তিন দিন যাবৎ মুসলধারে বৃষ্টি হচ্ছে । মনে হচ্ছে আকাশের ওই নিম্নচাপটা আমাদের গ্রামকে একটু বেশিই ভালোবাসে । দু’ধারের নালা থেকে জল উপজে মোরামের রাস্তা যেন এক সদ্যোজাত নদী ।
পরিচিত বুড়ো মুখগুলো ঘরের কোনে নির্বাসিত । তাসের আসরেও কেউ নেই । কিন্তু ওই কিশোর মুখগুলোকে আটকাবে কে ? মাধ্যাকর্ষনের হাত ছিনিয়েও ওরা ছুটে আসবে ।
কি সুন্দর বাঁশ পাতার নৌকা তৈরি করে ভাসিয়ে দিচ্ছে স্রোতের অভিমুখে । কি উচ্ছাস, কি আনন্দ, কি মুখরতা । যেন ওই নৌকার সাথে ওরাই ভেসে যাচ্ছে কোনো এক রূপকথার নগরীতে ।
আমার শৈশব আমার দু’হাত ধরে টানতে থাকে । বলে “চল্ ওদের সঙ্গ দিই’’ । অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলেও শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বিশ্বাস নেই । তার উপর অফিসে এখন কাজের খুব চাপ । তাই উঠানেই ঠেস দিয়ে বসলাম ।
মা বাটি করে লেবু চা এনে দিলো । এই মরসুমের অনবদ্য পানীয় । মা আমার পাশেই এসে বসলো । মা বসে বসে খেজুর পাতার তালাই বুনছে ।আমি লেবু চা’য়ে একটা একটা করে চুমুক বসাচ্ছি । আর বৃষ্টির ভীতরে খুঁজছি তাঁর আকর্ষনের ধারাপাত ।
--“ কিরে সাগর আজ কাজে যাসনি ?’’ আমি মুখ ফিরিয়ে দেখি আসরফ । মাথায় তালপাতার পেকে ।ডান হাতে একটা বড় লাঠি আর বাঁ হাতে দু’টো ঘুনি ।
--না’রে আজ যেতে পারিনি । আজকের দিনটা বৃষ্টিকেই দিলাম । তা তুই আবার কোথায় চললি ?
--‘পশ্চিম মাঠের জমি গুলোতে দেখছি ক্যানেল থেকে ভালোই মাছ উঠেছে । দেখি ঘুনি দিয়ে কালকের তরকারিটা জোটাতে পারি নাকি’ !
--যা । (মনে মনে হাঁসি পেল খুব) ।
আসরফ আর আমি সমবয়স্ক । একই সাথে পড়তাম ।আসরফ পড়াশুনা না পারলেও মাছ ধরতে ভালো পারতো ।
তখন আমরা ক্লাস এইটে পড়ি । ঘোর বর্ষাকাল । দু’জনেই মা’য়ের ওই মাধ্যাকর্ষনের জাল ছিঁড়ে বেড়িয়ে সোজা পশ্চিম মাঠের জমিতে । কোনোদিন সমুদ্র দেখিনি । বর্ষার জল আলপথ উপজে যেন এটাই আমাদের সমুদ্র ।সমস্থ মাঠ একটা সাদা মসৃণ তল । চকচক করছে । আর আমরা যেন দিক হারানো দুই নাবিক । কোনো পিছুটান নেই । নিজেদের মতো করে ছুটে গিয়ে লাফ দিচ্ছি । ধরাধরি খেলছি । একেবারে সীমাহীন গোল্লাছুট ….
ছুটতে ছুটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল আসরফ । কিছুক্ষন চুপ করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো পাশের জমিটার দিকে । আমি এক পা এক পা করে কাছে গিয়ে বললাম ‘কি দেখছিস ?’
--‘ওই দ্যাখ, কতো বড় একটা মাগুর মাছ !’
--(জলটা একটু ঘোলাটে) কই রে ঠিক করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না । তবে হ্যাঁ, কিছু একটা নড়ছে ।
--‘কিছু কিরে ! পাক্কা মাগুর ।ওই যে পিঠের পাখনাটা দ্যাখা যাচ্ছে ।হলুদ হয়ে গেছে । বেশ পুরানো । কিলো তিনেক তো হবেই …’
দেখলাম সত্যিই হলুদ হয়ে গেছে । মাছের লোভ কেই বা সামলাতে পারে ? তার উপর আবার বলছে কিলো তিনেক …
বললাম, ধরবি কি করে ? আমাদের কাছে তো জাল নেই !
--‘আরে, আসরফকে তুই কি মনে করিস ? ইয়ে হাত নেহি, ফাঁসি কা ফান্দা হ্যে…’ বলেই কমপ্ল্যান বয়ের মতো ঝপাং করে এক লাফ । সোজা মাছটার ঘারে । মাছের মাথাটাকে প্রথমে ভালো করে কায়দা করার চেষ্টা করতে থাকে ।
--‘বলেছিলাম না পাক্কা মাগুর । দ্যাখ আমাকে কাঁটা মারছে …’
--(আমি তো আনন্দে আত্মহারা) যতই কাঁটা মারুক । আসরফ, ছাড়বি না একদম … আমিও যাচ্ছি ।
বলেই এক লাফে গিয়ে মাছের লেজটার কাছে হাত লাগালাম । সত্যিই বেশ বড় মাছ । খুব জোড়ে ঝাপটা মারছে ।
দু’জনে তখন সম্পূর্ণ দিশেহারা । আমরা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে মত্ত । আসরফ মাথার দিকটা চেপে ধরলো । আর আমি লেজটা । অনেক যুদ্ধের পর দু’জনের সম্মতিক্রমে এবার মাছটাকে জল থেকে তোলার পালা । ঠিক হলো মাছটাকে তুলেই একছুটে সটান পাশের চটানে গিয়ে উঠবো ।
কথা মতোই এক ছুট ।
এক ছুটে চটান … চটানে উঠেই মাছটাকে মাটিতে ফেলে দিই ।
অসীম ছটফটানিতে উৎসুক চার চোখ এক লহমায় মাছের শরীরে গিয়ে বসলো ।
একি কান্ড ? দু’জনেই হতবম্ব ।
--“ এ’মা! মাগুর রাগে ফোঁস ফোঁস শব্দে আমাদের দিকে ছুটে আসছে কেন ?
আর মাগুর মাছের পা’য় বা এলো কোথ্থেকে ?”
আমি কিছু বুঝে ওঠবার আগেই আসরফ প্রাণপনে মেরে দিলো ছুট …
---‘ ওরে সাগর পালা ! ওটা মাগুর নয়, একটা মস্ত গো-সাপ ।’
কথাটা শুনে আমার চোখ দুটি গোল গোল করে ঘুরে গেলো । বাব্বারে করে আমিও এক নিঃশ্বাসে সোজা ঘরের উঠোন । তারপর জল-কলের মুখে এক দীর্ঘ চুমুক ।
(মনে মনে হাঁসতে হাঁসতে) লেবু চা’য়ের বাটিতে শেষ চুমুকটা দিলাম । মনে পড়ছে সেটাই আমার মাছ ধরার প্রথম ও শেষ প্রয়াস ।।
![]() |
| পরিচিতি |
সেখ সাদ্দাম হোসেন
Reviewed by Pd
on
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
ডিসেম্বর ১৬, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন