"সেইদিন বেশি দূরে নেই যেদিন মানুষ নিজেই নিজের নামের আগে 'বরেণ্য', 'প্রাতঃস্মরণীয়', 'কালজয়ী' ইত্যাদি লিখতে শুরু করবে। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় কান পেতে শুনলুম এক অতিপরিচিত ফালতু লেখক নাকি প্রকাশককে বলেছেন, তাঁর বইয়ের বিজ্ঞাপনে যেন 'বরেণ্য লেখক' কথাটি থাকে। আজ প্রকাশককে বলেছেন। কাল নিজেই বলবেন, 'আমি বরেণ্য।' লাজ-লজ্জা এখন বোকার ভূষণ।
সত্যি বলতে কী, আধা-লেখকদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি। একজন গাড়িতে উঠে ফেসবুকে ছবি দিলেন 'অমুক জায়গায় সংবর্ধনা নিতে যাচ্ছি।' পাশে বসে কন্যার বয়সি স্বঘোষিত 'বান্ধবী।' তাঁর যে দাঁত-পড়া বয়সেও একজন বান্ধবী আছে, সেটা জগৎবাসীকে না-জানালে চলে? আর একজন কার একটা 'আমন্ত্রণে' বিমানে বাংলাদেশে যাবেন। বিমানবন্দরে পৌঁছেই সে-কথা ছবি-সহ জানিয়ে দেওয়া হল। রানাঘাট কিংবা বর্ধমান লোকালে ওঠার আগে কেউ কিন্তু ছবি দিয়ে লেখে না, এই যে আমি রানাঘাট যাচ্ছি। কারা এই লোকগুলোকে সংবর্ধনা জানায়, আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে। কেউ কেউ নাকি পুজোর উদ্বোধনও করে থাকেন। তারপর নেতিয়ে পড়া নিমকি, গজা, রসে গড়াগড়ি খাওয়া প্যাকেট নিয়ে নিজ গৃহে গমন করেন। পরের দিনই ফেসবুকে তেত্রিশটা ছবি----দেখো আমি বাড়ছি মাম্মি।
এক পঞ্চায়েত কর্তা মাঝে-মধ্যে নিজেই নিজের সংবর্ধনার ব্যবস্থা করে থাকেন। আড়ালে থাকে 'বালক সঙ্ঘ', 'আমরা কজন' সংঘের নাম। গাঁয়ের নিতাই শীল কিংবা হারাধন পালের মেয়ে তাঁর গলায় ঝুলিয়ে দেন মোটা একটা ফুলের মালা। তিনি মাধ্যমিকও পাশ করেননি। কিন্তু মঞ্চে উঠে শাল, উত্তরীয় পরতে আদৌ গা কুটকুট করে না। অনেক কসরত করে গলার স্বরটাকে গম্ভীর করে ফেলেছেন। মাইক হাতে পেয়ে তিনি দেশ, কাল, মহাকাল---ইত্যাদি বিষয়ে কত কথা যে বলে যান! না, লজ্জা লাগে না। ওঁরও না। শ্রোতাদেরও না। আজকাল কেউই কোনও বিষয়ে লজ্জা পায় না। আত্মপ্রচারের আফিং-গুলি হরেক মাল পাঁচ সিকে দরে বিকোচ্ছে।
কম-বেশি আত্মপ্রচার আমরা সবাই করে থাকি। কিন্তু মাঝে-মাঝে সেটা এমন চরমে ওঠে যে হজম করা মুশকিল। এক সাংবাদিকের ম্যালেরিয়া না ডেঙ্গি কী একটা হয়েছিল। তা তিনি একদিন লিখলেন, 'আমি যখন ঘরে বন্দি তখন আমার আরোগ্য কামনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, মুখ্যসচিব...। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।
' তাঁর আরোগ্যলাভের জন্য যাঁরা খুব উদ্বিগ্ন ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ লোকটি হলেন জেলাশাসক। পাড়ার বন্ধু, পাশের বাড়ির কাকু-কাকিমা কেউই তাঁর আরোগ্য কামনা করেননি। অন্তত ফেসবুকে তাঁদের নাম নেই।
আমাকে এক মফসসলের নেতা প্রায়ই বলতেন, 'আমাকে নিয়ে কাগজে কিছু লিখুন।' আমার মাথায় ঢুকত না যে, ওঁকে নিয়ে আমি কী লিখব? শেষে একদিন বললাম, 'দেখুন আপনি তো বিখ্যাত লোক। আমি বিখ্যাত লোকেদের নিয়ে লিখি না। তার জন্য আপিসে অন্য লোক আছে।' 'বিখ্যাত লোক' কথাটি শুনে তাঁর চোখমুখে হ্যালোজেনের আলো। মনে হল, কেউ যদি তাঁকে সকাল-সন্ধ্যায় 'আপনি তো বিখ্যাত লোক' বলে যান তা হলে হয়তো দু-কাঠা জমিই দান করে দেবেন।
বিখ্যাত হওয়ার বাসনা আমাদের ফালাফালা করে দিচ্ছে। লোকজন দিনভর সেলিব্রিটিদের গাল দেয়। কিন্তু মনে মনে বোধহয় সবাই সেলিব্রিটি হতে চায়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলের ঝুড়িটার কথা মনে পড়ছে। কত পুতুল সেখানে। রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন...। ভানু গেয়ে যাচ্ছেন পুতুল নেবে গো পুতুল।
ভানু জানতেও পারছেন না, তাঁর ঝুড়ি কবে ভরে উঠেছে নগা, খগা, বগার পুতুলে। তিনি যে কার বন্দনা করে গান গাইছেন হয়তো নিজেই জানেন না।
মাঝে-মাঝে খচাখচ সেলফি তোলার আওয়াজ আসছে ঝুড়ি থেকে। পুতুলের সেলফি। ফেসবুকে দিতে হবে না?"
© অনিমেষ বৈশ্য
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন