মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর


১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের মানুষের স্বপ্নময় লগ্ন। দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর, দিকে দিকে শুরু হয়েছে দামাল ছেলেদের প্রতিরোধ। হতাহত হচ্ছে পাকিস্তানি সেনারা। বাংলা মায়ের কোলও খালি হচ্ছে , তবু এগিয়ে যাওয়া, বাংলার মাটিকে স্বাধীন করার নেশা। 

ভুরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম) বাংলাদেশে সব উত্তরের পল্লী জনপথ, গ্রামের মানুষ সহজ সরল, খেটে খাওয়া। পরিবারের বন্ধন, সমাজের বন্ধন এখানে নিবিড়। ১৯৭১ সালে বর্বর পাক-হানাদার বাহিনী এসব নিরীহ মানুষদের অকাতরে হত্যা করে, মা বোনের ইজ্জত লুটে নেয় । গ্রামের মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস পায়না, রাজাকার, আলবদরদের দাপট এদের সে সাহস দেখাতে দেয়না। প্রতিদিন খালি হয় মায়ের বুক, প্রতিদিন হারায় বোন তার সম্মান।
স্থানীয় মুক্তিবাহিনী, এলাকার চিত্র তুলে ধরে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতা চায় । সিদ্ধান্ত হয়, শত্রুর হাত থেকে ভুরুঙ্গামারীকে মুক্ত করার।

মুক্তিবাহিনীর আক্রমণেই পিছু হটতে থাকে পাকি সেনারা ।  স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনী, ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং যৌথবাহিনীর সাড়াঁশি আক্রমণে পাকিস্তানী বাহিনী ভুরুঙ্গামারী থেকে পিছু হটে; ১৪ নভেম্বর রায়গঞ্জ ব্রীজের দক্ষিণ পাড়ে নদীর কিনারা ধরে অবস্থান গ্রহন করে।

এই রায়গঞ্জ ব্রিজের পাশেই পাকিস্তানীদের ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এবং রাজাকার বাহিনীর শক্ত প্রতিরক্ষা ছিল।
লেঃ সামাদ ও লেঃ আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে দুই গ্রুপে কমান্ডো শত্রুর রায়গঞ্জের এই দূর্ভেদ্য ঘাটি দখলের পরিকল্পনা গ্রহন করেন।

দুই গ্রুপে কমান্ডো রায়গঞ্জে অবস্থিত ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে লক্ষ্য করে দুইদিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। লেঃ সামাদ তাৎক্ষণিক ভাবে বুঝতে পারেন, তার গ্রুপের কমান্ডোরা ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ফাঁদে আটকা পড়তে যাচ্ছে। রায়গঞ্জ ব্রীজের নিচে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি এলএমজি সহ বাঙ্কার ছিল। যা আগে থেকে তিনি জানতেন না, তার পরও তিনি শত্রুর রায়গঞ্জ প্রতিরক্ষা দখলের পরিকল্পনায় অটল থেকে অগ্রসর হন। অপর দলটিকে এই ভুল পজিশনের খবর দেবার জন্য লেঃ সামাদ তার ওয়্যারলেস সেট চালু করার সাথে সাথেই তাতে দলের উপর শুরু হয় পাকিস্তানীদের আর্টিলারি গান ও মর্টার এর টানা গোলা বর্ষণ । পাকিস্তানীদের গোলা গুলিতে সবাই তখন তাদের পরিনতি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন। লেঃ সামাদ বলেন "কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবেনা, মরলে সবাই এক সাথে মরবো, বাঁচলে সবাই একসাথে বাঁচবো" 

লেঃ আব্দুল্লাহ তখন লেঃ সামাদের দলের অবস্থা অনুধাবন করে হেড কোয়ার্টারকে এই আকস্মিক ঘটনাটি অবগত করান। তখন ৬নং সেক্টর কমান্ডার বাশারের নেতুত্বে মূক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে । ১৯ নভেম্বর রাত থেকে রায়গঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের উপর তিনদিক থেকে প্রচন্ড আক্রমণ শুরু হয়, এর জবাবে পাকিস্তানীরাও প্রতিরক্ষা অবস্থান হতে যথাসম্ভব বাধা প্রদান করতে থাকে। ১৯ তারিখ ভোর থেকে ২০ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩৬ ঘন্টা একটানা গোলাবর্ষণের পর ২০ নভেম্বর রাতে আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন এসে খবর দেয় শত্রুরা পালাতে শুরু করেছে। এ যুদ্ধে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দেড়শতাধিক সেনা হতাহত হয়েছিল।

১৯ নভেম্বর রাতে যুদ্ধরত অবস্থায় (ঈদুল ফেরতের আগের রাতে) ঢাকা নিবাসী, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস নিউজের বাংলাদেশ সংবাদদাতা বিশিষ্ট সাংবাদিক আতাউস সামাদের ভাতিজা লেঃ আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ, মাত্র ২১ বছর বয়সে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শাহাদত বরণ করেন। লেঃ সামাদ সহ ১৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেদিন ২৫ পাঞ্জাবের এক ব্যাটালিয়ন সেনার বিরুদ্ধে অসীম সাহস ও বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে জন্মভূমিকে স্বাধীন করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন।

তিনি যেমন বীর বিক্রমে লড়াই করে ছিলেন, তেমনটি তার সহযোদ্ধারাও জীবন দিয়ে স্বাধীন ক’রে গেছেন কুড়িগ্রামের মাটি তথা বাংলাদেশের মাটি । উইং কমান্ডার বাশার শ্রদ্ধাবসত হয়ে লেঃ সামাদকে স্যালুট করে যুদ্ধক্ষত্র থেকে উদ্ধার করে জয়মনির হাটের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে ৪১ বার গান স্যালুটের মাধ্যমে তাদের ৪ জন বীরকে সমাহিত করেন । লেঃ সামাদের বীরত্বের জন্য তাঁকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আমরা তোমাদের ভুলবোনা, ভুলবোনা।

পরিচিতি 



মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর Reviewed by Pd on ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.