ইলিয়াস খুন হয়ে গেছে!
এই মুহূর্তে থানার দিকে একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। সবার সামনে হাঁটছে ইলিয়াস!
থানার গেটে দাঁড়িয়ে মেজোবাবু, বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টি মিছিলের গায়ে। মনে প্রশ্ন, " ইলিয়াস! কি করে?"
পরশু গভীর রাতের ঘটনা।
পথচারীকে পিষে দিয়েছে গাড়ি। ব্যাপারটা সবার অলক্ষ্যেই ঘটেছে। কীর্তিমান সিংয়ের গাড়ি নজরে আসেনি কারো।
সমস্যা হলো লাশটা!
লাশটা যেভাবেই লাশ হোক না কেনো, লাশের সুযোগ নিতে চাইবে সবাই। বিষয়টা রাতের আঁধারেই মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিল কীর্তিমান সিং। লাশটা গায়েব করবার ব্যবস্থাও হয়েছে পাক্কা। ফাঁক ফোকর নেই কোনো।
কিভাবে জানতে পেরেছিল ইলিয়াস! গতকাল সাত সকালে থানায় আসে সঙ্গে একজন মহিলা, মৃতের মা। অভিযোগ নিতে হবে কীর্তিমান সিংয়ের বিরুদ্ধে।
"মানে!"
ইলিয়াসের কথা শুনে মেজবাবু অবাক। " কোথাও এমন কিছু ঘটেনি। বললেই হলো! মামাবাড়ি নাকি? তাছাড়া কীর্তিমান সিং সমাজ সচেতন মানুষ। একজন সম্মানীয় জনপ্রতিনিধি। তেমন কিছু ঘটলে নিজে এসে থানায় জানাত।"
" কাহিনী শোনাবেন না স্যার। বিচার চাই।" বলেছিল ইলিয়াস।
কে দেবে বিচার! ছেলের হাতের মোয়া নাকি। এদিকে মিডিয়াও হয়েছে! ব্রেকিং নিউজ পেতে হাজির হয়েছে সব।
খবরটা শিমুল তুলোর মত ছড়িয়ে পড়লো এলাকায়। পাবলিকের মুখে মুখে ফিরছে কীর্তিমানের কীর্তি। তবে পাবলিকের মুখ তো, সেটাই ভরসা।
কীর্তিমান প্রভাবশালী মানুষ। সে হোক, সিং সাহেবেরও শত্রু আছে। পরিস্থতি এমন হয়ে ওঠে যে অভিযোগ নিতেই হবে।
ইলিয়াসের কথা জানে সিং সাহেব। নাছোড় ছেলে। সাহস ধরে কলজেতে। গত বছর শহরের এক নামকরা হসপিটালে ভুল চিকিৎসায় শিশু মৃত্যু ঘটে। সেই নিয়ে এলাকা তোলপাড় করেছিল ইলিয়াস। ডাক্তার পালের জেল যাত্রা প্রায় নিশ্চিত ছিলো। মিডিয়াও পিছনে পড়ে ছিল খুব। শেষমেষ কীর্তিমান সিং এর হস্তক্ষেপে ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়েছে। রেহাই মিলেছে ডাক্তার পালের। মিডিয়া মুখ ফিরিয়েছে অন্য দিকে।
" ইলিয়াস জীবনের পরোয়া করে না...।" গতকাল সিংজিকে ফোনে শুনিয়েছে মেজবাবু।
" আরে ছাড়ুন তো, উপর থেকে নিচে ফাঁক নেই কোথাও। পাশে আছে সবাই । আপনি ভয় পাবেন না।...।" গতকাল সন্ধ্যা বেলায় ফোন করেছিল সিং সাহেব। আজ সকালে থানায় খবর আসে, ইলিয়াস লাশ হয়ে গেছে!
কনস্টেবল লালন সিং মেজোবাবুকে জিজ্ঞাসা করে, " স্যার ইলিয়াসকে খুন করলো কে?"
প্রশ্ন শুনে মেজোবাবুর মেজাজ টং। " কি করে বলি লালন! ক্যালাসের মত কথা বলিস তুই। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসবে, দেখতে হবে আদৌ খুন হয়েছে কিনা। তবে আমার আইডিয়া এটা অ্যাকসিডেন্ট, হয়তো পেটে অ্যালকোহল ছিল। তুই মনে হচ্ছে খুব কষ্ট পেয়েছিস?"
