শর্মিষ্ঠা শ্যাম বলনিয়োগী



শ্রাবনের এক সন্ধ্যা, এক বড় অনুষ্ঠান বাড়ি। 
সারা বাড়ি ঝলমল করছে, আলোর বন্যায়। আজ এখানে একটি অন্নপ্রাশনের শুভ মিলন-সন্ধ্যা। চারিদিক সুবসনা, সুন্দরীদের কোলাহলে গমগম করছে, সব নিমন্ত্রিতরা আসছে একের পর এক। আর সেখানে সবার সাথে আনন্দে মত্ত নবযৌবনা, তন্বী সুন্দরী মধুজা। মধুজা ঠিক যে ডানাকাটা পরী তা নয়, কিন্তু তার রূপের ছটা এমনই যে, কেউ তাকে না দেখে পারে না; এক কোমলতা অথচ, ভারী রমণীয় মিষ্টত্ব তার মধ্যে। খুবই মিশুকে, সারাক্ষণ হৈ হৈ করছে সবার সাথে। মধুজার মামার ছেলের আজ অন্নপ্রাশন। সে এতই প্রানপ্রাচুর্যে ভরা যে, সব কচি-কাঁচাদের মাঝে সে মধ্যমনি। আবার মাঝে মাঝে সমবয়সীদের সাথেও আড্ডা-ইয়ার্কিও দিচ্ছে। দারুন জমকালো সেজেছে আজ সে, সবার চোখে মুগ্ধতা আর নিশ্চুপ প্রশংসা।
সমবয়সীদের মধ্যে একজন “কি রে দোলা, আজ যে ফাটিয়ে সেজেছিস। কেন বিশেষ কেউ, মানে ওই চোখের ডাক্তারের জন্য নয়ত আবার?”
দোলা মধুজার ডাকনাম, এই কথাগুলো শুনলেই মাথা গরম হয় তার। আজ সারাদিন বাড়ির সবাই এই একটা ব্যপার নিয়েই তাকে জ্বালিয়ে মারছে। “দূর, ভালো লাগে না আর... যেদিন থেকে ওই প্রফেসার আনন্দবাবুর চোখের ডাক্তার ছেলের সাথে, সম্বন্ধ এনেছে বড় পিসি; সেদিন থেকে তার জীবনটা একেবারে নরক হয়ে গিয়েছে। বাড়িশুদ্ধ সবাই যে যখনই দেখছে, জিজ্ঞাসা করছে “কবে, কি, কার সাথে?। উফ, আর ভালো লাগছে না তার বাবা অবশ্য বলেছেন যে মেয়ের পছন্দ না হলে রাজি হবে না। আর এতো হুড়তাড়ারই বা কি আছে সবার?”,  মনে মনে ভাবে, “সবে পার্ট ওয়ান দিয়েছি--এতো জলদি এই বন্ধনে জড়াতে চায় না মন। আরো কিছুদিন স্বাধীনতা উপভোগ করার পরে না হয় ভাবব সেকথা। কিন্তু ভাবতে দিচ্ছে কে?...”।
মামী আজ সারা বাড়িতে রাষ্ট্র করে দিয়েছে সেকথা। এমনিতেই সেই দিনের পর থেকে চোখ দেখানোর নাম করে একের পর এক আত্মীয় ডাঃ অতনু রায়-কে দেখতে যাচ্ছে, একেবারে আদেখলামির একশেষ। তার নিজের মনেও তো একটা কিন্তু আছে ওঁনার ব্যাপারে। দেখতে সুন্দর না হলে কিছুতেই সে রাজি হবে না। আর আনন্দ স্যার তো বেশ ছোটখাটো চেহারার, তাই অতনুও সেরকম হবার সম্ভাবনা বেশি। না কিছুতেই সে মাথায় খাটো ছেলে বিয়ে করবে না, ছোট থেকেই ঐ একটাই তো সখ। মেঝদা অবশ্য বলেছে, সে পাশে আছে— তাই আজ দাদাকে বলে দিয়েছি যেন দেখে আসে অতনুকে”।  দাদারা যেখানে আড্ডা মারে তার পাশেই তো মেজদার বন্ধুর মেডিকাল স্টোরে উনি চেম্বারে বসেন। মনে মনে তাই দাদার সঙ্কেতের অপেক্ষা করে আছে, মধুজা গিয়ে বসে সমবয়সী ভাই-বোন ও মামা-মাসিদের জমায়েতে।
“এই শোন তোরা, আমি ওই ডাক্তারকে বিয়ে করছি না কোনোমতেই। আমি বয়েই গেছে ডাক্তারের বউ হতে।”
রিন্টু মামা “দোলা, জানিস ডাক্তারের বউ হবার কত সুবিধা”
পিঙ্কিদিদি “তুই খুব লাকি রে, খুব ভালো ছেলে শুনলাম, আর ব্রাইট কেরিয়ার।”
সোনাদা “ দুটো গাড়ি, বাড়ি......।”
“ডাক্তারদের কোণও ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকে না। আমার ওইরকম চাই না। আর শুধু গাড়ি-বাড়ি দিয়ে কি হবে? তা তো আমার বাবারই আছে।” রিনরিন করে বলে মধুজা
পিঙ্কিদিদি “পরে আফসোস করতে হবে, দেখিসখন...”
তখন মধুজার প্রিয় মামা চন্দন বলে ওঠে, “তোরা কি শুরু করলি? ওর জীবন, ওর পছন্দটাই তো সব থেকে আগে, তাই না?”
“থ্যাঙ্ক ইউ, চন্দন মামা, তুমি অন্ততঃ বুঝেছ......”
