ভবতোষ গোঁসাইকে রমাকান্ত খুব ভালো ভাবে চেনেন। সাধু প্রকৃতির লোক তিনি। বিয়ে থা করবেন করবেন মনে করেও করেন নি। পঞ্চাশ পার করেই তিনি আশ্রমবাসী হয়েছেন। সংসারের টান তেমন ছিল না। তাঁর বাবা মা মারা যাবার পরে ভাই বোনদের বিয়ে থা দিয়ে তিনি গৃহ ত্যাগ করে ছিলেন। ঘরে থাকা কালীন ভবতোষ রমাকান্ত উভয়ে উভয়ের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। ওঁরা গল্পগুজব করতেন, পরস্পর নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেন।
--জানেন রমাকান্ত বাবু, একবার ইচ্ছে হয় বিয়ে করি বলে আবার মনটা কেমন যেন দমে যায়, বলতেন ভবতোষ।
--এমনটা তো হওয়া উচিত নয়--বিয়ে করা জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম, রমাকান্ত মাঝখানে বলে উঠেছিলেন।
--ধর্মকর্ম মাঝে মাঝে আমার গুলিয়ে যায়--বিয়ে করে কোন মেয়েকে ভালবাসা যদি দিতে না পারি--
--তা কেন ভাবছেন? একজন নারী পুরুষের মাঝে ভাল লাগা ভালবাসা তো এসেই যায়।
--ঠিক তা নয় --ব্যাপারটা আপনাকে কি ভাবে যে বোঝাই!
--কি ব্যাপার মশাই—বুকের মাঝে ব্যর্থ প্রেম জনিত নিরাশা জমে নেই তো?
--না, তা ঠিক নয় --
--তবে অনেকটা ওই মত--তাই তো?
--তা বলতে পারেন--আপনাকে বলব সে কথা--
সে দিন রমাকান্ত ব্যস্ততার মাঝে আর শুনতে পারেন নি ভবতোষ বাবুর কথা। প্রায় মাস খানেক পরে ভবতোষ এসে হাজির হয়ে ছিলেন রমাকান্তর ঘরে। রমাকান্ত তখন ঘোর সংসারী। স্ত্রীর সঙ্গে সে সময় চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছেন। ছেলে পুলে তখনও আসে নি কি না !
ভবতোষ বসে ছিলেন বৈঠকখানায়। রমাকান্তর মা চা বিস্কুট দিয়ে গিয়ে ছিলেন। চা বিস্কুট খাবার পর ভবতোষ কেন যেন উশখুশ করছিলেন।
রমাকান্ত প্রশ্ন করেছিলেন, কিছু বলবেন ?
--ভেবেছিলাম, আজ সে দিনের কথাটা আপনাকে বলি।
--কোন কথা ?
হাসলেন ভবতোষ, ওই যে আমার জীবনের অপূর্ণ প্রেমের কথা!
--ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, এটাই কিন্তু সুযোগ, আমার ঘরের লোক পারা বেড়াতে গেছে --
ভবতোষ হাসতে চেষ্টা করলেন, একবার কাশলেন, বোধহয় গলার জড়তা সরাবার জন্যে হবে অথবা বিরহ জনিত ব্যথার অনুভবেও হতে পারে !
ভবতোষ বাবুর উঠতি বয়সের কথা ছিল। বয়স আঠার পার হবার আগের কথা। ইন্দিরা নামের একটি মেয়েকে ভালবাসতেন তিনি। ভবতোষ ও ইন্দিরা একই ক্লাসে পড়ত। প্রথমে চোখের ভালবাসা--চোখে চোখে কথা হয়ে যেত ওদের। কিছু দিন পরে চোখের কথায় আর মন ভরল না। ভালবাসার ইজেহার দিতে বেশী আগ্রহী ছিল ইন্দিরা। পথের মাঝে কেন যেন একদিন ওরা মুখোমুখি থেমে গেল। সামান্য সময় নীরবতার পর ইন্দিরাই মুখ উঁচিয়ে কথা বলল, কিছু তো বল ?
দ্বিধা কাটিয়ে ভবতোষ বলতে পেরে ছিলেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ ?
--শীলাদের বাড়িতে,হেসে বলেছিল ইন্দিরা।
--কেন? সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন ছিল ভবতোষের।
--একটা বই আনতে--
ব্যাস, সেদিন ঐটুকুই কথা হয়ে ছিল। ইন্দিরার ভবতোষকে ভালো লেগেছিল। তাঁর নায়কোচিত গম্ভীর চেহারা ভালো লেগেছিল কিন্তু এতটা চুপচাপ নিষ্ক্রিয়তা ইন্দিরার যেন পছন্দ ছিল না। সে চাইত ভবতোষ বেশ স্মার্ট হয়ে উঠুক।
ভবতোষের বাড়ির সবাই ইন্দিরাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়ে ছিল। ইন্দিরা প্রায়ই আসত ভবতোষদের বাড়িতে। একটা সাদাসিধে ছেলে ভবতোষ, পোশাকে আশাকে যেমন অতি সাধারণ তেমনি কথায় বার্তায় অতিরিক্ত মার্জিত। সে অনুপাতে ইন্দিরা কিন্তু অনেক প্রগলভ--সাজসজ্জায় অনেকটাই আধুনিকা। প্রসাধনের উগ্রতা ভবতোষের চোখকে পীড়া দিলেও ততটা খাপার লাগত না তাঁর। নিভৃত ঘরে কখনো দু জনে প্রেমালাপে ব্যস্ত থাকত। ইন্দিরা বড় বেশী গা ঘেঁষে থাকতে চাইত ভবতোষের। ভবতোষ বারবার সরে যেত। কিন্তু কেন, এত নির্বিকার কেন ? বহুবার এ প্রশ্ন ইন্দিরার মনে এসেছে। এত সুন্দর একটা ছেলে, যে গম্ভীর, স্বল্পভাষী, ইন্দিরাকে সর্বদা আকর্ষণ করে এসেছে। সেই ছেলেটা তা বলে এত নির্বিকার কেন হবে !
ইন্দিরা দেখতে চায় কতখানি এগোলে প্রেমিক তাঁর পৌরুষ সামনে খুলে ধরবে ? ইন্দিরার প্রতি তার ভালবাসা যদি থাকে তবে এক জাগায় এসে তার আসক্তির প্রকাশ ঘটবেই।
ইন্দিরার নিকটতম বন্ধু শীলা। ইন্দিরা ভবতোষের সব কথা তাকে জানিয়েছে। শীলা ঠাট্টা করে বলে ছিল, কি রে এমন তো নয়--তোর নায়ক একেবারে জড়ভরত ! কথাটা ইন্দিরার মনে সাড়া দেয় নি--যে ভালবাসতে জানে তার দৈহিক চেতনা থাকবে না--এমনটা কি হতে পারে ?
সেদিন নিরিবিলিতে ভবতোষ ও ইন্দিরা প্রেমালাপে ব্যস্ত ছিল। ইন্দিরার মনে বারবার একটা কথায় উঁকি মারছিল, আজ ভবতোষকে বাজিয়ে নিতে হবে। তাই সাজসজ্জায় মোহিনী রূপ ছিল ইন্দিরার। ভালবাসার জন্যে আজ প্রেমের পরীক্ষায় নামাতে চায় সে। শীলার কথাটাকে ব্যর্থ করে দেবার একান্ত ইচ্ছায় ইন্দিরা এগিয়ে গেল প্রেমিকের দিকে। মায়াবী দৃষ্টি নিয়ে ইন্দিরা নিজের মুখটা এগিয়ে দিল ভবতোষের মুখের দিকে। ভবতোষ তাকিয়ে ছিলেন--এক প্রেমিকের দৃষ্টি নিয়ে হারিয়ে গিয়ে ছিলেন। ইন্দিরা আরও এগিয়ে গিয়ে ভবতোষকে কিস করেছিল। ভবতোষের দিক থেকে তখনও তেমন সাড়া নেই। স্তব্ধ উদাসী চাহনি নিয়ে ভবতোষ তাকিয়ে আছেন ইন্দিরার দিকে। ইন্দিরা আরও এগিয়ে গেল--একের পর এক চুম্বনে ভরিয়ে দিল প্রেমিকের গাল।
ভবর দেহে এবার যেন রাগ আসছে, ভালো লাগা, ভালবাসার রাগ, অনুরাগ। অবশেষে ভবতোষ আস্তে করে ঠোঁট ছোঁয়ালেন ইন্দিরার গালে। কিন্তু সে ছোঁয়া ছিল বড় শান্ত, জুড়িয়ে যাওয়া, ভাবাবেগের সামান্যই প্রকাশ ছিল তাতে। আরও প্রগলভ হল ইন্দিরা, সে হাসল, খিলখিল হেসে প্রেমিকের গায়ে গড়িয়ে পড়ল। ভবতোষকে জড়িয়ে ধরল, তাঁর নিষিদ্ধ স্থান স্পর্শ করল। ভবতোষ উত্তপ্ত। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। ইন্দিরাকে জড়িয়ে ধরলেন। ইন্দিরার ঠোঁটে চুমু কাটলেন। এবং এরপর যেন মনে হল ভবতোষ বেসামাল হবেন। খানিক সময়ের জন্যে ইন্দিরার মনে হচ্ছিল এক শক্ত পাথর খণ্ড বুঝি তার দিকে উঁচিয়ে আসছে! সে বাধা দেয় নি। সমস্ত পরীক্ষার শেষ দেখতে চেয়ে ছিল সে। কিন্তু সমস্ত পরিণতি অসমাপ্ত থেকে গেল। কিছুতেই ভবতোষ সক্ত সমর্থ হতে পারেন নি। তিনি বিনা কারণেই ন্যাতিয়ে পড়লেন। এক অবসাদগ্রস্ততা তাঁকে নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছিল। ব্যাস, সে দিন ইন্দিরা নীরবে বেরিয়ে গিয়ে ছিল ভবতোষের ঘর থেকে। সে আর কোন দিন কথা বলে নি ভবতোষের সাথে, আর কোন দিন আসেনি তাঁর কাছে।
