কাজরী তিথি জামান

কবি পরিচিতি 
‘কপোতাক্ষ’কাজরী তিথি জামানের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র কাব্যগ্রন্থ,প্রকাশ করেছে ধানসিঁড়িটির তীরে প্রকাশনী। বইটি পড়ছিলাম,অধিকাংশ কবিতার সাথে জুড়ে আছে অনেক পরাবাস্তব দৃশ্য।অসম্ভব সুন্দর শব্দের নকশী কারুকাজে ভরে উঠেছে কপোতাক্ষের সবুজাভ আঁচল। “বিলের ধারে পানসীখানা কেমন দোলে, আমার মতো?” কী চিরন্তন এই অনুভূতির দোলা,প্রচ্ছদের ষোড়শী হয়ে উঠলাম নির্জনে,কপোতাক্ষের ঢেউয়ে ঢেউয়ে  নিয়ত ভেসে আসছিল,সপ্তমী সন্ধ্যা,শ্যাওলা বিছানো ঘাট, ডুরে শাড়িতে মায়ামাঠ আর দিগন্তের ডিঙ্গি নৌকা।কপোতাক্ষের প্রেম, বিরহ, স্পর্শসুখ, নির্জনতা কি অপূর্ব শৈলীতে ছুঁয়ে যাচ্ছিল আমাকে।হারিয়ে যাওয়াই যেন একমাত্র আনন্দ এই লেখাজ স্বপ্নলোকে।লোকজ বন্ধন ছিঁড়ে ইচ্ছে করলো নির্জনের,বসে রইলাম কপোতাক্ষের তীরে,অনেকক্ষণ।

আসলে তাঁর কবিতাগুলি একবার পড়বার পর আবারো পড়তে হবে,তবে এবার চোখ বন্ধ করে।
“ঘাসের কচি নরম ডগায় শ্বেত শিশির
সূর্যের সাত রঙ রক্তিম হয়ে উঠেছে।নিঃশ্বাসে 
পাচ্ছো না সোঁদা গন্ধ?নিশ্চুপে ভিজে যাওয়া মাটি?
আমি তোমাকে একবিন্দু শিশির দেবো,
দেখো অভিমান লাল হয়ে যাবে”
                      -একগুচ্ছ অভিমান - 
অভিমানী এই বালিকার মুখ আর গভীর নীল চিঠির ভালোবাসায় তিরতির কাঁপতে থাকা ঠোঁট আমার পাশে ছিল সবসময়... যতটা সময় ছিল কপোতাক্ষ। 
মেয়েটির শীত রাতের পাতলা কুয়াশা চিরে দেয় অব্যক্ত দীর্ঘশ্বাস,তবুও সে ভালবাসতে ভোলে না। প্রেম স্পর্শের উন্মুখ আবেগে খুলে যায় নিরাপদ কারাবাস,ঘর ছেড়ে মেয়েটি হেঁটে যায় দীর্ঘশ্বাসের পথে,জেনেশুনেই। সে জানে একমাত্র দীর্ঘশ্বাসই মানুষের চেনা বাতাস। সে উড়ে চলে অচেনা স্বপ্নঝিলের উপর দিয়ে,আর কি তুমুল ভালবাসে!
“প্রেম বুনেছে নকশী কাঁথা 
ঝিলিক রোদের সুতো...
ঘাসের বুকে ঘাসফুলেদের
রাজ্যকথার ছুতো”
স্বপ্নঝিলের পরিযান শেষ করে সে যখন নীড়ে ফেরে,বাস্তবতার পাথর আর ক্ষরণের রক্তে ভেসে যায় তার ঠোঁটে করে নিয়ে আসা ধানের শীষ।ক্ষুধা আর ক্ষরণের গদ্য উঠে আসে তার ছন্দময়তাকে ভেদ করে... 
“পথের পাশে ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত দেহটি...
বড় জোর নয় বা দশ বছর হবে
অনিয়মের দিনরাত্রি পার করে
ছয় বা সাতে এসে ঠেকে আছে”
-মৌলিক প্রার্থনা 
ঈদের রঙ্গিন বিলাসিতায় অভুক্ত টোকাই,ক্ষুধা থামিয়ে রেখেছেতার শরীরের সময়।নাম নেই,পরিচয় নেই,ঘর নেই,উৎসব নেই শুধু আছে ক্ষুধা ক্ষুধা আর ক্ষুধা।তার সাথেই তীব্রভাবে কেঁদে উঠেছে লেখিকার বোধ -
“আমি কোন উৎসব বুঝি না
উদযাপন বুঝি না,আর্তনাদ বুঝি”
-আমার সোনার বাংলা
আসলে এ পৃথিবীতে এখন বরফের দিন,বরফের রাত আর বরফের সঙ্ঘাত। হিমবাহের এ যুগে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে আমাদের মানবিক বোধ।আর বিবর্তনে সৃষ্টি হচ্ছে বহুরূপী পিশাচ।সে কারণেই বেঁচে থাকা এত দুরূহ হয়ে উঠছে মানুষের। অভিমান ফিরে আসে লেখিকার,তবে মেঘের কোমলতায় নয় সমুদ্রঝড়ের শক্তিতে।
“মানুষ জন্মে ফিরবোনা আর,বেছে নেবো...
অন্য কোন ‘অবয়ব’এবারে শেষবারের মতো সামলাবো 
জীবনানন্দের ‘কবিতাসমগ্র’ খুঁটে খুঁটে দেখবো বুনোহাঁস
ধানসিঁড়ি।কলমির গন্ধ ভরা জল
ঠাণ্ডা শীতল অনল...
অতল মরা চাঁদ,মৃতের নীরব কোলাহল”
তবুও তিনি প্রকৃতি ও প্রেমের কাছে শিশু হয়ে যান সন্ধ্যেবেলা,কোমল সন্ধ্যাদীপ জ্বালেন পয়মন্তী দেউড়িতে, ঘোমটা, সিঁদুর, আলতায়, প্রথা ও ভালবাসায়।প্রেমে ও নিসর্গের অপূর্বতায় পূর্ণ হয়ে নাম লেখান ‘পাখি বিশারদ’পরিষদে।  
“অজান্তেই পাখি বিশারদ পরিষদে নাম লিখে রাখি...
বোধ করি এটুকুই বাকি জন্মের পাদটীকা”
-বাকী জন্মের পাদটীকা 
এই যে শ্রাবণসন্ধ্যা, ভ্রমরের ডানা,অস্তমিত চাঁদ কিংবা নীরবতার নিশিডাক- সেখানেই জীবনের সার্থকতা। মেঘের দূরত্ব পার হয়ে তাঁর অনুভূতিরা আসে অচিন আকাশে পরিযায়ী হয়ে। বিকেলের আলো ফেরে সুসংবাদে।ছায়াদলে নাম লেখায় অনন্য অনুভূতির আলো। তাঁর করতলে অশ্রু রেখে উড়ে যায় শ্যামল মেঘ।
“চোখের ভেলায় মন ভাসিয়ে মন ফিরে যায়।
কেন জানি জল জমে যায় চোখের কোলে,
নোনাধারায়,মায়ায় মায়ায় ভোর হয়ে যায়।
কেমন করে,কেন এমন উল্টো দৌড়ে ভোর হয়ে যায়?”

এমনই কবির জীবন। বাস্তবতার মানুষগুলো যখন সময়ের স্রোতে সামনের দিকে এগোয়,কবির স্বপ্ননীল মন তখন পেছন ফিরে অতীত দেখে,অতীতের ভেতরে বর্তমান এবং বর্তমানের গর্ভে ভবিষ্যৎ। কবির নিয়ত এই মাছরাঙ্গার পালক হয়ে ওঠা নিসর্গের কাছে যতটা আদরের। ঠিক ততটাই আদরের হয়ে উঠবে পাঠকের কাছেও এ আমার অন্তরীণ বিশ্বাস।

পরিচিতি 
কাজরী তিথি জামান কাজরী তিথি জামান Reviewed by Pd on ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.