মধুছন্দা পাল



 বড়দির  মেয়ে  টুবুদি। যতদুর  মনে হয় আমার দিদি / রাঙ্গাদিদের বয়সি কারণ সঙ্গে  খুব ভাব ছিল মনে আছে । তো সেই টুবুদির বিয়ে । আমাদের বাড়ী থেকেই হবে । দিদিদের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল । বিহারের যৌথ পরিবারে জন্মেছিলাম ,  বড় হয়েছিলাম। বাড়ীতে অনেক  ঘর , বারান্দা , উঠোনছাদ , আর অনেক লোকজন । তাদের কেউ  স্থায়ী  বাসিন্দা  কেউবা   অস্থায়ী । কখনও  আসে কখনও  যায় !

এই রকমই  ছিল আমাদের  বড়দি  জ্যাঠামণির  বড় মেয়ে। মাঝে মাঝে  আসতো। অনেক'কটি  ছেলে মেয়ে  ছিল বড়দির  তাদের  কেউওদের  কেউ  আমাদের  বাড়ীতে থাকতো ,পড়াশোনা  করতো ।  পশ্চিম বাংলায়  এক আধা শহরে বাড়ী  ছিল । জামাইবাবু  ছিলেন না । পাত্র বিহারের গ্রামের ডাক্তার ,নাম   রাখাল । এখন লিখতে গিয়ে মনে হচ্ছে  বোধহয় আত্মীয় স্বজন তেমন কেউ ছিলনা  কারণ বিয়ে করতে একলা এসেছিল যতদুর মনে পড়ছে । আর আমাদের বাড়ীতেই  বউভাত  ফুলশয্যা ইত্যাদি  হয়েছিল সেটা  মনে আছে ।

তো রাখাল যে  গোপালের  মতই  অতি সুবোধ বালক  একেবারে অক্ষরে অক্ষরে প্রমান  করে দিল বর।  মুখে কোন কথা নেই । সেটা অবশ্য বহুদিন বিহারের দেহাতে থেকে   বাংলা ভাষা বলার অভ্যেস চলে যাওয়ার কারনেও হতে পারে । 

বিয়ের  নিয়ম কানুন  করাতে গিয়ে  নানারকম  হাস্যকর   পরিস্থিতি তৈরি করছিল ,  ,আর  জোরে জোরে হাসির হররা উঠছিল ।  একটা ব্যাপার মনে আছে । বিয়ের সময় কয়েকবার শিলের ওপর দাঁড়ানোর  নিয়ম আছে  বর শিলের ওপর উঠেই ধপ করে বসে পড়ছিল । একবার নয় বারবার ,পিঁড়িতে উঠেও    একই ঘটনা । সেই সব  নিয়ে খুব হাসল মেয়েমহল। আমরাই বা  পিছিয়ে থাকি কেন ? বরের কাছাকাছি  গিয়ে “ রাখালগোরুর পাল নিয়ে যায় মাঠে ......” বলে তার যাকে বলে ঠ্যাং টানা  তার  চেষ্টা করা । তবে বর কিছু  বুঝছিল বলে মনে হয়না । আমরা বললাম বটে আমি সঙ্গে থাকা ছাড়া আর কিছু করিনি , মায়ের কানে গেলে  যে কপালে দুঃখ আছে তা জানতাম ।

টুবুদির ভাই বোনেরাই  অনেক ভাবে হয়রান করার চেষ্টা  করছিল । ওদের অধিকারও ছিল অবশ্য । বয়স যাই হোক সম্পর্কে আমি শ্বাশুড়ী ।

যাই  হোক  ,বিয়ে  মিটে  গেলো ভালোয় ভালোয় ।  আগেই বলেছি   টুবুদির ফুলশয্যা আমাদের বাড়ীতেই  হয়েছিল । সেদিন গভীর  রাতে চোর এলো বাড়ীতে। গরমকাল যে যেখানে পেরেছে  শুয়ে পড়েছে। টুবুদিরা তিনতলায় জ্যাঠাইমার ঘরে । বাকি দুটো ঘর  খালি, বাইরে থেকে বন্ধ । ওরাও  দরজা খোলা রেখেছিল মনে হয় । তো চোর  ঢুকলো  গিয়ে  টুবুদিরা যে ঘরে  শুয়েছে সেই ঘরে ।  ঘরে ঢুকে খাটের নীচ থেকে টেনে বার করেছে স্যুটকেশ সেই আওয়াজে  ঘুম ভেঙে  উঠে টুবুদি দেখে   মেঝেতে  চোর  বসে । চোর  নাকি টুবুদিকে  দেখেই  এক বিরাট দাঁত খিঁচুনি  দিয়েছিল ভয়  দেখানোর  জন্যে ।  টুবুদির    তারস্বরে  চোর চোর  চিৎকার শুনে বাড়ীর  লোকজন উঠে  চোর ধরার জন্যে   ছোটা ছুটি শুরু করলেও  ধরা তত সহজ ছিলনা , সব জায়গার আলো  তেমন জোরাল  নয় । ছোটকাকার একটা  পাঁচ ব্যাটারির  টর্চ ছিল  সেটা দিয়ে  চোর  খোঁজাখুঁজি চলল  মাঝে মাঝে দেখা যায় আবার কোথাও লুকিয়ে পড়ে । আমাদের মেজজ্যাঠা বাবুর  সারারাত জেগে বই পড়ার   অভ্যাস ছিল  । একটু অদ্ভুত  মানুষ ছিল ।  ভালো ডাক্তার হওয়া সত্তেও কোনদিন  প্র্যাকটিস  করেনি । এক পিসিমা ছাড়া  কারো সঙ্গে কথা বলতনা  বড় একটা ।  তো বারান্দায়   আড় হয়ে  শুয়ে  একগাদা  মেডিক্যাল জার্নাল  পড়েছে , তখনও  পড়ছে  মাথার কাছে একটা লন্ঠন  জ্বলছে । বারান্দার আলো যথেষ্ট  জোরাল  নয় বই পড়ার পক্ষে তাই একটা লন্ঠন নিয়ে আসতো ।  শেষ পর্যন্ত চোরকে দেখা গেলো হাতে একটা ছোট ছুরি সেটা   ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেজজ্যাঠাবাবুকে  ডিঙিয়ে  যে পথে এসেছিলো সেই দিকে দৌড়ল  বাধ্য হয়ে আর সবাইও অগত্যা  মেজজ্যাঠা বাবুকে ডিঙিয়েই।  ছোটোকাকা  লন্ঠনটা তুলে নিল ছুটল  চোরের পেছনে ।  মেজজ্যাঠাবাবু নির্বিকার । চোর  দোতলার  ছাদের পাঁচিল  ডিঙিয়ে  পাশের বাড়ীর  পোড় জমিতে লাফিয়ে পড়ে পালাল । 

চোর পর্ব মিটতে মিটতে প্রায় ভোর  । আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখিকা  লীলা মজুমদার  বলেগেছেন  ছোটদের নাকি বিশেষ  রকম  বড় বড় কান থাকে  তাই দিয়ে তারা অনেককিছু শুনতে পায় । সেই কান দিয়ে আমি শুনলাম  এবং দেখলামও টুবুদির হাতে একটা নতুন আংটি । ওটা নাকি বরের   দেওয়া । আংটি  পরানোর কাহিনীও  আমার  বিশেষ কান দিয়ে শুনেছিলাম  যখন দিদি / রাঙাদিদের চাপাচাপিতে ওদের  কাছে গল্প করছিল ।  টুবুদির সঙ্গে বরের আলাপ হয়নি । রাতে মটকা মেরে পড়ে থাকা টুবুদি হঠাৎ  টের পেল  বর হাত ধরে টানছে  তাকিয়ে দেখে  বর উঠে বসে   আংটি পরানোর চেষ্টা করছে  । টুবুদিকে  ধড়মড় করে উঠে বসতে দেখে  বর নাকি কাজ অসমাপ্ত রেখেই ধুপ করে শুয়ে পড়েছিল । আর  টুবুদি নিজে নিজেই  আংটিটা  পরে  নিয়েছিল ।

টুবুদি খুব সুখী হয়েছিলো ।  দুটো ছেলে হয়েছিল একদম বিহারের মানুষ । বড়টার নাম ছিল কুমার । লালচে চুল , ফুটফুটে  দেখতে । নাম জিজ্ঞেস করলে বলত  “কুমার বা” ওখানে  গ্রাম্য লোকেরা  ঐ ভাবেই নাম বলতো । 

~ লেখিকা পরিচিতি ~ 

মধুছন্দা পাল মধুছন্দা পাল Reviewed by Pd on সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.