মৌ দাশগুপ্তা





ভাঙাচোরা ইঁটের খাঁচা, জংধরা সিং দরজা,পূর্বপুরুষদের বিলাস ব্যাসনের স্মৃতি আর হারানো মেজাজেই যা জমিদারির শেষচিহ্নটুকু টিঁকেছিল, জমিজিরাত সবটাই বাঁধা পড়ে আছে মহাজনের খাতায়, শেষসম্বল পিতৃপুরুষের  আমলের পুরানো মেহগনী কাঠের ভারী কিছু আসবাব। সেও আজ বৃদ্ধ শশাঙ্কশেখর জলের দরে বেচে দিলেন, টাকার খুব প্রয়োজন। একমাত্র নাতি দিব্যশেখর অফিসের তহবিল তছরূপের দায়ে জেলে, যদিও শশাঙ্কশেখর জানেন দিব্য দোষী নয় কিন্তু আইনি ঘোরপ্যাঁচে ছেলেটা ফেঁসে গেছে। গরমিলের টাকাটা ফেরত দিলে চাকরীটা গেলেও ছেলেটা ছাড়া পাবে এমন আশাতেই ঘরখালি করে টাকার যোগাড়ে নেমেছেন অসহায় বৃদ্ধ।

আসবাবর সাথে জোড়া ছোটবেলার কত মধুর স্মৃতি, ঠাকুরদার আমলের ড্রয়ার টানা দেরাজ, ঠাকুমার বিয়ের খাট, ছোট খুড়োর স্মৃতি আটপায়ার কালো মেহগনীর ভারী পড়ার টেবিল, ওনার নিজের ছোটবেলার বইয়ের ভারী আলমারী। ভাড়াকরা মালবাহকরা মালপত্র ঘরের বাইরে বয়ে এনে লরীতে তুলছে, চোখের জল এড়াতে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন শশাঙ্কশেখর।খটখট ঠকঠক আওয়াজটা কানে লাগতে দেখলেন, ওনার ছোটবেলার পড়ার বই রাখার আলমারিটা থেকেই আওয়াজটা আসছে। যদিও সকালে ওটাকে নিজের হাতেই খালি করেছিলেন বলেই জানেন কাগজের কুচিটুকু নেই ওতে।

খালি আলমারিটাই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে চারজন । মালবাহকদের দাঁড় করিয়ে ভাল করে খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে দেখা গেল আলমারির মাথায় কাঠের পাটাতনে একটু ফাঁক আছে,তার নীচে একটা লুকানো তাক, হাতের পিতল বাঁধানো লাঠিটা দিয়ে গায়ের জোরে ঠেলাঠেলি করতে গিয়েই ফট করে খুলে গেল। এটার কথা তো উনি জানতেননা। কিন্তু ভেতরে এটা কি? চকচক করছে। হাত গলিয়ে তুলে নিলেন, ছোটখুড়োর সেই হারিয়ে যাওয়া শখের সোনার ঘড়িটা না? ডায়ালে হীরে বসানো? বালক শশাঙ্কশেখররও খুব নেকনজর ছিল ঘড়িটার ওপর, কিন্তু বদরাগী ছোটখুড়োর জন্য ছুঁতেও ভয় পেতেন, তারপর মেজদির বিয়ের দিন ছোটখুড়ো যখন সম্প্রদানে বসেছেন তখন ফাঁকতালে ঘড়িটা নিয়ে এসে হাতে পড়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলেন, হঠাৎ কেউ ঘরে চলে আসায় তড়িঘড়ি আলমারির মাথায় রেখে নীচে চলে গেছিলেন। তারপর ঘড়ির খোঁজ পড়ল,চোরের মার খেল ছোটখুড়োর চাকর নন্দী,ছোটখুড়োর খড়মের মারে নাকমুখ দিয়েরক্ত পড়ছিল, বারবার হাতজোড় করে বলছিল নন্দী,

-  ‘আমি চুরি করিনি বাবুমশাই,আার মরা মায়ের দিব্বি,এই খোকাবাবুতো সকালে এসেছিলেন ঘরে,তখনও ঘড়িটা ছিল।“

- হারামজাদা,নিজে চুরি করে খোকাবাবুর নাম?
দশাশই দামু পালোয়ানের বিশাল রদ্দা খেয়ে উঠানের কোনে ছিটকে পড়েছিল নন্দী।মুখ দিয়ে রক্ত উঠে এসেছিল।দোতলায় দাঁড়িয়ে মায়ের শাড়ীর আঁচলে মুখ ঢেকে থরথর করে কাঁপছিলেন বছর দশেকের শশাঙ্কশেখর, তার আগে অনেকবার পাগলের মত খুঁজে এসেছেন আলমারীর ওপরটা, ঘড়িটা নেই। নন্দীকে ভাবে মার খেতে দেখে সত্যিটাও বলতে পারেননি। আধমরা নন্দীকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেছিল পুলিশ কিন্তু ঘড়িটার কোন খোঁজ কেউ পায়নি। জেল হয়ে গেছিল নন্দীর।

শশাঙ্কশেখরের অনেকদিনের জমিয়ে রাখা অপরাধ বোধটা আর্তনাদ হয়ে গলা চিরে বেরিয়ে এলো,
- রাধামাধব!ক্ষমা করো!


~ কবি পরিচিতি ~ 

মৌ দাশগুপ্তা মৌ দাশগুপ্তা Reviewed by Pd on সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪ Rating: 5

কোন মন্তব্য নেই:

সুচিন্তিত মতামত দিন

banner image
Blogger দ্বারা পরিচালিত.