেবদেবীর মুখের আদলের সাথে অমিল আছে, তাই মুখোশের ব্যবহার বাঞ্ছনীয়। বলাবাহুল্য, এই মত তীব্র ভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করে। তবে একটা বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একমত, এই বিশেষ নৃত্য শৈলী সৃষ্টি হয়েছিল যুদ্ধ শিবিরে অবসর যাপনের উদ্দেশ্যে। তাই এর সনাতনী মুদ্রায় বিশেষ ভাবে যুদ্ধ শৈলী’র প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এর গল্পেও থাকে যুদ্ধের ছায়া।বলা হয়, ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলা হ’ল ছৌ নাচের আঁতুড় ঘর।পুরুলিয়া, ওড়িশা এবং ঝাড়খন্ডের ছৌয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। গবেষক রাজ্যেশ্বর মিত্রের মতে ছৌ নাচের বীজ লুকিয়ে আছে তিব্বতি ছম নাচের মধ্যে। আবার অনেকের মতে ‘ছৌ’ কথার অর্থ ‘ছেলে’ বা ‘ছু’। এটা একান্তই ছেলেদের নাচ। গবেষক সতিকান্ত মাহাত মনে করেন ‘ছৌ’ কথার অর্থ ছাউনি। অর্থাৎ এটি যুদ্ধের নাচ। তবে সময়ের সাথে সাথে বদলে গেছে ছৌ নাচের শৈলী এবং অবশ্যই ছৌ মুখোশ। ধামসা-মাদল- সানাইয়ের সাথে এসে ভিড়েছে সস্তার সিন্থেসাইজার। এই লেখার প্রথমে ‘চড়িদা’ গ্রামের কথা বলেছিলাম। সে গ্রামেই বাস করতেন ছৌ নাচের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ‘গম্ভীর সিং মুড়া’।

পুরুলিয়ার গ্রামে গঞ্জে এ সময় মোরগ লড়াইয়ের আসর বসে। আরেকটা খেলা এখানে খুব জনপ্রিয়, ‘কাড়া লড়াই’। সিগারেটের মোথায় শেষ টান দিয়ে সৌরভ দা জানতে চাইল, ‘এটা আবার কী?’  ‘কাড়া’ কথার অর্থ হল ‘ষাঁড়’। অর্থাৎ ব্যপারটাকে গোদা বাংলায় বলা হয় ‘বুল ফাইটিং’। শুদ্ধ ভাষায় ‘ষণ্ড যুদ্ধ’।‘কাড়া’ তৈরি করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অন্যদের থেকে এদের আলাদা রাখা হয়। রাতের বেলা মাঠে চড়ানো হয়। সরা দিন থাকে গৃহবন্দী। ফলত এরা বেজায় হিংস্র হয়ে ওঠে। বাইরের জগতের সাথে সংযোগহীনতা এবং একাকীত্ব এদের হিংস্র করে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। ‘কাড়া লড়াই’ এক সনাতনী ঐতিহ্য। একে ঘিরে জমে যায় জুয়ার আসর। একবার বাঘমুন্ডিতে ‘কাড়া লড়াই’ দেখেছিলাম।

কথা বলতে বলতে কখন রাত আটটা বেজে গেছে, খেয়ালই করিনি। এবার গ্রামে ফেরা দরকার। তখন ঝিঁঝিঁ পোকার নিরবচ্ছিন্ন কলরোল আর পাহাড়ের কোলে আছড়ে পড়া অপার্থিব জোছনা আমাদের হাতছানি দিচ্ছে। এ ডাক অগ্রাহ্য করে এমন সাধ্য কার! ঝিনঝিন করে বেজে চলেছেন বব ডিলান- ‘... I heard ten thousand whispering and nobody listening.

‘শুধু শিশিরের জল;/ অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে / হিম হয়ে আসে / বাঁশ পাতা- মরা ঘাস- আকাশের তারা !/ বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা।/ ... ঝিমায়েছে এ পৃথিবী / তবু পাই টের / কার যেন দু’ চোখে নাই এ ঘুমের / কোন সাধ’।
জঙ্গলের মাথায় চাঁদ ভাসা জোছনার আলো। জানিনা আজকের রাতটাই কেন পূর্ণিমা। সরু সরু বাতাসের রেখা পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে পাতায় পাতায় কাঁপন ধরায়। সেই কাঁপন শরীরে প্রবেশ করে। শরীরের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। জ্বরের মত ঘোর লাগে।জোছনা ভাঙা রাতের চুম্বনে জ্বর কমে আসে।পাশেই সরু ফিতের মত একটা নদী। নাম জানি না। এক ফোঁটা জল নেই। শুধু রূপোলী বালু।সমস্ত দিন লাল মাটির বুকে অজস্র পাথর ভেঙে, শুষ্ক স্তনের থেকে রুক্ষ কাসাইয়ের বালিতে জল খুঁজে ঘরে ফেরে কৃষ্ণ, রাসু, শান্তি, সহদেব।পাহাড়ের ছায়া পড়ে তখন গ্রামের উঠোনে। তারপর ভাঙা ঘরের ফুঁটিফাঁটা চাল চুঁইয়ে চাঁদের আলোর ধারা নেমে আসে সারা গ্রামে।

ক্রমে একটা ঘোর গ্রাস করছে আমায়। চোখের সামনে সরে সরে যাচ্ছে ক্যালেন্ডারের পাতা। একটা তীব্র হলদেটে গন্ধ। আমাদের আজন্ম লালিত স্মৃতির গন্ধ। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি স্পেনের প্রত্নতাত্ত্বিক সাউটুওলা পাহাড়ের গুহায় আশ্চর্য কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছেন।তাঁর পায়ের কাছেই লণ্ঠন থেকে আলো আসছে। এই লণ্ঠনের আলোয় আরেকটা ছায়া দেখা যাচ্ছে... তাঁর বারো বছরের মেয়ের ছায়া। সেও এসেছে বাবার সাথে আদিম মানুষের ব্যবহৃত জিনিষপত্র খুঁজতে।লণ্ঠনের খোলা মুখ থেকে আলোর ছটা প্রতিফলিত হচ্ছে গুহার ছাদে। আঁতকে উঠলেন সাউটুওলা। চিৎকার করছেন, ‘টেঁরো... টেঁরো’।স্প্যানিশ ভাষায় ‘টেঁরো’ কথার অর্থ ষাঁড়।এই গুহার নাম ‘আলতামিরা’। মানভূমে ‘কাড়া’ কথার অর্থ ষাঁড়। পুঞ্চার কাড়া লড়াইয়ে একই রকম পোজে দাড়িয়েছিল একটি কাড়া। কিন্তু এসব কথা একাকার হয়ে যাচ্ছে কেন? আমি কী নেশাগ্রস্থ?

আরও কয়েক মাস পরে বৈশাখের পূর্ণিমায় জেগে উঠবেন শিকারের দেবী টাঁড়ি। অযোধ্যা পাহাড়ে চলবে বীর দিশম সেঁদরা বা শিকার। এই লেখা লেখার কয়েকদিন আগেই একটা খবর চোখে পড়ল, ‘ভারতে যে অরণ্যে আদিবাসী মানুষজন বাস করেন, সেখানে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে’। কে সভ্য, কে অসভ্য, কে নেটিভ, কে ট্রাইব- এসব নির্ণয় করে কে?

এদিকে আকাশে বাতাসে ধামসার নিনাদ। জেগে উঠছেন মারাং বুরু। ফাঁকা আকাশের নীচে আদিম আবহে শুরু হয়েছে ছৌ। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। করুণা হচ্ছে তাঁদের জন্য, যারা শুধু ঘরের কোণে বসে ‘আরণ্যক’ পড়লেন।
              

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