তাপসকিরণ রায়




উৎস হারিয়ে গিয়ে জীবনের এখন অন্য নাম। জন্মকাল মুছে গিয়ে শুধু স্মৃতিটুকুর একটি তারিখ—জন্মদিন, ধরা থাকে। শুরুতে সে দিনটা নিয়ে উৎসব হয়। তারপর ক্রমশ অন্তরাল হতে থাকে, একদিন মনে হয় যাক না হারিয়ে সেই বয়সের মাপজোক ! এক দিন মৃত্যু হবেই জানেন, ভাবনাকে নিয়ে তাই নিজেকে ঢেলে সাজিয়ে রেখেছেন রমাকান্ত। আয় রে দোলন, পট  করে কচি কুমড়ো ডগার মত ছিঁড়ে নে প্রাণটাকে। তিনি জানেন প্রাণ অজড় অমর। 

এই মাত্র রমাকান্তর মৃত্যু হয়েছে। তিনি চোখের সামনে এক খণ্ড দলা পাকানো অন্ধকার দেখতে পাচ্ছেন। ভূমির সামান্য স্পন্দন তখনও অনুভব করতে পারছেন। নিজের সত্ত্বহীন ছায়াটুকু অস্পষ্ট হয়ে আছে তাঁর সামনে--তাঁর চোখের সামনে। যদিও চোখ বলে এখন তাঁর কিছু নেই। যে হেতু শরীর ছেড়েছেন তিনি। তবু বহুদিনের অনুভবগুলি কিন্তু ছুটে যায় নি। যেমত লোকে স্বপ্ন দেখে, সেখানে চোখের বা শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছাড়াই কেমন চলতে থাকে জীবন! 

অভ্যাস অনুভূতির সংস্কার বোধ আত্মার সহজাত ধর্ম হয়, তাতে জাগতিক প্রকাশ না হলেও বৌদ্ধিক ধর্মটুকু বিদ্যমান থাকে। আর এজন্যেই বোধহয় বলে বাস্তবে মৃত্যু বলে কিছু নেই। প্রাণের সম্পূর্ণ জড়ত্ব আসতে পারে না। 

হুই--রমাকান্তর চমক ভাঙল। তিনি দেখলেন তাঁর স্ত্রী শৈলবালা অন্য পুরুষের হাত ধরে দিব্বি হেঁটে চলেছেন ! আশ্চর্য হলেন তিনি, কেন ? এমনটা কেন ? তবে কি শৈলবালা রমাকান্তকে ভুলে গেছেন ! ভাবনা এক সময় মনের ভেতর থেকে তাঁকে জানান দিল, না, এটা কোন অলিক স্বপ্নই হবে, কারণ শৈলবালা তো ইহলোকে নেই। রমাকান্ত এখন বুঝে উঠতে পারছেন না--তিনি স্বয়ং ইহলোকে আছেন তো ? অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছেন তিনি--তাঁর দেহ নেতিয়ে পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে। ছেলে, ছেলে বউ, নাতনী পাড়া-পড়শিরা সে দেহ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। নাতনী কেঁদে চলেছে, ছেলে, বৌমার চোখে জলের দাগ পড়ে আছে। 

অদ্ভুত স্বপ্ন। ওই তো শ্যামলী, ওও আছে, রমাকান্তর নষ্ট প্রেমিকা, সেও দুঃখে শোকে মুহ্যমান। তার চোখ জলজ হয়ে আছে--হুবহু নষ্ট প্রেমিকার জন্যে যেমনটা হয়। 

দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন রমাকান্ত। স্বপ্ন, নিজের মৃত্যু দেখলে নাকি আয়ু আরও বেড়ে যায়। বিষণ্ণ দৃশ্য। রমাকান্ত নিজের মৃত্যুতে নিজেই দুখী। মৃত্যুর পরিবেশকে কি ভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় ? কিছুটা দুঃখ ব্যথা তাঁর বুক বেয়েও সমস্ত শরীরে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। 
রমাকান্ত শ্যামলীকে ডাকার চেষ্টা করলেন, এই এই শ্যামলী, এই, এদিকে একটু এস তো--কি খামোখা মনের মধ্যে দুঃখ ভরছ ? না কোনও রেসপন্স নেই, তার মানে দুঃস্বপ্নই। তিনি এবার শরীর ঝাঁকিয়ে নিতে চেষ্টা করলেন, মনে হল ঘুম ভেঙ্গে গেলে আবার বাস্তব জীবনে ফিরে আসবেন তিনি--আর সে সঙ্গে মানসিক দুঃখ ব্যথারও সমাপ্তি ঘটবে। 

না, সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ। স্বপ্নগুলি আরও জেঁকে বসছে। ঘর ভর্তি লোকগুলি এবার পিলপিল করে বাইরে বেরিয়ে আসছে। বাঁশ কাঠামোয় রমাকান্তর দেহ সাদা কাপড়ে মোড়া, নাকে-কানে তুলো গোঁজা। হায় কপাল, এবার মরা কাঁধে উঠছে! ছেলে এক দিকে কাঁধ দিয়েছে। ওরে বাবা! স্পষ্টত দৃশ্যগুলি রমাকান্ত সামনে বাস্তবের ধারাবহে ঘটে চলেছে যে! এবার চমকে উঠলেন তিনি, ধ্বনি উঠেছে, বলো হরি, হরি বোল...

রমাকান্ত এগিয়ে গেলেন, চীৎকার করে ডেকে উঠলেন, আমি মরি নি, আমি মরি নি...স্বপ্ন, বিষাক্ত একটা স্বপ্ন, তিনি চোখ ফেড়ে দেখবার চেষ্টা করলেন। শ্যামলী, ছেলে বউ, নাতনী ওরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে। 

রমাকান্ত চেষ্টা করলেন, খুব করে চেষ্টা করলেন, কিন্তু শক্তিহীন জড়ত্বের অনুভূতি ভেঙ্গে তিনি যেন কিছুতেই বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। 


পরিচিতি 
তাপসকিরণ রায় তাপসকিরণ রায়  Reviewed by Pd on মার্চ ২৬, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.