মাথা নামিয়ে সরে যায় লালন। মেজোবাবু তাকিয়ে থাকে লালনের দিকে। বড্ড গোলমেলে ক্যারেকটার এই লালন সিং। হাইলি সাসপিসাস যাকে বলে। মেজোবাবুর সব কথায় কান পেতে থাকে। ভাব এমন যেনো কিচ্ছুটি বোঝে না। ব্যাটা আস্ত ঘুঘু। লালনকে আবার কিছু বলাও যায় না, কীর্তিমান সিংয়ের রিস্তেদার। আগে কলকাতা বড়োবাজারে খৈনির গুমটি চালাতো। আরো কি কি করতো ভগবান জানে। কীর্তিমানজীর চেষ্টায় কনস্টেবলের চাকরি জুটেছে মাস খানেক হলো। লালনকে এখনও সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি মেজোবাবু।
গতকাল নাইট ডিউটি ছিল মেজবাবুর।
দেউলী, বিজাপুর হয়ে শেষ রাতে দরাপপুরের বিলের ধারে গিয়েছিল। কোথাও কোনো অশান্তির খবর নেই। এক্কেবারে শান্তিপূর্ন রাত। থানায় ফিরেছে প্রায় ভোর পৌনে চারটার দিকে। লিকার চা তখনও মুখে ছোঁয়ায়নি, ফোন বেজে ওঠে, দরাপপুরের অঞ্চল প্রধান নন্দীবাবুর ফোন।
" হ্যালো, নন্দীবাবু বলছি, দরাপপুরের অঞ্চল প্রধান। ইলিয়াস খুন হয়ে গেছে।"
খবরটা শুনে আঁতকে ওঠে মেজবাবু। বলে কি! ইলিয়াস খুন! খবরটা হজম করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, " কি বলছেন কি! কে দেখেছে?"
" আমাদের গ্রামের রতন ঘোষ দেখেছে। সবজি নিয়ে হাটে যাবার পথে...।"
নন্দীর মুখের কথায় থাবা মারে মেজবাবু বলে, " খুন হতে দেখেছে ?"
" না, না, ইলিয়াসের লাশটাকে জলে ভাসতে দেখেছে।"
" ও তাই বলুন। সত্যি খবর, নাকি ইলিয়াস-জুজু দেখাচ্ছেন?"
" হ্যাঁ, টাটকা খবর। লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন করছি। ছুটে আসুন।" বলে নন্দী।
ব্যস! শুরু দৌড় ঝাঁপ। লাশ নিয়ে থানায় আসা। তাকে ময়না করতে পাঠানো। বিভিন্ন ফর্মালিটি মেনটেন। মাঝে মধ্যেই মিডিয়ার উৎপাত, এই সব করতে গিয়ে সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। বাড়িতে ফোন করবার ফুরসৎ মেলেনি। আজ আবার মেজবাবুর মেয়ের জন্মদিন। সেই আনন্দে সন্ধ্যা বেলায় ছোটখাটো পার্টির আয়োজন করেছে মেজোবাবু।
ফোনটা হাতে নিয়ে থানার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মেজবাবু। হরির দোকানে চিনি ছাড়া লাল চা অর্ডার দিয়েছে।
মিছিলটা এগিয়ে আসছে থানার দিকে। দুই চোখ কচলে দৃষ্টি ধারালো করে নিয়ে সামনে তাকায়, হ্যাঁ ওই তো খয়েরী জামা গায়ে একটি ছেলে। ইলিয়াস বলেই মনে হয়। সেই নির্ভীক পদক্ষেপ। মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে ছুঁড়ছে। যেনো প্রতিবাদের আঘাতে আকাশ ভেঙে ফেলবে।
মেজবাবু ফোন করে কার্তিককে। কার্তিক কনস্টেবল, ইলিয়াসের লাশ নিয়ে গেছে হসপিটাল। পোস্টমর্টেম হবে।
" হ্যালো, কার্তিক। শুরু হয়েছে?"
" না স্যার। লাশ আগলে বসে রয়েছি সকাল থেকে। এইবার নিয়ে যাবে...।"
" চোপ! বড্ড বেশি কথা বলিস তুই। বলছি প্লাস্টিকটা সরিয়ে লাশের মুখটা একবার দেখতো।"
"কি দেখবো স্যার?"
" দেখ, লাশটাকে ইলিয়াস বলে চেনা যাচ্ছে কি না।"
" হ্যাঁ স্যার চেনা যাচ্ছে। মুখটা ফুলে গেছে ঠিকই, তবে ইলিয়াস বলে বোঝা যাচ্ছে। মুখের সামনে মাছি ভন ভন করছে।"
লাইনটা কেটে দেয় মেজবাবু। দেখে পাশেই দাঁড়িয়ে লালন। " তুই কি শুনছিস লালন?" কিছুটা রাগত স্বরে প্রশ্ন করে মেজোবাবু।
মেজোবাবুর সামনে থেকে সরে যায় লালন সিং।
সামনে তাকায় মেজোবাবু। মিছিলটা আরো কয়েক পা এগিয়ে এসেছে থানার দিকে। চিৎকার করে স্লোগান তুলছে। কি বলছে শুনতে চেষ্টা করে । সে উপায় নেই। বেটার ছেলে হরি চায়ের দোকানে গান বাজাচ্ছে। ধমক দেয় মেজোবাবু। গান বন্ধ হয়। এইবার শোনা যাচ্ছে মিছিলের কণ্ঠ। " বাঁচাও", " বাঁচাও।"
কি বাঁচানোর আবদার কে জানে!
" হরি চা দে।" সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে মেজবাবু।
হরি উনুনে বাতাস করে। মেজাজ খরে ওঠে মেজবাবুর।বলে " হ্যাঁ তুমি সারাদিন বাতাস দাও উনুনের পিছনে।"
পাশ থেকে কে যেন হেসে ওঠে ফ্যাক করে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অঞ্চলপ্রধান নন্দী।
" নিন এইবার ঠেলা সামলান। মিছিল আসছে।"
" মিছিল কেনো আসছে বলুন তো নন্দীবাবু?"
" মিছিল তো আসবেই। আরে মশাই আমাদের দেশে যে কোনো ঘটনা ঘটার আগেও মিছিল পরেও মিছিল! মিছিলের একই অঙ্গে শত রূপ। রাস্তায় মিছিল হাঁটিয়ে কখনো পাবলিকের মনে সাহস দেওয়া হয় আবার ভীষন ভয় দেখানো যায় মিছিল হাঁটিয়েই। কেউ সত্যি কথা শোনাতে চায় আবার কেউ সত্যি কথা ভোলাতে চায় সেই মিছিলের চেহারা দেখিয়ে। এক কথায় যেকোনো ঘটনার বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরির সহজতম উপায় হলো মিছিল।"
ইতিমধ্যে আরো খানিকটা এগিয়ে এসেছে মিছিলটা। মেজবাবুর চোখে পাতা পড়ে না। মিছিলের সামনে খয়েরী জামা গায়ে হাঁটছে...।
" আরে ভয় পাবেন না, মিছিল নিয়ে আপনার চিন্তার কিছু নেই। রতন ঘোষ এসেছে, বয়ান দেবে। চলুন।" বলে নন্দীবাবু।
" নেব নেব। বয়ান তো নিতেই হবে।" গ্লাসের চা শেষ করে চেম্বারে আসে। সংক্ষিপ্ত বয়ান। ভোর বেলায় বাঁধের রাস্তা ধরে হাটে যাচ্ছিল রতন। দেখে জলে লাশ।
" তুই হঠাৎ জলের দিকে তাকালি কেন? সাইকেল তো রাস্তায় চলছিল। হঠাৎ জল দেখবার কি হলো?" মেজবাবুর কথায় বেকায়দায় পড়ে রতন। আমতা আমতা বলে " শান্তি জেলে মাছ ধরছিল। সেই দেখেছে প্রথম।"
" শান্তি জেলে কি দেখেছে?"
" খুন হয়ে...।"
" খুন হতে দেখেছে? বলিস কি রে।"
" না স্যার। খুন হওয়া লাশ দেখেছে।" বলে রতন।
" লাশটা খুন হওয়া বুঝলি কেমন করে?" একটা কাঁচা খিস্তি দিয়ে বড় বড় চোখে রতনের দিকে চেয়ে থাকে মেজবাবু। রতনের অবস্থা শোচনীয়। কাঁদো কাঁদো মুখে চেয়ে থাকে নন্দীবাবুর দিকে।
" শান্তি জেলে কে থানায় ডাকতে হবে। সবটা ওই জানে। খতরনাক লোক শান্তি জেলে!"
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মেজবাবু। গেটের দিকে হেঁটে আসে আবার। পাশে হাঁটে নন্দীবাবু। রাস্তার আই ল্যান্ডের পাস ঘুরে মিছিলটা এগিয়ে আসছে।
" মিছিলের সামনে ওই যে খয়েরী জামা গায়ে হাঁটছে, ঠিক করে দেখুন তো নন্দীবাবু চিনতে পারেন কিনা! বলে মেজবাবু।"
মিছিলটা একঝলক দেখে নেয় নন্দী। বলে," খয়েরী জামা গায়ে!" ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ওঠে নন্দী। বলে , " ইলিয়াস। ভূত হয়ে ফিরে এসেছে। ধরবে আপনাকে!"
ভিতরে ভিতরে রেগে ওঠে মেজবাবু, বলে " ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন? ওসব অনেক দেখেছি।"
একপাশে দাঁড়িয়ে লালন। মেজোবাবু দেখে লালনকে, ব্যাটা কি মতলব আঁটছে কে জানে। থানার সব খবর কীর্তিমান সিংকে রিলে করছে হয়তো। সিং সাহেবের জন্য এত করেও শেষে লালনের জন্যই না সিং সাহেবের বিরাগ ভজন হতে হয়।
" লালন সাহেব যে! একলা দাঁড়িয়ে। শরীর খারাপ নাকি?" জিজ্ঞাসা করে নন্দীবাবু।
ঘাড় নাড়ে লালন।
" পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না এলে বোঝা যাবে না ইলিয়াস খুন হয়েছে নাকি অ্যাকসিডেন্ট, বুজলেন নন্দীবাবু।" বলে মেজোবাবু।
নন্দীর মুখে একটা রহস্যময় হাসি। " অ্যাকসিডেন্ট-ই হওয়া উচিত।"
" কি করে বুঝলেন?"
" রাজনীতিতে আছি মশাই। খুন আর দুর্ঘটনা চিনব না!" হাসতে থাকে নন্দীবাবু।
একটু পাশে সরে গিয়ে কার্তিককে ফোন করে মেজোবাবু , " হ্যালো, কার্তিক। পোস্টমর্টেম শুরু হয়েছে?"
" না স্যার।"
" প্লাস্টিকটা সরিয়ে একবার লাশটার নাকের সামনে হাত নিয়ে গিয়ে দেখত।"
" কি দেখবো স্যার?"
" হারামজাদা বোঝো না, কি দেখবে? শ্বাস চলছে না তো?"
" না স্যার। এক্কেবারে বরফ ঠাণ্ডা। মাছি...।"
" আচ্ছা লাশের মুখের কাছে অ্যালকোহলের গন্ধ পাচ্ছিস?"
" না স্যার।"
"বেশ বেশ। বুঝেছি।"
একটা ইম্পর্টেন্ট কাজ। ডাক্তারের সময় হয়নি এখনো। চিন্তা একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা ভীষন জরুরি।
" স্যার আসবো?"
"কাকে চাই?"
" আমি শান্তি কৈবর্ত।"
বয়ান দিতে এসেছে শান্তি জেলে। ভোরবেলায় তার জালেই ইলিয়াস লাশ হয়ে ধরা দেয়। বয়ান দিতে গিয়ে রতনের মতোই মেজোবাবুর কথার জালে ফেঁসে যায় শান্তি , আপাতত শান্তি আর রতন দুজনই পুলিশ কাস্টডিতে রয়েছে।
মিছিলটা থানার সামনে এসেছে।
" লালন" ডাকে মেজবাবু।
" হ্যাঁ স্যার।"
" ইলিয়াস কে চিনিস?"
" হ্যাঁ স্যার।"
" দেখেছিস কখনও?"
" একবার স্যার, দুর থেকে দেখেছিলাম। বাঘের বাচ্চা।"
" চোপ!" ধমক দেয় মেজবাবু, " ভয় দেখাচ্ছিস?"
"সরি স্যার।"
ফ্যাক করে হেসে ওঠে নন্দী, বলে " চললাম। দেখুন ময়না রিপোর্ট সুইসাইড-ই হবে। মিছিল নিয়ে ভাববেন না।" নন্দী চলে যায়।
কার্তিক ফোন করেছিল মেজবাবুকে। এইমাত্র লাশ নিয়ে গেছে লাশ কাটা ঘরে। এখনও ঘণ্টা খানেক, মানে রাতের আগে রিপোর্ট জানা যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজোবাবুর ফোন বেজে ওঠে। কীর্তিমান সিংয়ের ফোন। " শুনুন, বলছি ওটা সুইসাইডই। ইলিয়াসের পেটে অ্যালকোহল পাওয়া যাবে।"
" কিন্তু বিলের জলে যাবে কি করে?" শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা করে মেজোবাবু।
" রাতের বেলায় বাঁধের রাস্তায় সাইকেল নিয়ে বেসামাল তারপর জলে ডুবে শেষ, সিম্পল।"
সিং সাহেবের কথায় স্বস্তি পায় মেজবাবু। একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে, " যাক তাহলে অ্যাকসিডেন্ট।"
লালন সিং দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। জিজ্ঞাসা করে মেজোবাবুকে, " কে বললো স্যার, ইলিয়াসের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে? কার্তিককে ফোন করেছিলাম। ময়না তো চলছে, শেষ হয়নি এখনও।"
" তোমার অত কৌতূহল কেনো বাপু? চুপ থাক।" রেগে যায় মেজোবাবু।
তারপর থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টা। মিডিয়ার দৌলতে পাবলিক জেনেছে সব খবর। "পথচারীকে পিষে দেওয়া" আসলে গুজব ছড়িয়ে বিপদে ফেলতে চাওয়া জনপ্রতিনিধি শ্রী কীর্তিমান সিংকে। " ইলিয়াসের মৃত্যু আসলে অ্যাকসিডেন্ট।" হিসাবে গরমিল নেই কোথাও। সব চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ, ফিরে গেছে মিডিয়া।
মিছিলটা চত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। ইলিয়াসের মত দেখতে খয়েরী জামা গায়ে ছেলেটাকেও দেখা যাচ্ছে না আর। মেজোবাবু খুশি।
মেজোবাবুর মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান জমে উঠেছে। শহরের রথী মহারথীরা আমন্ত্রিত। ঝকঝকে সন্ধ্যা। মেজোবাবুর ফোন বেজে ওঠে। থানা থেকে কার্তিক ফোন করেছে। কথা শেষ করে আতঙ্কে ডুবে যায় মেজোবাবু।
" কিছু গড়বড় হয়েছে স্যার?" জিজ্ঞাসা করে কীর্তিমান সিং।
" মোমবাতি জ্বেলে থানার সামনে ধর্নায় বসেছে লালন সিং।"
কীর্তিমান সিং আর নন্দীবাবু সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে নেয়। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সকাল বেলার মতোই একটা মিছিল নামে পথে। জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে বেশ কিছু পরিচিত বিদ্বজ্জন রয়েছে মিছিলে। হাজার হাজার প্রজ্জ্বলিত মোমের শিখার উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত শহর, মিডিয়ার ক্যামেরার ঝলকানি...।
সবার অলক্ষ্যে নিষ্প্রভ হয়ে আসে একটি মোমের আলো।
এই মুহূর্তে থানার দিকে একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। সবার সামনে হাঁটছে ইলিয়াস!
থানার গেটে দাঁড়িয়ে মেজোবাবু, বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টি মিছিলের গায়ে। মনে প্রশ্ন, " ইলিয়াস! কি করে?"
পরশু গভীর রাতের ঘটনা।
পথচারীকে পিষে দিয়েছে গাড়ি। ব্যাপারটা সবার অলক্ষ্যেই ঘটেছে। কীর্তিমান সিংয়ের গাড়ি নজরে আসেনি কারো।
সমস্যা হলো লাশটা!
লাশটা যেভাবেই লাশ হোক না কেনো, লাশের সুযোগ নিতে চাইবে সবাই। বিষয়টা রাতের আঁধারেই মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছিল কীর্তিমান সিং। লাশটা গায়েব করবার ব্যবস্থাও হয়েছে পাক্কা। ফাঁক ফোকর নেই কোনো।
কিভাবে জানতে পেরেছিল ইলিয়াস! গতকাল সাত সকালে থানায় আসে সঙ্গে একজন মহিলা, মৃতের মা। অভিযোগ নিতে হবে কীর্তিমান সিংয়ের বিরুদ্ধে।
"মানে!"
ইলিয়াসের কথা শুনে মেজবাবু অবাক। " কোথাও এমন কিছু ঘটেনি। বললেই হলো! মামাবাড়ি নাকি? তাছাড়া কীর্তিমান সিং সমাজ সচেতন মানুষ। একজন সম্মানীয় জনপ্রতিনিধি। তেমন কিছু ঘটলে নিজে এসে থানায় জানাত।"
" কাহিনী শোনাবেন না স্যার। বিচার চাই।" বলেছিল ইলিয়াস।
কে দেবে বিচার! ছেলের হাতের মোয়া নাকি। এদিকে মিডিয়াও হয়েছে! ব্রেকিং নিউজ পেতে হাজির হয়েছে সব।
খবরটা শিমুল তুলোর মত ছড়িয়ে পড়লো এলাকায়। পাবলিকের মুখে মুখে ফিরছে কীর্তিমানের কীর্তি। তবে পাবলিকের মুখ তো, সেটাই ভরসা।
কীর্তিমান প্রভাবশালী মানুষ। সে হোক, সিং সাহেবেরও শত্রু আছে। পরিস্থতি এমন হয়ে ওঠে যে অভিযোগ নিতেই হবে।
ইলিয়াসের কথা জানে সিং সাহেব। নাছোড় ছেলে। সাহস ধরে কলজেতে। গত বছর শহরের এক নামকরা হসপিটালে ভুল চিকিৎসায় শিশু মৃত্যু ঘটে। সেই নিয়ে এলাকা তোলপাড় করেছিল ইলিয়াস। ডাক্তার পালের জেল যাত্রা প্রায় নিশ্চিত ছিলো। মিডিয়াও পিছনে পড়ে ছিল খুব। শেষমেষ কীর্তিমান সিং এর হস্তক্ষেপে ব্যাপারটা ধামা চাপা পড়েছে। রেহাই মিলেছে ডাক্তার পালের। মিডিয়া মুখ ফিরিয়েছে অন্য দিকে।
" ইলিয়াস জীবনের পরোয়া করে না...।" গতকাল সিংজিকে ফোনে শুনিয়েছে মেজবাবু।
" আরে ছাড়ুন তো, উপর থেকে নিচে ফাঁক নেই কোথাও। পাশে আছে সবাই । আপনি ভয় পাবেন না।...।" গতকাল সন্ধ্যা বেলায় ফোন করেছিল সিং সাহেব। আজ সকালে থানায় খবর আসে, ইলিয়াস লাশ হয়ে গেছে!
কনস্টেবল লালন সিং মেজোবাবুকে জিজ্ঞাসা করে, " স্যার ইলিয়াসকে খুন করলো কে?"
প্রশ্ন শুনে মেজোবাবুর মেজাজ টং। " কি করে বলি লালন! ক্যালাসের মত কথা বলিস তুই। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসবে, দেখতে হবে আদৌ খুন হয়েছে কিনা। তবে আমার আইডিয়া এটা অ্যাকসিডেন্ট, হয়তো পেটে অ্যালকোহল ছিল। তুই মনে হচ্ছে খুব কষ্ট পেয়েছিস?"
মাথা নামিয়ে সরে যায় লালন। মেজোবাবু তাকিয়ে থাকে লালনের দিকে। বড্ড গোলমেলে ক্যারেকটার এই লালন সিং। হাইলি সাসপিসাস যাকে বলে। মেজোবাবুর সব কথায় কান পেতে থাকে। ভাব এমন যেনো কিচ্ছুটি বোঝে না। ব্যাটা আস্ত ঘুঘু। লালনকে আবার কিছু বলাও যায় না, কীর্তিমান সিংয়ের রিস্তেদার। আগে কলকাতা বড়োবাজারে খৈনির গুমটি চালাতো। আরো কি কি করতো ভগবান জানে। কীর্তিমানজীর চেষ্টায় কনস্টেবলের চাকরি জুটেছে মাস খানেক হলো। লালনকে এখনও সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি মেজোবাবু।
গতকাল নাইট ডিউটি ছিল মেজবাবুর।
দেউলী, বিজাপুর হয়ে শেষ রাতে দরাপপুরের বিলের ধারে গিয়েছিল। কোথাও কোনো অশান্তির খবর নেই। এক্কেবারে শান্তিপূর্ন রাত। থানায় ফিরেছে প্রায় ভোর পৌনে চারটার দিকে। লিকার চা তখনও মুখে ছোঁয়ায়নি, ফোন বেজে ওঠে, দরাপপুরের অঞ্চল প্রধান নন্দীবাবুর ফোন।
" হ্যালো, নন্দীবাবু বলছি, দরাপপুরের অঞ্চল প্রধান। ইলিয়াস খুন হয়ে গেছে।"
খবরটা শুনে আঁতকে ওঠে মেজবাবু। বলে কি! ইলিয়াস খুন! খবরটা হজম করতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, " কি বলছেন কি! কে দেখেছে?"
" আমাদের গ্রামের রতন ঘোষ দেখেছে। সবজি নিয়ে হাটে যাবার পথে...।"
নন্দীর মুখের কথায় থাবা মারে মেজবাবু বলে, " খুন হতে দেখেছে ?"
" না, না, ইলিয়াসের লাশটাকে জলে ভাসতে দেখেছে।"
" ও তাই বলুন। সত্যি খবর, নাকি ইলিয়াস-জুজু দেখাচ্ছেন?"
" হ্যাঁ, টাটকা খবর। লাশের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন করছি। ছুটে আসুন।" বলে নন্দী।
ব্যস! শুরু দৌড় ঝাঁপ। লাশ নিয়ে থানায় আসা। তাকে ময়না করতে পাঠানো। বিভিন্ন ফর্মালিটি মেনটেন। মাঝে মধ্যেই মিডিয়ার উৎপাত, এই সব করতে গিয়ে সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। বাড়িতে ফোন করবার ফুরসৎ মেলেনি। আজ আবার মেজবাবুর মেয়ের জন্মদিন। সেই আনন্দে সন্ধ্যা বেলায় ছোটখাটো পার্টির আয়োজন করেছে মেজোবাবু।
ফোনটা হাতে নিয়ে থানার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মেজবাবু। হরির দোকানে চিনি ছাড়া লাল চা অর্ডার দিয়েছে।
মিছিলটা এগিয়ে আসছে থানার দিকে। দুই চোখ কচলে দৃষ্টি ধারালো করে নিয়ে সামনে তাকায়, হ্যাঁ ওই তো খয়েরী জামা গায়ে একটি ছেলে। ইলিয়াস বলেই মনে হয়। সেই নির্ভীক পদক্ষেপ। মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে ছুঁড়ছে। যেনো প্রতিবাদের আঘাতে আকাশ ভেঙে ফেলবে।
মেজবাবু ফোন করে কার্তিককে। কার্তিক কনস্টেবল, ইলিয়াসের লাশ নিয়ে গেছে হসপিটাল। পোস্টমর্টেম হবে।
" হ্যালো, কার্তিক। শুরু হয়েছে?"
" না স্যার। লাশ আগলে বসে রয়েছি সকাল থেকে। এইবার নিয়ে যাবে...।"
" চোপ! বড্ড বেশি কথা বলিস তুই। বলছি প্লাস্টিকটা সরিয়ে লাশের মুখটা একবার দেখতো।"
"কি দেখবো স্যার?"
" দেখ, লাশটাকে ইলিয়াস বলে চেনা যাচ্ছে কি না।"
" হ্যাঁ স্যার চেনা যাচ্ছে। মুখটা ফুলে গেছে ঠিকই, তবে ইলিয়াস বলে বোঝা যাচ্ছে। মুখের সামনে মাছি ভন ভন করছে।"
লাইনটা কেটে দেয় মেজবাবু। দেখে পাশেই দাঁড়িয়ে লালন। " তুই কি শুনছিস লালন?" কিছুটা রাগত স্বরে প্রশ্ন করে মেজোবাবু।
মেজোবাবুর সামনে থেকে সরে যায় লালন সিং।
সামনে তাকায় মেজোবাবু। মিছিলটা আরো কয়েক পা এগিয়ে এসেছে থানার দিকে। চিৎকার করে স্লোগান তুলছে। কি বলছে শুনতে চেষ্টা করে । সে উপায় নেই। বেটার ছেলে হরি চায়ের দোকানে গান বাজাচ্ছে। ধমক দেয় মেজোবাবু। গান বন্ধ হয়। এইবার শোনা যাচ্ছে মিছিলের কণ্ঠ। " বাঁচাও", " বাঁচাও।"
কি বাঁচানোর আবদার কে জানে!
" হরি চা দে।" সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে মেজবাবু।
হরি উনুনে বাতাস করে। মেজাজ খরে ওঠে মেজবাবুর।বলে " হ্যাঁ তুমি সারাদিন বাতাস দাও উনুনের পিছনে।"
পাশ থেকে কে যেন হেসে ওঠে ফ্যাক করে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অঞ্চলপ্রধান নন্দী।
" নিন এইবার ঠেলা সামলান। মিছিল আসছে।"
" মিছিল কেনো আসছে বলুন তো নন্দীবাবু?"
" মিছিল তো আসবেই। আরে মশাই আমাদের দেশে যে কোনো ঘটনা ঘটার আগেও মিছিল পরেও মিছিল! মিছিলের একই অঙ্গে শত রূপ। রাস্তায় মিছিল হাঁটিয়ে কখনো পাবলিকের মনে সাহস দেওয়া হয় আবার ভীষন ভয় দেখানো যায় মিছিল হাঁটিয়েই। কেউ সত্যি কথা শোনাতে চায় আবার কেউ সত্যি কথা ভোলাতে চায় সেই মিছিলের চেহারা দেখিয়ে। এক কথায় যেকোনো ঘটনার বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরির সহজতম উপায় হলো মিছিল।"
ইতিমধ্যে আরো খানিকটা এগিয়ে এসেছে মিছিলটা। মেজবাবুর চোখে পাতা পড়ে না। মিছিলের সামনে খয়েরী জামা গায়ে হাঁটছে...।
" আরে ভয় পাবেন না, মিছিল নিয়ে আপনার চিন্তার কিছু নেই। রতন ঘোষ এসেছে, বয়ান দেবে। চলুন।" বলে নন্দীবাবু।
" নেব নেব। বয়ান তো নিতেই হবে।" গ্লাসের চা শেষ করে চেম্বারে আসে। সংক্ষিপ্ত বয়ান। ভোর বেলায় বাঁধের রাস্তা ধরে হাটে যাচ্ছিল রতন। দেখে জলে লাশ।
" তুই হঠাৎ জলের দিকে তাকালি কেন? সাইকেল তো রাস্তায় চলছিল। হঠাৎ জল দেখবার কি হলো?" মেজবাবুর কথায় বেকায়দায় পড়ে রতন। আমতা আমতা বলে " শান্তি জেলে মাছ ধরছিল। সেই দেখেছে প্রথম।"
" শান্তি জেলে কি দেখেছে?"
" খুন হয়ে...।"
" খুন হতে দেখেছে? বলিস কি রে।"
" না স্যার। খুন হওয়া লাশ দেখেছে।" বলে রতন।
" লাশটা খুন হওয়া বুঝলি কেমন করে?" একটা কাঁচা খিস্তি দিয়ে বড় বড় চোখে রতনের দিকে চেয়ে থাকে মেজবাবু। রতনের অবস্থা শোচনীয়। কাঁদো কাঁদো মুখে চেয়ে থাকে নন্দীবাবুর দিকে।
" শান্তি জেলে কে থানায় ডাকতে হবে। সবটা ওই জানে। খতরনাক লোক শান্তি জেলে!"
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মেজবাবু। গেটের দিকে হেঁটে আসে আবার। পাশে হাঁটে নন্দীবাবু। রাস্তার আই ল্যান্ডের পাস ঘুরে মিছিলটা এগিয়ে আসছে।
" মিছিলের সামনে ওই যে খয়েরী জামা গায়ে হাঁটছে, ঠিক করে দেখুন তো নন্দীবাবু চিনতে পারেন কিনা! বলে মেজবাবু।"
মিছিলটা একঝলক দেখে নেয় নন্দী। বলে," খয়েরী জামা গায়ে!" ফ্যাক ফ্যাক করে হেসে ওঠে নন্দী। বলে , " ইলিয়াস। ভূত হয়ে ফিরে এসেছে। ধরবে আপনাকে!"
ভিতরে ভিতরে রেগে ওঠে মেজবাবু, বলে " ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন? ওসব অনেক দেখেছি।"
একপাশে দাঁড়িয়ে লালন। মেজোবাবু দেখে লালনকে, ব্যাটা কি মতলব আঁটছে কে জানে। থানার সব খবর কীর্তিমান সিংকে রিলে করছে হয়তো। সিং সাহেবের জন্য এত করেও শেষে লালনের জন্যই না সিং সাহেবের বিরাগ ভজন হতে হয়।
" লালন সাহেব যে! একলা দাঁড়িয়ে। শরীর খারাপ নাকি?" জিজ্ঞাসা করে নন্দীবাবু।
ঘাড় নাড়ে লালন।
" পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না এলে বোঝা যাবে না ইলিয়াস খুন হয়েছে নাকি অ্যাকসিডেন্ট, বুজলেন নন্দীবাবু।" বলে মেজোবাবু।
নন্দীর মুখে একটা রহস্যময় হাসি। " অ্যাকসিডেন্ট-ই হওয়া উচিত।"
" কি করে বুঝলেন?"
" রাজনীতিতে আছি মশাই। খুন আর দুর্ঘটনা চিনব না!" হাসতে থাকে নন্দীবাবু।
একটু পাশে সরে গিয়ে কার্তিককে ফোন করে মেজোবাবু , " হ্যালো, কার্তিক। পোস্টমর্টেম শুরু হয়েছে?"
" না স্যার।"
" প্লাস্টিকটা সরিয়ে একবার লাশটার নাকের সামনে হাত নিয়ে গিয়ে দেখত।"
" কি দেখবো স্যার?"
" হারামজাদা বোঝো না, কি দেখবে? শ্বাস চলছে না তো?"
" না স্যার। এক্কেবারে বরফ ঠাণ্ডা। মাছি...।"
" আচ্ছা লাশের মুখের কাছে অ্যালকোহলের গন্ধ পাচ্ছিস?"
" না স্যার।"
"বেশ বেশ। বুঝেছি।"
একটা ইম্পর্টেন্ট কাজ। ডাক্তারের সময় হয়নি এখনো। চিন্তা একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা ভীষন জরুরি।
" স্যার আসবো?"
"কাকে চাই?"
" আমি শান্তি কৈবর্ত।"
বয়ান দিতে এসেছে শান্তি জেলে। ভোরবেলায় তার জালেই ইলিয়াস লাশ হয়ে ধরা দেয়। বয়ান দিতে গিয়ে রতনের মতোই মেজোবাবুর কথার জালে ফেঁসে যায় শান্তি , আপাতত শান্তি আর রতন দুজনই পুলিশ কাস্টডিতে রয়েছে।
মিছিলটা থানার সামনে এসেছে।
" লালন" ডাকে মেজবাবু।
" হ্যাঁ স্যার।"
" ইলিয়াস কে চিনিস?"
" হ্যাঁ স্যার।"
" দেখেছিস কখনও?"
" একবার স্যার, দুর থেকে দেখেছিলাম। বাঘের বাচ্চা।"
" চোপ!" ধমক দেয় মেজবাবু, " ভয় দেখাচ্ছিস?"
"সরি স্যার।"
ফ্যাক করে হেসে ওঠে নন্দী, বলে " চললাম। দেখুন ময়না রিপোর্ট সুইসাইড-ই হবে। মিছিল নিয়ে ভাববেন না।" নন্দী চলে যায়।
কার্তিক ফোন করেছিল মেজবাবুকে। এইমাত্র লাশ নিয়ে গেছে লাশ কাটা ঘরে। এখনও ঘণ্টা খানেক, মানে রাতের আগে রিপোর্ট জানা যাবে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেজোবাবুর ফোন বেজে ওঠে। কীর্তিমান সিংয়ের ফোন। " শুনুন, বলছি ওটা সুইসাইডই। ইলিয়াসের পেটে অ্যালকোহল পাওয়া যাবে।"
" কিন্তু বিলের জলে যাবে কি করে?" শুকনো গলায় জিজ্ঞাসা করে মেজোবাবু।
" রাতের বেলায় বাঁধের রাস্তায় সাইকেল নিয়ে বেসামাল তারপর জলে ডুবে শেষ, সিম্পল।"
সিং সাহেবের কথায় স্বস্তি পায় মেজবাবু। একটা লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলে, " যাক তাহলে অ্যাকসিডেন্ট।"
লালন সিং দাঁড়িয়ে ছিল পাশে। জিজ্ঞাসা করে মেজোবাবুকে, " কে বললো স্যার, ইলিয়াসের অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে? কার্তিককে ফোন করেছিলাম। ময়না তো চলছে, শেষ হয়নি এখনও।"
" তোমার অত কৌতূহল কেনো বাপু? চুপ থাক।" রেগে যায় মেজোবাবু।
তারপর থেকে মাত্র কয়েক ঘন্টা। মিডিয়ার দৌলতে পাবলিক জেনেছে সব খবর। "পথচারীকে পিষে দেওয়া" আসলে গুজব ছড়িয়ে বিপদে ফেলতে চাওয়া জনপ্রতিনিধি শ্রী কীর্তিমান সিংকে। " ইলিয়াসের মৃত্যু আসলে অ্যাকসিডেন্ট।" হিসাবে গরমিল নেই কোথাও। সব চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ, ফিরে গেছে মিডিয়া।
মিছিলটা চত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। ইলিয়াসের মত দেখতে খয়েরী জামা গায়ে ছেলেটাকেও দেখা যাচ্ছে না আর। মেজোবাবু খুশি।
মেজোবাবুর মেয়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান জমে উঠেছে। শহরের রথী মহারথীরা আমন্ত্রিত। ঝকঝকে সন্ধ্যা। মেজোবাবুর ফোন বেজে ওঠে। থানা থেকে কার্তিক ফোন করেছে। কথা শেষ করে আতঙ্কে ডুবে যায় মেজোবাবু।
" কিছু গড়বড় হয়েছে স্যার?" জিজ্ঞাসা করে কীর্তিমান সিং।
" মোমবাতি জ্বেলে থানার সামনে ধর্নায় বসেছে লালন সিং।"
কীর্তিমান সিং আর নন্দীবাবু সংক্ষিপ্ত আলোচনা সেরে নেয়। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই সকাল বেলার মতোই একটা মিছিল নামে পথে। জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে বেশ কিছু পরিচিত বিদ্বজ্জন রয়েছে মিছিলে। হাজার হাজার প্রজ্জ্বলিত মোমের শিখার উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত শহর, মিডিয়ার ক্যামেরার ঝলকানি...।
সবার অলক্ষ্যে নিষ্প্রভ হয়ে আসে একটি মোমের আলো।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন