“আমারো তো সাধ ছিল আশা ছিল মনে সরস্বতীর চরণ ছুঁয়ে থাকব জীবনে”-- চমকে ওঠে কেশর, সুরটা এসে পুরো মনের দরজায় আঘাত করে। ইভেন্ট ম্যানেজার হিসেবে নানা শহরে ঘুরতে হয় তাকে। গান তার প্রাণ, নিজে গাইতে না পারলেও মাউথঅর্গ্যান বাজায় অনেক ছোট থেকে, সুরের জগৎ তাকে বরাবর টানে। মাটির ভিতরের সুর, পথের বাঁকের সুর, পাখির ডাকের সুর প্রকৃতির সুরের টানে মাঝেমাঝেই বেড়িয়ে পরে সে অ্যাডভেঞ্চারে। জন্মসূত্রে সে প্রবাসী বাঙালি। বাবার দিক থেকে বাঙালী হিন্দু, আর মা মারোয়াড়ী, কলকাতায় তাদের নিজেদের পৈতৃক বাড়ি আছে বাগবাজারে। বিয়ের পর বাবা কর্মসূত্রে বাইরে চলে যান। তার আর তার দাদার জন্ম, বড় হয়ে ওঠা ইউরোপে। প্রবাসী হলেও কিন্তু বাড়িতে বাবা মাতৃভাষায় কথা বলার রেওয়াজ বজায় রেখেছিলেন। দ্বিজেন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি শুনে বড় হওয়া তাদের। রক্তের বিন্দুতে রবীন্দ্রনাথ, মননে শরৎচন্দ্র-বঙ্কিমচন্দ্র- মহাশ্বেতাদেবী- সুনীল গাঙ্গুলী, সংস্কারে বিবেকানন্দ- নেতাজী। তাই বড় হতে হতে কখন যেন নিজের দেশ, ভাষা, সংস্কৃতিকে ভালবেসে ফেলেছে নিজেও জানেনা কেশর। হাভার্ড ইউনিভার্সিটির রিসার্চের অফার অবলীলায় ফিরিয়ে দুবছর হল দিল্লিতে মামার বাড়িতে উঠেছে সে। সুরের প্রতি গভীর টান আর বাবার মুখে শোনা শিল্পীদের প্রতি অবিচার শুনে সে একটা মিউজিক ইভেন্ট সংস্থায় যোগ দিয়েছে, প্রতিভা খুঁজে তাদের সঠিক ভাবে সামনে আনতে পারে যদি। আর সাথে বাংলাকে আরো ভালো করে কাছ থেকে জানতে চায় বলেই ইচ্ছে করেই ইস্টার্ন রিজিওনে পোষ্টিং নিয়েছে। ইউরোপে থাকতে বাবা কথায় কথায় আক্ষেপ করতেন আমাদের দেশে প্রতিভারা ঠিক মত সুযোগ পায়না, কত জাত শিল্পী হারিয়ে যায়, সামনে আসতেই পারেনা। নিজের মত করে কেশরের প্রয়াস খুঁজে বার করা সেসব শিল্পীদের।
বর্ধমান থেকে সে পুরুলিয়া যাবার ট্রেন ধরেছে আজ বিকেল সাড়ে চারটায়। বর্ধমানে একটা এন.জি.ও সংস্থা থেকে অনাথ আশ্রমে একটা অনুষ্ঠানে সে চিফ গেস্ট হিসেবে এসেছিল, এখন পুরুলিয়া যাচ্ছে সেখানের লোকসংস্কৃতি মেলায় যোগ দিতে। অফিসের এক কলিগ ইনভাইট করেছে, তার বাড়ি পুরুলিয়ায়, ছৌ দেখার তার খুব সখ। বাঙালী ঐতিহ্যের এক ধারক এই ছৌ নৃত্য-- এসব ভাবতে ভাবতে কেশরের চোখ জানলার বাইরে । সূর্যাস্তের এখনও একটু দেরী আছে, কিন্তু এই সন্ধিক্ষন মুহুর্ত ভারী ভালোলাগার। দিগন্ত রেখায় এমন আলো-আঁধারের মিলে যাওয়া তাকে অবাক করে। পরপর স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে অবলীলায়। কত মানুষ, কত দৃশ্য, সতেজ একটা বুনো গন্ধ নাকে এসে লেগে থাকে। পাশের লাইনের ওভারহেডের তারে বসে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি, আর একটু পরেই বাসায় ফিরবে ওরা। মাঝে মাঝে মোবাইল থেকে দুএকটা স্ন্যাপ নিচ্ছিল সে।
“ঝালমুড়ি... ঝালমুড়ি..., এই স্বাদ কোনদিন ভুলবেন না, আমতেল দিয়ে মাখা ঝাল ঝাল মুড়ি...” মুড়ি খুব প্রিয় কেশরের। আমতেল আহঃ, দিদান আগে দেশে আসলেই এক বয়াম করে সাথে দিয়ে দিত বাবার। নিয়ে গিয়ে মুড়িতে, ভাতেতে, এমনকি পপকর্নেও মিশিয়ে খেত বাবা, বলত, ঘরের স্বাদ পায়। মা তো হেসেই খুন হত। আমতেলের গন্ধটা নাকে এসে লাগতেই সব স্নায়ুগুলো একযোগে জানান দিল ক্ষিদে পেয়েছে।
“দিনতো আমায় একটা, কত করে দাদা?”
“এই যে দিদিমনি, দিচ্ছি এক্ষুনি...বেশি না দশটাকা...”
“ভালো করে বানিয়ে দিন বেশি করে আমতেল দিয়ে...”
“হ্যাঁ দিদিমনি আমার ঝালমুড়ি খেয়ে আপনি অনেকদিন ভুলতে পারবেন না, ঘরে বানানো আমতেল দিয়ে মুচমুচে ঘরেরই ভাজা মুড়ি”
হাসি হাসি মুখ করে কেশর দেখে লোকটা নিপুন হাতে স্টিলের কৌটোতে মুড়ি পেঁয়াজ, লঙ্কা, শসা, আরো নানা সামগ্রী মেশাচ্ছে। সাথে পিছন থেকে একটা বাচ্চা ছেলে বছর সাতেকের হবে বোধহয়; রুগ্ন চেহারা এলোমেলো চুল, সারা গায়ে মলিনতা, কিন্তু চোখ দুট অসম্ভব ঝকঝকে, চুপিচুপি তাকেই দেখছে। কেশর দেখে ফেলতেই সে মুখ লুকিয়েছে বাবার কাঁধের ঝোলার পাশে। কেশরের ভারী মজা লাগে এই লুকোচুরি খেলা দেখে, সে ইচ্ছে করেই না দেখি করে। ঝালমুড়িয়ালাকে যখন বানাতে বলল ঠিক তখন পাশের লোকটার কথাগুলো কানে আসে হঠাতই; সাথের বাচ্চা মেয়েটা ঝালমুড়ি খাবার বায়না করছিল, ধমকায় লোকটা, রাস্তার ধুলোময়লা নাকি মিশে আছে ওতে। হাসি পায় কেশরের, পলিউশান নিয়ে যেন কত ওরিড লোকটা। এখন বসে বসে সিগারেট খেয়ে যে ধোঁয়াটা ছড়াচ্ছে তাতে অবশ্য ক্ষতি হচ্ছেনা মেয়ের; হিপোক্র্যাট যত।
“দাদা আরো একটা বানান...”
উর্ধাঙ্গের আই মি মাইসেলফ লেখা টিশার্টের উপরে চাপানো জিন্সের জ্যাকেটের বুকপকেট থেকে কেশর টাকা বার করতে গিয়ে দেখে খুচরো নেই, “ একশো টাকার ভাঙতি হবে দাদা”
“না দিদিমনি, আজ ভালো ফেরি হয়নি, আপনাকে দিয়েই এই বেলা বউনি করছি...”
“ঠিক আছে, আমি দেখছি” কেশর পার্স থেকে বের করে কুড়ি টাকা।
ঠোঙ্গা দুখানা এগিয়ে দেয় লোকটা, কেশর প্রথম ঠোঙাটা ঝালমুড়িয়ালার বাচ্চাটার হাতে দিতে গেলে অবাক চোখে পিছিয়ে সিঁটিয়ে যায় আরো।
“কি করছেন দিদিমনি...”
“এটা ওর জন্য, ওর মুখটা ক্ষিদেয় শুকিয়ে গেছে, কই নাও”
ঢোক গেলে বাচ্চাটা, বাবার মুখের দিকে তাকায়,
“না না দিদিমনি...”
“না নিতেই হবে... নইলে আমিও নেব না”
অগত্যা বাপের সমর্থন পেয়ে বাচ্চাটা এগিয়ে আসে, ঠোঙা হাতে নেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কেশর, “কি নাম তোমার?”
একমুখ হেসে বলে সে “কানহা...”
“এই নাও দিদিমনি আরো দুটো নারকেল তোমার জন্য, না করবে না কিন্তু, কানহা দিল তোমায় নাও”
‘ঝালমুড়ি...’, আস্তে আস্তে ডাকটা মিলিয়ে যায়, দূরে...
মুড়ি মুখে দিয়েই মনটা ভালো হয়ে যায় কেশরের, চেনা আমতেলের গন্ধ। দিদানের চলে যাবার পর আজ কতদিন পর চেনাচেনা গন্ধটা, কাস্তের মত দুধসাদা নারকেল কামড় দেয় কেশর, মিষ্টি স্বাদ... ফ্রেশ জিনিসের স্বাদ এমনি হয় হয়ত। ইউরোপে প্যাকেট আর টিনড খাবারের স্বাদ একেক সময় অসহ্য লাগত কেশরের। সুন্দর সুন্দর ঝাঁ চকচকে দোকানে পসরা সাজিয়ে বসে সব, টাকা দাও আর কেনো, ব্যস শেষ; কোন এক্সট্রা কথা কেউ বলে না, সব কেমন মাপামাপা কৃত্রিম। আর এখানে এই ট্রেনের ঝালমুড়ি, এতে বিক্রেতার অভাব আছে, অনেক কিছুতে পিছিয়ে থেকেও কিন্তু আছে আন্তরিকতা, ঘরোয়া ভালবাসা নিজের দেশে পথেঘাটে খুঁজে পায় কেশর। ভাবতে ভাবতেই কানে আসে এবার, “আমারো তো সাধ ছিল আশা ছিল মনে, সরস্বতীর চরণ ছুঁয়ে থাকব জীবনে...”, পরিষ্কার হচ্ছে ক্রমশ। কেশরের খুব ইচ্ছে করে মানুষটাকে দেখতে, একটা খুব পরিচিত গান, কিন্তু যে গাইছে তার গায়কিতে কাউকে অন্ধ অনুকরণত্ব নেই, নিজের মত করেই গাইছে লোকটা; সেটাই সব থেকে নাড়া দিচ্ছিল কেশরকে। তার দুই চোখ খুঁজে ফেরে মানুষটাকে যার এমন উদাত্ত কন্ঠস্বর, এমন সহজাত গায়কি। ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসছিল সুর, আশেপাশের লোকজনের কেউ কেউ একটা বাড়িয়ে দেওয়া হাতে খুচরো দুটাকা-পাঁচটাকা দিচ্ছিল। ভাবতে ভাবতেই সামনে তারই সমবয়সী একটি ছেলে এক হাতে মাইক্রোফোন, অন্যহাতটা পয়সার জন্য বাড়াচ্ছে মাঝে মাঝে। লম্বা, পাতলা ক্ষয়াটে চেহারার এক যুবক, এতো সুরের খাজানা ওই রোগাটে বুকে! কেউ সেভাবে শুনছেও না, কারোর কারোর কাছে তো মুফতের এন্টারটেনমেন্ট। কানে ভেসে আসে, “আরে ভাই এসব গান পুরানো, কিছু মশালাদার শোনাও...”, তির্যক ব্যঙ্গ, “চলমান এফ এম...” হাসির আওয়াজ, ছেলেটা সেভাবে বিচলিত না, মাপ হাসি ঠোঁটের ডগায়, দীপ্ত কণ্ঠে গেয়ে এগিয়ে আসছে, যেন কারোর কাছে কোন অভিযোগ নেই। চৌকো চোয়ালে এক দৃঢ়তা, চোখে শুধু একটা চাপা কষ্টের প্রাণপন লুকোবার প্রয়াস। কেশর খতিয়ে দেখছিল, ততক্ষনে গান বদলেছে, এখন গাইছে, “গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে, ভেবেছিল একটি পাখি...”
হাতপাতার আগেই কেশর একটা পাঁচশ টাকার নোট এগিয়ে দিল, ছেলেটা শ্লেষের হাসি হেসে গানটা শেষ করে বলে, “মেমসাহেব, ভিক্ষা যদি এত দেন লোকে আপনাকে লুট করবে যে। ভুল করলেন বোধহয়; আপনার চেহারা বলছে আপনি বাইরের, তাই হয়ত...”
“না, আপনি সত্যি ভালো গেয়েছেন; আর এটা আপনার গানের জন্য আমার উপহার, ভিক্ষা নয়”, ছেলেটাকে থামায় কেশর।
“মেমসাহেব, উপহার পেতে ঠিক অভ্যস্ত নই তো, তাই... গরীব মানুষের কাছে উপহার পাওয়াটা স্বপ্নের”
“আরে বড়লোকি ব্যপারস্যপার...”, হাসির রোল ওঠে ট্রেনের আশপাশের ভিড়ে।
“তবুও রাখুন, ভালো লাগবে আমার...”
“কপাল ফিরে গেল রে তোর...” ভিড় থেকে ভেসে আসে।
“ধন্যবাদ ...” ছেলেটা এগিয়ে যায়...। কেশর ভাবতে থাকে, “কি অদ্ভুত ছেলেটা, কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাসী, কিন্তু বুকের গভীরে যেন কোন যন্ত্রণা লুকিয়ে রেখেছে। খুব জানতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু..., সেটা কিভাবে সম্ভব...”। ভিড়ে হারিয়ে গেল ছেলেটা, শুধু সুরটা মাঝে মাঝে ভেসে আসছে এখনও, রেশ রেখে গেছে চলে গিয়েও। ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেন থেমে যায়। কিন্তু স্টেশন তো এখনও আসেনি। তাকিয়ে দেখে জঙ্গল জঙ্গল মত একটা জায়গা। সবাই উৎকন্ঠিত, কি হল কি হল? চেন টেনেছে কেউ? নাকি অন্যকিছু... ভাবতে ভাবতে মিনিট দশেক কেটে যায়, কেশর উঠে দাঁড়ায়। এভাবে বসে থাকাটা তার পোষায় না, পায়ে পায়ে দরজার দিকে যায়। অনেকেই ট্রেন থেকে নীচে নেমে দাঁড়িয়েছে, গেটের কাছে গিয়ে চোখ পড়ে, গায়ক ছেলেটা রড ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে ঝুঁকে আছে। পাশে এসে উঁকি দেয় কেশর, “কি হয়েছে বলতে পারেন?”
“সেটাই তো জানার...” উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায় ছেলেটা...
“এমন হুট করে মাঝপথে দাঁড়িয়ে গেল কেন ট্রেনটা?”
“আরে আপনি...” আলতো হাসে ছেলেটা।
কেশর চোখে চোখ রাখে, হাসে, “হ্যাঁ, জানতে এলাম কি হয়েছে, এরকম কি হয় এখানে?”
“মনে হয়না সিগন্যালের সমস্যা, অন্য কিছু মনে হচ্ছে... হ্যাঁ, এখানে এমন হয়, আশেপাশে সব কয়লাখনি কিনা, তাই এমনিতেই ট্রেন খানিক ধীরে যায় এই পথটুকু”
“এরপর কোন স্টেশন আসছিল?”
“বার্নপুর”
“আপনার নামটা কি জানতে পারি?”
“স্বপন”
“আমি কেশর; আচ্ছা স্বপন, কয়লাখনি কাছে থাকতে ট্রেন আস্তে যায় ঠিক বুঝলাম না”
“ধস, দুর্ঘটনা প্রায়ই নিত্যসঙ্গী এখানের মানুষের কয়লার নানা খাদানের জন্য, এমনকি রেললাইনের নীচের জমির কয়লাও চুরি হয় এখানে, তাই আর কি...”
“হুমম... আপনার বাড়ি এখানে?”
“হ্যাঁ, আমার বাড়ি বার্নপুরে”
“খুব জানতে ইচ্ছে করছে একটা কথা”
“বলুন”
“আপনি খুব সুন্দর গান করেন, একদম নিজের হৃদয় দিয়ে ভিতর থেকে পুরো, তাহলে এভাবে ট্রেনে...?”
“ম্যাডাম, পেটের দায়...”
“মানে?”
“আপনি এত কথা জানতে চাইছেন কেন? আমি খুব সাধারনের থেকেও সাধারন একটি মানুষ”
“আসলে আমি তো ইভেন্ট ম্যানেজার... প্রতিভা খুঁজে বেড়ানোটাই আমার কাজ আর ভাললাগাও বলতে পারেন”
“ও বুঝেছি তার মানে আপনিও...”, কালো ছায়া স্বপনের মুখে।
“কি বুঝলেন? আপনি কি কিছু মনে করলেন আমি জানতে চাইলাম বলে?”
“নাহ, মন থাকলে মনে করা... আমি ত সেটাকে খুন করেছি নিজের হাতেই”
“মানে?”
“মানে... খুব কঠিন বুঝলেন, কিন্তু বাস্তব”
“আপত্তি না থাকলে একটু বলবেন কেন এতো অল্পবয়সে আপনি এভাবে ট্রেনে গান গেয়ে নিজের প্রতিভার অপচয় করছেন?”
“বললাম যে বাস্তব, বাবা বার্নপুর ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন, মেকানিকের। একদিন কারখানায় একটা অ্যাক্সিডেন্টে হাত কাটা পড়ল। আমি তখন বি.কম. ফাইনাল দেব, দিদি বি.এ. পাশ করে বিউটি পার্লারে কাজ করত। ফ্যাক্টরি থেকে ক্ষতিপূরণ, পি.এফ, গ্র্যাচ্যুইটিতে যা টাকা পাবার কথা তার অর্ধেক দিতে দিতেই ওরা ছমাস কাটিয়ে দিল। তখন দিদি হাল ধরল সংসারের। বিউটি পার্লারের কাজে অনেক ঝুঁকি, পার্লারের ডিউটি শেষ করে কাস্টমারদের বাড়িতে গিয়ে গিয়ে বাড়তি কাজ করে দিদি টানছিল সংসার। কিন্তু নানা প্রলোভন, যুবতী মেয়ে তায় আবার গরীবের ঘরের। হায়না, শকুনরা তো ওঁত পেতেই বসে থাকে ঝোপেঝাড়ে। কর্তৃপক্ষ এরপর বাবার জায়গায় দিদিকে কাজ দিতে চাইল ক্ষতিপূরণ হিসেবে, অফিসেই ছোটখাট একটা পিওন জাতীয় কাজ। দিদি গেছিলও, কিন্তু কারখানার মালিকের বিছানা গরম করতে হবে এটাও চাকরির শর্তে এসে জুড়ল। ক্ষতিপূরন নিতে গিয়ে দিদির এত বড় ক্ষতি কি মানা যায় বলুন?”
“তারপর?”, রুদ্ধশ্বাসে জানতে চায় কেশর -
“হলনা... আমিই দিইনি দিদিকে ওপথে যেতে, পড়ার ফাঁকে গানের টিউশানি করতে লাগলাম, দুই ভাইবোন নিজের মত করেই এগোতে লাগলাম। এদিকে মা অ্যাজমার রুগী, বাবার ঐ হাল, টাকার খুব দরকার তখন আমাদের, দিদিটাকেও তো বিয়ে-থা দিতে হবে; বাবার চাকরী যাবার পর আমাদের রিভারসাইড কলোনি কোয়ার্টার ছেড়ে অন্য জায়গায় উঠে আসতে হল। এমন সময় আমি সুযোগ পাই এক রিয়েলিটি শো-তে... গেলাম কলকাতায়, জয়ও আসল সহজেই। নাহঃ, আমার কোন ব্যাকিং ছিল না, মা স্বরস্বতীর আশিসটুকু সম্বল করেই গেছিলাম। কিছু টাকা পেলাম পুরস্কার হিসাবে আর পেয়েছিলাম ক্যাসেট করার অফার। তখনই দেখলাম আরো কঠোর রূপ বাস্তবের, নোংরামিতে ভরা। ওরা আমাকে ঘুরাতে লাগল নানা অছিলায়। আপনি তো এ লাইনে আছেন, জানেনই তো তেল দেয়াটা কতটা জরুরী”
“তেল দেওয়া? মানে?”
“ম্যাডাম, তোষামোদ আর ওটাই আমি পারিনা। আর হল কাঠি করা, নাহ, আমি কলকাঠি বুঝিনা। কাঠি দিই না আর দিতে চাইও না। ফলে যথারীতি আমার বিদায়ঘন্টা বাজল ওখান থেকে। মিথ্যা বলবনা আমার মেন্টর খুব ভালবাসতেন আমায়, আপনারই মত একজন মহিলা উর্মি ম্যাডাম। স্বপ্ন দেখেছিলেন অনেক আমায় নিয়ে আর ভালোবেসে ফেলেছিলেন। আমার মত গরীব বেকার ছেলের মধ্যে কি দেখেছিলেন জানিনা। কিন্তু পারেননি উনি, ওঁনারও যে টিকি বাঁধা ছিল এক জায়গায়, আমার জন্য নিজের কেরিয়ার জলে দেবেন আমিও সেটা মানতে পারিনি। আমায় রেখে দিয়ে চেয়েছিলেন তার কাছে, জুড়তে চেয়েছিলেন নিজের জীবনের সাথে। নাম আমার স্বপন কিন্তু তা বলে অন্যের স্বপ্নকে ভাঙব কি করে? ফিরে এলাম। তারপর কাজের চেষ্টা চালাচ্ছি আর সাথে সাথে ট্রেনে।
“এই নাও আমার কার্ড, রেখে দাও তোমার কাজে লাগবে”
“না ম্যাডাম, আর ওপথে যাব না, প্রদীপের তলায় ঘন আঁধার”
“স্বপন, যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে, জীবনে সুযোগ আসা বন্ধ হয়না। তোমার মত খাঁটি মুক্তো খুঁজতেই আমার আসা এদেশে। জানিনা, আমার ক্ষমতাও সীমিত তবু আমি চেষ্টা করব, তোমার জন্য কিছু করতে পারলে আমার ভালো লাগবে, তবুও এভাবে নিজের প্রতিভাকে পথে পথে বিপনন করে শেষ কর না”
“আপনাকে একটা কথা বলি ম্যাডাম যাবার আগে, এই হাতপাতা মানে জানেন কি? ভিক্ষা... আমি গান গেয়ে ভিক্ষা করি, গান বিক্রি করিনা, আর ভিক্ষা করায় অহং মরে ম্যাডাম। বাউল সন্ন্যাসীরা যা করে এসেছেন যুগেযুগে... আপনারা ঝাঁ চকচকে দুনিয়ার মানুষরা বুঝবেন না, গরীবের কাছে, প্রকৃত শিল্পী তথা প্রকৃত মানুষের কাছে তার আত্মসম্মানটাই সব। প্রতিভার বিপণন তো আপনারা করেন, নিজেদের স্বার্থে। তবুও ভালো আপনি আলাদা ভাবতে পারছেন... ভাল লাগল, চলি, এভাবে সময় কাটালে আমাদের দিন কাটবে না ”, লাফ দিয়ে নামে ছেলেটা...
ঝুঁকে দেখে কেশর, দৃপ্ত দুখানি পা হেঁটে চলেছে হনহন করে... যতক্ষন দেখা যায় দেখে কেশর...। বাইরে সন্ধ্যে নেমেছে ততক্ষনে... দূরে ঐ যে বার্নপুর ফ্যাক্টরি বোধহয়, কমলাটে ধোঁয়া উঠছে অনর্গল। মিশে যাচ্ছে অন্ধকার ঘনানো আকাশে, ঠিক যেন স্বপনের মতই... সন্ন্যাসের কমলা ধোঁয়া...
ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা চলতে শুরু করে হঠাৎই, পিছিয়ে আসে কেশর... এতক্ষনে সিগন্যাল পেয়েছে বোধহয়..., জীবনও... চলার শুরু আবার...।।
পরিচিতি |
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন