আমি রুবি । কল গার্ল । এটাই আমার পেশা । ঘেন্না হচ্ছে ? তা হতেই পারে , আপনারা ভদ্দরলোক কিনা । তবে কি জানেন , “কল গার্ল” শব্দটাকে আমি এক সময় খুব ঘেন্না করতাম এই এখন যেমন আপনারা করছেন । যখন দেখলাম এই পেশায় এসে আমার বাবা মাকে আর মারে না , বোন আর ভাইকেও ইস্কুল ছাড়তে হল না , বাবার মুদিখানার দোকানে মালপত্তর তুলে দিতে পারছি অর্থাৎ এক কথায় সংসারটা ঠিকঠাক চলতে লাগল তখন থেকেই এই কাজটার প্রতি মমতা জন্মে গেল । আমার কথা শুনে আপনারা বলতেই পারেন অন্য কাজ কি আর করা যেত না ? এই পথে কেন ? এটা আমারও মনের কথা । কিন্তু সমাজে ধর্ষিতা মেয়েদের বড় জ্বালা যে । গরীব ছিলাম তবু ইজ্জতটা তো ছিল। সমাজ তার কোন দাম দিল না। অন্ধকার রাস্তা , একলা পেয়ে পৌরুষের দেখনদারি , ছোট জামা , বুকের খাঁজ দেখা যায় , ব্যাস নাও ধর্ষণ কর। বার মাসে তের পার্বণ , চাঁদা দিতে পারেনি বাপটা আর কি ? সমত্ত মেয়েটা তো আছে । এই তো সমাজ !
আমি আগে ভয় পেতাম , কোচিং থেকে ফিরতে অনেক সময় সন্ধ্যে পার হয়ে যেত , মা ঘর – বার করত , বাবাও কখনও আমাকে আনতে যেত স্যারের বাড়ি থেকে। এখন পাড়ায় বুক ফুলিয়ে ঢুকি । তপন , পেলু , তোতলা আর যেসব ল্যা... থুড়ি এই লাইনে থাকতে থাকতে যা মাল হয়ে গেছি না ! যাক গে, ওরা আগে খুব আওয়াজ দিত এখন ওসব বন্ধ হয়ে গেছে । অনেক রাতে পাড়ায় যখন ঢুকি শালারা চোখ পিটপিট করে দেখে । সত্যি বলতে কি , শরীরের জেল্লাও বেড়েছে মাইরি । খড়ি ওঠা গা এখন মোমের মত । মা টা প্রথমে সতীপনা করছিল , টাকা কিছুতেই ছোঁবে না । বাপটার সে সবের বালাই নেই , টাকার গন্ধ খুব ভালবাসে । এখন প্রতিবছর ভাই – বোনকে পুজোয় নতুন জামা দিতে পারি । বাবা – মাকেও দিই। তখন দু চারটে খদ্দের বেশি ধরতে হয় । হোটেলের মালিকটাও কমিশন খায় । তাকেও কিছু দিতে হয় ।
ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি । কলেজে পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল । সাগর স্যার খুব ভালোবাসত । যখন তখন আমায় ডেকে পাঠাতো । বউদি কিছু রান্না করলে খাওয়াত । সেদিন তো ছিল এমনই একদিন । পড়ার ডেট ছিল না । মানিক এসে খবর দিল সাগর স্যার ডেকেছে তাড়াতাড়ি যেন যাই । তখন আর কি করে জানবো পেটে পেটে শয়তানী ছিল । আমার জীবনটাই এক নিমেষে বদলে গেল । বউদি নেই । ফাঁকা বাড়িতে আমায় হঠাৎ একটা ঘরে ঢুকিয়ে দিল । তারপর সেই প্রথম বাড়িতে মাকে মিথ্যে বলেছিলাম । আমার মুখ বন্ধ রাখার জন্য ভাইটাকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় । আমি চুপ করে গেলাম । তারপর আর পড়াশোনা মাথায় ঢোকেনি ।
প্রায় দিনই নানা ছুতোয় আমাকে ডেকে পাঠায়; না গেলে হুমকি দেয় । নিজের শরীরের ওপর ঘেন্না ধরে গেল একসময় । ভাবলাম , এমন একটা কাজ করবো যাতে এই শরীরটাই পুরুষের খাদ্য হয়ে যায়। তবেই সারা পুরুষ জাতটার প্রতি চরম শোধ নেওয়া হবে ।
ক্লাসে ফেল করলাম । বাবা খুব মারল । মাও বাবার পক্ষে সায় দিল। সারারাত না খেতে দিয়ে বাড়ির বাইরে রেখে দিল। খিদের জ্বালায় আর অপমানে মাথা কাজ করল না । তখন কারও কথা ভাবতে পারছিলাম না। পালিয়ে গেলাম । শুনেছি কলকাতায় মেয়েদের শরীরের ব্যবসা হয় । কোথায় তো জানি না। কিন্তু একটা কথা আছে না “ যে খায় চিনি তাকে যোগায় চিন্তামণি” ...আমাকেও তেমনি সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এল দিলিপ । মেয়েছেলের দালালি করে । তখন অবশ্য পরিচয় দিয়েছিল ‘বিজনেস’ করে বলে । সারা দেশ জুড়েই তো সাগর স্যারেরা ছড়িয়ে আছে । মেয়েমানুষের গন্ধ পেলে আর কি চাই শালাদের। লজ্জা তো আগেই ভেঙে দিয়েছিল সাগর স্যার । “স্যার” বলতে ঘেন্না করে মাইরি। এরাই নাকি আবার মানুষ গড়ার কারিগর । হা হা হা ।
ভালো রোজগার হত। কিন্তু হারামি মাসিটার জন্যই ওই জায়গা ছেড়ে একটা হোটেলে কাজ নিলাম । মাসে দশ থেকে পনের দিন কাজ থাকে বাকি দিনগুলো মস্তিতে কাটে । বাড়ি যাই। বাবা – মা – ভাই – বোনদের দেখে আসি । প্রথমে বাবা ঢুকতেই দেয়নি বাড়িতে । কোথায় ছিলাম জানতে চেয়েছিল । সটান বলে দিয়েছিলাম হোটেলের কল গার্ল । শুনে তো বাবা এই মারে সেই মারে । শেষে ভাইটার জন্য বেঁচে গেলাম । বোনের ভবিষ্যত ভেবে মা আমায় বাড়িতে আসতে বারণ করেছিল । তাই রাতের অন্ধকারে প্রতিমাসে একবার গিয়ে সংসার খরচের টাকা দিয়ে চলে আসি । আমি চাই ওরা ভালো থাকুক । এখন অনেক টাকার দরকার । বোনটার খুব ভালো ঘরে বিয়ে দিতে হবে । তবে ওকে কোন স্যারের বাড়িতে পড়তে পাঠাইনা । দ্বিগুন টাকা খরচ করে বাড়িতেই আনি স্যারেদের। মাকে বলে দিয়েছি বোনকে যেন চোখে চোখে রাখে । আর একটা “রুবি” কিছুতেই যেন না হয়।
পরিচিতি |
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন