সাঈদা মিমি

saidamimi


           
অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাওয়ার সংকটে ভুগি, কেউ জানে না, আমার রাত্রি অনিদ্রিতা, আমি নিঃসঙ্গতার পূজারী ।  একদিন কীর্তনখোলায় ঢল নেমেছিলো, স্বর্ণাভ বাতাসে জলে উড়ে পড়েছিলো ওড়না, নাফিদা ঘাবড়ে গেলো, ‘এই অবস্থায় বাসায় ফিরবি কিভাবে?’ আমি ফিরেছিলাম, ফিরতে হয় বলে ফেরা ।  তারপর নদীর ঘাটে আটঘাট বেঁধে যাওয়া হতো, কতবার ওকে বসন দেবো? তারপর এলো খসরু ।  না, না, সে মোটেই আমার প্রেমিক নয়, বন্ধুও নয়, আমরা এক স্কুলে পড়তাম ।  ও এত বোকা ছিলো! ক্লাসে আমরা যখন পণ্ডিত স্যারের পড়া মুখস্ত করতাম, ও তখন ছবি আঁকতো ।  নিত্য পিটুনি খসরুর গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো বলে, ওর বাৎসরিক উপাধি হয়ে গিয়েছিলো, ‘গণ্ডার খসরু ।‘ যেন এটাই স্বাভাবিক, বরং ও পিটুনি না খেলেই সবাই অবাক হতো! আর কি থেকে কি হলো, জ্যাঠা বেবী পড়লো সুলতান স্যারের প্রেমে!! আমরা তখন এগারো কিম্বা বারো, বেবীর বয়স পনেরো ।  হয় না এমন? একই ক্লাসে তিনটে বছর পার করে দিলে, এরকম হতেই পারে ।  সুলতান স্যারের কি মতি বা ভীমরতি হলো, বেবী কে নিয়ে পালালো । আমরা একটা অভিজ্ঞতা থেকে অনেক বড় হয়ে গেলাম; ঈশ্বরের ক্যামেরা চলছে । 

চুল ছড়িয়ে বসে আছি, দুইপাশে দুইজন, পিছনে একজন, উকুন বাছার প্রতিযোগিতায় নেমেছে ।  এদিকে আমার অবস্থা শোচনীয়, এতগুলি মানুষ বাতাস অশুদ্ধ করছে! নিলি এলো হন্তদন্ত হয়ে...।
-খবর শুনেছিস?  
-কোন খবর?  
-খসরু মারা গেছে ।  
-মারা গেছে মানে! কি হয়েছিলো? 
-মেরে ফেলা হয়েছে, কুপিয়ে ।  

খসরু আমার বন্ধু ছিলো না, প্রেমিক তো নয়ই, তবু আমরা জানতাম, ও নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো ।  নেশা এবং মাস্তানী, টেণ্ডারবাজি, ছোট শহর, গল্পগুলি কানে আসতো ।  প্রাইমারী স্কুলে মাত্র একবছর পড়েছি ওর সঙ্গে । ও ছবি আঁকতো, পেশিবহুল মানুষের ছবি, আর পিটুনি খেতো নির্বিকারচিত্তে ।  তার স্পন্দন সতেরতেই থেমে গেলো, আমরা নিঃশ্বাসের উত্থান পতন চালিয়ে যেতে থাকলাম । কেনো জানিনা, বুকের কোথাও কষ্ট কাঁদলো, ওহ অপচয়!

সাবেরের সাথে বসে মুভি দেখছিলাম, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা ।‘ সাবের আমার কাঁধে হাত রেখেছিলো, বুকে, কুমারী ঠোঁটে, অনেকবার বলেছিলো, বিয়ের পর আমরা হানিমুন করতে যাবো দার্জিলিং । আমার চোখে তখন স্বপ্নের ঘোর, শরীরে উপচানো শ্রাবন । কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় আমি দেখেছি, কিন্তু সাবেরের সাথে নয়, পাশে কাউকে নিয়েও নয়; একা ।  মেঘের বিস্তার ঠেলে ওই একদিনই, কিছু সময়ের জন্য । সাবের আমার হয়নি, সে কারোরই হতে পারেনি, হয়তো হতেও চায়নি ।  আমি হয়েছি, একজনের হয়েছি নিশ্চিত; সেই প্রাপ্তি নিয়ে ভাবি, আরেকবার কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে যাবো ।  মনোরমা এসে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে দিলো ...
-আজ তোর সঙ্গে খাবো ।  -কি রাঁধবি? 
-চ্যাবা শুঁটকির ভর্তা । 
-ইয়াক.. ইয়াক... 
-তাহলে খাসনে, আজ নিলির বাসায় দাওয়াত আছে, চল যাই, ভুরিভোজ হবে ।  শাড়ি প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে ভাবি, একটু সাজগোজ করা দরকার ।  তখুনি ঘরঘন্টি বেজে ওঠে, ডাকপিয়ন এসেছে ডা ক পি য় ন ।

পুতুল ভাবীর হাসিটা ম্লান হয়নি, আগের মতই নির্মল আর সতেজ ।  এমনকি তার চোখ, কি আশ্চর্য কথাবলা, মায়াবী! অসঙ্গতি আছে, পলকা শরীর আরও কঙ্কালসার হয়েছে, দুইবার কেমো দেওয়ার পর কোমর ছাপানো চুলগুলো নেই হয়ে গেছে ।  ভাবী হাসছিলো যন্ত্রণার তিক্ততা নিয়ে, 'আমি তো চলেই যাচ্ছি রে, কে তোকে গাইয়ের দুধ দিয়ে চা বানিয়ে খাওয়াবে? হাঁসের মাংস দিয়ে চালের রুটি?' আমি চোখদুটোকে পাথর বানিয়ে ফেলি, না, কিছুতেই কাঁদবো না ।  'কতদুর যাবে ভাবী? তোমার পিছনেই আমি আছি ।' দৃশ্যগুলো অলৌকিক ধোঁয়ার মধ্যে হারিয়ে যায়, যেমন ধোঁয়া ওঠে কুমারের মাটির বাসন পোড়ানো চুল্লি থেকে! সেইরাতে আমি অনেককে স্বপ্নে দেখি, বিপুল ভালোবাসা দিয়ে যারা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে ।

শীতশুরুর আগেই শিউলি ফুটছে এন্তার, মালা গেঁথে ঝুলিয়ে রাখি রোজ, কেউ পরুক বা না পরুক ।  অশত্থের ছায়ায় বসে আকাশ দেখি, ঠিক বসে নয়, হেলান দিয়ে ।  মনে হতে পারে, সে বুঝি পৃথিবীর ছাদ! অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বোঝা যায়, আসলে আকাশ মানেই এক অনন্ত শূন্যতা ।  সেই শূন্যতার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে অন্ত্যনদীর মত শুয়ে থাকি ।  একটা সময় এসে বয়স কমতে থাকে, আর রুচি বদলে যায় ।  আমি প্রায়ই কবরখানায় যাই, এখানকার বাতাসে অন্যরকম এক সংযোগ সেতু আছে, হাজার প্রাণের অতীত হয়ে যাওয়া বর্তমান, ‘ফ্রম অ্যাশেস টু অ্যাশেস’ ফ্রম ডাস্ট টু ডাস্ট ।‘ শূন্যতার দিকে কন্ঠস্বর ছুঁড়ে দেই, ভালোবাসা ক্ষমা করতে জানে, আমি শিখে গেছি ।  প্রজাপতির খামারে মৃতরা গালিচার বর্ণ নিয়ে পড়ে থাকে, নতুনেরা উড়ছে ।

saidamimi
পরিচিতি




সাঈদা মিমি সাঈদা মিমি Reviewed by Pd on অক্টোবর ০৬, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.