ইফতেখারুল হক



একটা ব্রিজ হঠাৎ করে ভেঙে পড়ল আজ । স্থায়িত্বকাল তিনশো সত্তর দিন, নির্মাণকাল ছিল অনির্ধারিত । ব্রিজটা অনেক আগেই ভেঙে যেতে পারতো কিংবা আরও কিছু দিনপর ! দেবব্রত এই ব্রিজ ভাঙার দিনক্ষণ জানতো না । কোন দিন ভেঙে যেতে পারে তাও মনে আসতো না; তবে মনে মনে এই ব্রিজটা যেন ভেঙে না পড়ে তা-ই চাইতো । কিন্ত একদিন দেবব্রত প্রখর রোদের শহরে দাঁড়িয়ে দেখল ব্রিজটা শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গেই গেলো। বুকের মধ্যে এমন এক কষ্ট চেপে ধরল তাঁকে যে, মনে হচ্ছিলো এখনি বুঝি ভেতরটা বিষের বালিতে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে ! ব্রিজটি তাঁর চোখের সামনে ভাঙছে অথচ তাঁর কিছুই করার নেই এটাই ওকে মারাত্মক আঘাত করে বসে ।

কি করবে এখন, কেমন করে এই ব্রিজ ভাঙার বেদনা বুকে লালন করবে ?  ভাবে সে । রাত নেই, দিন নেই এমন কি মাঝে মধ্যে খেতেও ভুলে যেতো এই ব্রিজ নির্মাণের সময় । তেত্রিশ বছরের জীবনে দেবব্রতের কাছে ঐ ব্রিজ নির্মাণের সময়টা সবচায়তে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ।

দেবব্রতের জীবনে অনেক ঘটনা, দুর্ঘটনা ঘটেছে কিন্তু ওসব সময়ের সাথে সাথে ভুলে গেছে সে । ভুলে যেতে হয় বলেই ভুলে যাওয়া ।

একটি মৃত্যুর ঘটনা দেবব্রতের জীবনে বেশ প্রভাব ফেলে । যেদিন ওর ছোট ভাইটি একুশেই ছেড়ে গিয়েছিল পৃথিবী সেদিন শোকে বিহ্বল হয়ে পরেছিল দেবব্রত । এই মৃত্যু দিনের ঘটনাটি এখনো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় । অবস্থা আরও খারাপ ছিল কিন্তু যেদিন ওর জীবনে শান্তা’র আগমন,ঠিক সেদিন থেকেই দুঃখ, কষ্টের জমিনে প্রলেপ পড়তে শুরু করে । শান্তার অশেষ পরশে ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠে সেই শোক । স্পর্শে, মায়ায়, মমতায় দেবব্রতকে ভরিয়ে দিয়েছিল শান্তা দিনের পর দিন ।

জীবন চলার পথে তিনশো সত্তর দিনের এই ব্রিজ নির্মাণের কাল তাঁর কাছে মহাকালের চায়তে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল । দেবব্রত কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা এটা ।

একটা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে হাটতে থাকে দেবব্রত, উদ্দেশ্যহীন । মোবাইলে রিং বেজে উঠে । একটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল । দেবব্রতের ধরতে ইচ্ছে করেনা ।

ঘটনাটি ঘটে যাবার পর কিছুই ভালো লাগেনা । দেবব্রত দ্রুত অন্ধকারের আশা করে । কিন্তু সন্ধ্যা হতে এখনো কিছু দেরি । কেবল আকাশ থেকে সূর্যের তাপ সরে গেছে । পরন্ত বিকেল  সোজা বাসায় চলে আসে দেব । পড়ার  টেবিলে বসে এটা ওটা হাতে নেয় কিছুই ভালো লাগছে না । একবার বিছানায় হেলান দিয়ে সিগারেটে আগুন ধরায় । দেবব্রতের চোখের সামনে ভেসে ওঠে শান্তার মুখ-কি মায়াবী, তীক্ষ্ণ ! এক কবিতা উৎসবে পরিচয় । বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, কবিতা অন্তঃপ্রাণ । দেবব্রত সেদিন মঞ্চে আবৃত্তি করছিল শেষের কবিতার ‘হে বন্ধু বিদায়’। ভরাট কণ্ঠের সেই সুর সেদিনই শান্তার এতদিনের শান্ত, স্থির হৃদয়ে রীতিমতো ঝড় তুলে দেয় !