পিঙ্কিদিদি “চন্দনতো তোকে বরাবরই একটু বেশি বোঝে সবার চেয়ে”। পিঙ্কির কথায় যেন নোংরামির ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। তবে এটা সত্যি যে চন্দন আর মধুজার মনের মিল অনেক, দুজন খুব ভালো বন্ধুও। দুজনের পছন্দ-অপছন্দও অনেকটা একইরকম। কিন্তু তাই বলে কোন কদর্যতা নেই তাদের সম্পর্কে। মধুজার ভীষণ রাগ হয়। “শোনো, পিঙ্কিদি, তোমার যদি অতই পছন্দ তাহলে তুমিই কর না ওঁকে বিয়ে”। সে আরও কিছু বলতে যাবে, কিন্তু চন্দন চোখের ভাষায় ওকে সংযত হতে বলে। 
“চল দোলা, একটু গুবলুকে আদর করে আসি, তোরা গল্প কর।”
মধুজা আর চন্দন উঠে যায় গুবলু মানে আজ যাকে নিয়ে অনুষ্ঠান তার কাছে। 
“চল একটু কফি খেয়ে আসি”
দুজনে কফি স্টলের দিকে যায়...... 
“কিরে তোর কি ওঁকে পছন্দ নয়,আপত্তি আছে তোর?”
“তুমিতো জান আমার পছন্দ-অপছন্দ। আর দেখো পিঙ্কিদি কিভাবে নোংরা ইঙ্গিত করল তোমাকে আর আমাকে ঘিরে!”
চন্দন হাসে,“বোকা কোথাকার, কে কি ভাবল তাতে কি কিছু যায় আসে? আর সবার সব কথায় কষ্ট পেতে নেই। তুই-আমি তো ঠিক আছি, বল। আমাদের সমাজটাই এরকম যে ছেলে-মেয়ের বন্ধুত্ব মানতে পারি না আমরা। দোলা, আমি জানি তুই আমাকে বুঝিস। আমিও যে তোকে ভালবাসি তাতে কোণও নোংরামি নেই। কারন, আমি জানি আমাদের সম্পর্কের গন্ডিটা কি। ভালবাসার অনেক নাম হয় দোলা”। 
স্মৃতির অতলে ডুব দেয় চন্দন।  “মনে পড়ে সেই রত্নার বিয়ের স্মৃতি। প্রায় আট- নয় বছর আগের কথা, মধুজা তখন ক্লাস সেভেন, আমি টুয়েলভ। ওর সাথে প্রথম আলাপ, তখন থেকেই মধুজা আমার সব থেকে প্রিয়। বলতে গেলে তখন সেই ছোট বয়সেই ওকে আমার খুব ভাল লেগেছিল, মনে হয়েছিল ওই সেই যে আমার একান্ত আপন। আর কারনও ছিল, মধুজা তখন ছিল ঠিক একটা পাহাড়ী ঝরনার মত। আমার খুব রাগ হত, কেন সে আমার আত্মীয় হল। আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম যে এই চোরাটান নিষিদ্ধ। কিন্তু মানুষের মনের উপর বোধহয় কোন সমাজ-বিধিনিষেধের নিয়ন্ত্রন নেই। সেই চোরাটানে আমি তখন ভেসে গিয়েছিলাম বেশ খানিকদূর। কিন্তু, তখন হঠাৎ একদিন বাবা আমার ডায়েরী থেকে সব জানতে পারে। আমি খুব ভয় পেয়ে যাই, আর বাবার কাছে ধরা পড়ে সব স্বীকার করে নিই। বাবা আমাকে বোঝায় যে, এটা হতেই পারে; অনেকেরই এই বয়সে এরকম হয়, অন্যায় নয় এটা; এটা বয়ঃসন্ধির সাময়িক অনুভুতিমাত্র। আর আরও বলে যে, হৃদয়ের এই অনুভূতি কিন্তু আমাদের সমাজের চোখে নিষিদ্ধ, এবং এর থেকে প্রভূত সমস্যা হতে পারে। বাবাই প্রথম বলেছিল, মধুজাকে অন্য চোখে দেখতে। আর শেষ সময়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবাকে কথাও দিয়ছিলাম যে আর কখনও কোনও ভুল করব না এই ব্যাপারে। আর, এতে কারোরই যখন ভালো হবে না, তাই ব্যপারটা মনের গহনেই থেকে গেছে। তাই ওকে কখনও বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমার হৃদয়ের ঠিক কোন স্থানটা ওঁর...।”    
“চন্দনমামা, কি ভাবছ তুমি? পিঙ্কিদি-কে কিছু বলা হল না যে।”
“আরে ছাড় তো, তুই বরং বল। অতনুকে তো নয় বুঝতেই পারছি, তাহলে কি অন্য কাউকে তোর পছন্দ? কিরে, মন দিয়েছিস কাউকে?”
“না গো, সেরকম কিছু নয়। তবে আমি যে আমার স্বপনের সাথীকে কল্পনা করে রেখেছি আগেই, আর তাঁকে এখনও খুঁজে পাইনি”। মধুজা লজ্জা পায়, “জানো মামা, আমি অতনুকে একবার দেখব। তবে অতনুর জন্য যদি কোনও অনুভূতি জাগে মনে তাহলেই...”
এমন সময় মায়ের ডাক“দোলা, এদিকে আয়; দিদা ডাকছে।”
“যাই, চন্দনমামা, মা-দিদা ডাকছে।”
“যা পাগলী, আমি সিগারেট খেয়ে যাচ্ছি”।
মধুজা চলে যায়। মা আর দিদা অনেক নতুন নতুন অতিথিদের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেয়। দিদা একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার সাথে আলাপ করিয়ে দেয়,“ দিদিমনি, পরিমলবাবু, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?”
মধুজা ওঁনাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করে। পরিমলবাবু বলেন, “না তো, কে এটা বউদি?”
“আরে দোলা, আমার দিদুভাই পরিমলবাবু।”
পরিমলবাবু অবাক হয়ে দেখতে থাকেন। আর দিদিমনি মানে ওঁনার স্ত্রী কেকা হাসি মুখে এগিয়ে আসেন, “কত বড় হয়ে গেছে ও। আর খুব সুন্দরীও হয়েছে আপনার নাতনি। আর হবে নাই বা কেন, আপনি এখনও যা সুন্দরী এই বয়সে...। তুমি কি নিয়ে পড়ছ এখন?”
দিদা জানায়, “দোলা, উনি তোমার মার দিদিমনি, অনেক ছোটতে দেখেছেন তোমায়। 
মধুজা ওঁনাদের প্রনাম করে বলে, “ আমি ইংলিশ অনার্স, থার্ড ইয়ার”।
“পরিমলবাবু, দিন না একটা ভালো ছেলে দেখে, আমার নাতনির জন্য”। দিদা শুরু হয়ে যান, মধুজা লজ্জা পেয়ে পালায়। দিদিমনি হাসতে থাকেন, “আপনার নাতনি শিক্ষিতা-সুন্দরী, পাত্রের অভাব হবে না।”
“তা ঠিকই, অনেক সম্বন্ধও আসছে কিন্তু!!”
কেকা দিদিমনি একটা ফোন ধরতে ব্যস্ত হলে পরিমলবাবু বলেন…..
বউদি,আপনার নাতনিকে দেবেন আমার ছেলের জন্য?” 
“কি বলছেন পরিমলবাবু? এত একেবারে অপ্রত্যাশিত। আপনার ছেলের কথা অনেক শুনেছি। কি করছে ও এখন? কোথায় আছে? নামটা, নামটা কি যেন ছিলও...”
“রিমো, আর ভালো নাম সাগ্নিক। ও তো কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, এখন কলকাতায়, ফ্ল্যাট কিনেছে সদ্য, একাই থাকে। একটা বড় প্রাইভেট বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি করছে”।
“আরে! কত বড় হয়ে গেছে, সেই ছোট্টবেলায় দেখেছিলাম”। 
“আজ শনিবার, বাড়ি আসছে, দেখি গিয়ে; একবার যদি নিয়ে আসতে পারি।”
“অবশ্যই নিয়ে আসুন। মনে আছে আপনার, যেদিন ও জন্মায় আমি দেখতে গেছিলাম নার্সিংহোমে?”
“মনে আছে বৌদি, সব মনে আছে। আপনাদের সাথে আমার আজকের সম্পর্ক নাকি?”
“একটা কথা বলি, আমারও অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল, আপনার ছেলেকে নাত-জামাই করার, কিন্তু যোগাযোগটা ঠিক হয়ে উঠছিল না। ঈশ্বরের পরম করুণা, তাই আজ...”।
পরিমলবাবু কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় অন্যান্য অতিথিরা এসে পড়ায় দিদা চলে যান। 
ওদিকে মধুজার মেজদা মানে পিসতুতো দাদা এসে উপস্থিত। মধুজা তো এতক্ষণ সব অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত ছিল, সে দেখে মেজদা এসেছে। দৌড়ে যায় দাদার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে। বসে একপাশে একটু নিভৃতে, “কি রে, এতো দেরি করতে হয়, আমি অপেক্ষা করছি কতক্ষন ধরে?”
“কেন রে, আমার জন্য কেন দোলা-রানি?”
“না, তুই জানিস না যেনও! আর কোথায় গেছিলি? আড্ডা দিতে, না? উফ, কি আছে তোর আড্ডায় যে একদিনও বাদ দেয়া যায় না। জানিস সেই কখন থেকে আমি অপেক্ষা করছি”।
“হুম, আরে একটা কাজও ছিল; একেবারে সেরে এলাম”।
“কিরে আজ দেখলি ওকে?”
“কাকে,হুঁ?”
“খুব না, জানিস না যেন?”
“এই তোর হবু বর না, নাম করে বল”
“কি রে? আমি ওঁকে বিয়ে করব তোকে কে বলল? ও মানে ডাঃ অতনু, বল না তোকে যা দেখতে বলেছিলাম, দেখেছিস কিনা?”, মধুজার আর যেন তর সইছিল না।   
“বলছি বলছি, যা আগে কিছু নিয়ে আয়, আমার খুব খিদে পেয়েছে। এখানে আসব বলে আজ গ্যাঁজে কিছু খাইনি”
মধুজা দ্রুত পায়ে যায় আর দাদার জন্য কফি আর কবিরাজী কাটলেট নিয়ে আসে। দাদার হাতে দেয়। “এবারে বল না, মেজদা?”
“হু ,বল, কি জানতে চাস?”
“একটু দেখা ও কি রকম, মানে কতটা লম্বা?”
“দেখ দোলা, পাগলামি করিস না। এভাবে আপস করবি না, ও সত্যি লম্বা নয় রে, মানে তোর সাথে মানাবে না ওঁকে লম্বাতে। যদিও অতনু খুবই ভালো ছেলে, কিন্তু তুই পছন্দ না হলে জোর করে করিস না। আমি আছি তোর পাশে। মামা আর বাড়ির সকলকে রাজি করাব। আর তোর জন্য ছেলের কোনও অভাব হবে না, বোন আমার।”
মধুজার বুকের উপর থেকে যেন একটা বোঝা নেমে যায়, সে দাদাকে জড়িয়ে ধরে। দাদাও বোনের মাথায় স্নেহের হাত রাখে, “পাগলি একটা, নে যা এবারে; সবাই আছে না”
মধুজা ভিতরে চলে যায় আর আবার আড্ডায় মেতে ওঠে।
রাত্রি তখন প্রায় এগারোটা, শেষ ব্যাচে খেতে বসেছে বাড়ির বাকি প্রায় সবাই মানে মধুজা আর তার সব প্রায় সমবয়সী আত্মিয়রা। মধুজা আর তার চন্দন মামা পাশাপাশি। দিদা,মামা,মা-রা সবাইকে লক্ষ্য রাখছে, যেন কোনো ত্রুটি না হয় আপ্যায়নে। হটাৎ মধুজার কানে আসে যে দিদা তারই পিছনে কোনও একজনকে খুব প্রশংসা করছে, বিশেষভাবে খেয়াল রাখছে, যত্ন করে খাওয়াচ্ছে। মধুজা মনে মনে ভাবে, “কে না কে,কি জানি?” নেহাৎ ঔৎসুক্যবশতঃ ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকায় কে দেখতে; কিন্তু সেভাবে কিছুই বুঝতে পারে না। শুধু গাঢ় নীল রঙের শার্ট পড়া কেউ একজন, অল্পবয়সি কেউ হবে বোধ হয়। ভাবে, “ যাক গে, আমার কি...”
মধুজা মন দিয়ে পোলাও-মাংস খেতে থাকে, হঠাৎ সেই ‘পরিমলমামা’, মা ওভাবেই সম্বোধন করতে বলেছে ওঁনাকে, এসে উপস্থিত; বলেন, “কি মধুজা কেমন খাচ্ছ?”
মধুজা একটু অবাক হয়, দিদা আবার এসে বলে, “দোলা, এই যে রিমো...”; আর সেই নীল জামার উদ্দেশ্যে বলেন, “ রিমো, এই আমার নাতনি মধুজা”
মধুজা আর রিমো দুজনেই ঘাড় ঘুড়িয়ে একে অপরকে দেখার বৃথা চেষ্টা করে। তা দেখে পরিমলবাবু বলেন –“ আরে থাক না, খাওয়া শেষে আলাপ কর দুজনে।”
মধুজা মিষ্টি হেসে সম্মতি জানায়। 
রিমো ঘাড় ঘুড়িয়ে মধুজার উদ্দেশ্যে “তুমি আমার বন্ধু হবে?”
“আমায় বলছেন?” মধুজা(ঘাড় ঘুড়িয়ে)
“হ্যাঁ, আমার না এখানে কেউ বন্ধু নেই, জানো। তাই ভাবলাম তুমি যদি হও তাহলে এই বোর ফিলিং হয় না।”
“নিশ্চয়ই”

খাওয়া শেষে মধুজা আর রিমো এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। 
“আমার নাম কিন্তু সাগ্নিক”
“আর আমি মধুজা”
“বাঃ, বেশ সুন্দর নাম”
“ আমি কিন্তু রিমোদা বলেই ডাকব”
“ঠিক আছে, তোমার যা খুশি”
“তুমি কি এ শহরেই থাকো? তুমি করেই বলছি, আর কি কর? মানে স্টাডি না অন্য কিছু?”
“তুমি করেই তো বলবে...না আমি এখানেই বড় হয়েছি, কিন্তু এখন কলকাতায় থাকি। আর একটা চাকরি করি। আমার কথা ছাড়ো, তুমি তোমার কথা বলনা একটু। কি নিয়ে পড়ছ তুমি, কোন সাবজেক্ট তোমার? আর কোন স্পেশাল হবি?”
“আমি ইংলিশ অনার্স, পার্ট টু, আর হবি বলতে, গান শোনা, গাওয়া; আর গিটার বাজানো”
রিমো—“ বাঃ, বেশ ভালো, আমিও খুব ভালবাসি গান শুনতে, কিন্তু নিজে কিছুই পারিনা। তা তোমার মামার তো নিজের ট্রুপ আছে, গাও তুমি সেখানে?”
“না এমনিতে প্রোগ্রামে খুব একটা যাওয়া হয় না। আমি বাড়িতে বা সুযোগ পেলে কোনও কোনও অনুষ্ঠানে গাই, বাজাই।”
“আমাকে শোনাবে একদিন?”
“হ্যাঁ নিশ্চই, আজই তো আমাদের ঘরোয়া আসর; তুমি থাক না কিছুক্ষন...”
“দেখি, খুব টায়ার্ড লাগছে। আচ্ছা কখন হবে তোমাদের আসর?”
এমন সময় মধুজার মামা এসে উপস্থিত“ আরে রিমো যে, ইয়ং ইঞ্জিনিয়ার, কেমন আছো? কেমন চলছে সব?”
লাজুক হাসে রিমো “কিছু স্পেশ্যাল না, একইরকম সব; আর সফটওয়্যারের প্রাইভেট চাকরি-- খুব খাটুনি, নিংড়ে নেয় যেন সব।”
মধুজা অবাক হয়ে সব শুনতে থাকে। মানে রিমো তো কিছুই বলেনি, “দোলা, রিমো খুব ভালো পড়াশোনায়; বরাবর ফার্স্ট হয়ে এসেছে। খুব বড় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, বিদেশে ছিলও দুই বছর, মাস দুয়েক হল ফিরেছে।”
“না না আমি কিছু না এমন , এভাবে বলবেন না প্লিজ”
মামাকে একজন ডাকায় মামা উঠে যায়, “তোমরা গল্প কর, আমি আসছি একটু”
মামা চলে গেলে রিমো মধুজার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে দেখে.........  
মধুজা খুব অভিমান করে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। 
“কি হল মধুজা? চুপ করে আছো কেন?”
“কি আর বলব? তুমি আমায় তোমার সব কথা লুকালে কেন?”
“কি লুকালাম? আরে ছাড়ো তো, তুমিও কি ওই নিয়ে শুরু করলে?”
“রিমোদা তুমি পড়াশোনায় এত ভালো, কত বড় চাকরি কর; আবার বিদেশে ঘোরাও হয়ে গেছে...”
“তাতে কি, বিদেশে গেছি, এতে কোনও কৃতিত্ব নেই। কোম্পানির দাস ছাড়া কিছু নই”
পরিমলবাবু “বৌদি, আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না, রিমো কারুর সাথে সেভাবে মেশে না; কিন্তু দেখুন, মধুজার সাথে কিভাবে হেসে হেসে কথা বলছে...”
“দুজনকে বেশ মানাবে তাইনা পরিমল” দূরে বসে আলোচনায় দুজন। 
“চলুন বউদি ওদের কাছে যাই...” দুজনে ধীর পায়ে এসে উপস্থিত হন বারান্দায়।
“কি রিমো, বাড়ি যাবি না। রাত হল, জার্নি করে এসেছিস, চল এবারে।”
“মামা, রিমোদা থাকুক না খানিকক্ষন আমাদের জলসাতে, এখুনি শুরু হবে”
পরিমলমামা রিমোর দিকে তাকালে, রিমো “ বাবা, খানিকক্ষন থাকি, মধুজার গিটার একটু শুনে যাই”
খানিক পর জলসা শুরু হয়। রিমো বসে একপাশে। তার মনে হয়, এই মধুজা মেয়েটা বেশ অন্যরকম—খুবই প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরা, হাসি-খুশি, মিশুকে—কয়েক মুহুর্তে বেশ বন্ধু হয়ে গেছে। 
“অফিসে, ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে যা সব মেয়েদের সাথে ওঠা-বসা করি”, রিমো মনে মনে ভাবে, “তারা কিন্তু অনেকটাই অন্যরকম—মানে কেমন যেন জেদি ও উগ্র স্বভাবের”। 
“বাবা!, ভয় করে... কলেজে পড়ার সময় মেয়েদের যা রূপ দেখেছি, চরিত্রের কোনও বালাই নেই। তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ইঞ্জিনীয়ার মেয়ে বিয়ে করব না কখনও”। এদিকে জলসায় গান শুরু হয়। কিন্তু রিমো অপেক্ষা করতে থাকে কখন মধুজার পালা আসবে। তার খুবই ক্লান্তি লাগছিল, একবার ভাবে চলেই যাই; আবার মন চায়, না থাকি...এরকম কেন হচ্ছে সে বুঝতে পারে না। কিসের যেন এক চোরাটান অনুভব করে সে মধুজার প্রতি। তার দৃষ্টি খুঁজতে থাকে মধুজাকে।
   
আর অন্য দিকে মধুজা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিল রিমোকে। তারও একটা ভালোলাগা কাজ করছিল ছেলেটার প্রতি, কিন্তু ভয়ও আছে মনের গোপন কোণে; কারন রিমো সব দিক থেকেই আলাদা আর সকলের চেয়ে, কিন্তু...। একটা কিন্তু থেকে যাচ্ছে মনে, সে তাই আড়াল থেকেই দেখে রিমোকে। আর দূর থেকে দেখে বোঝে রিমোর দৃষ্টি যেন কাউকে খুঁজছে, তাঁর মন একবারের জন্য বলে ওঠে“ আমায় কি? কিন্তু......”।
তখনই মধুজার ডাক পড়ে, সে গিটার নিয়ে ডায়াসের দিকে যায়। কিন্ত অবাক হয় যখন দেখে যে তার হৃৎস্পন্দন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। ভাবে, “আমি প্রথম তো বাজাচ্ছি না আজ, তাহলে কেন এমন হচ্ছে?”...
ডায়াসে গিয়ে সে প্রথমেই হাতটা ভালো করে মুছে নেয়, উত্তেজনায় তার হাতের তালু ভিজে উঠেছিল। আর, তারপর চোখ বন্ধ করে মনোনিবেশ করে সুর তোলে গীটারে—
“অন্তবিহীন, কাটে না আর যেনও বিরহের এই দিন
তুমি না আসিলে ভালো না বাসিলে সুরহীন, তালহীন, প্রাণহীন
বড় শূন্য শূন্য দিন......”
রিমো অবাক হয়ে মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে, বেশ ভালো বাজায় মধুজা। ভালই দখল আছে বোঝা যায়। গান শেষ হতেই মধুজা উঠতে যাবে, সবাই রে রে করে ওঠে। সকলের দাবি আর একটা হিন্দী গানের সুর। মধুজা তাকিয়ে দেখে—“রিমো হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকেই। সেও ইশারায় আর একটা গানের জন্য অনুরোধ জানায়। মধুজা সেই নিশ্চুপ অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারে না।  তার অঙ্গুলি আবার সুর তোলে—
“ চুরা লিয়া হ্যায় তুম নে যো দিল কো...”

কিছুদিনের মধ্যেই মধুজার বাড়ির তরফ থেকে রিমোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব যায়। পরিমলবাবু খুবই খুশি হন সে প্রস্তাবে, কারন ওঁনার খুব মেয়ের সখ ছিল একটা। আর মধুজাকে বেশ পছন্দও হয়েছিল। 
শুধু ভাবছিলেন, “ছেলের মনে কি আছে কে জানে? মায়ের কথায় ওঠে বসে, কারন রিমো বরাবরই মা-ঘেঁষা। যদিও ছোট বেলা থেকে তিনিই বেশি যত্ন করেছেন ছেলের, আর এখনও শনিবারে দৌড়ে যান রিমোর কাছে—একা থাকে ছেলেটা, কে ওর দেখাশোনা করে, তাই যান। নিজে হাতে রান্না করে খাওয়ান, সব গুছিয়ে রেখে আসেন। সারা সপ্তাহ রান্নার লোকের হাতে খায় ছেলেটা, ঠিক মত মায়ের স্নেহ-যত্ন পায়নি কোনদিন। ছেলেকে নিয়ে অনেক অশান্তি করেছেন স্ত্রীর সাথে। কেকা ছোটবেলা থেকে মিশনারি স্কুলে পড়েছে, ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে দাদার কাছে মানুষ। তাঁদের যদিও প্রেমের বিয়ে, তবুও কেকা কোনদিনিই প্রকৃত ঘরনী হয়ে উঠতে পারেননি। চাকরি করার সুত্রে অর্থের অভাব না থাকলেও, আরো কিছু থাকে চাওয়া পাওয়া। নানা অব্যক্ত চাহিদা থাকে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে। আর শারীরিক সুখ দিয়ে সেতুবন্ধন করা যায়না সবসময়, কারন দাম্পত্য-জীবন কখনই শুধু যৌনতার গণ্ডিতে বাঁধা থাকে না। অনেক অতিরিক্ত কিছু বাসনা, যা কোনদিনিই পাননি তিনি। চেয়েছিলেন তাঁর অর্ধাঙ্গীনি তাঁর ঘরনীও হবে, সুন্দর একটা সংসার বাঁধবেন দুজন—কিন্তু যে কারণেই হোক, সেই সুখের নীড় গড়ে ওঠেনি কোনদিনই। প্রথমে অনেক অশান্তি হয়েছে, ক্রমশঃ সময়ের সাথে সাথে সব কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে; এক নিঃশব্দ বরফ-শীতলতা যেন তাঁদের সম্পর্কে। এখনও রান্নার লোককে কি রান্না হবে তা পরিমলবাবু ঠিক করে দেন। যখন রিমো ছোট ছিল ও দেখেছে, বাবা-মার মধ্যে অশান্তি হতে; তাতে সে ভয় পেত, কাঁদত। কিন্তু ছোট্ট রিমোকে সামলাবার মত কেউ ছিল না।”
“কেকা সবসময় মনে করে এসেছেন সে কিসে কম, আর এই দাঁড়িপাল্লার হিসেব তাঁদের সম্পর্ককে, তাদের সন্তানকে প্রভাবিত করে এসেছে আবহমানকাল। রিমো পড়াশোনায় ভালো, কিন্তু খুব চাপা অন্তর্মুখী স্বভাবের—হয়ত বা তাঁদের সম্পর্কের ফলশ্রুতিই। ভালো চাকরি করে, কিন্তু মন খুলে কারোর সাথে মিশতে পারে না। তাই যখন দেখলাম যে মধুজার সাথে মন খুলে, হেসে রিমোকে কথা বলতে...” ভাবতে ভাবতে তাঁর মনটাও আনন্দে ভরে যায়। যাক, ছেলেটা অন্ততঃ একটা সুখী জীবন পাবে। তাই তিনি সানন্দে রাজি হয়ে যান সেই প্রস্তাবে। 
বিদেশে যাবার আগে রিমো আর মধুজা, মধুজার মামার বাড়িতে একবার দেখা করে। ঠিক পাত্র-পাত্রী দেখার মত নয়। তারা দুজনে নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে গল্প করতে থাকে, সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় বোঝে না দুজনেই। সেদিন বাড়ি যাবার সময় পরিমলবাবুর যেন মনে হয় যে রিমো নিশ্চয়ই মধুজাকে পছন্দ করছে। সেদিন সারারাত মধুজাও দুচোখের পাতা এক করতে পারে না, এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করে রিমোর প্রতি। যদিও প্রাথমিক বন্ধুত্ব গড়ে উঠছিল, কিন্তু মধুজা এটুকু বোঝে যে তা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব নয়। কারণ, তা যদি হত তবে আজ যখন ও আসবে শুনল তখন থেকেই বুকের ঠিক মাঝখানে কেমন একটা ধুকপুক অনুভূতি—ভয় আবার একই সঙ্গে ভালোলাগার। নিজের ওয়াড্রোবের কোনও পোশাক তার আজ পড়তে ইচ্ছা করে না। যেন মন চায় “ও”র চোখে সব থেকে সুন্দরী হয়ে উঠি”। শয্যায় একান্তে মধুজা সে কথাই ভেবে চলে, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে কি ঘটে চলেছে তার কোমল মনের গহীন অর্ন্তলোকে। আজ যখন রিমো বলল যে সে ছ- মাসের জন্য চলে যাচ্ছে বিদেশে, তখন তার মন-খারাপই বা লাগল কেন? আর এক অজানা দুশ্চিন্তা “আচ্ছা, রিমোদা কি আমার জন্য কোনও টান অনুভব করে? বিদেশে গিয়ে ভুলে যাবে না তো আমায়? যদি আমার থেকেও ভালো কেউ আসে “ও”র জীবনে তাহলে কি......”, আর ভাবতে পার না মধুজা। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে থাকে, কিছুতেই আজ দুচোখ এক করতে পারছে না সে। দিদু কিন্তু সব আন্দাজ করে, “কি রে দোলা, ঘুম আসছে না। আসবে কি করে দিদুভাই?”
“না, আমি ঠিক আছি, কেন ঘুম আসবে না?”
“ঘুমের আর কি দোষ বল? প্রেমে পড়লে অমন সবার হয়, আমাদেরও হয়েছে।”
“তাই নাকি? কিন্তু আমি তো প্রেমে পড়িনি”
“আমার চোখকে তুই ফাঁকি দিতে পারবি না দিদু, বল আমাকে খুলে।”
মধুজা তাঁর দিদাকে জড়িয়ে ধরে শোয়, আর মনের সব কথা খুলে বলে, 
“জানিস, আরেকজন আজ রাতে ঘুমাতে পারবে না”
“কে?”
“রিমো”
“তুমি কি করে জানলে দিদু? “ও” কি আমায়...”
“ভালোবেসে ফেলেছে তোকে, আমি বুঝতে পেরেছি, আর তুইও। দেখ দিদু, আমার মাথার চুল এমনিতে সাদা হয়নি, জীবন অনেক বেশি দেখেছি।”
“তুমি সত্যি বলছ দিদু,” বলে দিদুর গালে চুম্বন করে।
“আমায় না দিদুভাই, তুলে রাখ। কিছুদিন পর আমার দাদাভাই এলে তাঁকে দিস উপহার হিসাবে”; মধুজাকে কাছে টেনে নেন আদর করে,বলেন,“তোর এই নরম রমনীয় তনু যখন তাঁর হাতে পড়বে,তখন কি যে হবে ভেবে কূল পাই না আমি”, বলেই হেসে ওঠেন।
মধুজা লজ্জা পায়,“দিদু, কিযে বল না। আচ্ছা,দাদুও তো তোমায় খুব ভালবাসত, আমি জানি তুমি খুব সুন্দরী ছিলে, বলনা তোমাদের প্রেম-কাহিনী?”
“না রে, তোর থেকে বেশী ছিলাম না সুন্দরী। আর হ্যাঁ, খুবই প্রেম ছিল আমাদের মধ্যে। জানিস দিদু, কতদিন ছেড়ে থাকতে হয়েছিল? তুই তো এখনি তোর ভালোবাসার মানুষ দূরে কাজে যাবে ভেবে মরছিস, আর যখন দেশভাগ হয় আমি একা বাংলাদেশে আর তোর দাদু জীবিকার জন্যে এই দেশে। কোনও খবর পেতাম না, দেখা হয় নি এক বছর--কি করছে,কোথায় আছে জানতাম না কিছুই। তখন ফোনও তো ছিল না, আমরা চিঠি লিখতাম আর সেগুলোই আমাদের সম্পদ ছিল, বুঝলি? পারবি দিদু এভাবে ?!!! নে আলো জ্বালা। আজ তোকে একটা জিনিস দিই। দিদু, তুই নিজের ভালবাসার উপর বিশ্বাস রাখ, ভরসা রাখ, আমিও রেখে দেখেছি; তোর প্রথম প্রেম কখনও অসফল হবে না রে দিদুভাই— আমি আশীর্বাদ করি। নে ওঠ, কি হল? আবার চোখে জল কেন?”
মধুজা অশ্রুসিক্ত চোখ “দিদু বলছ? ‘ও’ আমায় ভুলে যাবে না তো?”
“না, পারবে না। নে, আলো জ্বালা”
মধুজা আলো জ্বালালে দিদু ওর হাতে দেয় একটা খাম,“খুলে দেখ, কি আছে...”
মধুজা—“ কি?”............       
খাম খুলে মধুজা অবাক দেখে রিমোর ছবি দু-তিনটে, “ দিদু কোথায় পেলে?”
“বল তাহলে, এটাই তো চাইছিলি মনে মনে, কি তাই না?”
“সত্যি, দিদু, you are great...”
“আনিয়ে রেখেছি তোর জন্য, পরিমলবাবুকে দিয়ে। নিজের কাছে রাখ, মনে করবি “ও” সাথেই আছে সবসময়”
এভাবে দিন কাটতে থাকে, মধুজার অনন্ত অপেক্ষার দিন একটা একটা করে পার হয়ে যায়। মধুজা নিজের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, ছবির সাথেই রোজ কথা বলে। হাসি-কান্না, সোহাগ-শাসন সবই চলে সেই ছবির সাথে। ডায়েরির পাতা আর তাতে রাখা রিমোর ছবি মধুজার সবচেয়ে মুল্যবান সম্পদে পরিনত হয়েছে এখন। 
কিন্তু অদৃষ্টের আড়ালে হয়ত অন্য কিছু লেখা ছিল। 
মধুজার এই সম্বন্ধের কথা আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। এই ছয়মাসে মধুজা পরিমলবাবুর অপার স্নেহের পাত্রী আর খুবই কাছের একজন হয়ে ওঠে। রোজই একবার মধুজাকে দেখার জন্য তিনি মধুজার মামাবাড়ি আসেন। মধুজা দিদার কাছে থেকেই পড়াশোনা, কলেজ, গীটার চালাতে থাকে। পরিমলবাবু মধুজাকে তাঁর পুত্রবধূর স্থান দিয়ে ফেলেন নিজের অজান্তে। আর তাঁর কথার সুত্র ধরে মধুজাও রিমোর সাথে সুখের নীড় বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে। কল্পনার মোড়ক আর আত্মীয়দের নানা মন্তব্য “তোর শশুর, তোর বর,” বলে সম্বোধন তাঁর মনটা আরও রঙীন করে তোলে। মনে মনে সে রিমোর জীবনসঙ্গিনী হয়ে উঠতে থাকে ক্রমশঃ। কিন্তু, কিছু পরিজন মধুজার স্বর্নালী আগামী ভেবে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। মানবজাতির চিরন্তন  ঈর্ষার সেই সবুজ চাহনি।
ছয় মাস পড়ে রিমো ফিরে আসে। একদিন মধুজা সাহস করে রিমোকে ফোন করে। দুজনে অনেক সময় ধরে কথা বলে। মধুজা বুঝতে চেষ্টা করে তাঁর প্রতি রিমোর অনুভূতিটা ঠিক কি এখন? কিন্তু কিছুই সে বুঝতে পারে না, কেমন যেন খোলকের মধ্যে রিমো গুটিয়ে রেখেছে। বদল, অনেকটাই বদল, মধুজার মনে কালো মেঘের ঘনঘটা ভীড় করে আসে, সবই ভুল নাকি সত্যি? 
মাঝে মাঝেই রিমোকে ফোন করে মধুজা, কিন্তু অবাক রিমো কখনই নিজে থেকে ফোন করে না; এটা বেশ খারাপ লাগে মধুজার। একদিন দিদা জানতে চায়, কি ব্যাপার? কি ঘটেছে মধুজা আনমনা থাকে আজকাল খুব— মধুজা খুলে বলে মনের গোপনে রাখা সব কথা, সব ব্যথা। 
দিদা পরিমলবাবুর কাছে জানতে চান রিমো কি ভাবছে মধুজাকে নিয়ে; কারন পরিমলবাবুর রোজের উপস্থিতি আর মধুজাকে নিয়ত স্বপ্ন দেখানো, আর তাতে মধুজা কত দূর এগিয়ে গেছে ভিতরে ভিতরে— তা তিনি বুঝতে পারছেন কিনা? পরিমলবাবু জানান তিনি কথা বলবেন ছেলের সাথে। দিদা তাতে মনে মনে ক্রুদ্ধ হলেও বাইরে কিছু বুঝতে দেন না। কয়েকদিন পরে পরিমলবাবু এসে জানান, কেকা এই সম্পর্কে রাজি নন কারন তিনি মনে করছেন রিমোর আরও ভালো কাউকে জীবনসঙ্গিনী করা উচিৎ। দিদা হতবাক, শুধু জানতে চান যে রিমোর ভাবনাটা কি? তাঁর উত্তরে শোনেন যে রিমো এখন বিয়ে করবে না, সে বিয়ে করতে ভয় পায়। দিদা একথায় খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়েন,“আপনি কেন তবে এই বাচ্চা মেয়েটাকে স্বপ্ন দেখালেন, কিভাবে সামলাবে মেয়েটা?”
“কিন্তু রিমো তো বিয়ের কথা দেয়নি, আর আমি তো সর্বদা চেয়েছি যে মধুজাই আমার পুত্রবধূ হোক”
“কিন্তু আমি এখন মেয়েটাকে কি বোঝাব, পরিমলবাবু আপনার ছেলে এটা ঠিক করল না মধুজার সাথে। রিমো কখনও সুখী হতে পারবে না জীবনে, আপনি মিলিয়ে নেবেন। একটি মেয়ের চোখের জলের বিনিময়ে কেউ সুখী হতে পারেনা, মধুজার অশ্রুজল রিমোর বুকে রক্তের ফোঁটার মত পড়বে”।
“আমার সন্ধানে অনেক ভালো পাত্র আছে, আমি দেখে দেব”।
“না থাক, আমার মধুজার পাত্রের অভাব হবে না। আপনাকে আর কিছু করতে হবে না, দয়া করে আর কিছু করবেন না, আসবেননা, মেয়েটাকে আর মিথ্যা স্বপ্ন নাই বা দেখালেন”
মধুজা আড়াল থেকে সব শোনে। তাঁর এই কদিনের সযত্ন লালিত সুখী গৃহকোণের স্বপ্ন-আশা মুহুর্তে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে যায়, ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি; সে দৌড়ে চলে যায় নিজের ঘরে, আর ডায়েরিটা বুকে চেপে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
হঠাৎ দিদার নাকে একটা পোড়া গন্ধ লাগে, ছুটে রান্না ঘরে যান; অবাক হতবাক, মধুজা রিমোর সমস্ত ছবি গ্যাস-ওভেনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে, আর তাঁর দুচোখে শ্রাবণের অঝোর ধারা । দিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অশ্রুসজল চোখে মধুজাকে জড়িয়ে ধরেন,“দিদু রে, ছবি জ্বালিয়ে দিলে কি আর বুকের আগুনের জ্বালা মেটে? মেটে না। তোর জন্য আরও ভালো কোন রাজপুত্র কোথাও নিশ্চয় অপেক্ষা করছে, তুই এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না, কাঁদিস না দিদু।”
সেদিন সারা রাত দিদা তাঁর আদরের দোলাকে সামলান। কিন্তু তারা দুজনেই জানতে পারে না কিসের জন্যে এমন হল, কি এমন ঘটল যে এরকম ভাবে সব কিছু বদলে গেল আচম্বিতে।
রিমো তাঁর জন্মদিনের দিন একটা ক্যুরিয়ার পায়; তাতে মধুজার একটা চিঠি আর কিছু উপহার ছিল। চিঠিতে মধুজা জানিয়েছে সে কারোর কাছে ঋণী থাকতে চায় না, তাই এই উপহারগুলো সে ঋণশোধের জন্য তাকে পাঠিয়েছে। চিঠি পড়ে রিমো বুঝতে পারে সে মধুজাকে কতটা আঘাত করেছে। নিঃশব্দে তাঁর চোখও জলে ভরে ওঠে, আর বাবার প্রতি ঘৃণাটাও আরও বেড়ে যায়। সে শুধু ভাবে সেই ফোনটার কথা, যেটা আসার পর আর মায়ের কথায় সে মধুজাকে বিয়ে করতে রাজি হয় নি। নাহলে সে মধুজাকে সত্যিই খুব ভালোবেসেছিল মন থেকে; তাঁর প্রথম প্রেম—নিজের হাতে যাকে খুন করেছে সে। সে ভাবতে থাকে, তারপর থেকে মধুজা কোনোদিন একবারের জন্যও ওকে ফোন করেনি। 
কিন্তু মধুজাও কোনোদিন জানবে না কেন সে এরকম করতে বাধ্য হল, তার মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। মাকে ছোট থেকে সে শুধু কাঁদতেই দেখেছে নীরবে বাবার জন্য, তাই মায়ের কথা সে ফেলতে পারেনি কোনোদিন। সে ভেবেও ছিল কোনোদিন আর বিয়ে নামক এই প্রাতিষ্ঠনিক বন্ধনে সে আবদ্ধ হবে না। কারন সে ভয় পায় এই বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনের ভবিষ্যতের ফলশ্রুতিকে, যা সে স্বচক্ষে দেখেছে তার নিজের বাবা-মার মধ্যে। সর্বদা তার মনে একটা ভীতি কাজ করে যদি সুখী করতে না পারে তাঁর জীবন-সঙ্গিনীকে, যদি বাবা-মার মত হয়। শুধু মধুজাকেই সে নিজের করে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর সুখ মায়ের অশ্রুর কারন হতে পারে না। আর সেই ফোনটা......।
প্রায় একবছর পর 
সেদিন সন্ধ্যাবেলা মধুজার ফোন আসে রিমোর কাছে। ওঁর বিয়ে, হবু বর বড় ডাক্তার, বিয়ের পর তারা কিছুদিনের জন্য বিদেশ চলে যাবে। সে রিমোকে আমন্ত্রন করে। নানা কথার পর মধুজা জানায় তাঁর নিজের মামী বিয়ে ভাঙ্গার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সেই অচেনা পুরুষটি তার মামীর বানানো কথা বিশ্বাস করেনি, বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার দিকেই; সে ভরসা করেছে মধুজাকে। তাই তাকেই সে বরণ করে নিচ্ছে তাঁর জীবনসাথী রূপে। 
রিমো শুধু একথাই বলে “মধুজা, তুমি অবশ্যই সুখী হবে। আর একটা কথা, এই নতুন মানুষটি আমার  থেকে অনেক বেশি যোগ্য তোমার জীবনে”। 
একটা মিথ্যা আশ্বাস রিমো তাকে দেয় যে, সে উপস্থিত থাকবে তার বিয়ের দিন। 
কিন্তু অন্তরের নির্মম সত্যিটি হল যে; সে যেতে পারবে না, যাওয়া সম্ভব নয় তার পক্ষে। কারন সে যে চিরদিন মধুজাকে ভালবেসে যাবে অন্তরালে। আর একটা গূঢ় সত্যি যা সে বলতে পারে না মধুজাকে শত চেষ্টা করেও, তা হল—“তাঁর মামী রিমোকেও ফোন করে মধুজার নামে অনেক কিছু জানিয়েছিল। সেদিন সে নিজের ভালবাসাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। এই নবাগত পুরুষটির মত সে ভরসা করতে পারেনি তার মধুজাকে। এই সাহসী পদক্ষেপ যদি নিতে পারত সেদিন, তাহলে হয়ত তাঁর মধুজা আজ তারই হত”। 
সে অশ্রুসিক্ত চোখে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে কোনদিন আর কাউকে মধুজার জায়গা দেবে না, সে বিয়ে করবে না। সে অন্ধকারে বাইরের কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে; নির্বাক-নিশ্চুপ, শুধু মনের কোণে যেন জীবনের শ্রান্ত বাণী ধ্বনিত হতে থাকে---
“কেন গেল চলে...
আমি বোঝাতে পারিনি, দেখাতে পারিনি আমার হৃদয় খুলে...
কেন গেল চলে......”

পরিচিতি 
শর্মিষ্ঠা শ্যাম বলনিয়োগী শর্মিষ্ঠা শ্যাম বলনিয়োগী Reviewed by Pd on জানুয়ারি ২৬, ২০১৫ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.