ভবতোষ সেদিন তাঁর প্রেমের গল্প রমাকান্তকে বলে ছিলেন।
এ ঘটনা ভবতোষের অক্ষমতার প্রমাণ কতটা দিতে পারে ? এমনটা স্বাভাবিক পুরুষের ক্ষেত্রে কি কখনও ঘটতে পারে না ? কিন্তু সে দিনের ঘটনার কথা স্মরণ করে ভবতোষ নিজেকে অসমর্থ ভাবতেন, প্রেমের ব্যর্থতার জন্যে নিজেকেই দায়ী মনে করতেন। আসলে এই পৌরুষ শক্তি মনের দিক থেকেই পরিচালিত হয়। মন থেকে যে ভেঙ্গে যায়, নিজেকে যে অসমর্থ ভেবে নেয়, সে প্রকৃতই ক্রমশ অসমর্থতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
আজ সত্তর ছুঁই ছুঁই করছেন রমাকান্ত। ভবতোষ আরও দু এক বছরের সিনিয়র। ভবতোষ গোঁসাই বনে আজ বিশ বছর হয়ে গেল আশ্রমে চলে গেছেন। রমাকান্ত বিপত্নীক হয়েছেন আজ দশ বছর হয়ে গেছে। তাঁর ছেলে আজ বেশ কিছু দিন হয়ে গেল সপরিবারে আমেরিকায় আছে। বছরে একবার ওরা এসে রমাকান্তকে দেখে যায়। ঘরে এখন একলাটি রমাকান্ত। ইতিমধ্যে ভবতোষ বাবুর আমন্ত্রণ এসেছে অনেকবার, আশ্রম ঘুরে যাবার জন্যে।
এবারও আশ্রমের বার্ষিক উত্সবে তাঁর নিমন্ত্রণ পত্র এলো। কোন দিক না ভেবে রমাকান্ত এবার আশ্রমে পৌঁছেই গেলেন। আর দশটা আশ্রমের মতই শান্ত পরিবেশের মাঝে গ্রাম প্রকৃতির খোলামেলা জাগায় এই আশ্রম। রমাকান্তকে দেখে খুব খুশি হলেন ভবতোষ। তাঁর অনুরোধে রাতটা কাটিয়ে যেতেও রাজি হয়ে গেলেন রমাকান্ত। রাতে সাত্ত্বিক নিরামিষ ভোজনের পর দুজনের আলাপপর্ব শুরু হল। রমাকান্ত ভবতোষের সাধু জীবনের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলেন।
ভবতোষ গোঁসাই মুখ খুললেন, আপনি তো জানেন আমার প্রথম জীবনের প্রেমকথা। ওই সময়টা পার করেও আমার মাঝে মাঝে বিয়ে করার ইচ্ছে হত। কিন্তু ভয় হত খুব, নিজেকে দুর্বল মনে হত। মনে হত স্ত্রীকে আমি কখনো সুখী করতে পারব না।
--বিয়ে করে নিলে সব ঠিক হয়ে যেত, মাঝে রমাকান্ত বলে উঠলেন।
--হয় তো তাই, হয় তো না--উদাসী ভবতোষ বলে উঠলেন, তবে একটা কথা ঠিক জানবেন রমাকান্ত বাবু, যারা সাধু সন্ত হন, তাঁদের শারীরিক দুর্বলতা থাকে। এ ধরণের দুর্বলতা নিয়েই বোধহয় ওঁরা জন্ম নেন। অথবা এমন হতে পারে, সংসার জীবনে মনো নিবেশের চেতনা শক্তি ওঁদের একেবারেই থাকে না--এটা শারীরিক ত্রুটি হোক, কিম্বা মানসিক। আমার মত লোকেরা তো অর্ধেক সাধু ! তবু আমি গোঁসাই জীবন মন থেকে মেনে নিতে পেরেছি, এটাই তো বড় কথা।
চুপ হলেন ভবতোষ। স্তব্ধতা নেমে এলো ঘরে। কারও মুখে আর একটিও কথা নেই। রমাকান্ত ভাবলেন, ভবতোষ বাবু ভালো আছেন। তবে প্রেম জনিত ঘটনায় তাঁর স্বাভাবিক জীবনের ব্যাঘাত ঘটেছে , এটা না মেনে উপায় নেই।
![]() |
| পরিচিতি |
তাপসকিরণ রায়
Reviewed by Pd
on
জানুয়ারি ২৬, ২০১৫
Rating:
Reviewed by Pd
on
জানুয়ারি ২৬, ২০১৫
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন