ঠিক এক বছর আগে এইরকম সময়েই যাদবপুরের স্বপ্নদীপের স্বপ্নের দীপ নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল সংগঠিত অপরাধীদের ধর্ষকাম প্রবৃত্তির তারণায়। সে’তো গেল প্রথমবর্ষের ছাত্রনিগ্রহের সংস্কৃতি। আমাদের দেশে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির শিক্ষা এবং দীক্ষার পরিকাঠামোতে ছাত্রনিগ্রহ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। অস্বাভাবিক হলো, তাতে ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা। আমরা কলেজে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাবর্ষের শুরুতে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের উপরে সংঘটিত ছাত্রনিগ্রহের ঘটনায় বিচলিত নই। অনেকেই মনে করি এই পদ্ধতির ভিতর দিয়েই ছাত্রছাত্রীদের মানসিক গঠন এবং ব্যক্তিত্ব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যেটি শিক্ষার ভিতর দিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সেটি নিগ্রহের ভিতর দিয়ে হওয়ার রীতি এবং পদ্ধতিগুলি আমাদের কাছে অস্বাভাবিক এবং অনুচিত ঠেকে না। তবু আমরা নড়েচড়ে বসি। যখন কোন মৃত্যুর ঘটনা ঘটে যায়। আমাদের তাৎক্ষণিক মনুষ্যত্ববোধ মানবিকতার ধ্বজাগুলি তখন খাড়া হয়ে ওঠে। তখন আর আমরা চুপ করে থাকতে পারি না। বিশেষ করে এই ইনটারনেট যুগে। আমাদের মনুষ্যত্বের সেল্ফি পোস্ট না করা পর্য্যন্ত আমদের অস্থিরতা শান্ত হয় না। সময় এবং সুযোগ বুঝে পথে নামতেও পা নেচে উঠতে পারে তখন। স্বপ্নদীপের মৃত্যু তেমনই একটি ঘটনা। আমাদের মানবিক নৃত্যে প্রায় সারা মাস রাজ্যজুড়ে স্বপ্নদীপের আত্মা হয়তো সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিল কোনভাবে। তারপর গঙ্গা দিয়ে যত জলই ঘোলা হোক না কেন। কেন স্বপ্নদীপের হত্যাকারীরা আজও তাদের অপরাধের উপযুক্ত এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি। সেই প্রশ্ন নিয়ে আমরা অন্তত আর জলঘোলা করিনি। আমরা যে যার মতো নিজেদের চরকায় তেল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। স্বপ্নের ভাঙা স্বপ্নও আমাদের নিশ্চিত নিদ্রায় প্রেতনৃত্য করে কোনরকম ব্যঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি।
বছর ঘুরে গিয়েছে। স্বপ্নদীপকাণ্ডও আমদের চিন্তার পরিসর থেকে অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে। আমরা আর অপরাধীদের বিচার হয়নি কেন। কেন সেই বিচার থমকে আছে। আদৌ কি কোনদিন সেই বিচার শেষ হবে। কিংবা স্বপ্নের হত্যাকারীরা আদৌ কি তাদের জঘন্যতম অপরাধের উপযুক্ত শাস্তি পাবে। আমরা আর এইসব ভাবনা নিয়ে বসে নেই। এইসব ভেবে সময় নষ্ট করার মতোন সময় আমাদের হাতে নেই। মিডিয়াও এই নিয়ে পড়ে নেই। পাস্ট ইজ পাস্ট। যা গেছে তা গেছে। কিন্তু মানুষের সমাজ। আমাদের দেশ। অপরাধ সংঘটন তো আর বন্ধ হয়ে যাবে না। ফলে মিডিয়ার হাতে আবার হাতে গরম আরও একটি মৃত্যু এসে গিয়েছে। আর জি কর হসপিটালের জুনিয়র ডাক্তারের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা। মিডিয়ার হাতেই কিন্তু সব। মিডিয়া কোন খবরকে ধামাচাপা দিয়ে রাখবে। আর কোন খবরকে হাওয়া দিয়ে বাজার গরম করবে। সেটা মিডিয়ার মালিকদের স্বার্থের সাথে জড়িত বিষয়। আর আমরা জনতাও মিডিয়ার স্কুলের বাধ্য ছাত্রছাত্রী। মিডিয়ানৃত্যের তালে আমাদেরও চিত্ত দুলতে থাকে। এক ডাক্তারের খুন হওয়া। এক ডাক্তারের ধর্ষণ হওয়া। নতুন কোন খবর নয়। ঐ একই হসপিটালে চার বছর আগে এমনই আরও এক জুনিয়র ডাক্তার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মারা গিয়েছিল। খাতায় কলমে লেখা হয়েছিল আত্মহত্যা। মিডিয়া সেবারে সেই সাজানো আত্মহত্যার পিছনে পড়ে ছিল না। আমাদের রাতের ঘুমের ব্যঘাত হয়নি কোন। কিন্তু এবারে সেই একই মিডিয়া। সেই একই প্রতিষ্ঠানের একই ধরণের খবরকে অন্যমাত্রায় তুলে দিয়েছে। মিডিয়ার পক্ষে কাজটুকু আরও সহজ করে দিয়েছে সরকারী হসপিটালের জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন। ফলে আমাদেরকেও আবার প্রায় গত বছরের মতো নড়ে এবং চড়ে বসতে হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপ্লব শানাতে হচ্ছে।
এবারে আমরা বেশ এক অভিনব বিপ্লবের নকশা তৈরী করে ফেলেছি। স্বাধীনতাদিবসের পুণ্যলগ্নে নারী স্বাধীনতা নারী সুরক্ষার দাবিতে রাত দখলের বিপ্লব। মেয়েরাই নাকি এই বিপ্লবের হোতা। তবে তাদের বিপ্লবে পুরুষেরাও স্বাগত। যদিও আর জি করের সেই নিহত জুনিয়ার ডাক্তার কিন্তু পুরুষের হাতেই জীবন দিতে বাধ্য হয়েছিল। কলকাতার বুকে জন্ম নেওয়া এই বিপ্লবের পথে একযোগে সামিল হতে চলেছেন সমগ্র রাজ্যবাসী। ভালো কথা। রাত বারোটার রাজপথ কাঁপাতে নামবেন আমাদের মেয়েরা। একটি মেয়ের অন্যায় মৃত্যুর ন্যায্য বিচারের দাবিতে। ‘রিক্লেইম দ্য নাইট’ ব্যানারে। আমাদের দেশে মেয়েরা রাত তো দূরস্ত, দিনের বেলাতেও তো নিরাপদ নন। সেই তাঁরাই এবারে ঝাঁপিয়ে পড়তে চলেছেন মধ্যরাতের রাজপথে। রাতের দখল নিতে। ভালো কথা। রাতই তো। অনন্ত রাত। সভ্যতার ভোর না হওয়ার অসভ্য রাত। অনন্ত সেই চিরন্তন রাতেই মেয়েরা এবারে বড়োসড়ো একটা চ্যালেঞ্জই যেন ছুঁড়ে দিতে চলেছেন সমগ্র পুরুষ সমাজের দিকে।
এই যে রাজ্যজুড়ে দেশজুড়ে মেয়েদের এতরকম নিরাপত্তার অভাব। তার কারণ তো একটাই। সেই পুরুষ। জগৎ পুরুষশূন্য হয়ে গেলে মেয়েরাও নিরাপদ। কিন্তু সে হবে ধুলো থেকে পা বাঁচানোর জন্য গোটা পৃথিবীটাকেই চাদরে মুড়ে ফেলার মতোন। অনেকেই কেন, সকলেই বলবেন। পুরুষ মাত্রেই ধর্ষক নয়। খুনি নয়। বদ নয়। অসৎ নয়। খারাপ নয়। আরও আছে। এই পুরুষের কাছেই আবার মেয়েদের নিরাপত্তার গ্যারাণ্টি। মধ্যরাতে পুরুষের সঙ্গ ছাড়া পথে নামার কথা প্রায় কেউই ভাবেন না। কারণটাও আবার মারাত্মাক।
বিজন পথের পুরুষ-আতঙ্ক! একদিকে পুরুষই আতঙ্কের কারণ। অন্যদিকে পুরুষই রক্ষাকর্তা। এই যে একটি চক্রব্যূহ। স্বভাবতই সেই চক্রব্যূহের ভিতরে বাস করতে করতে রণক্লান্ত মেয়েরা এবারে হয়তো ঠিক করেছেন, আর নয়। এই চক্রব্যূহকেই ভাঙতে হবে। আর মধ্যরাতের দখল নিতে রাত বারোটার রাজপথই সেই বিপ্লবের সঠিক স্থান। এই অভিনব বিপ্লবে সামিল হতে প্রায় সকলেই এক পায়ে খাড়া। দিকে দিকে সাড়া পড়ে গিয়েছে। নগর থেকে শহরে। পাড়ায় পাড়ায়। পথের মোড়ে মোড়ে। স্থান নির্দিষ্ট করা হয়ে গিয়েছে। সময় ঠিক করা হয়ে গিয়েছে। এবারে শুধু সিংহনাদের অপেক্ষা।
‘রাত দখল’-এর বিপ্লব শুরুর সময় আমরা জেনে গিয়েছি। কিন্তু সেই বিপ্লব কোন পথে সার্থক হবে। সেই বিষয়ে আমরা কিছু জানি কি? আমি অন্তত মিডিয়া কিংবা ইনটারনেট ঘুরেও তার কোন হদিশ পাইনি এখনো। সে না পাই। সেটা বড়ো কথাও নয়। মেয়েরাই ডাক দিয়েছেন বিপ্লবের। তাঁরাই ঠিক করবেন। বিপ্লব কোন পথে সার্থক হবে। কতদিনে হবে। কিন্তু আমি যে কথাটি ভাবছিলাম। প্রতিটি পুরুষ। নারীর গর্ভেই তো জন্ম নেয়। নারীর কোলেই তো প্রতিপালিত হয়ে দিনে দিনে ষণ্ডাটি হয়ে ওঠে। ষণ্ডা হয়ে ওঠার কথা হচ্ছে এই কারণেই যে, ষণ্ডা না হয়ে উঠলে নারীর বিপদের কারণই বা কিভাবে হবে? একজন পুরুষ। যে একজন নারীরই গর্ভজাত। আত্মজ।
সত্যিই আত্মজ। আমরা প্রত্যেক পুরুষই একজন নারীর আত্মজ। নারীর সঙ্গে আমাদের জন্মাবধি নাড়ীর সংযোগ। সেই সংযোগ, নাড়ী কাটলেও কেটে যাওয়ার নয়। সেই নারীরই আত্মজ কিন্তু প্রতিটি ধর্ষক। প্রতিটি নিপীড়ক। প্রতিটি খুনি। অর্থাৎ পুরুষ জন্ম নিয়ে যে মানুষটি একটি নারীর বিপদ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। তার সেই অপকর্ম সাধিত হচ্ছে কারণ। তার জন্মদাত্রী তাকে পুরুষ করেছে। মানুষ করতে পারেননি। যিনি জন্ম দিচ্ছেন। প্রতিপালন করছেন। স্নেহে মায়ায় মমতায়। তিনি মানুষ করে তুলতে পারছেন না। কিন্তু কেন? প্রতিটি ধর্ষক এবং খুনির, প্রতিটি নিপীড়কের এবং অত্যাচারীর একজন জননী রয়েছেন। যিনি স্নেহ দিয়ে মায়া দিয়ে আদর দিয়ে আপন সন্তানকে বাঁদর তৈরী করে তুলেছেন। যিনি আপন সন্তানকে নারীর মূল্য শেখাতে পারেননি। যিনি আপন সন্তানের ভিতরে সুস্থ বলিষ্ঠ মনুষ্যত্বের বীজ বপন করে দিতে পারেননি। এইখানে খুব যুক্তিসঙ্গত কারণেই অনেকেই হয়তো ভাবছেন। সন্তানকে মানুষ করে তোলায় পিতার ভুমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। অনেকেই বলবেন, পিতার ভুমিকাই সন্তানের জীবনে নির্ণায়ক। কারণ সমাজটাই তো পিতৃতান্ত্রিক। ফলে বিষবৃক্ষের গোড়ায় সেই আদি এবং অকৃত্রিম পিতৃতন্ত্র। অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ কথা। চিরকালীন সত্য কথা। অর্থাৎ শুধু জননীই নন। স্নেহ দিয়ে মায়া দিয়ে মমতা দিয়ে আদর দিয়ে ছেলেপিলেদের বাঁদর করে তোলায় পিতার ভুমিকাও কম নয়। রাতের বেলায় বাড়ি ফিরে নেশার ঝোঁকে বৌ পেটানো বাবার ছেলে নারীর সমানে সুবোধ সজ্জন সদাশয় পুরুষরূপে আবির্ভুত হবে। এমনটা কেউ আশাও করে না। অর্থাৎ বিষয়টুকু দাঁড়িয়ে রয়েছে ঠিক দুইজন মানুষের উপরে। বাবা এবং মা। জননী এবং পিতা। নিজের সংসারে। নিজের ঘরে। আঁতুরঘর থেকে শুরু করে সন্তানের প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার সময় পর্য্যন্ত। ঐ আঠারোটা বছরের দখল নিয়ে দেখুন। এই সময়টুকুর পূর্ণ দখল যদি ঘরে ঘরে মায়েদের হাতে থাকে। ঘরে ঘরে বাবাদের হাতে থাকে। ঠিক মত। তাহলেই দেখা যাবে যাদবপুরের স্বপ্নদীপের স্বপ্নের দীপ আর নিভে যাবে না অসময়ে। অমানুষদের হাতে। আর জি কর’এর মৌসুমী’র সময় ঘনিয়ে আসবে না রাতের শেষ প্রহরে অমন নৃশংস ভাবে। নিজের ঘরের দখলটুকু। নিজের মাতৃত্বের দখলটুকু। নিজের পিতৃত্বের দখলটুকু। আপন সন্তানের শৈশব কৈশোর বয়ঃসন্ধির সময়ের দখলটুকু নিজেদের হাতে নিয়ে দেখুন না হয়। ঠিক মতো। আদর্শ মত। মানুষের মতো। তাহলে আর মধ্যরাতের দখল নিতে এইভাবে রাজপথে নামতে নাও হতে পারে একদিন। কবি বেঁচে থাকলে হয়তো আবারো বলতেন, ‘সে অনেক শতাব্দির মনীষীর কাজ’। আমি বলি না, সে আজকের আমার আপনার প্রতিটি জনক জননীর কাজ। সেই কাজে গাফিলতি যত বাড়বে। স্বপ্নদীপদের মৌসুমীদের বেঁচে থাকাও তত অসম্ভব হবে। মধ্যরাতের দখল নিতে হাজারবার রাজপথে নামলেও একবারও কিন্তু বিপ্লব সফল হবে না।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন