জয়া চৌধুরী




“সবে মুনিষে পজা মমা”- সেই কবে মৌর্য শিরোমণি সম্রাট অশোক মুখ নিঃসৃত শব্দগুচ্ছ কিংবা আদর ভাষণ শুনে আপামর ভারতবাসী নড়েচড়ে বসেছিল তাদের এতদিনে হিল্লে হলো বলে। কলিঙ্গ অনুশাসন –এ মহামতি অশোক প্রথমবার সকল রাজ্যবাসীকে নিজের সন্তান রূপে ঘোষণা করেন এবং ৩০২ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত ৪৪ বছর ধরে প্রাচীন ভারতের রঘু বংশের রাজ্যশাসন ধারাই বজায় রাখলেন। যে রঘুনন্দন শ্রীরামচন্দ্রের শাসনকাল আজও রামায়ণ কাব্যধারা বয়ে অবশেষে প্রবাদ হয়ে মানুষের মুখে মুখে ফেরে...সেই রূপকথার দেশ। যেখানে নীতি পুস্তকে বর্ণিত সব ভালো ভালো জিনিষ হত। শস্যে মাংসে ভরভর্তি পেট আর চুরি চামারি বিহীন কিংবা নীতিবান চোর ডাকাত ইত্যাদি লোকে পূর্ণ সেই সমাজ-এ প্রজারা সুখেই ছিল বলে আজকের প্রজাগণ মনে করে দেদার। ব্যাক করে করে যদি গৌতম বুদ্ধ –এর সময় লিচ্ছবি রাজবংশের কথা মনে করি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এঁদেরই তিনি গণসংঘ বলে উল্লেখ করেছিলেন। উপজাতি শাসক রা নিজেরাই নিজেদের রাজবংশ ঘোষণা করে রাজ্যপাট চালিয়েছিলেন। যদিও যেমন আর সব ব্যাপারেও অসভ্য আদিবাসীরা সভ্যতার উত্তুঙ্গ সাফল্য দেখিয়ে রীতিনীতি পালন করে আসে চিরকাল ঠিক তেমনই প্রজা নির্বাচিত রাজাই লিচ্ছবি দেশে (উত্তর বিহার আর নেপালের প্রান্ত সীমায়) প্রজাতন্ত্রের প্রথম উদাহরণ হিসাবে জাজ্বল্যমান। 

তবে কি প্রজানুরঞ্জন মানে বংশানুরঞ্জন? আসলে প্রজা মানে অধীনস্থ মানুষ জন যেমন বোঝায় আবার বংশবৃদ্ধি কেও তো প্রজাবৃদ্ধি বলা হয় বলেই শুনি। আর নিজবংশ কুলতিলক বা তিলকিনীদের জন্য তো আমাদের আদিখ্যেতার শেষ নেই। ওদিকে আবার তন্ত্রের কথা ভাবলে চাপই চাপ। তন্ত্র মানে ভেবে দেখুন রাজতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, ভুডুতন্ত্র, স্বাতন্ত্র্য...ইস যা বেলাইন হয়ে যাচ্ছে চিন্তা গুলো। ইয়ে মানে তন্ত্র মানেই সেই কালিপুজোর সময় গেরুয়া বসন পরা টকটকে ঊর্ধ্বনেত্র রুদ্রাক্ষ জড়ানো ঘোর কারণবারি  সেবিত মানুষ দ্বারা অনুসৃত বিষয়ের কথাই মনে পড়ে আমাদের আম জনগণেশের। কিন্তু তার সঙ্গে জুড়ে দিন রাজ বা ভুডু বা প্রজা... গল্প বদলে বদলে যায়। বহুকাল ট্যারা হয়ে ভাবতাম ডেমোক্র্যাসি আর রিপাবলিক এর তফাত কোথায়? পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র না হলে এ জন্মই বৃথা এমন ধারাও ভাবতে শুরু করেছিলাম। বহুকষ্টে হেঁচড়ে মোটামুটি যা জানলাম তা হল তুমি ডেমোক্র্যাট হলে শাসক নির্বাচনের স্বাধীনতাই পেতে পারো শুধু। কিন্তু রিপাবলিক দেশ হলে তোমার নিজের মত প্রকাশজনিত ও আরো কিছু অধিকারও রাষ্ট্র সূত্রে প্রাপ্য। এইটে জানার পর থেকে আমার তন্ত্র শব্দে দারুণ ভক্তি বেড়ে গেল। কারণ আফটার অল ওইটে প্রজার পেছনে এঁটে দিতে পারলেই এক করতল স্বাধীনতার সুখ যে পাবো! 

