গৌরচন্দ্রিকা- ট্রেন লেট করল। ভোর চারটায় পৌঁছুলাম জয়পুর। জয়পুরে নেমে দেখি হাড় কাঁপানো শীত। স্টেশন থেকে বেরোতেই অটোওয়ালারা ছেঁকে ধরল। এই শীতের রাতেও রোজগারের তাগিদ মানুষকে পথে নামিয়েছে। বাসস্ট্যান্ড কাছেই। হাঁটা শুরু করলাম। গন্তব্য আরও ৪৯৫ কিলোমিটার । মনোহরথানা। রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ সীমান্তের একটা গ্রাম। কোটা হয়ে যেতে হবে। প্রাইভেট বাসের দালালরা টিমটিমে বাল্বের আলো জ্বালিয়ে বসে আছে রাস্তার দু’ধারে। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর যুতসই বাস পাওয়া গেল। একটা কেবিন বুক করে নিলাম। পাঁচটা বাজে। বাস ছাড়বে ছ’টায়। এদিক ওদিক ঘুরে একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল। চা খেয়ে সোজা বাসে উঠে গেলাম। বাস ছাড়ল সাড়ে ছ’টা নাগাদ। ১২ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে হুহু করে বাস চলছে। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। গভীর ঘুম। ঘুম ভাঙল, কেননা বাস দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। নীচে নেমে একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। সারবদ্ধ সাদা- নীল ঘিঞ্জি বাড়িগুলো পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গিয়েছে। মৌচাকের মত লাগছে। উপরে পেল্লাই কেল্লা আর জনপদ। আরবল্লীর ডাকাত, লালমোহন গাঙ্গুলি, মোহনলাল – সব এক হয়ে গেল। ‘ জায়গাটাকে তো কাল্টিভেট করতে হচ্ছে।’ পথের ধারে লেখা- ‘বুন্দী’। ২০০ কিলোমিটার অতিক্রম করে এসেছি। আর বড়জোর মিনিট পঞ্চাশ- তারপরেই কোটা। তবুও নেমে গেলাম। একটা ফোন করে জানিয়ে দিলাম- মনোহরথানা পরের দিন যাচ্ছি।
১।
পাহাড়ের গায়ে অজস্র ঘরবাড়ি জমেছে এই কেল্লাকে কেন্দ্র করে। খাবারের পাশে যেমন সারিসারি পিঁপড়ে জমে। এইসব ঘিঞ্জি গলি পেরিয়ে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল রাজস্থানের সিগনেচার হিউম্যান পোট্রেট। সুতীব্র তামাটে মুখে জমেছে কয়েক দশকের বলিরেখা। মাথায় রঙিন কাপড়ের কুণ্ডলী।নাকের তলায় সাদা পুরু গোঁফ। এইসব বলিরেখা জমে আছে গোটা রাজস্থানের ত্বকে।তার খাঁজে জমেছে শতশত বছরের ইতিহাস আর বহু পুরনো হলদেটে ঘ্রাণ। অবিশ্রান্ত ইতিহাসের হরফ চুঁইয়ে পড়ে এইসব শহরের শরীরে।
অনেকসময় কোনকোন লেখা পড়ে চমকে উঠি- এসব তো আমার লেখা! ঠিক যেমন জাহিদুল হকের এই পঙক্তিটি আমার লেখার কথা ছিল- ‘ ... ওরা যাপিত এবং মৃত; জীবনেরা চিজেলে অধরা থেকে যায়’।
অনেকসময় কোনকোন লেখা পড়ে চমকে উঠি- এসব তো আমার লেখা! ঠিক যেমন জাহিদুল হকের এই পঙক্তিটি আমার লেখার কথা ছিল- ‘ ... ওরা যাপিত এবং মৃত; জীবনেরা চিজেলে অধরা থেকে যায়’।
