রোজ অফিস থেকে বের হয়ে আমি হাঁটি কিছু পথ । হাঁটা শরীরের জন্য ভালো এমনটি মনে করে নয় আবার হাঁটতে যে খুব ভালো লাগে তা-ও নয় । তবুও পঁচিশ মিনিটের পথটুকু হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে রোজরোজ । শহরের ব্যস্ত পথ ধরে হেঁটে যাই আর দেখি মানুষের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মুখ গুলো। হাসি নেই কারো মুখে, দেখে মনে হয় বহু দিন মানুষ গুলো হাসেনা ! শুধু হাসতে দেখা যায় পথের ধারে খেলায় ব্যস্ত শিশুদের আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে বের হওয়া কিছু তরুণ তরুণীদের ।
এই বয়সে এই পথের মানুষরাও হাসত, কিন্তু যখন সময় বাড়তে থাকল, জীবন বড় হতে থাকল, কঠিন আর নির্মম বাস্তবতার ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে গেল এইসব মানুষের জীবন; তখন থেকে তাঁদের হাসিটাও ছোট হতে হতে একসময় উধাও ! জীবন কত সংক্ষিপ্ত অথচ কি সাঙ্ঘাতিক জটিলতার ভেতর দিয়ে যেতে হয় মানুষকে ! পৃথিবীর অনেক মানুষই জীবন নিয়ে ভাবে না । এলাম, দেখলাম, একদিন চলে যাব ব্যস- এমনটিই ভাবে । আবার অনেকের ভাবনায় জীবন আর কিছুই নয়- একটা খেলা মাত্র । অনেকেই জীবনের হিসেব মিলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে অতঃপর জীবনের কাছে হেরে যায় । এই পথের মানুষদের জীবনটাও মনে হয় এমন । অন্য পথেও বিপরীত কিছু আছে বলে মনে হয় না ।
হেঁটে যাবার সময় দেখি পথশিশুরা কেমন করে রোদের তাপে পুড়ে, কখনোবা বৃষ্টিতে ভিজে ভিক্ষা মাগে । কোন কোন শিশু রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামে ফুল বিক্রি করে আবার কেউ খবরের কাগজ । গরীব বুড়িটা কেমন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রাস্তা পার হয় সরকারী হাসপাতালে মৃত্যু পথ যাত্রী মেয়েটিকে দেখার জন্য । একটা পকেটমার কারোর সারা মাসের বেতনটা মেরে দিয়ে ভোঁ দৌড় দেয়। তাকিয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই । সরু গলিতে ঘাপটি মেরে বসে থাকা দুই তিনজনের একটি ছোট ছিনতাইকারীর দল সুযোগ বুঝে কোন কোন নারীর গলায় পড়ে থাকা সোনার চেইনটা টেনে নেয় কিংবা পার্সটা ।
মানুষের পথ চলায় বিঘ্ন ঘটিয়ে রাস্তার উপর কেউ কেউ বসে যায় তাবিজ কবজ নিয়ে কিংবা গাছগাছালির ছাল, শেকড় নিয়ে; পাশে বিরামহীন বেজে চলে রেকর্ডার । এমন কাউকেও চোখে পড়ে যে কিনা পথচারীর অসুবিধায় নিজে থেকেই এগিয়ে আসেন । জ্যামে পড়ে বাসে বসে থাকা লোকটি পানের পিক ফেললে হেঁটে যাওয়া মানুষটির গায়ে গিয়ে পড়ে আর তখনই বাকযুদ্ধ শুরু !
এয়ার কন্ডিশন যুক্ত কালো গ্লাসের গাড়িতে বসে দৃশ্যের নীরব দর্শক স্যুটেট বুটেট লোকটি, সঙ্গে কড়া লাল রঙ ঠোঁটে মেখে অর্ধ খোলা বুকে বসে থাকা শয্যাসঙ্গিনীটি ।
উলঙ্গ শিশুটি কি সাহসিকতার সাথেই না রাস্তার মাঝ খানে চলে যায় না বুঝে ! রাস্তার পাশেই জ্বলা উনুনের পাশে বসে থাকা মা’টি যার অর্ধনগ্ন স্তনে মুখ রেখে অন্য শিশুটি ঘুমিয়ে গেছে- তাঁকে এক ঝাটকায় পাশে ফেলে দিয়ে অন্যটিকে তুলে আনে ।
আমার চলার পথটিতে এমন দৃশ্য গুলো প্রতিদিনকার । দৃশ্যে কোন বিরতি নেই । দৃশ্যের আড়াল নেই। খোলা জীবনের খোলামেলা আসল ও সত্য অভিনয় গুলো মঞ্চস্থ হয়, হচ্ছে চোখের সামনে ! জীবনে এর থেকে সত্য অভিনয় আর কি কিছু হতে পারে ?
দেখতে দেখতে আর ভাবতে ভাবতে যখন পৌঁছে যাই নিজ ঘরে, মাঝে মাঝে দেখি মায়ের অসুস্থ চেহারা । ভাইটি ঝগড়া করছে বউটির সাথে । বোনটি স্বামীর সাথে রাগ করে মায়ের কাছে । খুব অভিমান করে পাশের বাড়ির সুমিত্রা বিষ মুখে পুরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেও বেঁচে যায় ! সেই দৃশ্যও আড়াল থাকেনা । বিচিত্র জীবনের যে খেলা আমার পঁচিশ মিনিটের পথ চলায় দেখে আসি রোজ রোজ; তার ভেতরের সূক্ষ্ম সূত্রটি ঠিক কোথায় এসে যেন আমার, আমাদের জীবনের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায় !
ইফতেখারুল হক
Reviewed by Pd
on
সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪
Rating:
Reviewed by Pd
on
সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৪
Rating:


কোন মন্তব্য নেই:
সুচিন্তিত মতামত দিন