তো এই মহার্ঘ্য প্রজাতন্ত্র কে সেলিব্রেট করার জন্য আমাদের দরদী শাসকরা সম্বচ্ছর একটি দিন রেকে দিয়েছেন গো। প্রতি বছর এই দিনটায় আমরা প্রজাতন্ত্র ঠাকুরকে পুজো দিই। প্যান্ডেল সাজাই পদ্মশ্রী, ভারতরত্ন ... ইত্যাদি মূল্যবান অলংকারের প্রাপক ঘোষণা করে। ক্রেমে ক্রেমে ঝুলি থেকে আরো বেড়াল বের হয়। তারপর ধরুন গে যান আমাদের কতখানি অস্ত্র শস্ত্র আছে , ট্যাঙ্কার, সাঁজোয়া বাহিনী, রাজ্যিক বৈচিত্র্য , মেধা জাত সম্পদ ইত্যাদি প্রভৃতি যত পারি গয়না দেখিয়ে আমরা আমাদের লাইটিং এর কর্তব্য সারি। পুরোহিত হিসাবে রাষ্ট্রনায়ক যখন কেল্লাপরি ভাষণ দেন উদ্দীপনাময়... মনে মনে ভাবি বড়ঠাকুরের পুজো এমনি করেই তো করতে হয়। তারপর দিন ফুরালে যখন পরদিন হয় তখন আবার লড়াই ছোট ছোট বৃত্তে। 

যা বাবা, এতেও হিংসে করছি? আমার কি তালে নিন্দে করাই অভ্যেস হয়ে গেলো? ঠিক তা নয় বোধহয়। দেখুন প্যান্ডেল সেজে উঠলে, প্রতিমা আনা হলে,এমনকি পুরুত মশাই পুজো করলে আমরাই তো অঞ্জলি দিই... তাই না? কিন্তু প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো কি না তার খবর কি সত্যি ই রাখি? যে ফলের কুচি প্রসাদ বলে দুহাত পেতে নিই তা কি সত্যি প্রজাতন্ত্র ঠাকুর গ্রহণ করেন প্রাণিত হয়ে? তাই যদি হবে তাহলে বাবুদের বাড়ি কাজ করতে আসা মেয়েগুলোকে সব্বার আগে এইটা মেনে নিতে হয় কেন যে বাড়ির কত্তারা অমন এট্টুআধটু গায়ে হাত টাত দিলে রা কাড়তে নেই । কিংবা তুমুল সাপ্তাহিক কর্ম ব্যস্ত দিনে হঠাত মেনে নিতে হয় কেন জনসাধারণকে বঞ্চনার প্রতিবাদে কাল ২৪ ঘন্টার ধর্মঘট? অথবা বাসে ধরা পড়া পকেটমার বেচারী পাবলিকের মার খেয়ে মরে গেলেও ট্র্যাফিকে দাঁড়ানো পুলিশ তা না দেখার ভান করে তার নরকবাস নিশ্চিত করে? সক্কাল থেকে সেজেগুজে ভোটের লাইনে হাপিত্যেশ করে দাঁড়িয়ে থাকার পরেও কেন মেনে নিতে হয়- আপনার ভোটটা পড়ে গেছে। যান বউদি বাড়ি চলে যান? আর এতসব প্রাপ্যের হিসেব ছেড়ে কর্তব্যের হিসেব মেলাতে গেলেও প্রজাতন্ত্র ঠাকুর-এর অবস্থা “তোমার দেখা নাই রে তোমার দেখা নাই” হয় না কি? না হলে কোন শোভন দেশে যেখানে সেখানে পথচলতি ব্যস্তবাগীশ বেকার সাকার মানুষেরা নিষ্ঠীবন লেপন করে অবলীলায়? অটোর পিছন সিটে বসে সারা জীবনে একটি বারও থুতু রঞ্জিত প্যাসেঞ্জার কেউ হন নি বুকে হাত দিয়ে বলুন দিকি? ট্রেন আসলে গেলে কেন সব্বাইকে একসঙ্গে একে অন্যের ঘাড়ে পা দিয়ে ওঠানামা করতে হয় এই ধাঁধার জবাব কোন ঠাকুর দেবেন? মত প্রকাশের নামে নামী ব্যক্তিদের অবলীলায় চরিত্র হনন করে যে পাবলিক, তাদের ভোটেই না পুরুত ঠাকুরের মত লোকেরা প্রজাতন্ত্র মন্দিরে ঢোকার চান্স পান। এমনি করেই আমরা যে যার যত জীবনের না পাওয়া আর যে সব টোটাল ক্যাওস রোজ সয়ে গিয়ে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ঢ্যামনামো জাহির করি। 

প্রবন্ধের শুরুতে যে দুটি সুখী শাসনকাল এর কথা বলছিলাম দুটোই ছিল রাজবংশ শাসন। প্রজারা তাতে কি অবহেলা পেয়েছিলেন আদৌ? তাহলে কিসের গ্যারান্টি যে প্রজাতন্ত্রেই সব সুখ আর রাজতন্ত্র চালুনির মত ছ্যাঁদা বিশিষ্ট!  তাহলে কোনও বিশেষ তত্ত্ব আউড়ে যে দেশগুলোয় পরোক্ষে মততন্ত্র চালু ছিল তারা এত অসুখী প্রমাণ হলো কেন? এত বছর আঁশ ছোবো না মাছ খাবো না –র সতীপনা করার পরে কেনই বা কিউবা আজ আমেরিকার প্রায় স্বভাব মিত্র হতে চায়? সোভিয়েত মরীচিকা বিলোপের পরে চিন নামক প্রলেতারিয়েত সাম্রাজ্যবাদই কি তাহলে আসলে প্রজাতন্ত্র হবে নতুন ব্যকরণে? উলটোদিকে আমেরিকা নামক সব পেয়েছির দেশে আজ সব ভুলের কাঁদুনিও গণতন্ত্রের কুফল গুলো তুলে ধরে। নিত্য সেখানে ইস্কুল কলেজের কচি কচি প্রাণগুলো কি জানি কি আক্রোশে দুমদাম গুলি চালিয়ে সহপাঠীদের, শিক্ষকদের বুক ফুটো করে দেয় অবলীলায়। আর তথাকথিত লিবারাল রাষ্ট্রের শিক্ষিত স্বাধীন বাপ মায়ের হাতে পড়ে থাকে গণতন্ত্রের পেনসিল। কিংবা রাগ হলেই বুদ্ধিমান তাজা প্রাণগুলোকে এক লহমায় শার্লি এবদো করে দেওয়া যায়। এত সব কথার মানে রাজতন্ত্রের হয়ে সাফাই গাওয়া নয় ।নানান ভাবে মানবতন্ত্রের ঠিকঠাক প্রয়োগ করাটাই হয়ত বলতে চাইছি। আসল কথা হলো কোন রাষ্ট্র তখনই সুখী তখনই সফল যেখানে ভালোমন্দের ভেদ থাকে, যেখানে মন খুলে কথা বলার মানে কাছা খুলে কথা বলা নয়, যেখানে কাজ করলে পুরষ্কার জোটে আর না করলে তিরস্কার, যেখানে অনেক কিছু ভালোর ফাঁক দিয়ে হয়ে চলা মন্দ গুলো মানুষের চোখ এড়ায় না চিরটাকাল...তার সংশোধন হয়... হতেই থাকে। তবেই না প্রজাতন্ত্রের সার্থকতা। কোন কিছু স্ট্যাটিক হলে তা তো বদ্ধ জলাশয়... অ্যানোফিলিসের আঁতুড়ঘর। সচল প্রাণময় কোন তন্ত্র যদি গড়তে হয় তাহলে চেষ্টা শাসক ও শাসিত উভয় পক্ষে হওয়া দরকার। একহাত করতাল বাজালে ধ্বনি কারো কানে পৌছায় না। দুটো হাতের দরকার বৈকি। প্লেটোর বিখ্যাত সেই “রিপাবলিক” বইটিতে সেই বিখ্যাত কথাটি দিয়ে আজকের কলম শেষ করি... “কোন কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সেটার শুরুর অংশ”। চলুন প্রকৃত প্রজাতন্ত্রের প্রয়োগ ঘটানোর কাজটা আজ থেকেই আমরা... শুরু তো করি।


পরিচিতি 
জয়া চৌধুরী জয়া চৌধুরী Reviewed by Pd on জানুয়ারি ২৬, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.