দেবব্রত কবিতা লেখে । কবিতার জন্য ছেড়ে আসে বাবার সংসার । দেবব্রতের মা-ই এতদিন তাঁর কবিতার পাঠক ছিলেন; কিছুই বুঝতেন না তবুও দেবব্রতের কাছে মনে হতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাঠক তাঁর মা । মা বলতো, দেব- ‘তুই বিয়ে করবি এমন কাউকে যে তোর কবিতা বোঝে’ । মায়ের কথাটি বেশ ভালো লাগে দেবের । সংসার ছেঁড়ে আসবার সময় মায়ের জন্য কেঁদে ওঠে মন । হাহাকার করে হৃদয় তবুও দুর্নীতিবাজ পুলিশ বাবার সংসারে আর নয় ।

মায়ের পর শান্তা কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক । আজ অনেক ঘটনাই মনে প’ড়ে যায় দেবব্রতের । পরিচয়ের দিনক্ষণটি থেকে শুরু করে গত তিন বছরের যাবতীয় ঘটনা গুলো । ভেবে দেবব্রত অবাক হয় এই তিনটি বছরে একটিবারের জন্যেও কোন অসুখী মুহূর্ত ছিল না সম্পর্কের ! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখ গুলোই ওরা ভোগ, উপভোগ করেছে এই ক’টি বছর । ভাবে- ‘’তবে কি এই একটি দিনের জন্য সকল দুঃখ কষ্ট তুলে রেখেছিল ভাগ্য, নিয়তি ?’’ সমাধানে আসতে পারেনা দেবব্রত ।

একটি বিশেষ দিনের কথা মনে প’ড়ে যায় দেবের- শান্তার এক জন্মদিনে সে উপহার পেয়েছিলো শান্তার আকস্মিক একটি প্রস্তাব । খুব বায়না ধরেছিল দেবের চিলেকোঠায় যাবার । এমন ভাবে বলেছিল যে না করতে পারেনি দেব । এসে বলেছিল- ‘দেব চল আজ আমরা আদিম হই । ভেসে যাই নোনা জলে । তুমি আবিস্কার করবে আমাকে, আমি তোমাকে’ কি রাজি ? না করোনা কিন্তু, প্লিজ, প্লিজ । আমি সিরিয়াস ।‘’ 

সেদিনের  শ্রাবণ সন্ধ্যার মুহূর্ত গুলো দেবব্রতের জীবনের সেরা মুহূর্ত । বৃষ্টির সাথে মিষ্টি বাতাসে সেদিনের সন্ধ্যায় ঝরে পড়েছিলো শান্তার দেহের সমস্ত মুক্তো দানা । চার দেয়াল, বৃষ্টি আর মাথার উপরে ঘন কালো মেঘকে সাক্ষী রেখে দু’জন হয়েছিলো আদিম এবং আধুনিক দেব দেবী । নিষিদ্ধ ছুঁয়া, স্পর্শের আকর্ষণ ওদেরকে পাগল করে তুলেছিল । ভিজেছিল শ্রাবণধারায় । বৃষ্টি শেষে উষ্ণ তাপে শান্তা দেবকে বলেছিল-‘আজ যে আগুনে পুড়লাম; পুড়ে গিয়ে যে জলের স্রোতে ভাসলাম ,পুনর্বার এমন আগুনে পুড়তে চাই, ভেসে যেতে চাই দেব’।

দেবব্রত প্রশ্ন রাখে- ‘’আচ্ছা শান্তা, তুমি কি আমাকে ছেড়ে যাবে কোনোদিন ?’’ শান্তা চুপ থাকে । দেবের আবারো একই প্রশ্ন । শান্তা এবার বলে- ‘দেব আমাদের সম্পর্কটি কি পরিবার মেনে নেবে ? যদি নেয়ও তাহলে কি সমাজ মেনে নেবে ? মেনে নেবে রাষ্ট্র ? কতটা বেদনার কথা দেখো, সম্পর্কের পরিণতিতে মানুষকে আজো এই আধুনিক সময়টিতে এসেও ভাবতে হয় সমাজের কথা রাষ্ট্রের কথা ! আমাদের সম্পর্কের সাথে যে পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রের বিরোধ রয়েছে ঐতিহাসিক, মর্মান্তিকও’ । কথাটি বলার সাথে সাথে চোখ ভিজে যায় শান্তার । খুব অসহায় বোধ করে নিজের ভেতর সম্পর্কটির শেষ নিয়ে । দেব বলে ওঠে- ‘’আমাদের রক্ততো লাল । কেউ কি দেখাতে পারবে তোমার রক্ত মুসলমানের আর আমার হিন্দুর ? মানুষ সৃষ্ট ওসব তথাকথিত সমাজের অসুস্থ প্রথা, অমানবিক রীতিনীতি পালন ওদের কাজ; আমাদের নয় ।

তাছাড়া ধর্মের জায়গায় ধর্ম আমাদের জায়গায় আমরা । আমরাতো ওদেরকে টানছি না তাহলে ওরা কেন আমাদেরকে টানবে ?’’ দেবব্রতের ভেতর চাপা ক্ষোভ দেখতে পায় শান্তা । বলে- ‘ওসব থাক এখন সময়তো চলে যায়নি । দেখা যাক না শেষ পর্যন্ত কি হয়’। বলেই আদর করতে থাকে দেবকে-সোহাগে মেতে ওঠে পরস্পর । আনন্দে ভরে ওঠে মন প্রাণ, পুনরায় আগুন তাপে পুড়া, পুনরায় স্রোতে ভাসা ।   

মোবাইলে আবারো রিং বেজে উঠে । দেবব্রত চোখের জলে ঝাপসা দেখে সবকিছু, ফোন ধরেনা । আবার সিগারেটে আগুন ধরায়, রিং বেজে উঠে এবার একনাগাড়ে । দেবব্রত যেই বিরক্তিতে মোবাইল বন্ধ করতে যাবে- চেয়ে দেখে শান্তার নম্বর থেকে বারবার ফোন আসছে । দেবব্রতের মনে আনন্দ জাগে আবার নিজের উপর রাগও হয়- কারণ, এতক্ষণ কেন ফোনটি ধরেনি এই জন্য ।

‘‘হ্যালো শান্তা কেমন আছো ? তুমি কি ঠিক মতো বাসায় পৌছুতে পেরেছিলে ?’ ওপ্রান্ত থেকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অনবরত বলে যায় দেবব্রত। কিন্তু কোন উত্তর নেই । কান্নার শব্দ শুনতে পায়, আবারো বলে ওঠে- হ্যালো 'শান্তা, শান্তা' । অপরপ্রান্ত থেকে কান্নাকে সংযত করে একটি মেয়ে বলে ওঠে- ‘দেব‘দা আমি রাঙা’ । ‘হ্যাঁ রাঙা, তুমি কাঁদছ কেন । কি হয়েছে, শান্তা কোথায়’ ? অস্থির হয়ে ওঠে দেব । অন্য সময় হলে রাঙার ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে তারপর শান্তার খোঁজ নিতো দেব । কিন্তু আজ এই মুহূর্তে দেবের মাথায় শান্তা ছাড়া আর কেউ নেই । আবারো বলে- ‘কি হলো রাঙা, কিছু বলছ না যে’ ? দেব’দা আপা নেই......’।

দেবব্রতের হাত থেকে মোবাইলটি পড়ে গিয়ে ভেঙ্গে যায় । মন ভেঙ্গে গিয়েছিল আগেই এবার মাথার উপর পুরো পৃথিবী ভেঙ্গে পড়ে । পরদিন খবরের কাগজে সংবাদ- ‘নিজ ঘরে যুবতীর আত্মহত্যা, কারণ অজ্ঞাত’ । কারণটি সম্ভবত জানত দেবব্রত ।

শান্তা ছিল অনেকটা দেবব্রতের জীবন দর্শনের প্রতিচ্ছবি । আধুনিক। অনেক প্রথাই মানতে চায়তো না । বিভিন্ন নারী সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিল, নারী ও শিশু অধিকারে সোচ্চার ছিল । মৃত্যু’র কাছে আত্মসমর্পণ করে যেন বুঝিয়ে দিলো প্রথাকে অমান্য করেছে সে । সম্পর্কের সাথে সমাজের, রাষ্ট্রের যে বিরোধ তাঁর মৃত্যু যেন এ এক নীরব প্রতিবাদ ! 

ঘটনার তিন বছর পর : প্রায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা দেবব্রত সেদিনের স্মৃতি মনে আলিঙ্গন করে, কবিতাকে হৃদয়ে ধারণ করে হাঁটতে থাকে রেললাইন ধরে। আকাশে তাকায় । এক মধ্য দুপুরে আকাশের ফাঁকে যেন দেখতে পায় শান্তার উজ্জ্বল, মায়াবী মুখ । ঠোঁটের কোণে হাসি ধরা দেয় । বহুদিন পর হেসে ওঠে দেবব্রত কিন্তু পরক্ষণেই হাসি মিলিয়ে যায় । দেবব্রত হাঁটে । ট্রেনের শব্দ, হুইসেলের শব্দ কানে পৌঁছেনা ।

দেবব্রত মহাকালের চিরন্তন সত্য হয়ে হারিয়ে যায় আকাশে, যেখানে অপেক্ষায় আছে তাঁর প্রিয়তম প্রাণ । পরদিন খবরের কাগজে সংবাদ- “জয়শ্রী জীবনের সন্ত কবি দেবব্রত রায়ের অকাল মৃত্যু” ।

পরিচিতি  
ইফতেখারুল হক ইফতেখারুল হক Reviewed by Pd on নভেম্বর ২১, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.