খাতা বের করে একটা রাফ স্কেচ করে নিলাম। মোবাইলে গুগুল সার্চ করে ইতিহাসের হরফ খুঁজতে থাকি। যদিও জানি, শব্দ-বর্ণ-ঘ্রাণ অধরা থেকে যায় এভাবে। ইতিহাস বইয়ে লেখা থাকত, ‘ইতিহাস মানে শুধু রজা-মহারাজাদের কাহিনি নয়’। তবে গুগুল ব্যাটা ‘বুন্দীর ইতিহাস’-এ শুধু রাজাদের গল্পই বলছে। ঠিক যেন মিথ্যেবাদী ইতিহাস বই।
১১৯৩ সালে মুহম্মদ ঘোরি’র হাতে পৃথ্বীরাজ চৌহানের পতনের পর তাঁর কয়েকজন অনুচর পালিয়ে আশ্রয় নেয় চম্বলের উত্যকায়। এই অঞ্চল সে সময় ছিল ভিল আর মিনা উপজাতির আবাসস্থল। কালক্রমে এই অঞ্চলের দখল নেয় চৌহানরা।মাঝেমাঝে আশ্চর্য লাগে। ইতিহাস কী শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরের দাস্তান? জোর যার মুলুক তার!তবুও ইতিহাস ভাল লাগে।
এরপর চম্বলকে মাঝে রেখে গড়ে ওঠে দু’টো পৃথক রাজ্য- বুন্দী আর কোটা।
২।
ঘিঞ্জি নীল সাদা বাড়িঘরের মাঝেমাঝে সরু গলি। দেওয়ালে রাজস্থানী ঢঙে আঁকা ছবি। যুদ্ধরত হাতি, ময়ূর, রাধাকৃষ্ণ। এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাইকেল, ছেলে-বুড়োর দঙ্গল। সরু গলি আরও সরু হয়ে আসে। পাথরের রাস্তায় জলের ছোপ শুকোয় নি এখনও। মাঝে মাঝেই পচা আবর্জনার গন্ধ ভেসে আসে। মাকড়শার ফিনফিনে জালে জড়িয়ে যাওয়া পোকার মত আটকে পড়েছি যেন।
সদর বাজারে পৌঁছে দেখি পর্যটকেদের ভিড় জমেছে মিনিয়েচার পেইন্টিঙের দোকানে। কয়েকটা দোকানে মেয়েদের ভিড়। নখে এঁকে দিচ্ছে অদ্ভুত সব ছবি। নেইল পেইন্টিং। ছবির শহর বুন্দী। দেওয়ালে, পাথরে নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে রাজপুত সমাজ আর তাদের ঘিরে জমতে থাকা গল্প, ধর্মের ইতিবৃত্ত।
ঘর জুড়ে রঙিন ছবি। মুরাল আর মিনিয়েচার পেইন্টিঙের জন্য বুন্দীর ‘চিত্রশালা’ বিখ্যাত।‘চিত্রশালা’ আসলে ছবির ঘর। এখানে মুঘল আর রাজপুত ঘরানা মিলেমিশে একাকার।১৭৩৯ সালে রাও রাজা উম্মেদ সিংহের আমলে ‘চিত্রশালা’ তৈরি হয়। দেওয়ালের গায়ে আঁকা ছবি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা একসময় গুহার দেওয়ালে ছবি এঁকেছে। ভীমভেটকা, রাইসেন, কাঁথিবাগড়ে এখনও দেখতে পাওয়া যায়। এরপর অজন্তার গুহাচিত্র খুঁজে বের করেছিল ওয়েলেসলির সেপাইরা। আসলে ছবি আঁকা আমাদের রক্তে রয়েছে। তাই এতদিন পরেও ‘চিত্রশালা’ এত জনপ্রিয়। একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
দেওয়ালে আঁকা ছবিকে বলাহয় ‘ফ্রেস্কো’। এধরণের ছবি মাঝে মাঝেই লোকচক্ষুর আড়ালে হারিয়ে যায়। অজন্তার বিখ্যাত গুহাচিত্রের কথা হিউয়েন সাঙের বইতে পাওয়া গেলেও, তার অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কেননা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ নিজেই তা দেখেন নি।
এর অনেক পরে, যুদ্ধশেষে ফেরার সময় ওয়েলেসলির সেপাইরা আস্তানা গেড়েছিল অজন্তায়। কে বা কারা যেন সেই সময় অজন্তার গুহা আবিষ্কার করেছিল। ওয়েলেসলির সেপাইরা নাকি আজন্তার গুহাগুলোকেই ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
‘ফ্রেস্কো’ বা দেওয়ালে আঁকা ছবির কথা উঠলেই মনে আসে ‘দ্য লাস্ট সাপার’-এর কথা। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির অমর কীর্তি। এই ছবিটি আঁকা হয়েছিল ইঁটের দেওয়ালে। দীর্ঘদিন ইটালিতে এই ছবির কথা মানুষ ভুলে গিয়েছিল। ফরাসী সৈনিকেরাও নাকি এই ঘরকে ঘোড়ার আস্তাবল হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
৩।
দুপুরের একটা বিবর্ণ রঙ আছে। এই বিবর্ণতার সাথে তারাগড়ের অদ্ভুত মিল। এদের বিবর্ণ রঙ কখনও বিবর্ণ হয়না। উপরে চেয়ে দেখি মেঘের ছায়া পড়েছে প্রাসাদের গায়ে। আরবল্লীর কোলে এই সুবিশাল দুর্গ দেখে জেমস টেড বলেছিলেন, ‘বুন্দীর দুর্গ আসলে রাজস্থানের গয়না’।১৩৪১ সালে হাড়া রাজপুত কবীলের আমলে বুন্দী শহরের পত্তন হয়। এর এক দশক পরেই তারাগড় দুর্গের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। সম্ভবত ষোল শতকের মাঝামাঝি সময় তারাগড় দুর্গের সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়। এরপর প্রায় দু’শ বছর ধরে তারাগড় ক্রমাগত আকারে বেড়েছে।
১৩৫২ (মতান্তরে ১৩৫৪ সাল) সালে রাও বরসিং এই দুর্গের কাজ শুরু করেন। শত্রু পক্ষের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য গোটা শহর ঘিরে ফেলা হয়। পাহাড় কেটে ঢাল তৈরি করা হয়। মূল দুর্গ দুই ভাগে বিভক্ত।উপরের ভাগ ‘তারাগড়’ নামে পরিচিত। নীচের ভাগকে বলা হয় ‘বুন্দী গড়’।
ইতিহাস হাতড়ে হেঁটে যাওয়ার একটা অদ্ভুত অনুভূতি আছে। সে বর্ণ-গন্ধ লিখে বা বলে বঝানো যায়না। এইসব নিপুণ-নিখাদ অনুভূতিরা ঘোরের মত পাক খেতে থাকে। শীতের আলোর ফিনফিনে স্নিগ্ধতা আর বাতাসের হিমানী কাফন জড়িয়ে যাচ্ছে সারা শরীরে। সমস্ত পাটিগণিতের নিয়ম ভেঙে এইসব মাল্যবান স্তূপে সঞ্চয় করছি জীবনের রসদ। একেএকে পেরিয়ে গেলাম চার দুয়ার। পাটনপোল, ভৈরবপোল, শুকুলবারী পোল এবং চৌগান।
মোহময় রাধাকৃষ্ণ, পদ্ম, হাতি, মানুষ সবাই কেমন জমে আছে এইসব যুগজীর্ণ স্তূপের গায়ে। চোরাগোপ্তা অলিগলি আর তার পাশে সারবদ্ধ বাড়িঘরের ছায়ায় অদ্ভুত বিজনতা। মাথা তুললেই চোখে পড়ে বাড়ির ছাদে সিপিয়া রঙে আঁকা আদিম আকাশ। দুপুরের এই নির্জনতায় বেশ অনুভব করা যায় ওয়াল্টার ডি লা মেয়ারের ভৌতিক কবিতা। ‘দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া’। বারবার মনে হচ্ছে কোন একটা বাড়ির কড়া নেড়ে দিই- ‘অবনী বাড়ি আছো’? শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় যে রাতের কথা পড়েছি, তা আমার ভেতরের আমি নয় তো? এরকম হিসেবনিকেশহীন ভ্রমণ কেমন ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে আমার ভেতরে জমতে থাকা তরল অন্ধকারের পাত্রটাকে।‘অবনী বাড়ি আছো’?
‘গাঢ়’ প্রাসাদে ঢোকার মুখেই ‘হাতি পোল’। ধাতব দরজা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছি। সিলিং জুড়ে সূর্যদেবের প্রতিকৃতি।এরপর দেখে নিলাম ‘দেওয়ান ই খাস’, ‘বড়া মহল’।‘গাঢ়’ প্রাসাদের ছাদ থেকে বুন্দী দেখার অনুভূতিই আলাদা।এখান থেকে ‘চিত্রশালা’ ঘুরে আবার নেমে এলাম বুন্দীর সরু রাস্তায়।
শেষ বিকেলের আলো ক্রমে মরে এসেছে। আমি এগিয়ে চলেছি। ক্ষীয়মাণ আলোর রেশ রয়ে যাবে আরও কিছুক্ষণ। এরমধ্যেই ঘুরে নিতে হবে ‘নাভাল সাগর লেক’, ‘রানীজী কি বাউরি’। অতএব এবার বেলাশেষের তাড়াহুড়ো।
৪।
এরপর এখানে রাত আরও গভীর হয়ে আসবে। পাথর- ছবি জড়ো করে উদ্বাস্তু হৃদয় যত হেঁটে বেড়াবে অলিগলি। যৌবন যৌতুক রাখা কয়েকজন নিজের জঠরে জমাবে শহরের বলিরেখা। অখন্ড নীরবতার পেলব গন্ধ মাখা অজস্র তুলি আঁকতে থাকবে জীর্ণ মানুষের ইতিহাস। আরবল্লীর বুকে ইতিহাসের দোহাই দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে মৌচাক সদৃশ বুন্দীর রাজপাট।আর চম্বল নদী বিভাজিকা টেনেই যাবে।
ধূসর প্লীহা- ধমনী- অঙ্গুলি সন্নিবেশে
অলৌকিক গল্পমালার ক্ষান্তিহীন হরফ কিছু
জমা থাকুক এভাবে অথবা যেভাবে
অঙ্গচ্ছেদের শল্যাঘাতে তৃপ্তিহীন মাথা উঁচু।
অপার্থিব সোনালী বিভ্রম ম্লান হয়ে এলে ফিরে চাইব মাটির দিকে। ধাত্রী বুন্দীর গভীরে আরও কোন সুগভীর বলিরেখায় জমা আছে পার্থিব ঝরনা, নদী, সোঁতা, ফসলের বীজ আর বীজতলার স্বপ্ন। ফুটিফাটা পাহাড়, বাজরার ক্ষেত, নীলাভ রঙ আর কোলাহল দেখে দেখে চোখ ক্লান্ত হলে অতীতচারী হওয়া যায়। এবার ফিরে চাইব অলৌকিক গল্পমালার ক্ষান্তিহীন হরফের দিকে। শল্যাঘাতের বিপ্রতীপে শিল্পের ডালি। অভূতপূর্ব তৃপ্তি। অবশ্যই মাথা উঁচু...
শ্রী শাম্ব
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২৫, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
নভেম্বর ২৫, ২০১৫
Rating:






সাধু, সাধু!
উত্তরমুছুনakta darun vraman kahini anek din pore porlam amio bolbo sadhu,sadhu.
উত্তরমুছুনdhonyobad
উত্তরমুছুন