নিউরোন হাঁটছে, তাড়া নেই । এখন যেতে হবে কালীবাড়ি রোড, প্রেসে। পত্রিকার কাজ শেষ, প্রুফ দেখার কাজ করতে হবে । গেলেই কাকা তার বিখ্যাত হাসিটা দিয়ে ইন্টারকমের রিসিভার তুলবেন, দুই কাপ আদা চা পাঠাও, পাগলিটা এসেছে । ভিতরে খটখট শব্দ, ছাপানোর মেশিন চলছে, ম্যানুয়াল, অক্ষরগুলি সাজিয়ে কাজ করতে হয় । ও কিপটা কাকা, বলি দিন বদলেছে, এই মেশিন এখন অচল……….
নিশুতির ঘুম ভেঙ্গে গেছে, সে ওয়াশরুমে যাবে কিন্তু তার ভয় লাগছে । অন্ধকারে স্নানঘরে স্কন্ধকাটা বসে থাকলে! মা কে জাগাতে গিয়ে থমকালো সে, মা গভীর ঘুম । চোখের পাতা কাঁপছে, স্বপ্ন দেখছে নিশ্চই? নাহ থাক, মিনি টর্চটা নিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো সে ।
এখন যেতে হবে রামকৃষ্ণ মিশনে, ভারী শান্তির জায়গা, বিশাল প্রার্থনা রুমে পূন্যের নিস্তব্ধতা, দীর্ঘ একটা ঘন্টা অনায়াসে ধ্যানে মশগুল থাকা যায় । কানের কাছে গলা ফাটানোর কেউ নেই, ধ্যানের শূন্যস্তরে নির্মল সাদা কুয়াশায় অবগাহন, শ্বেত কবুতরেরা উড়ছে…..
নিশুতি মশারীর ভিতর ঢুকে দেখলো, মায়ের মাথাটা বেকায়দাভাবে কাত হয়ে আছে । ঠিক করে দিলো সে, এখনও মায়ের চোখের পাতা কাঁপছে । এত কি স্বপ্ন!
আরে সাগরদি যাওয়ার সময় হয়েছে! এ কে এস স্কুলের পাশে যে চিপা রাস্তাটা আছে, ওটার শেষমাথায় মেডিকেল কলেজের পেছন দিকের খোলা মাঠ, ঘাস লতায় ভরা, এরপরেই ডাক্তারদের কোয়ার্টার । যদিও দেয়াল দিয়ে ঘেরা সীমানা কিন্তু ওরা পাঁচজন মিলে দেয়ালের ইট খসিয়ে একটা ফোকর তৈরি করে নিয়েছে, যথেষ্ট নিরাপদ জায়গা । আজ ইনসান ভাই খাঁটি বিলিতি শরাব আনবে, সঙ্গে মেনথল দেয়া সিগারেট ‘মোওর’ । মেয়েটা মার্লবোরো টানতে পারে না । আড্ডা হবে আজ, হোটেল থেকে ঝাল করে রাঁধা মাংস থাকবে, আর বোতলে চুমুক দেবে সবাই । বরফ গেলাসের ব্যবস্থা নেই । ছুট… ছুট… ছুট… আজ ঘাসের জমিনে শুয়ে ঘোলা চোখে আকাশ দেখার দিন…..
নিশুতির কাঁচা ঘুমটা চটে গেছে, মায়ের দিকে ফিরলো সে, মা কিছু বলছে ঘুম ঘোরে, ‘আরও তরল আগুন দাও’ সব ভুলে যেতে হবে…’ নিশুতির একটু ভয় লেগে ওঠে বুঝি?
যখন সে স্কুলে পড়তো, জোহরের আজান পড়ার পর তার ছটফটে ভাব শুরু হতো । একটু পরেই টিফিন ব্রেক, প্রথমেই সে অজু করে ঢুকতো নামাজের কামরায়, তারপর টিফিন, বন্ধুরা মস্করা করে বলতো ‘ধর্মের বড়ি’ । কয়েকজন তাকে অদ্ভুত সব রূপকথা শোনাতো’ বলতো তাদের সাথে যোগ দিতে । সরল যুক্তি ওকে সেই প্ররোচনা থেকে বিযুক্ত করলো । অনেকদিন পর কলেজের এক সভা শেষে অনেকের সাথে মিছিলে বেরিয়েছিলো সে, বিপ্লবের জোসে টের পায়নি পাঁজরের একটু নীচে রক্তের ধারা, সাদা ইউনিফর্ম লাল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে । কারা তাকে বের করে এনেছিলো? ডাক্তার, সেলাই, ব্যাণ্ডেজ, অনেকদিন তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা, বাবা মায়ের দিব্যি…..
নিশুতি দেখে মায়ের মুখটা কেমন বেঁকে যাচ্ছে, কান্নার মত । সে যখন ছোট ছিলো, কোন দুঃস্বপ্ন দেখলে মা তাকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে পিঠে চাপড় দিতো আস্তে আস্তে, আর মাথায় ফুঁ দিতো । এই মূহুর্তে নিশুতি মা কে কাত করে দিলো. পিঠ চাপড়াচ্ছে. ফুঁ দিচ্ছে মাথায় । মায়ের করুন মুখে স্বাভাবিক আভা ফিরে আসছে ।
এখন সে ঢুকছে আসাদ ম্যানসনে, তিনতলায় যাবে, আসর আছে । পথটা ঘিঞ্জি আর সরু, দুইপাশে বিল্ডিং । এই অন্ধকারে অচেনা একটা ছেলে তার বুকে হাত দিয়েছে! কয়েক সেকেণ্ড হতভম্ব ভাব কাটতেই একটা চড়, ধাওয়া করছে ছেলেটাকে । ছিঁচকেরা তত সাহসি হয় না, ছেলেটা আপ্রাণ দৌড়াচ্ছে, ভেগে গেলো । নিস্ফল ক্রোধ নিয়ে আসরে বসে আছে সে, কাউকে এই সত্য বলার উপায় নেই ।
নিশুতি দেখলো মা ছটফট করছে ঘামছে । মা, মা, ডেকে উঠলো মেয়েটা, কি হয়েছে তোমার? মা চোখ মেললো ,একটু পানি দেও মামনি । পানিটা খেয়েই আবার ঘুম ।
-জাগো মা, ক’টা বাজে জানো?
-কটা!
-সাড়ে দশটা ।
-ওরে বাবা, এত বেলা পর্যন্ত ঘুমালাম?
-ওঠো তো, আজ ছুটির দিন, একসঙ্গে নাস্তা করবো ।
সে চোখে পানি ছিটাচ্ছে, এত ক্লান্তি কোথা থেকে এলো? সারারাত ঘুমিয়েও! একটু কম সচেতন হলে বেঁচে যেতে, নিজেকে ধমকায় সে, কি ক্ষতি হতো মানুষ না হয়ে নারী হয়ে বাঁচলে? আজ তোমার চোখ ঘুমায় আর নিউরোন পথে পথে ঘোরে? কাজের মেয়েটা কুসুম ভেঙ্গে যাওয়া ডিমপোচটা সামনে রাখতেই নিউরোন তাতিয়ে উঠলো । এখন পিরিচটা ছুঁড়ে মারতে পারলে তার একটু ভালো লাগবে ।
গতরাতে অনিচ্ছুক একটা পার্টির সদস্য হয়ে সে ক্যাম্পফায়ার ঘিরে নেচেছিলো। আরও অনেক চেনামুখ, কড়া মেকাপ, ট্যান করা হাসি, চৌবাচ্চায় ঢালা হয়েছিল স্প্যানিশ ওয়াইন, তার মধ্যে কুঁচি করে কাটা আপেল আর কালো আঙ্গুর। আগুনে ভেড়ার রোস্ট, অচেনা মুখোশ, চেনা চোখ। ভোররাতের একটু আগে গেস্টহাউসের রুমগুলোতে সবাই যখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে ছিলো এবং ঘোরমগ্ন অনুভূতি নিয়ে সে ও একটা ডিভানের ওপর, তার চোখ অসার ছিল, শরীরও। কিন্তু একটা দরজা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছিলো না। সেই পথ দিয়ে অনেক পথে যাওয়া যায়, খয়েরী বার্নিশ করা পেতলের হাতল লাগানো দরজা, বেরোলেই সন্তদের পুরোনো গোরস্তান।
গেটে তালা, শেষবার ওখানে শুয়েছিল হিলডা উইলিয়ামস, নিরানব্বই বছর আগে। সাহেবের গোরস্থান, ঢোকার অনুমতি নেই, যে লোকটা মাসে দুইবার জায়গাটা পরিষ্কার করে তাকে ঘুষ মাত্র একবারই ঢুকতে পেরেছিলো সে। ঝাউগাছের ঘন পীত হয় আসা অনেক ওপরের পাতারা টুপটাপ ঝরছিল, ওরা কিছু বলতে চায়? সে জানেনা, পাতাদের ভাষা শেখেনি। অনেক পুরোনো মাটির ঘ্রান, মরচে পড়া লোহার গন্ধ, এখানে স্পন্দন দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঘুরছে। তার প্রার্থনাসভায় যেতে ইচ্ছে করে।ফাদার অ্যান্টোনিও গিলবার্ট বেশ মিশেল টানে সম্ভাষন করলেন, আও ইয়ং লেডি, আইজ কোরগোশের মাংশ রান্ধা হইসে।
দরোজা আরেকট পথ কে উম্মোচিত করে, টানা আটদিন বৃষ্টি হচ্ছে, এই ভাটির দেশে একবার বৃষ্টি শুরু হলে থামতেই চায় না। আমানতগঞ্জ এলাকায় যে বাড়ি তাদের, কাঠের দোতলা, পশ্চিমমুখী পুকুরের পাশের কামরাটা তার, সঙ্গে ঝুল বারান্দা, সেখানে চুপচাপ বসে আছে সে, টিনের চালে অবিরাম ঝরছে বিষন্নতা।উঠোনে চোখ পড়লো তার, অবাক কাণ্ড, পুকুরের উত্তরকোনা দিয়ে একেবেঁকে উঠে আসছে বৃষ্টিহত অসংখ্য কই মাছ, ভরে উঠছে উঠান। আর বৃষ্টিতে ভিজে বৌ-ঝি রা কপাকপ করে মাছ ধরে যাচ্ছে!
নদী ডাকছে, আজ বটঝুরিতে দোল খাওয়ার দিন। যখন সে পৌঁছুলো, বাতাস পড়ে এসেছে, বালিমাখা রোদ শরীরে লেপ্টে যাচ্ছে।ছেলেমেয়েদের দস্যিপনায় ঘোলা হয়ে উঠেছে জল, তারও খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু সময় কিছুতেই অনুমতি দিচ্ছে না। নাহ, আজ সে ভাসবে না। খেয়াঘাটের টংঘর পেছনে ফেলে উজানের দিকে হাঁটতে থাকে। বেলতলার কাছাকাছি বুড়ো বটের সাথে একটা জবুথবু হিজল, লতায় ঝুলে আছে হলুদ ফুল। খালুই হাতে তপা যাচ্ছে, -কি মাছ? -দগরী, কিনবেন? এক্কেরে টাটকা। নাহ, মাছ নিয়ে এখন ঘোরা যাবে না বরং উঁচু ঢালে বসা যাক।
ফোন বাজছে, ‘কবে আসবে মা? বদ পার্টি শেষ হলো? নানুবাড়িতে আমার ভালো লাগছে না।‘ তার মনে পড়লো, কাল রাতে সে নেচেছিলো, মুখের কৃত্রিম রঙ ধোয়া হয়নি, মুখোশ বদলাতে হবে। বাটলার লেবুজল নিয়ে এসেছে, হ্যাঙওভার কাটবে তো?
আজ সন্ধ্যায় চৌরঙ্গি থেকে রসমালাই আনা হয়েছে, সে মুখের কাছে নেয়ার আগেই হিপো কায়দা করে লাফ দিয়ে ছিনিয়ে নিচ্ছে । সেই যখন থেকে রসমালাই এলো তার কোলে আয়েশ করে বসলো হিপো, সাড়ে পাঁচ মাস বয়সের অ্যালসেসিয়ান । কোন কোনদিন দিব্যি আরামে তার বিছানায় শুয়ে আয়েশ করে সে, হতচ্ছাড়ার চোখ এড়ানোর উপায় নেই, রোজ তার সাথে স্কুল পর্যন্ত যাবে । ভালোই হয়েছে, বখাটেরা পালিয়েছে । আজ জেসি আসেনি । কেনো? সমস্ত ক্লাসে ঐ একটাই মাত্র বন্ধু তার । কারো কাছে খবর আছে? নিউজডিপো লাভলির কাছে আছে, আজ জেসির বিয়ে, কি সাংঘাতিক! মাত্র ক্লাস নাইন! সে কেনো জানেনি!
পাথরঘাটার বাড়িটাকে সবাই বলতো শিউলিনন্দন । শীতকালে গালিচার মত ছড়িয়ে থাকতো সাদা কমলা রঙের পবিত্রতা । জ্যাঠা অপেলি গোমেজ রোজ আসতো কি সব ছুতা নিয়ে, ফিরিঙ্গি পাড়ার মেয়েগুলোর ভারী দূর্ণাম ছিলো । কেনো যে! ওদের কমিউনিটি আলাদা, বাঙালী কিছু ছুঁচো দিব্যি ঘুরঘুর করে ওদের পাড়ায়, ব্যতিক্রম অপেলি আসে বাঙালির ঘরে । বড়’দা বলে দিয়েছে নিয়ম ভেঙ্গে সে অপেলিকে ঘরের বৌ বানাতে পারবে না । কাহিনী তাহলে এই! আপেলি কার হলো সেটা জানার আগেই বাবন নোটবুকটা নদীতে ফেলে দিলো । স্টিমার তখন মেঘনায়, দুলুনি ঘূর্ণির দিকে যাচ্ছে, সে কেবিনে না ঢুকে বয়া ধরে বসে রইলো । বাবন জানে না, অপেলি আপার সাথে তার যোগাযোগ আছে । অপেলি আপা বরের সাথে এখন ম্যাসাচুসেটস থাকে।
বন্ধুরা মজা করে তাকে হোস্টেলের ভূতুড়ে কামরায় আটকে রেখেছিলো, ওরা জানতো না, তার অন্ধকার এবং উচ্চতায় ভীতি আছে । জ্ঞান ফেরার পর প্রথম কথা ছিলো, ‘নোংরা মোজা সরা’ সবাই ভয় পেয়েছিলো। একবার সদর রোডে দুই রাজনৈতিক দলের ক্রশফায়ারে পড়ে তার বাম হাতের কব্জিতে গুলি লেগেছিলো আর কয়েকটা স্প্লিন্টার পাঁজরে, সেইদিন ভয় কোথায় ছিলো? অথচ অন্ধকার কিংবা ছাদের কার্ণিশ! মনে হয়, এখুনি পৃথিবীর অধরা পাতাল তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে, তার কন্ঠে কোন ভীতিকর শব্দ গোঙ্গাচ্ছিলো, নিশুতির মনে হলো ঘুমঘোরে বোবা ভূত এসে মা কে ধরেছে।
একবার সে একটা মন্দ কাজ করেছিলো, একটা বেড়ালের লেজের আগা কেটে দিয়েছিলো আর সেখানে বেঁধে দিয়েছিলো তারাবাতি । বাতির মুখে আগুন জ্বালিয়ে দিতেই পাগলের মত ছুটছিলো বেড়ালটা, জ্ঞানত প্রথম পাপ । আজও অপরাধবোধ তাকে সংকুচিত করে রাখে । তাই বলে বেড়ালটা ছাড়েনি তাকে, সেই শীতের রাতে যখন লেপ এবং কম্বল দু’টোই মুড়ো দিয়ে ঘুমিয়েছিলো, একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি নিয়ে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিলো । খুব কাছে দাঁড়ানো ছিলো ন্যাড়াখোঁড়া সাদা একটা বল, কে? চীৎকার করে উঠে বসেছিলো সে। কেয়াও শব্দ করে বেড়ালটা খাঁমচে দিয়ে গেলো তার বাহুমূল থেকে কনুই । প্রথমে ভেবেছিলো পেট সেমিট্রি থেকে উঠে আসা বেড়ালের আত্মা, তারপর মাথাটা কাজ করতেই বাতি জ্বালিয়ে দৌড়ঝাঁপ । হতভাগা কোথা থেকে এসে কোন পথে পালালো? হাত বেয়ে রক্ত ঝরছে আর চৌদ্দটা ইঞ্জেকশনের যন্ত্রণা।
প্রশ্নটা মাথায় নিয়ে সেদিনও সে ঘুরেছিলো সারা শহর । আসলে তার কোন গন্ত্যব্য ছিলো না, একটা পেপার মাথায় দিয়ে কিছুক্ষণ বসে ছিলো মুচির বাক্সের ওপর, জুতো সেলাই শেষ হওয়ার পর মনে হলো খিদে পাচ্ছে, অনন্যায় বসে দুটো শামি কাবাব খেয়েছিলো তারপর সাগরদি হয়ে তিরিশ গোডাউন, যেখানটায় নদীর নাম আলাদা হয়েছে সেই সঙ্গমে বসে প্রশ্নটা আবারও জাগলো, আমি কেনো তোমাদের মত নই? কেনো আমার গোপন বই খুলে তোমরা লেখাগুলি পড়ো? আমার জন্য যত পথ বানাই তার ওপর দেয়াল তুলে কি সুখ পাও? বলেছি তো শেকলের আহ্বানে আমি সাড়া দেবো না! কেউ তাকে কোন উত্তর দেয়নি, নীতিবাক্য চাপিয়ে দিয়েছে । তারপর মনে হলো, একটা অনন্ত ঘুমের কাছে যাওয়া যেতে পারে, মাত্র দু’শো ঘুমবড়ি । ভুলটা করার পরেই প্রথম নিজেকে প্রহার করলো সে, কাদের জন্য মরছি আমি? কেনো ভাবিনি নিজের জন্যে বেঁচে থাকতে হয়! সে ফিরলো তার নিজের কাছে, নিজ যোগ্যতায়, রক্তসম্পর্কের বহুল প্রচলিত ঋণ শোধ করে । হাসপাতালের দিনগুলিতে তার প্রথম প্রতিজ্ঞা ছিলো, আমি আমার ছায়াগুলোকে পরিত্যাগ করলাম।
রাত কত হয়েছে কে জানে? খাবার টেবিলে মাথা রেখে বেবী চেয়ারটায় বসে আছে সে । মানুষের আয়ু কতদিনের? অর্ধেকের বেশি বয়স ঘুমিয়ে কাটানোর দরকার কি? নিউরোনগুলি যন্ত্রণা করে, ঘুমাতে চায় না । সম্ভবত তারা আয়ুকালের পরিধি বুঝতে পারে । গুরুমস্তিষ্কে প্রবেশ করেছো মানেই ডুবলে, নিজেকে শোনায় সে কিংবা এরকম, 'পাগলেরা উন্নত চিন্তাশীল হয় ।' ঘুমটা জরুরী ছিলো কিন্তু দোল পূর্ণিমার চাঁদ প্রতিকী আলো ছড়িয়ে তার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে ।
কিভাবে নীরব থাকে মুখ, আর চোখ বলতেই থাকে? যদি ভালোবাসার প্রশ্ন আসে, তাকে তুমি ভালোবাসতে পারবে না, কারণ, সে তোমার চেয়ে বয়সে ছোট! তার ক্লান্তিকর মুখটাকে বুকে জড়িয়ে স্বান্তনাবাক্য বলা যায়, প্রেমপূর্ণ সোহার্দ্য আসতে নেই । বাবা স্পষ্টতই বলে দিয়েছেন, এরকম কোন সম্ভাবনা থাকলে মুছে ফেলো, নিশ্চই তোমার জন্য আমাকে মরতে হবে না? ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল । নিউ ভাটিখানা ছাড়িয়ে কাউনিয়ার দিকে হাঁটছে সে, কালো সিল্কের শাড়ি, নিপাট কালো কোন শোক বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার সাথে । ট্যোবাকোর ঘ্রাণ আসছে, তাইতো? এখানে সিগারেটের ফ্যাক্টরি রয়েছে । তার অবশ্য যাওয়ার কথা কালুশা' সড়ক, ঘরগুষ্টির দাওয়াত সেখানে, আর সে কাউনিয়া জানুকি সিং রোডে দাঁড়িয়ে ভাবছে, আজ দুপুরে মামির বাসায় খাবে, লাল করে রাঁধা রামছোছ মাছ দিয়ে ঝরঝরে ভাত ।
মামীর ঘরদোরের শ্রীছাদ যাচ্ছেতাই, তিনি ডাক্তারদের ডাক্তার, বরিশাল মেডিকেল কলেজের শিক্ষিকা। মামাও, তবে সে হাতেম আলি কলেজের একাউন্টিংয়ের প্রফেসর, দারুণ জুটি । এই মূহুর্তে দুইজনই বাসায়, বাড়তি মেহমান এই অস্থির ভাগ্নিটা । ঠিকই রামছোছ মাছ রান্না হয়েছে, মামি বেশ সাহিত্যের ভাষায় বললেন, এটাকে কিন্তু তপসি মাছ বলা হয়, জানিস তো? জানি। তাহলে এটা জানিস না কেনো, নিজের জীবন নেয়ার চেষ্টা আসলে পাপ! হ্যাঁ, মামি সেইদিন তার মাথা সোজা করে ধরে রেখেছিলেন, খবরদার চোখ খোলা রাখো, খোলা রাখো.............. একই কথার অনুরণন। দুটো পাইপ কন্ঠনালি চিরে ঢুকে যাওয়ার স্মৃতি মনে আছে, তারপর সবই অন্ধকার । আর কোনদিন এইরকম হবে না মামি, তিন প্রমিস । খেঁজুর গুড়ের পায়েস দিয়ে ডেজার্ট আর বিকেলে ছিলো পেঁয়াজ, মরিচ, আদা কুচানো দিয়ে মাখা মুড়ি, লাল চা । এখন বিকেলবাতাসে হাঁটতে হাঁটতে সে বাসায় ফিরবে ।
গ্রাম থেকে খবর এলো, ফসল কাটার মৌসুম এসে গেছে, মা বাবা দুজনেই গ্রামে চলে গেলেন । এখন চারবোন মিলে ঘর সামাল দিতে হবে, পঞ্চমজন ততদিনে সংসারী । সে রাঁধতে ভালোবাসতো বলে, হেঁসেলটা তার জিম্মায় ছেড়ে যেতেন মা । কেউ কোনদিন বলেনি, তার মশলার মিশ্রণ খারাপ । তবে দিনগুলিতে বাইরে বেরুনো যেতো না, অপেক্ষায় থাকতো তুলসি গেরেজ, শংকরমঠ, লুচি তরকারী নিয়ে নিরু মাসিমা, ঘুড়ি ওড়ানোর মাঠ, বিএম কলেজের ক্যান্টিন, বন্ধুদের আড্ডা, কীর্তনখোলা ।
একবার হোগলার বনে সে একটা বিবস্ত্র লাশ দেখেছিলো, বিক্ষত এক নারীর, পুলিশ…হাতকড়া... জনসমাগম । এখনও মানুষের রক্তের গন্ধ সে আলাদাভাবে চিনতে পারে । হঠাৎ করেই একধরনের ভয় এবং নিরাপত্তাহীনতা তাকে অবশ করে রাখে । নারী পুরুষের সম্পর্কে নিশ্চই সমঝোঁতা থাকবে, জোর করে ভাঙা কাঁচগুলোকে জোড়া দেয়া যায়? এইসব ভাবতে ভাবতে মহাবাজের দিকে যাচ্ছিলো সে । বেবি কয়েকদিন থেকেই খবর দিয়ে যাচ্ছে । বিয়ে না হওয়ার অপরাধে কাল তার মা খুব মেরেছে মেয়েটাকে ।
চকবাজারে সে কেবল কেনাকাটার জন্যই যেতো, তার আড্ডা ছিলো সোনালি সিনেমাহলের কাছে, কালিবাড়ি রোড, আর মহিলা কলেজের পিছনদিকের বাড়িটায় । ওখানে নতুন আসা মুভি ভিডিও ক্যাসেটে দেখা হতো, ঝালমুড়ি, গান, কবিতা আর বেহুদা নাচ চর্চা । এমনি এক দুপুরে গোলাপি পর্দাগুলি উড়ছিলো । খালাম্মা তখন ঘুমিয়ে, সে আর পিউলি কবিতার বারোটা বাজাচ্ছে আঞ্চলিক উচ্চারণে । কলিং বেল বাজলো? কে এই চৈত্র দুপুরে? পিউয়ের মামাতো ভাই । বসার ঘরটায় ওরা শুয়ে ছিলো, সেখানেই যে ঢুকে পড়বে ভদ্রলোক কে জানতো? ওরা বড্ড এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে যে! হঠাৎ ত্রস্তভাব, কামিজ ওড়না ঠিক করে উঠে বসা, চারটে চোখের পরিচয়, তারপর উঠে পড়া । ভাবের লেনদেন ছিলো না, সে চলে এসেছিলো একটু পরেই । কিছুদিন পর পিউলি জানালো, মানুষটা মরে গেছে, ক্যান্সারে । একটা নোটবুকের অসম্পূর্ণ অধ্যায়ে লিখে গেছে তার নাম । গোলাপি আভায় জড়ানো প্রথম এবং শেষ ভালোবাসার কথা ।কি বিস্ময়! প্রথম দর্শনে ভালোবাসা এই কলিযুগে আছে? তার একটু কষ্টও হয়। মানুষটার চেহারাও তার মনে নেই!
সাজগোজ বুঝতো না বলে কত বিপত্তি । ভালোবাসার মানুষটার জন্য তার সাজতে ইচ্ছে করতো । তখন সে কানে পড়তো পোখরাজ বসানো লম্বা দুল, চোখে এক ঝাপটা কাজল, কোমর ছাপানো চুলগুলি ছেড়ে রাখা । সেই দিনগুলিতে সে নারী ছিলো, চুম্বনের স্বাদ বুঝেছিলো, রোমকূপ জেগে ওঠার ঘ্রাণ বুঝতো, তার হাত কখনই মেহেদিশূন্য থাকতো না । তারপর কালোমতন ধুমসী মেয়েটা একদিন এসে বললো, বাবন আমাকে ভালোবাসে। কলেজের সবচেয়ে নাকউঁচু মেয়েটি প্রকাশ্যে জানালো, বাবন তাকেই চায়। গৃহকর্মী বললো, প্রথম শরীরের সুখ সে ই বাবন কে দিয়েছে। এতগুলি আলোর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে? সে দিশাহীন হয়ে পড়লো । তারপর বাবন এদের কারোই হলো না, সে এক বিমূর্ত ফাঁদে পড়ে দুটো বাচ্চার বাপ হয়ে গেলো । বাবনের সাথে এরপর তার দুইবার দেখা হয়েছে, প্রতিবার প্রেম কে বুঝতে না পারার কান্না ছিলো তার চোখে। তৃতীয় বার সে শুনেছিলো, হার্ট অ্যাটাকে বাবন মারা গেছে । অনেকদিন সে কেঁদেছে, কিন্তু লাশ দেখতে যায়নি, হাসিচোখের ছবিটাই থাক ।
দেলোয়ার বলেছিলো, আপু, কাল আমরা ভিক্ষা করতে ঝালকাঠি যাবো । এটা একটা ইউনিক আইডিয়া, সেখানে কেউ আমাদের চিনবে না । ভিখিরির পোষাক? শেষতক বস্তি থেকে আনতে হলো নতুন পোষাক বদলে । ওরা গিয়েছিলো বেশভূসা সাজেই, নীতুদির বাড়ি পৌঁছে পোষাক বদলালো, নির্ভেজাল ভিক্ষুক । অন্ধ ভাই কে নিয়ে বোন সুরে সুরে ভিক্ষা করছে ঝালকাঠির পথে । দিনশেষে রোজগার একশ সত্তর টাকা কত পয়সা যেনো । এই হতচ্ছাড়া কাপড় বদলাই আগে, ভারী গন্ধ । দিনশেষে বরিশাল ফিরে দুই ভাইবোন সকাল সন্ধ্যায় বসে পেটপুরে মিস্টি খেলো । আপু আবার খয়রাত করতে কবে যাবো? দেখি । সময়টা বের করার আগে পড়ার চাপ, পরীক্ষা । এদিকে হাটখোলা ওদের বাড়ি যাওয়া হলো একদিন, দেলোয়ারের মা কাঁদছিলো, ছেলে তার প্রেমিকা কে নিয়ে ভেগেছে!
প্রেম বিষয়টা সে ঠিকমত বোঝে না । কখনও মনে হয় এটা একটা রোগ, কখনও প্রয়োজন, বিশ্বাস হারানোর লজ্জা কিংবা দীর্ঘমেয়াদী পঙ্গুত্ব । সেবার তিনটা ঘটনা পরপর ঘটলো, ইনসান ভাইকে সৌদি আরব পাঠিয়ে দেয়া হলো, বাপের হোটেলের টাকা বন্ধুদের খাইয়ে ব্যাবসা লাটে তুলে দিয়েছে সে । বন্ধু হেলাল এসে কাঁচুমাচু হয়ে বললো, লিটন তোকে ভালোবাসে, লজ্জায় বলতে পারছে না । সে মারাত্মক আহত হলো, তবে কি নারী পুরুষের নির্ভেজাল বন্ধুত্ব অসম্ভব? ভেঙ্গে গেলো তাদের সাগরদি মেডিকেল চষে বেড়ানো দলটা । সেইরাতে দুই ক্যান হোয়াইট হর্স খেয়ে সে নামলো পুকুরের নীরব জলে, কলা গাছের বাকল আঁকড়ে চিৎ হয়ে ভাসলো । ওই তো আকাশের মাঝামাঝি ক্যাসিওপিয়া, আমার ক্যাসিওপিয়া, আমার প্রেম । বিকেলে অবশ্য আরেক ভালোবাসা দেখেছে সে, বাবা মায়ের কুৎসিত ঝগড়া । ক্যাসিওপিয়া, মেঘের আড়ালে যাও, আমি প্রেম ভালোবাসা বুঝতে পারি না ।
তার একটা আতঙ্কের জায়গা কেমিস্ট্রি ক্লাস শেষে ল্যাব । গেলো সপ্তাহে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিলো, তাহমিনার হাত ফসকে স্যালফিউরিক এসিড ছিটকে তার গলা আর পাঁজরে পড়েছিলো। সে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি কিন্তু নাহারের থুতনি ঝলসে গেছে । কয়েকদিন ল্যাব বন্ধ ছিলো । তাহমিনা কে টিসি দিয়ে কলেজ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে । নাহার হাসপাতালে, তার নিজেরও কয়েকটা জায়গা ফুঁসকুড়ি পড়ে গেছে । এর সপ্তাহখানেক পড়ে সেই বিভৎস দৃশ্য । গতকাল কলেজ সময় পার হওয়ার পরেও বিএসসি'র শর্বাণী দিদি কে পাওয়া যাচ্ছিলো না । আজ তাকে ল্যাবে পাওয়া গেছে, স্যালফিউরিক এসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেছে । তখনও বাইরে মাইকিং হচ্ছে, 'শর্বাণী নামের একজন একুশ বছরের মেয়ে গতকাল দুপুর থেকে নিঁখোজ....................................'
বিরক্তি বাড়ছে, এখানে এখন কিছু নেই । মাধবীরা ইণ্ডিয়া চলে গেলো, ওর সর্বশেষ বন্ধুটি । খুব কেঁদেছিলো মাধবী, সংখ্যলঘু হওয়া পাপ এই কথা বলতে বলতে, খুব কম মূল্য বাজার রোডের বাড়িটা বেঁচে ওরা চলে গেলো । মাধবী বলেছিলো, পৌঁছে ঠিকানা দেবে, অনেক বছর পেরিয়েছে, ঠিকানা আসেনি । একটা এসিডের বোতল এনে সে লুকিয়ে রেখেছে ক্লোথ কাবার্ডে । তার প্রিয় খরগোশ দম্পতি মারা যাওয়ার পর সে আরও নিঃসঙ্গ । প্রতিরাতেই হোমিওপ্যাথির শিশিটাকে দেখে নেয় সে, নাইট্রিক এসিডে ভরা এবং তার শর্বাণী দিদির মুখটা মনে পড়ে । মুখ? ঠোঁট থেকে কণ্ঠনালী ঝলসে বিকৃত এক মাংসপিণ্ড । সিদ্ধান্ত নিলো সে,ঝলসানো তরল ঢেলে দিয়ে এলো জোয়ার ভাটার নায় । পরদিন কলেজ যাওয়ার সময় আঁতকে উঠলো, জোয়ারের সময় আসা অনেক মাছ ক্ষতবিক্ষত হয়ে মরে ভেসে আছে ।
খায়, বটের ঝুঁড়ির আড়ালে বিশ্রাম করে । একটা পরিবারের সাথে সখ্যতা হয়েছে, তাদের কাপড় পরে জ্বিন দীঘিতে স্নান করে, গ্রাম্য নির্জনতার সাথে মিশে যায় । বিপত্তিটা না জানিয়ে এলো, অনু খালা বললেন,-এইদিকে আর আইও না মা । -কেনো খালা? -এইডা সর্বহারা গো এলাকা । হেরা পেলান হরছে তোমারে আটকাইবে, তোমার বাপের কাছ গোনে টাহা আদায় হরবে, আরও খারাপ কিছু অইতে পারে ।-এত কিছু তুমি কেমনে জানো? -মোর বড় পোলায় কইছে । -সে ও কি সর্বহারাদের দলে? -ঠেইক্কা মাগো, জমি জিরাত বাঁচাইতে, মোগো বাঁচাইতে, আইজ এই পথে পোলাডা আমার । দেরি হইররো না, মোগো একটা পাট বোঝাই গরুর গাড়ি শহরে যাইবে এট্টু পর, নেহাল হেই গাড়িতে লুকাইয়া তোমারে পার হইরা দেবে । পাট পঁচা গন্ধ খারাপ লাগেনি তার, মানুষের পঁচনে কলজে পুড়ছিলো । চারদিকে সদ্য শুকানো পাটের আঁশ, মাঝখানে লুকিয়ে বসে ছিলো দুই মাইল পথ, তারপর নদী পার হয়ে বাসায় । আর কোনদিন ওখানে যাওয়া হয়নি, মন বিদ্রোহ করেছে, মন কে সে দিয়েছিলো কুমন্ত্রণার দাওয়াই, বুড়ো বট ইতিহাস হলো আর সে দাপুটে খেলোয়ার ।
পরিধি কমে আসার যন্ত্রণা অসহনীয়, যেমন, মা বুঝতে পারে, সে মেয়েকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখায় । বাবা উদাসীন নয় কিন্তু সে মেয়েকে পাগলের ডাক্তার দেখাতে নারাজ । হঠাৎ দুপুরে খবর এসেছে সহপাঠী মীরা অপারেশন থিয়েটারে মারা গেছে, ওপেন করার আগেই অ্যাপেণ্ডিসাইটিস বার্স্ট করেছে… তার নিজেরও অ্যাপেণ্ডিসাইটিসে জখম । বাবা এত ভয় পেলেন যে, সামনে মেয়ের কলেজ ফাইনাল জানা সত্বেও ঢাকা নিয়ে এলেন তাকে, ভর্তি করলেন ক্লিনিকে । বারো ঘন্টা তাকে ভারী কিছু খেতে দেয়া হয়নি, জল দেয়া হয়নি কয়েকঘন্টা । সে হেঁটেই ওটিতে গিয়েছে, অপারেশন বেডে শুয়েছে, যন্ত্রপাতি দেখেছে । মাথার কাছে যিনি অ্যানেসথেসিস্ট দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি বিদেশি, একমাথা কোকড়া সোনালী চুল মাথায় । তার দিকে তাকাতেই মিস্টি হেসে সে বললো, ‘ডোন্ট ওয়ারি ইয়ং লেডি, ইটস এ মাইনর সার্জারি, ইউ উইল বি ওকে, ব্রেভ গার্ল ।‘ মাস্ক গলে জুঁই ফুলের ঘ্রাণ, ওটির দরজা বন্ধ হওয়ার আগে বাবা-মা কেমন করুণ চোখে তাকিয়ে ছিলো । আচ্ছা, তার জ্ঞান যদি আর ফিরে না আসে? ফিরে এলো, তখনও সেলাই শেষ হয়নি, তার অমানবিক চীৎকার, অপারেশন থিয়েটারে দৌড়ঝাপ । পরে ডাক্তার বলেছিলো, এত অতি সচেতন রোগী আমি আর দেখিনি, সময়ের আগে কিভাবে জ্ঞান ফিরলো!
জেসিকে দেখলো একদিন, ছেলের হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে । তার একটা বছর ড্রপ গেছে অপারেশনের কারণে । সুখি সুখি মা জেসি যাচ্ছে, -কেন বিয়েতে রাজি হয়েছিলি? -পাড়ার মস্তান সর্দার তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলো । -কিন্তু, তোর কর্তা বয়সে তোর দ্বিগুণ! -কি করা, সবই নিয়তি । সে ভাবনায় পড়ে যায়, জীবন কি নিয়তির দাস? মানি না, বিড়বিড় করে নিজেকে শোনায় সে । একুশ বছর পর জেসির সঙ্গে দেখা হয়েছিলো তার, বড় ছেলেকে ভর্তি করতে এনেছিলো মাদক নিরাময় কেন্দ্রে, তখন সে ওই কেন্দ্রের কাউন্সিলর ।
সমবয়সি চাচাতো ফুপাতো বোনেরা একত্র হলে কি হয়? রাজ্যের নিষিদ্ধ আলোচনা চলে । ফুপাতো ভাই বিয়ে করেছে, ভাবি একটু ট্যাঁরা । তাদের বাসর সাজানো হয়েছে বাড়ির কমন ঘরে, সবার জন্য ওপেন ঘর কিংবা একটা গেস্ট হাউজ । রাত শুনশান, দক্ষিণ দিকের টিনের বেড়ার ফুটো দিয়ে ছয়জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে, কিছু দেখা যাচ্ছে না, শোনাও যাচ্ছে না । আচমকা একটা মস্ত আধলা পড়লো চালে, সচকিত চারপাশ । আরে, কচুক্ষেতের দিকে দৌঁড়াচ্ছে কে? অবয়ব তো ছোটকা’র মত! তারা ছয়জনও হামাগুড়ি দিয়ে পালাচ্ছে, ধরা পড়লে সর্বনাশ । কেউ কিছু শুনতে পেলো না, তানিয়া নাকি শুনেছে, দাদা ভাবীকে বলছে, এই দেড় ব্যাটারী এইদিকে ঘোরো । সেই থেকে সবচেয়ে বড় ভাবির নাম হয়ে গেলো, দেড় ব্যাটারী ভাবি ।
পাড়ায় তিনজন লাবলু, একজন বয়রা, পরবর্তীজন ব্যাঁকা, শেষজন আইচা লাবলু । মানুষেরা কি সব টাইটেল দ্যায়! ঠিক এই মূহুর্তে সামনে আসা কিছু চৈত্র রোদ্দুরের ঝলক, চেনা পথ হারিয়ে ফেলার ভয়, প্রেমে ঘৃণা বরং একটু খেলানো যাক । বি এম কলেজের সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের পাশে ব্যাংক ক্রস চেক কেটে টাকা জমা দিচ্ছে সে, এসব নিয়ে জমা দিতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সার্টিফিকেট তুলতে হবে । বাংলাদেশ বিমানে ঝোঁকের মাথায় একটা দরখাস্ত করে বসেছে যে! এ মা, এতো দেখছি বয়রা লাবলু! কতগুলি হতচ্ছাড়াদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে । সটান গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো সে, আরে, লাবলু ভাই আপনি এখানে, প্লিজ ক্যান্টিনে চলেন, আপনার সাথে অনেক কথা আছে । আশেপাশের গুলো চম্পট, লাবলু ধরা ।
ক্যান্টিনে ঢুকে কয়েকবার মানিব্যাগ চেক করেছে লাবলু, বিষয়টা সে খেয়াল করে মুচকি হেসেছে এবং খেয়েই যাচ্ছে, সিঙারা, চপ, পকোড়া, চা, কোক । লাবলুর ব্যাপক আপত্তি সত্ত্বেও তার সামনেও একগাদা খাবার, গলা দিয়ে নামছে না । খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বয় মজিবর কে পাঠিয়েছে পান আনতে । লাবলুর অবস্থা তখন দেখার মত, পারলে কেঁদে ফেলে, চুপিসারে একবার বিল জেনে এসেছে । বাথরুমের কথা বলে ভাগতে চেয়েছিলো, পাষণ্ডিটা তাকে যেতে দেয়নি । আয়েশ করে পান চিবুতে চিবুতে বিলটা কাউন্টারে দিয়ে এলো সে, মজিবর কে দশটা টাকা বকশিশ দিলো। এবার এসে বসলো চেয়ারে, লাবলুর মুখের রঙ ফিরছে । সেদিকে তাকিয়ে সে বললো, প্রেমপত্রে এত বানান ভুল কেনো? একসঙ্গে তিনটে লাইন মারছেন, শুনেছি! গুর্দায় জোর আছে। আর হ্যাঁ, খাবারগুলি নষ্ট করবেন না, আমার মানিব্যাগে বাপের টাকা আছেবটে, আপনাকে খাওয়ালাম টিউশনির টাকাও । একটা উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার পর আজ তার অনেক ফুরফুরে লাগছিলো ।
সেবার জ্যৈষ্ঠে সোফিয়া আসার পর আনন্দ বেড়ে হলো দ্বিগুণ । দেড় সপ্তাহ তাদের বাসায় কাটালো ওরা । কাকিমা ইংরেজ, কাকা বাঙালী এবং দুজনের পারস্পরিক টান ঈর্ষণীয় । সে আর সোফিয়া শহর ঘোরে, রোদ দেখলেই সোফির আনন্দ বেড়ে যায় । এমন উজ্জল দিন ইংল্যাণ্ডে দূর্লভ । তাদের বাইরের খাবার খাওয়া নিষেধ । কাকিমা এবং সোফিয়া সহ্য করতে পারে না । এমনকি বাসায় ওদের জন্য কম মশলার খাবার রান্না হয় ।
ইংল্যাণ্ডের প্যাঁচপ্যাঁচে আবহাওয়া সোফিয়াকে ক্লান্ত করে তুলতো । তারা দুইজন যখন শহরময় ঘুরতো, উপচে পড়া রোদ গোরস্থান রোডের সবুজ ছাওয়া বাড়িটার উঠানে লুকোচুরি খেলতো, আর সোফিয়া দৌড়াতো পোষা মোরগ মুরগিগুলোর পিছনে । তার ভারী মজা লাগতোl এটা কি কোনো খেলা, সোফি? হ্যাঁ, লানডনের ওয়েদার... ইউ নো... ভেরী পচা... মেঘলা, মন খারাপ করা । তার খুব মায়া হয় সোফিয়ার জন্য, অথচ এই দেশে থেকে যাওয়ার জন্যেও সে প্রস্তুত নয় । ওরা চলে গেলো, সেদিনও রোদ কেঁদেছিলো । কিছুদিন চিঠিপত্রের আদান প্রদান ছিলো, তারপর সময় সেই সময়কেও কেঁড়ে নিলো ।
মা হঠাৎ এসে বললেন, সামনের দোকান থেকে আমাকে পাঁচফোঁড়ন এনে দে । কি ঝামেলা! এখন কিসের পাঁচফোঁড়ন? আচারে বাগার হবে আজ । তাকে উঠতেই হয় । সলিম কাকার দোকানটা তাদের গলির মোড় ঘুরলেই প্রথমে । আহামরি কিছু নয়, কৈশোর থেকেই দেখে আসছে সে । সময়ের প্রয়োজনে নতুন অনেক পন্য এসেছে কিন্তু দুটি জিনিস বদলায়নি, দোকানের নাম মায়া স্টোর এবং দোকানের ভিতরে সবার চোখে পড়ার মতন একটা হাতে সেলাই পোস্টার:
বাকির নাম ফাঁকি
দিও না ভাই বাকি
বাকি দেওয়া বড় কষ্ট
বাকিতে বন্ধুত্ব নষ্ট ।
প্রতিবারের মত সে রগঢ় করে বলে, কাকা পাঁচটাকার পাঁচফোঁড়ন বাকি দেন । সলিম কাকা ফিক করে হেসে ফেলে, ভাবিছাব তোরে টাহা না দিয়া পাডাইবে? মোরে ধুর পাইছো? সেও হাসে, কাকা পাঁচফোঁড়ন কাগজে মুচড়ে তার হাতে দেয়ার সময় একটা লাঠি চকলেট ধরিয়ে দেন হাতে, এইডা তর লইগ্যা । এইয়ার নাম জোকার, টিভিতে দেহো নাই, জোকার নামে এক ব্যাডা এই চকলেট খায়! হুঁ, তোমায় বলেছে! খালি উল্টাপাল্টা বলো কাকা!! এর নাম কোজাক চকলেট... কিন্তু আমি ঘোল খাবো । পাশের দোকানে দড়ি দিয়ে ঘুটনি টেনে দুধ থেকে মাখন তোলা হচ্ছে । পথহাঁটা মানুষেরা একটাকা দিয়ে একগ্লাস ঘোল খেয়ে যাচ্ছে ।
সি টাইপ কলোনির গলিটাকে এড়িয়ে যাবার পথ নেই, বাসায় ঢুকতে হলে ওটা পার হতেই হবে । বাবুদের মন্দিরের একটু আগে একটা খোলা সেপটিক ট্যাংক, আজ মেথরেরা ওটা সাফ করছে । ক্লাস শেষে ল্যাব ছিলো, তাও বায়োলজি । ব্যাঙের গঠনতন্ত্র এনালাইসিস করার পর এমনিতেই বমি পাচ্ছিলো, গলিতে ঢুকে আর আটকানো গেলো না । লখিয়া মেথর মাথায় করে বালতি ভরে মলমূত্র টেনে নিচ্ছিলো । পর্যাপ্ত বাংলা মদ গিলেছিলো সে । সব মিলিয়ে দৃশ্য এবং অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো যে, বাসায় ফেরার পর দাস্ত বমি করতে করতে সে অসুস্থ হয়ে পড়লো । ডাক্তার এলো, স্যালাইন দেয়া হলো, তার জ্বর এলো । এইরকম সময় জবার কথা মনে পড়লো তার । জবা লখাই মেথরের একমাত্র মেয়ে, প্রভুর ইচ্ছা, অপূর্ব সুন্দরী মেয়েটা । লখাইয়ের খুব ইচ্ছে ছিলো মেয়েটিকে লেখাপড়া শেখানোর । কিন্তু নিকৃষ্ট, নীচু জাত বলে কোনো স্কুল জবা কে ভর্তি করেনি । আজ কি লখাই কাঁদছিলো? তার ক্ষোভ কি বাংলা মদ হয়ে গন্ধ ঢালছিলো? সে কি তার জন্মকে অভিসম্পাত করছিলো? হঠাৎ সবকিছু তিক্ত লাগে । নিজেকে সে জবা ভাবতে শুরু করে ।
সে অনেক বেশি সরল ছিলো । হায়, কেউ যদি বলতো একটু গরল হয়ো, তাহলে অতগুলো জমানো পয়সা মাটির খাদ্য হতো না । সে প্রতিদিন চারআনা পুঁতে আসতো তাদের রান্নাঘরের পিছনের সোঁদা জায়গায় । এভাবে তার মাটির ব্যাংকটা খালি হয়ে গেলো কিন্তু পয়সার কোন গাছই গজালো না! কিন্তু সে বিশ্বাস করতো, অন্তর থেকে বিশ্বাস করতো, একদিন গাছ জন্মাবে । সোনালী পাতার মত ঝুলে থাকবে চারআনার স্প্যানিশ আঙুর । তারপর সে প্রার্থনা করলো, ধর্মগ্রন্থে মন দিলো, অতঃপর কাঁদলো, ইচ্ছের গাছ অঙ্কুরোদগম হলো না । অতঃপর সে একবোতল ব্লাডি মেরি নিয়ে নদীর নির্জনপাড়ে চলে গেলো । তার দিন সন্ধ্যায় সচেতন হলো, সে ঘরে ফিরলো, ঘর কিংবা ছাদ অথবা দেয়াল । সে জানলো, তার সাধ অতীতবাক্য বলে । আসলে কোনদিনই তার স্বপ্ন সত্যি হবে না । সে নিষ্ঠুরতার কাছে দীক্ষা নেয়া শুরু করলো ।
জানালাগুলি বন্ধ ছিলো, চৌচালা ঘরটার দরোজা, সম্ভাব্য সব চলাচল, তবু কিছু ছিদ্র দিয়ে আসছিলো বৈশাখের রোদ, তৈরী করছিলো সাদা কালো নকশা, দুটো খরগোশ নিজেদের মত খেলছিলো ঘরময় ।
শেষ মূহুর্তের আগেও পনির ভাই বুঝতে পারেনি, অতসি তার ভালোবাসা ছেড়ে টাকার কাছে চলে যাবে । বাবামায়ের একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় ছেলেটা আত্মহত্যা করে বসলো ।
কালও বন্ধুদের পার্টি ছিলো, একঘেয়ে, বিরক্তিকর, মুখোশআটা অসত্য হাসি । এই প্রথম সে এড়িয়ে গেলো পার্টির আয়োজন, ক্লান্ত । আলোকিত কোন পথ আছে, প্রভু? সাড়া নেই । অনাড়ম্বর জীবন? প্রভু তবুও নিশ্চুপ । সে উঠে দাঁড়ায়, এভাবে নয় হোরেশিও; বন্ধু আমার, নিজের পথটা এখন নিজেই তৈরি করে নিতে চাই ।
রাত কিংবা দিন সবখানেই নিষিদ্ধ হাওয়ার আনাগোনা ছিলো এবং শুদ্ধ বাতাসেরও ।
স্বপ্নটা আবার এসেছে, গাঢ় সবুজ নেতিয়ে আছে চারপাশে । গাছগুলো সংঘবদ্ধ, কোন পথ নেই, গভীর জঙ্গল । অ্যাসাগাই চালিয়ে লতা সরিয়ে এগোচ্ছে সে, সামনেই হারানো এক সভ্যতার চিহ্ন, একটা পাথুরে মন্দির, নাকি কোন পেরুভিয়ান পিরামিড? সে জানে, ওখানে একজন তার অপেক্ষায় অথচ পথ নেই! বেতঝোপের মত অসংখ্য প্যাঁচানো উদ্ভিদ । অ্যাসাগাই চলছে, ছড়ে যাচ্ছে ত্বক, আরেকটু দূরত্ব... আরেকটু । ওই তো মন্দিরের ধার ঘেঁষেই মানুষটা দাঁড়িয়ে, অ্যাজটেক পুরুষ । তার অবয়ব দেখা যায়, মুখটা কুয়াশার ধোঁয়ায় । আমি আসছি... চিৎকার করে ওঠে সে এবং ঘুমটা তখনই পাতলা হয়ে আসে । সব দৃশ্য মিলিয়ে গেছে, চারটে দেয়ালের খাঁচায় একটা টেবিল, ক্লোথ কেবিনেট, সারা ঘরে ছড়ানো বই, সিলিং ফ্যান নিজমনে ঘুরছে । সে চোখ বোজে কিন্তু স্বপ্ন তো জোর করে আসে না!
তার খুব ইচ্ছে করে, ঘুমটা স্বাভাবিক নিয়মে আসুক । মা বলেছে, ঘুম স্রষ্টার এক পরম কৃপা । আসে না, হয় ঘুমের অষুধ নয়তো রাত জেগে পড়া । বিশ্ব ইতিহাসের বইটা বালিশের পাশে পড়ে আছে, মায়া সভ্যতার একাংশ পড়তে পড়তেই ঘুম এসেছিলো, স্বপ্নও, সাইড বাতি রাতভর জ্বলেছে । সে খাটে ঘুমাতে পছন্দ করে না, কাঠের দোতলায় যেখানে তার কামরা, সেখানের প্রায় পুরোটাই বইয়ের তাক, জাপানী ধাঁচের একটা টেবিল, কাপড়ের কেবিনেট দেয়ালের সাথেই করা, দু’টো তোষক মেঝেতে পাতা । ব্যাস, এই তার সম্পদ, যদিও একটা ড্রেসিং টেবিল থাকতে পারতো কিন্তু হাত আয়নায় বেশ চলে যায় । স্বপ্নটা ভাবছিলো, এমন সময় মেজ'দির হাঁক, 'এই যে রঙের বিবি, তোমার ফোন ।' মেজ'দি সবসময় এমন রূঢ় আর অনাচারী । শপিংয়ের দায়িত্ব তার, সবার জন্য একসেট তো নিজের জন্য তিনসেট । লাইনে মিতালী, 'এক্ষুনি আয় প্লিজ, আমার খুব বিপদ, ফোনে বলা যাবে না ।
মিতালীর হাজারো বিপদ থাকাই স্বাভাবিক । পরশু ওর বড় ভাই এসেছিলো, সে তখন কলেজ থেকে ফিরে স্নান সেরেছে মাত্র, খেতে বসবে । -মিতি কি এসেছে রে তোর সাথে? -না তো, দাদা! -কোথায় গেছে জানিস? -জানি, আপনাকে বলবো কিন্তু দয়া করে আমাকে ফাঁসাবেন না । সব তথ্যই দিয়ে দেয়, কোন হিংসাবশত নয়, মিতির মঙ্গল চায় সে । দরিদ্র ঘরের একটা মেয়ে, ধনাঢ্য মোহের পাল্লায় পড়েছে । মিতালী নিজেও জানে না তার বয়ফ্রেণ্ড কয়জন! কলেজের পিছন গেটের দারোয়ান কে ঘুষ দিয়ে এই মেয়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছে । বিষয়টা লক্ষ্য করে দারোয়ান কে দ্বিগুণ ঘুষ দিয়ে তথ্যটা আদায় করে সে । মাহিমা কে দেখেছে ওর সাথে, শহরের সিল মারা মক্ষিরানী । সেই তথ্যই মিতির বড়ভাইকে দিয়েছিলো ও, মাহিমাদের পুলিশ লাইনের বাসার ঠিকানাও । কিন্তু আজ মিতালীদের বাসায় যাবে না সে । নিজের রয়েছে হাজারো সমস্যা, তাছাড়া কঠোর হওয়ার অনুশীলন চলছে তার । কোনো ছিঁচকে সাহায্যের নিকুচি করি, বিড়বিড় করতে করতে স্নানঘরের দিকে আগায় সে । দুদিন পরে খবর আসে, আবুধাবি ফেরত এক আত্মীয়ের সাথে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে মিতালীর ।
তারা দলবেঁধে মাধবপাশা যেতো, পরিবারের বারোজন, কাজিনরা মিলে দ্বিগুণ । এই একটা জায়গায় এলে তার মনভার উধাও । দীঘির জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে থাকতে সে দীঘির ঠিক মধ্যে আরেক টিলাভূমির দিকে তাকিয়ে থাকতো, কৃত্রিম টিলা । অসংখ্য গাছ, শাসন না পেয়ে বেড়ে উঠেছে হাজারো লতা । কতবার বাংলোর কেয়ারটেকার কে অনুরোধ করেছে মাত্র একবার ওখানে যাবার কিন্তু বুড়ো কাকা নেয়নি । 'ওম্মে মরতে যাবা, আয়? ওহানে বাবা সফেদ দেউ থাহে, হেরে ডিসটাব হরলে মোরা খতম ।' কিসব আজগুবি গল্প বানিয়ে বসে আছে! দিনটার অন্তিম কেটেছিলো মাধবপাশা জমিদারবাড়িতে । বাড়ি? না, বাড়ির কংকাল । চারদিকে বুনো লতা, শ্যাঁওলা পচা গন্ধ । দেয়ালের অনেক জায়গায় কলসাকৃতির খাঁজ, বাবা বললেন, এখানে নাকি মোহরের হাঁড়ি ছিলো । পাতারা এখন অক্সিজেন ছাড়ছে, তীব্র গুমোট । সে এদিক ওদিক তাকায়, তার মনে হতে থাকে, একটা পরিচিত অবয়ব তার ওপর নজর রাখছে ।
স্বপ্নটা আবারো এলো, সেই বনভূমি, গাদাগাদি করে বেড়ে ওঠা অলৌকিক সবুজ, পাতাঝড়ার শব্দ, বাওবাবের কন্দে একটা সতর্ক অজগর, অল্প কিছু দূরত্ব অথচ পথ অনেকদুর মরীচিকার মত ঢেউ খেলছে! কেউ একজন অপেক্ষমান ।
এখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে বলে ঢাকায় । বদরুন্নেছা কলেজে ভর্তি হয়ে নিয়েছে আগে, তারপর শুরু করেছে প্রস্তুতি । সাহানারা নামে পাশের বাসার একজন মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছে, দুজনে একই সাথে এগোচ্ছে ।
স্বপ্নটা পরের রাতেও এলো, এবার সবুজের দেহে কালচে আভা । একটা রহস্যময় জঙ্গলের রাত, অচেনা সব পতঙ্গ কলরব, কোথাও জলপতনের শব্দ, প্রপাত? সে সজাগ হয়, লাগোয়া গাছগুলির ফাঁকফোকড় খুঁজে এগোয় । স্বপ্ন কি ক্লান্ত হয়? এই যেমন সে? ক্লান্ত শ্যাঁওলার নির্যাস আর লালচে মাটি মাখা ভূত । অবশেষে চোখে পড়লো ধোঁয়ার বৈচিত্র তোলা বিশাল এক জলপ্রপাত ।
সাহানারা টেকেনি কিন্তু সে উতরে গেছে । এখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পা রাখার পালা । সেইরাতে একই স্বপ্ন! মানুষ একই স্বপ্ন বারবার দেখে?
মেমোরেণ্ডাম
১৫ জানুয়ারী ১৯৯৪
------------------------
ভূগোল পড়তে ভালো লাগে, বানিজ্যিক অংশটা বাদ দিয়ে । সমুদ্রস্রোত একটা ইন্টারেস্টিং অধ্যায় । বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের বিষয়টা কি আদৌ সত্যি? অদ্ভুতুড়ে!
১৩ মার্চ ১৯৯৪
------------------------
পিউলিরা পাকাপাকিভাবে বরিশাল থেকে চলে গেলো । পিউলির বিয়েটা এখানেই হয়েছে, তাজ ভিলায় । এমনকি ও যখন বরের সাথে ইংল্যাণ্ড চলে গেলো, সে এয়ারপোর্টে ছিলো । আশ্চর্য, তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু আর কোনদিন যোগাযোগ করেনি!
২১ জুন ১৯৯৪
------------------------
বাবার সাথে মন কষাকষি চূড়ান্ত পর্যায়ে যাচ্ছে, হোস্টেলে থাকা চলবে না, বিয়ে করতে হবে, অকারণে বাইরে যাওয়া নিষেধ, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে হবে, বোরখা পড়া বাধ্যতামূলক, বইয়ের ডিপো সরাতে হবে, যে ছেলেটা স্নেহের কাঙাল হয়ে আসে তাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না, নামাজ পড়া বন্ধ কেনো? এত খরচ বাড়ছে! লিখিয়েদের সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হবে, ইত্যাদি । রাগ দমন করা সম্ভব হয়নি, একটা টেবিল ফ্যান লাথি মেরে ফেলে ত্যাড়া করে এবং সোনালী ডিনার সেটটাকে আছাড় মেরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে সে ।
২৯জুন ১৯৯৪
------------------------
রাগ কমেনি । চারদিন হলো ছোটকার বাসায় দিব্যি আনন্দে আছে । আসার আগে অবশ্য একটা কাজ করেছে সে, কাজটা করেছে কলজের ওপর যমটুপি পড়িয়ে । প্রায় পাঁচহাজারের মত বই পাবলিক লাইব্রেরীতে দান করে এসেছে । ছোটকার বাসায় আনন্দ আছে সত্যি, কিন্তু এরা এত গিধর যে তার খাওয়া ঘুমের অবস্থা খুবই খারাপ, যেমন একজোড়া পাঠা পাঠি পালে তারা, সারা ঘরের সর্বত্র তাদের বিচরণ, একাধিক আহ্লাদি বেড়াল আছে, সূযোগ পেলে বিছানায় পেশাব করে, অগুণতি মোরগ মুরগী আছে, সারাদিন কঁকায়, একটা ডানার পালক কাটা টিয়া আছে, যখন তখন কথা বলে ওঠে, 'চোর চোর চোর' নয়তো 'অতিথি এসেছে, বসতে দাও' একদঙ্গল কুকুর আছে, দেশি প্রডাক্ট, নাম বাইসন বাহিনী, কাউকে খাবলাচ্ছে, কারও খাবার কেঁড়ে নিচ্ছে, যখনতখন এটা ওটা চাটছে, অসহ্য! মা বাবা এলেন পাঁচদিনের মাথায়, তাকে নিতে ।
২৭ আগস্ট ১৯৯৭
------------------------
কাবিন কবুল হওয়ার পর একজনের মন্তব্য ছিলো, 'আলহামদুলিল্লাহ, আমাদের আরেক সঙ্গীর মৃত্যু হলো ।'
৩০ডিসেম্বর ১৯৯৭
------------------------
যতটা ভেবেছিলো বিবাহিত জীবন তত খারাপ নয় ।
১০মে ২০০৩
------------------------
বারো বছরের ব্যবধানে চারটে সন্তান ।
১১মে ২০০৩
------------------------
স্বপ্নটা আর আসেনি ।
২৩ ফেব্রুয়ারী ২০০৮
------------------------
আগে অনেকে বলেছে, স্বভাববশত সে কান দেয়নি, একদিন দেখে ফেললো, কাজের বুয়া থেকে শুরু করে পতিতাপল্লীতে তার স্বামীর যাতায়াত আছে ।
১৫এপ্রিল ২০০৯
------------------------
প্রায় তিনটে বছর সন্তানদের বাঁচাতে আগুণের পথে চলতে হয়েছে তাকে । ঝড় থেমে গেলেও মন আর শান্ত হয়নি ।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১১
------------------------
বড় মেয়ের ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে গেলো, এমন ভয়ার্তস্বরে কঁকাচ্ছো কেনো মা! দুঃস্বপ্ন দেখছিলে? পানি দেবো? স্বপ্নটা মনের ক্যানভাসে ফুঁটে উঠলো, তীব্র শক্তিতে লতানো ঝুরিগুলো কাটছিলো সে, প্রায় কাছাকাছি এসে পড়েছিলো । একটু দম নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো, দাও মা, পানি দাও ।
সাঈদা মিমি
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
মে ০৯, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন