পুরুলিয়া খরাপ্রবণ এলাকা। গ্রীষ্মে জল কোন পাতালে থাকে ঈশ্বরও জানেন না। মাটির নিচে শুধু পাথর। স্তরে স্তরে প্রতিবন্ধকতা। নলকূপ নেই। থাকলেও অকেজো বা জল ওঠে না। জলের অপর নাম জীবন এখানে ভয়াবহ। আর এ ভয়াবহ জীবনের জন্য দায়ী জল। জলের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করে থাকতে হয় সাধারণ মানুষকে। শহরের মানুষ নলকূপ বা সরকারি পানীয় জল পেলেও প্রান্তের মানুষ বঞ্চিত। প্রান্তের মানুষ কেন বঞ্চিত এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। তবে ঘরে বসে কেউ কেউ ‘সাবঅলর্টান’ চর্চা করে।
এই চর্চায় ভীম, ঈশ্বর বাউরিদের কোন উপকার হয় না। বাউরিদের জল কষ্ট, সরকারি উদাসীনতা, নলকূপ খনন নিয়ে গড়ে উঠেছে সৈকত রক্ষিতের ‘ঢেঁকিকল’ উপন্যাসটি। পাঠকের ধারণাকে প্রথমেই ভেঙে দেওয়া ভালো। নইলে পাঠক ভাবতে পারে এ অখ্যান বুঝি ধান ভানার রহস্য। আগে ধান মাড়াই, পরে পেষাই। আধুনিক যন্ত্রে ধান পেষাইয়ের আগে ছিল ঢেঁকি। ইহা গ্রামীণ যন্ত্র, ধান চাল সহ বিবিধ শস্য পেষাই করার যন্ত্র। নলকূপের হাতলের সঙ্গে ঢেঁকির অনেকটা সাদৃশ্য থাকায় এমন নামকরণ। উপন্যাসের সময়পর্ব খুবই সামান্য। ছাতাডাং গ্রামে নলকূপ খননে এসেছে সরকারি কর্মচারীরা, দুদিনের চেষ্টায় জল না ওঠায় ফিরে যাচ্ছে। এই সামান্য সময় পর্বকে লেখক বৃহৎ ব্যাপ্তি দান করেছেন।
গ্রামে নলকূপ খননের গাড়ি প্রবেশ করেছে। উপন্যাস শুরুই হচ্ছে জল সমস্যা দিয়ে। কিন্তু সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন পথ নেই। তিনি তো নিছক কাহিনি লিখতে বসেননি যে উত্তরণের পথ দেখিয়ে দেবেন বা প্রেমের গল্প দিয়ে মিলিয়ে দেবেন। উপন্যাসের সমাপ্তিও তাই উত্তরণহীন জীবনে, সমস্যাহীন সমাধানে। বাউরিরা যে তলানিতে ছিল সেই তলানিতেই থেকে গেল। রাষ্ট্রের কোন দায়বদ্ধতা নেই বাউরি মানুষগুলির জন্য। কিন্তু দায়বদ্ধতা আছে লেখকের। তিনি সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন এই মানুষগুলির কাছে। নগরের হাতছানি বা লেখক বৃত্তির হাতছানি টেনে নিয়ে যেতে পারেনি কোথাও। আসলে তিনি এই মানুষগুলির কাছে পেয়েছিলেন অমৃতের সন্ধান। স্বদেশ আত্মার সন্ধান। প্রকৃতির রুক্ষ প্রান্তর। নিসর্গের সৌন্দর্য আছে তবে তা উপলব্ধির জন্য গ্রীষ্মের দাবদাহ সহ্য করতে হবে। বসন্ত এখানে প্রেমের গান নিয়ে আসে না। পলাশ ফোটে ঠিকই কিন্তু সেও যেন যন্ত্রণার মর্মবেদনা নিয়েই উপস্থিত হয়। প্রকৃতির রুক্ষ প্রান্তরে কর্পোরেট পুঁজির নজর পড়েনি। আসলে এ মাটিতে কিছু নেই। একেবারেই যে নেই তা নয়, সে বয়ান আমরা পাব লেখকের ‘আকরিক’ উপন্যাসে। তবে এ উপন্যাসের ভূগোলের মাটি এখনও দখল হয়নি। কেননা চাষ অযোগ্য। পীযূষ, অজয়, গেনু পরিমল গাড়ি নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে। লেখক প্রথমেই উপন্যাসের ভূগোল গড়ে তোলেন। যে স্থানে তিনি পাঠককে নিয়ে যাচ্ছেন তার চারপাশের জনজীবন, পরিবেশ ও ভৌগোলিক চিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যান। আসলে পাঠককেও সঙ্গে নেন। পাঠকের মানসিকতাও গড়ে তোলেন। বাউরি জনজীবন। তাঁতিপাথরের পাশে ছাতাডাং গ্রাম। তাঁতিপাড়া অপেক্ষাকৃত বিত্তবান হলেও ছাতাডাং দরিদ্র। তাঁতিপাথর গ্রামের মানুষ চাষ আবাদে যুক্ত হলেও ছাতাডাং চাষহীন। তাঁতিপাথর অর্থবলে সেচের সুবিধা করতে পেরেছে কিন্তু ছাতাডাঙে সে সুবিধা নেই। তবে গ্রামে রাজনীতি নেই। জোতদার বৃত্ত বিরাজ করে তাঁতিপাথর গ্রামে। এ গ্রামকে বাউরিরা এক সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখে। শহরের মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয় কেন চাষ হয়না। অসহনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয় বাউরিদের। ভীমের বয়ানে পাই –‘’হামারা একবারেই মৈরে গেছি আইজ্ঞা। মৈরে শুঁকায় গেছি। হামদের গায়ে এই হাড়-মাসটুকু ভিন্ন আর কিছু নাই।‘’( ঢেঁকিকল, পৃ. ১৩ )- এ জীবন রুক্ষ, বর্ণহীন। মুখে অভাবের চিহ্ন স্পষ্ট। বাউরিদের এটাই যেন নিয়তি, ভবিতব্য। তবে কোন অভিমান নেই, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। এমনকি গভমেন্টের বিরুদ্ধেও কোন অনুযোগ নেই। শুধু অনুযোগ নয় গভমেন্ট সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। তাঁদের একটাই প্রার্থনা জল –‘’লোকে ভাত-কাপড় মাঙে। লঙরখানায় মাইলো মাঙে। হামাদের দাবি সেরেফ জলের।‘’(তদেব, পৃ. ১৪ ) লেখক নিজেও যেন একটা চরিত্র হয়ে উঠছেন। বলা ভালো বাউরিদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। যেন আত্মার সম্পর্ক, হৃদয় আত্মার দোসর। উপন্যাসে কবি সুনীলের যে কথা পাব তা যেন লেখক সৈকত রক্ষিতেরই সত্তা। কয়েক পুরুষ ব্যবধানেও বাউরিদের চিত্র পাল্টায়নি। গভমেন্ট এঁদের প্রতি দৃষ্টি দেয়নি। এঁরা যেন রাষ্ট্রের বর্জিত অংশ, দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। লেখক সুনীল গ্রামে লেখার উপাদান সংগ্রহের জন্য গেলে সাধারণ মানুষ নানা আবদার করে, কখনও রাস্তা বা নলকূপ। বাউরিরা ভাবে লেখক সুনীলই বুঝি রাষ্ট্রের অংশ, এখানে আবেদন করলেই হবে। তবে সে আবেদন লিখিত নয়, বাউরিদের শিক্ষা কোথায় যে আবেদন পত্র লিখবে, ফলে মৌখিক ভাবেই বলতে হয়, ব্যর্থও হয়।
গ্রামে নলকূপ খননের গাড়ি প্রবেশ করেছে। উপন্যাস শুরুই হচ্ছে জল সমস্যা দিয়ে। কিন্তু সমস্যা থেকে উত্তরণের কোন পথ নেই। তিনি তো নিছক কাহিনি লিখতে বসেননি যে উত্তরণের পথ দেখিয়ে দেবেন বা প্রেমের গল্প দিয়ে মিলিয়ে দেবেন। উপন্যাসের সমাপ্তিও তাই উত্তরণহীন জীবনে, সমস্যাহীন সমাধানে। বাউরিরা যে তলানিতে ছিল সেই তলানিতেই থেকে গেল। রাষ্ট্রের কোন দায়বদ্ধতা নেই বাউরি মানুষগুলির জন্য। কিন্তু দায়বদ্ধতা আছে লেখকের। তিনি সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন এই মানুষগুলির কাছে। নগরের হাতছানি বা লেখক বৃত্তির হাতছানি টেনে নিয়ে যেতে পারেনি কোথাও। আসলে তিনি এই মানুষগুলির কাছে পেয়েছিলেন অমৃতের সন্ধান। স্বদেশ আত্মার সন্ধান। প্রকৃতির রুক্ষ প্রান্তর। নিসর্গের সৌন্দর্য আছে তবে তা উপলব্ধির জন্য গ্রীষ্মের দাবদাহ সহ্য করতে হবে। বসন্ত এখানে প্রেমের গান নিয়ে আসে না। পলাশ ফোটে ঠিকই কিন্তু সেও যেন যন্ত্রণার মর্মবেদনা নিয়েই উপস্থিত হয়। প্রকৃতির রুক্ষ প্রান্তরে কর্পোরেট পুঁজির নজর পড়েনি। আসলে এ মাটিতে কিছু নেই। একেবারেই যে নেই তা নয়, সে বয়ান আমরা পাব লেখকের ‘আকরিক’ উপন্যাসে। তবে এ উপন্যাসের ভূগোলের মাটি এখনও দখল হয়নি। কেননা চাষ অযোগ্য। পীযূষ, অজয়, গেনু পরিমল গাড়ি নিয়ে গ্রামে প্রবেশ করে। লেখক প্রথমেই উপন্যাসের ভূগোল গড়ে তোলেন। যে স্থানে তিনি পাঠককে নিয়ে যাচ্ছেন তার চারপাশের জনজীবন, পরিবেশ ও ভৌগোলিক চিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যান। আসলে পাঠককেও সঙ্গে নেন। পাঠকের মানসিকতাও গড়ে তোলেন। বাউরি জনজীবন। তাঁতিপাথরের পাশে ছাতাডাং গ্রাম। তাঁতিপাড়া অপেক্ষাকৃত বিত্তবান হলেও ছাতাডাং দরিদ্র। তাঁতিপাথর গ্রামের মানুষ চাষ আবাদে যুক্ত হলেও ছাতাডাং চাষহীন। তাঁতিপাথর অর্থবলে সেচের সুবিধা করতে পেরেছে কিন্তু ছাতাডাঙে সে সুবিধা নেই। তবে গ্রামে রাজনীতি নেই। জোতদার বৃত্ত বিরাজ করে তাঁতিপাথর গ্রামে। এ গ্রামকে বাউরিরা এক সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখে। শহরের মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয় কেন চাষ হয়না। অসহনীয় দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয় বাউরিদের। ভীমের বয়ানে পাই –‘’হামারা একবারেই মৈরে গেছি আইজ্ঞা। মৈরে শুঁকায় গেছি। হামদের গায়ে এই হাড়-মাসটুকু ভিন্ন আর কিছু নাই।‘’( ঢেঁকিকল, পৃ. ১৩ )- এ জীবন রুক্ষ, বর্ণহীন। মুখে অভাবের চিহ্ন স্পষ্ট। বাউরিদের এটাই যেন নিয়তি, ভবিতব্য। তবে কোন অভিমান নেই, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই। এমনকি গভমেন্টের বিরুদ্ধেও কোন অনুযোগ নেই। শুধু অনুযোগ নয় গভমেন্ট সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। তাঁদের একটাই প্রার্থনা জল –‘’লোকে ভাত-কাপড় মাঙে। লঙরখানায় মাইলো মাঙে। হামাদের দাবি সেরেফ জলের।‘’(তদেব, পৃ. ১৪ ) লেখক নিজেও যেন একটা চরিত্র হয়ে উঠছেন। বলা ভালো বাউরিদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছেন। যেন আত্মার সম্পর্ক, হৃদয় আত্মার দোসর। উপন্যাসে কবি সুনীলের যে কথা পাব তা যেন লেখক সৈকত রক্ষিতেরই সত্তা। কয়েক পুরুষ ব্যবধানেও বাউরিদের চিত্র পাল্টায়নি। গভমেন্ট এঁদের প্রতি দৃষ্টি দেয়নি। এঁরা যেন রাষ্ট্রের বর্জিত অংশ, দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। লেখক সুনীল গ্রামে লেখার উপাদান সংগ্রহের জন্য গেলে সাধারণ মানুষ নানা আবদার করে, কখনও রাস্তা বা নলকূপ। বাউরিরা ভাবে লেখক সুনীলই বুঝি রাষ্ট্রের অংশ, এখানে আবেদন করলেই হবে। তবে সে আবেদন লিখিত নয়, বাউরিদের শিক্ষা কোথায় যে আবেদন পত্র লিখবে, ফলে মৌখিক ভাবেই বলতে হয়, ব্যর্থও হয়।
বাউরিরা শুধু ভোটের উত্তরাধিকারী। শিক্ষিত অঞ্চলে ভোট পেতে হলেও কিছু দিতে হয়, কাজ করতে হয়। এখানে তার বালাই নেই। এই মানুষগুলিকে অতি সহজেই ভুল বোঝানো যায়। ঠকানো যায়। আর মানুষ ঠকাতে রাষ্ট্রের ভারি মজা।
গ্রামে রাস্তার চিহ্ন নেই। এঁরা যেন পথহীন মানুষ। পথ হারাতে এঁরা পথে নামেনি, সারাজীবনই পথহারা। নলকূপ খননে এসেছে পীযূষ। এ যেন তাঁর পুরুলিয়া দর্শন, অনার্য ভারতবর্ষ দর্শন, রুক্ষ প্রান্তর দর্শন। জলহীন মানুষ কেমন করে বেঁচে থাকে ! শুধু জল নয় খাদ্যও নেই। আসলে জল নেই বলেই শস্য উৎপাদিত হয় না। জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখানে অন্ধকার। ক্ষুধার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকা –‘’নাম ইয়ার মহুল গাছ।‘ সনাতন গ্রামের উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞের মতো তারিয়ে তারিয়ে বলে যায়-আর কিছুদিন পরে এই গাছে ধরবে নিমফলের মতো ছোট ও রসালো অজস্র ফুল। এই ফুল সিদ্ধ করে খেয়ে তারা বেলা কাটিয়ে দিতে পারে। কেউ আবার গমের সঙ্গে রোদে শুকনো মহুল মিশিয়ে কুঁড়ো করেও খায়।“(তদেব, পৃ. ১৫ ) তবে অনেক সময় মহুয়াও জোটে না। দরিদ্র মানুষের ভাগ্য শূন্য। ভাগ্যরেখা এঁরা বিচার করেনা, ভাগ্যফল মানে না, এঁরা জানে ভাগশেষের অংক। বিত্তবানের উচ্ছিষ্ট অংশ এঁদের প্রাপ্য। এজন্য কোন অভিমান নেই, হতাশা নেই। জানে এটাই ভবিতব্য, এ নিয়ে ঈশ্বরের কাছে কোন অভিযোগ করেনা, তাঁরা জানে ঈশ্বর লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমায়, তাঁদের অভিযোগ শোনার প্রাকমুহূর্তে নাকে নস্যি, কানে তুলা গুজে দেন। তাঁরা জানে –‘ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লীতে’ – সেখানে এ ধ্বনি পৌঁছাবে না। ছাতাডাং গ্রাম বটে কিন্তু গ্রামহীন গ্রাম। শুধু গ্রামের কাঠামো বা ম্যাপে নামযুক্ত গ্রাম। এখানে কিচ্ছু নেই। অতি সাধারণ বিষয়ের জন্য বাউরিদের যেতে হয় বিষপুরিয়াতে। এখানে সবই উল্টো নিয়ম। রাষ্ট্রের বিপরীত পিঠ। তাই পতিতপবনরা হয়ে যায় পবনপতিত। এই বিপরীত পিঠে সভ্যতার আলো পড়েনা। অন্ধকারে জোনাকির মতো ক্ষণিক আলো ঝিকমিক করে। আর তা হয়ে ওঠে ‘ক্ষণপ্রভা প্রভা দানে বাড়ায় মাত্রা আঁধার’। এই আঁধারবৃত্তের বাইরে বাউরি মহিলারা যায়নি। যাওয়ার সুযোগ হয়নি। পবনের ভাই বুধন। তাঁর ছিল ড্রাইভার হবার সখ। কিন্তু সখ পূরণ হয়নি। শহরের মানুষ বাউরিদের মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। সে এখন ভেড়ার লোম কাটে। সভ্যতা এই মানুষদের আসলে ভেড়া বানাতে চায়।
এ উপন্যাসের দুই দিক। একদিকে বাউরি সম্প্রদায়, অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীদের প্রতিনিধি। সরকারি প্রতিনিধিদের মধ্যেও বিভেদ আছে। পীযূষ সরকারের সমালোচনা, ছিদ্র আবিষ্কারে সচেষ্ট, অজয় নাকে নস্যি নিয়ে চুপ করে সরকারের পক্ষ নেয়। কেননা বেতন কাঠামো ঠিক রাখতে হবে। নলকূপ বসানো নিয়েও দুইনম্বরি শুরু হয়েছে। শহরের লোক ক্ষমতা প্রদর্শন করে নিজের বাড়ির সামনে নলকূপ বসিয়ে নিয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু বিত্তবানদের আছে উকিল। তিনি বেআইনকে আইন করে নিয়ে এসেছেন। বিত্তবানদের জয়ের জন্য ঘণ্টায় ঘণ্টায় আইনের নানা উপধারা সৃষ্টি করতে হয়। টাকায় সব হয়। নলকূপ হয়। আইন মিনিটে মিনিটে ডিগবাজি খায়। তবে সবাই মেরুদণ্ডহীন নয়। কেউ কেউ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পীযূষ আটকে দিয়েছিল ক্ষমতাবানদের চালাকি। আখ্যানও পাল্টে গেল। লেখককেও গ্রাম থেকে শহরে প্রবেশ করতে হল। সব জায়গাতেই প্রলেতারিয়েত রাজ বিরাজ করছে। তার সহায়ক হয়ে ওঠে সরকারি কর্মীরা। বিপরীত পথে গেলেই প্রমোশন আটকে যায়। তবে পীযূষকে এতো ভয়ংকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি, তবে জবাবদিহি করতে হয়েছে। আসলে মানুষ মেজরিটির পক্ষে থাকতে চায়। ব্যক্তি সমষ্টির সুবিধাকে ব্যবহার করতে চায়। রাষ্ট্রও ব্যক্তি অপেক্ষা সমষ্টিকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু রাষ্ট্রের মাসতুতো ভাইরা মেজরিটির অংশ নয়। রাষ্ট্রের মস্তিস্ক দংশন করে মাসতুতো ভাইরা বোঝায় ব্যক্তিই প্রধান। কেননা যাত্রীবাহী গাড়ির স্টিয়ারিং থাকে ড্রাইভার নামক ব্যক্তির হাতে। তাই যাত্রী অপেক্ষা ড্রাইভারকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। পীযূষ ছিল মেজরিটির পক্ষে, ক্ষমতার বিপক্ষে। তাঁর দাবি সমস্যার সমাধান করতে হবে মেজরিটির পক্ষ থেকে। পীযূষ বোঝে সাধারণ মানুষ, অজয় চেনে ক্ষমতা। পীযূষ কর্মী হয়েও সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে চেয়েছে, অজয় জানে কাজ অপেক্ষা ইউনিয়ানের দালালি বড় কাজ।
ছাতাডাং এর মাস্টার নিত্যানন্দ। স্কুলে সবাই পড়েনা। পড়ার ক্ষমতা নেই। নিত্যানন্দেরও কোন চাহিদা নেই। সেও যেন এক ঔপনিবেশিক ভাষ্য। তবে উপন্যাসের শেষে সেই বাউরিদের প্রতিনিধি হয়ে প্রতিবাদ করেছে। এ উপন্যাসে আপাত ভাবে কোন নায়ক নেই। আঞ্চলিক উপন্যাসে নায়ক থাকেনা। সমষ্টিই এখানে নায়কের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার ‘আঞ্চলিক উপন্যাস’ এই ধারণাটাও বড় গোলমেলে। উপন্যাস একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল নিয়েই রচিত হবে। কেউ অঞ্চলের আকাশ দিয়ে যাবেন, যেতে যেতে নিচের মানুষগুলিকে অল্প করে ছুঁয়ে যাবেন, কেউ নিচ থেকে মানুষ ও সমাজের সমস্যাগুলিকে ধরবেন। সামান্য অর্থবান ঘরের ছেলেরা পড়তে আসে, বৃহত্তর জীবনের সন্ধান পায়। সবাই পায় না, পাওয়া সম্ভব নয়। যারা পায় তারা মুনাফা লুটে নেয়। লধুড়কার ভূদেব মণ্ডল নিজের জমিতে নলকূপ বসিয়ে প্রতিবেশীদের বঞ্চিত করেছিল। অবধারিত পরিণাম হিসেবে গ্রামের মানুষ নলকূপ ভেঙে দেয়। লেখকের মতে বাউরিদের কল্পনার চোখ নেই। থাকা সম্ভব নয়। যেখানে ক্ষুধাই একমাত্র সত্য সেখানে কল্পনা থাকা সম্ভব নয়। সৃষ্টিও যেন তাদের কাছে বড় প্রতারক। জীবনের সৌন্দর্যতা এখানে নেই। আছে সংগ্রাম, লড়াই। এ সংগ্রাম নিজের সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে। এই নিম্নবিত্তের জীবন নিয়ে শহরের লেখক সাহিত্য রচনা করে পুরস্কার পান। সে রচনাকে লেখক ব্যঙ্গ করেন –
‘’সে ছিল সাহেবের বন্ধু। কলকাতার বাবু। গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াত। নাম উঠত কাগজে। মাঝেমধ্যে পুরুলিয়া এসে আস্তানা নিত অযোধ্যা-বাগমুণ্ডিতে। মদ্যপান আর আদিবাসী যুবতীর নেশা তার চোখে লেগে থাকতো পিঁচুটির মতো। উচ্ছন্নে যাওয়া জীবনের বেদনা নিয়ে সেই মুখার্জি সাহেব রচনা করত সমকালীন সাহিত্য। উপন্যাস। তার দুটো একটা অজয়ও পড়েছে বৈ-কি।‘’( তদেব, পৃ. ৩০ )
গ্রামজীবনের সঙ্গে শহরের জীবনের বহু প্রভেদ আছে। লেখকের মতে শহরের দুর্নীতির কালচার বেশি। সভ্য নাগরিকরাই রাষ্ট্রকে শোষণ করে বেশি মাত্রায়। রাষ্ট্রের মাসতুতো ভাইরা শহরে থাকে, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে নিজেকে রুচিবান হিসেবে পরিচয় দেয়, কিন্তু তলে তলে সরকারি অর্থ চুরি করে। দালালরা পরিণত হয় ঠিকেদারে। পুরুলিয়ার অতি মফস্সল গ্রামে দুর্নীতি এখনও প্রবেশ করেনি। বাউরিরা অতি সহজ সরল। নৈতিকতার মূল্য এখনও বিসর্জন দেয়নি। মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে ভয় পায়। এই বাউরিরা বৃত্তিহীন মানুষ। এখানে কোন কাজ নেই। কাজের সন্ধান নেই। কাজের জন্য সামান্য অর্থের জোগান নেই। পীযূষ বলেছিল বাউরিদের খাটিয়া বোনার কথা। কিন্তু খাটিয়ার জন্য দড়ি কেনার সামর্থ নেই। লেখকের বয়ান পদ্ধতি অতি অদ্ভুত। একদিকে দরিদ্র বাউরি সম্প্রদায়, অন্যদিকে শহর থেকে আসা এলিট বাবুরা। বলা ভালো শহরের লোকের গ্রাম দর্শন। ধারণার গভীরে ডুব দিয়ে ধারণাগুলি ভেঙে যায়। উঠে আসে ভারতীয় জনজীবনের প্রকৃত রূপ। ভারতে এমন কত গ্রাম আছে আমরা জানি না। সৈকত রক্ষিত পুরুলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নিজের স্বদেশ সন্ধানের কথা বলেছেন। যেমন করে বলেন তারাশঙ্কর বা চিনুয়া আচেবে।
পীযূষ আগে কবিতা লিখত। তবে দীর্ঘদিন লেখে না। এ গ্রামকে দেখে মনে হয়েছে কবিতার মতো সুন্দর। গ্রাম দর্শনে শহরের লোকের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চার হয় পীযূষেরও তা হয়েছে। লেখক সুনীল বাবু এ গ্রামে আসেন। এ লেখক আসলে সৈকত রক্ষিতের সত্তা। গ্রাম জীবনের সৌন্দর্যতায় মুগ্ধ হন। মুক্তির স্বাদ পান। অমৃতের সন্ধানে মৌজায় মৌজায় পরিভ্রমণ করে চলেন। এখানে বহু সমস্যা আছে। নেই এর তালিকা বৃহৎ। তবুও মুখে হাসি আছে। সৌন্দর্য আছে, জীবনবোধ আছে। সেই বোধের সন্ধানে যান –
‘’পীযূষেরও, ধাপে ধাপে, ওই লেখক-মানুষটির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। কেমন সে লেখক ? সমগ্র গ্রাম আঁতিপাতি করে কোন তথ্য খোঁজে সে ? সে লেখক, না সাংবাদিক ? ডায়েরির পাতা ভর্তি হয়ে যায়, এই ছোট্ট গ্রামে এত খবর আছে ?
হতে পারে। কত বিচিত্র এখানের মানুষ। তাদের সমস্যাও নিশ্চয় বিচিত্র ? শুধু জল নেই, পথ নেই নয়। আরো অনেক কিছু হয়ত এখানে নেই। ছাতাডাং মোটমাট যা চায়, তা আসলে একটা পূর্ণাঙ্গ অধ্যায়। মানুষের। জীবনের।‘’ ( তদেব, পৃ. ৩২ )
এই জীবন পীযূষের ভাবনালোকে দোলা দেয়। মনে হয় এগুলোর ডকুমেন্টারি করা প্রয়োজন। অভাবের তাড়নায় ভদু হাটে গিয়েছিল ছাগল বিক্রি করতে, কিন্তু বিক্রি হয়নি। ভীম কিনতে চেয়েছে কিন্তু বাকিতে। ভদু ছাগল বিক্রি করে বাড়ির মহিলাদের পোশাক কিনবে। এই নিদারুণ অভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ না তোলা মানুষগুলিকে লেখক ডকুমেন্ট করতে চেয়েছেন। লেখকের উপস্থাপন কৌশল অনবদ্য। গ্রামের মানুষগুলো যখন একটু উৎসাহ, অহংকার দাবি করে লেখক তখন গভমেন্টের প্রসঙ্গ এনে আখ্যানকে ভেঙে দেন। বাউরিরা গাছের ফল পুড়িয়ে ছাই করে কাপড় পরিষ্কার করে। তবে অভাবের মধ্যেও বিনোদনের চিত্র আছে, পালাগানের প্রসঙ্গ আছে। তবে অভাবে কেউ কেউ চুরি করে। ভীমের ছেলে অনাদি। প্রজন্মের ব্যবধানে পাল্টে যাচ্ছে বাউরি সমাজের চিত্র। অনাদিরা একটু উগ্র। অনাদির পড়াশোনা নেই। নিত্যানন্দের তেমন কোন টান দেখিনা ছাত্র তৈরি করায়। নিত্যানন্দের বৃহৎ চেতনা নেই। মধ্যবিত্ত সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিছক মাস্টারি করা। অনার্য ভারতবর্ষের চিত্র পাল্টে দেবার কোন অভিপ্রায় বা চেতনা নেই। বোধ নেই। তবে অহংকার আছে। পীযূষ সমীক্ষা করে জেলা নিয়ে। কীভাবে উন্নয়ন করা যাবে। সরকার যদি দৃষ্টি না দেয় তবে একটা গোষ্ঠীই ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ এঁদের শক্তি, ক্ষমতা ছিল। রাষ্ট্র এঁদের শক্তি ব্যবহার করেনি। গ্রোথ কমে যাচ্ছে, একদিন হয়ত বিলুপ্ত প্রাণী হয়ে যাবে। আসলে এগুলি লেখকের জীবনদর্শন। পুরুলিয়া নিয়ে নিজস্ব ভাবনা। খাদ্যের অভাব, পুষ্টির অভাব। মানুষ হারিয়ে ফেলছে সব। পীযূষকে আদর্শ চরিত্র হিসেবে ভাবা যেতে পারে। কিন্তু সে আদর্শের কোন মূল্য নেই। শরৎচন্দ্রের রহিমের মতো মহৎ ও পল্লি উন্নয়ন চরিত্র দুর্লভ। তবে রহিমের শেকড় কিন্তু গ্রামে। তাই চেতনাও গভীর। পীযূষদের শুধু ভাবনা ও মন্তব্য। আলগা সহানুভূতি আছে। সভ্যতার উন্নতি জন্য নির্দিষ্ট মাপকাঠি প্রয়োজন। একদিনে সব পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। শ্রমিকের শ্রমই মূলধন। এই শ্রমকে কাজে লাগাতে হবে। উন্নয়ন একদিনে অসম্ভব। গ্রামে একদিনেই সভ্যতার আলো ফেলা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে পাল্টাতে হবে। পীযূষ একটা দিক, সে গ্রাম নিয়ে ভেবেছে। এই ভাবাটা জরুরি।
এ উপন্যাসের দুই দিক। একদিকে বাউরি সম্প্রদায়, অন্যদিকে সরকারি কর্মচারীদের প্রতিনিধি। সরকারি প্রতিনিধিদের মধ্যেও বিভেদ আছে। পীযূষ সরকারের সমালোচনা, ছিদ্র আবিষ্কারে সচেষ্ট, অজয় নাকে নস্যি নিয়ে চুপ করে সরকারের পক্ষ নেয়। কেননা বেতন কাঠামো ঠিক রাখতে হবে। নলকূপ বসানো নিয়েও দুইনম্বরি শুরু হয়েছে। শহরের লোক ক্ষমতা প্রদর্শন করে নিজের বাড়ির সামনে নলকূপ বসিয়ে নিয়েছে। সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করেছিল। কিন্তু বিত্তবানদের আছে উকিল। তিনি বেআইনকে আইন করে নিয়ে এসেছেন। বিত্তবানদের জয়ের জন্য ঘণ্টায় ঘণ্টায় আইনের নানা উপধারা সৃষ্টি করতে হয়। টাকায় সব হয়। নলকূপ হয়। আইন মিনিটে মিনিটে ডিগবাজি খায়। তবে সবাই মেরুদণ্ডহীন নয়। কেউ কেউ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পীযূষ আটকে দিয়েছিল ক্ষমতাবানদের চালাকি। আখ্যানও পাল্টে গেল। লেখককেও গ্রাম থেকে শহরে প্রবেশ করতে হল। সব জায়গাতেই প্রলেতারিয়েত রাজ বিরাজ করছে। তার সহায়ক হয়ে ওঠে সরকারি কর্মীরা। বিপরীত পথে গেলেই প্রমোশন আটকে যায়। তবে পীযূষকে এতো ভয়ংকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়নি, তবে জবাবদিহি করতে হয়েছে। আসলে মানুষ মেজরিটির পক্ষে থাকতে চায়। ব্যক্তি সমষ্টির সুবিধাকে ব্যবহার করতে চায়। রাষ্ট্রও ব্যক্তি অপেক্ষা সমষ্টিকে বেশি ভালোবাসে। কিন্তু রাষ্ট্রের মাসতুতো ভাইরা মেজরিটির অংশ নয়। রাষ্ট্রের মস্তিস্ক দংশন করে মাসতুতো ভাইরা বোঝায় ব্যক্তিই প্রধান। কেননা যাত্রীবাহী গাড়ির স্টিয়ারিং থাকে ড্রাইভার নামক ব্যক্তির হাতে। তাই যাত্রী অপেক্ষা ড্রাইভারকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। পীযূষ ছিল মেজরিটির পক্ষে, ক্ষমতার বিপক্ষে। তাঁর দাবি সমস্যার সমাধান করতে হবে মেজরিটির পক্ষ থেকে। পীযূষ বোঝে সাধারণ মানুষ, অজয় চেনে ক্ষমতা। পীযূষ কর্মী হয়েও সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে চেয়েছে, অজয় জানে কাজ অপেক্ষা ইউনিয়ানের দালালি বড় কাজ।
ছাতাডাং এর মাস্টার নিত্যানন্দ। স্কুলে সবাই পড়েনা। পড়ার ক্ষমতা নেই। নিত্যানন্দেরও কোন চাহিদা নেই। সেও যেন এক ঔপনিবেশিক ভাষ্য। তবে উপন্যাসের শেষে সেই বাউরিদের প্রতিনিধি হয়ে প্রতিবাদ করেছে। এ উপন্যাসে আপাত ভাবে কোন নায়ক নেই। আঞ্চলিক উপন্যাসে নায়ক থাকেনা। সমষ্টিই এখানে নায়কের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার ‘আঞ্চলিক উপন্যাস’ এই ধারণাটাও বড় গোলমেলে। উপন্যাস একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল নিয়েই রচিত হবে। কেউ অঞ্চলের আকাশ দিয়ে যাবেন, যেতে যেতে নিচের মানুষগুলিকে অল্প করে ছুঁয়ে যাবেন, কেউ নিচ থেকে মানুষ ও সমাজের সমস্যাগুলিকে ধরবেন। সামান্য অর্থবান ঘরের ছেলেরা পড়তে আসে, বৃহত্তর জীবনের সন্ধান পায়। সবাই পায় না, পাওয়া সম্ভব নয়। যারা পায় তারা মুনাফা লুটে নেয়। লধুড়কার ভূদেব মণ্ডল নিজের জমিতে নলকূপ বসিয়ে প্রতিবেশীদের বঞ্চিত করেছিল। অবধারিত পরিণাম হিসেবে গ্রামের মানুষ নলকূপ ভেঙে দেয়। লেখকের মতে বাউরিদের কল্পনার চোখ নেই। থাকা সম্ভব নয়। যেখানে ক্ষুধাই একমাত্র সত্য সেখানে কল্পনা থাকা সম্ভব নয়। সৃষ্টিও যেন তাদের কাছে বড় প্রতারক। জীবনের সৌন্দর্যতা এখানে নেই। আছে সংগ্রাম, লড়াই। এ সংগ্রাম নিজের সঙ্গে, অস্তিত্বের সঙ্গে। এই নিম্নবিত্তের জীবন নিয়ে শহরের লেখক সাহিত্য রচনা করে পুরস্কার পান। সে রচনাকে লেখক ব্যঙ্গ করেন –
‘’সে ছিল সাহেবের বন্ধু। কলকাতার বাবু। গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে বেড়াত। নাম উঠত কাগজে। মাঝেমধ্যে পুরুলিয়া এসে আস্তানা নিত অযোধ্যা-বাগমুণ্ডিতে। মদ্যপান আর আদিবাসী যুবতীর নেশা তার চোখে লেগে থাকতো পিঁচুটির মতো। উচ্ছন্নে যাওয়া জীবনের বেদনা নিয়ে সেই মুখার্জি সাহেব রচনা করত সমকালীন সাহিত্য। উপন্যাস। তার দুটো একটা অজয়ও পড়েছে বৈ-কি।‘’( তদেব, পৃ. ৩০ )
গ্রামজীবনের সঙ্গে শহরের জীবনের বহু প্রভেদ আছে। লেখকের মতে শহরের দুর্নীতির কালচার বেশি। সভ্য নাগরিকরাই রাষ্ট্রকে শোষণ করে বেশি মাত্রায়। রাষ্ট্রের মাসতুতো ভাইরা শহরে থাকে, ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরে নিজেকে রুচিবান হিসেবে পরিচয় দেয়, কিন্তু তলে তলে সরকারি অর্থ চুরি করে। দালালরা পরিণত হয় ঠিকেদারে। পুরুলিয়ার অতি মফস্সল গ্রামে দুর্নীতি এখনও প্রবেশ করেনি। বাউরিরা অতি সহজ সরল। নৈতিকতার মূল্য এখনও বিসর্জন দেয়নি। মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে ভয় পায়। এই বাউরিরা বৃত্তিহীন মানুষ। এখানে কোন কাজ নেই। কাজের সন্ধান নেই। কাজের জন্য সামান্য অর্থের জোগান নেই। পীযূষ বলেছিল বাউরিদের খাটিয়া বোনার কথা। কিন্তু খাটিয়ার জন্য দড়ি কেনার সামর্থ নেই। লেখকের বয়ান পদ্ধতি অতি অদ্ভুত। একদিকে দরিদ্র বাউরি সম্প্রদায়, অন্যদিকে শহর থেকে আসা এলিট বাবুরা। বলা ভালো শহরের লোকের গ্রাম দর্শন। ধারণার গভীরে ডুব দিয়ে ধারণাগুলি ভেঙে যায়। উঠে আসে ভারতীয় জনজীবনের প্রকৃত রূপ। ভারতে এমন কত গ্রাম আছে আমরা জানি না। সৈকত রক্ষিত পুরুলিয়ার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। নিজের স্বদেশ সন্ধানের কথা বলেছেন। যেমন করে বলেন তারাশঙ্কর বা চিনুয়া আচেবে।
পীযূষ আগে কবিতা লিখত। তবে দীর্ঘদিন লেখে না। এ গ্রামকে দেখে মনে হয়েছে কবিতার মতো সুন্দর। গ্রাম দর্শনে শহরের লোকের যে অভিজ্ঞতা সঞ্চার হয় পীযূষেরও তা হয়েছে। লেখক সুনীল বাবু এ গ্রামে আসেন। এ লেখক আসলে সৈকত রক্ষিতের সত্তা। গ্রাম জীবনের সৌন্দর্যতায় মুগ্ধ হন। মুক্তির স্বাদ পান। অমৃতের সন্ধানে মৌজায় মৌজায় পরিভ্রমণ করে চলেন। এখানে বহু সমস্যা আছে। নেই এর তালিকা বৃহৎ। তবুও মুখে হাসি আছে। সৌন্দর্য আছে, জীবনবোধ আছে। সেই বোধের সন্ধানে যান –
‘’পীযূষেরও, ধাপে ধাপে, ওই লেখক-মানুষটির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। কেমন সে লেখক ? সমগ্র গ্রাম আঁতিপাতি করে কোন তথ্য খোঁজে সে ? সে লেখক, না সাংবাদিক ? ডায়েরির পাতা ভর্তি হয়ে যায়, এই ছোট্ট গ্রামে এত খবর আছে ?
হতে পারে। কত বিচিত্র এখানের মানুষ। তাদের সমস্যাও নিশ্চয় বিচিত্র ? শুধু জল নেই, পথ নেই নয়। আরো অনেক কিছু হয়ত এখানে নেই। ছাতাডাং মোটমাট যা চায়, তা আসলে একটা পূর্ণাঙ্গ অধ্যায়। মানুষের। জীবনের।‘’ ( তদেব, পৃ. ৩২ )
এই জীবন পীযূষের ভাবনালোকে দোলা দেয়। মনে হয় এগুলোর ডকুমেন্টারি করা প্রয়োজন। অভাবের তাড়নায় ভদু হাটে গিয়েছিল ছাগল বিক্রি করতে, কিন্তু বিক্রি হয়নি। ভীম কিনতে চেয়েছে কিন্তু বাকিতে। ভদু ছাগল বিক্রি করে বাড়ির মহিলাদের পোশাক কিনবে। এই নিদারুণ অভাবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ না তোলা মানুষগুলিকে লেখক ডকুমেন্ট করতে চেয়েছেন। লেখকের উপস্থাপন কৌশল অনবদ্য। গ্রামের মানুষগুলো যখন একটু উৎসাহ, অহংকার দাবি করে লেখক তখন গভমেন্টের প্রসঙ্গ এনে আখ্যানকে ভেঙে দেন। বাউরিরা গাছের ফল পুড়িয়ে ছাই করে কাপড় পরিষ্কার করে। তবে অভাবের মধ্যেও বিনোদনের চিত্র আছে, পালাগানের প্রসঙ্গ আছে। তবে অভাবে কেউ কেউ চুরি করে। ভীমের ছেলে অনাদি। প্রজন্মের ব্যবধানে পাল্টে যাচ্ছে বাউরি সমাজের চিত্র। অনাদিরা একটু উগ্র। অনাদির পড়াশোনা নেই। নিত্যানন্দের তেমন কোন টান দেখিনা ছাত্র তৈরি করায়। নিত্যানন্দের বৃহৎ চেতনা নেই। মধ্যবিত্ত সুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিছক মাস্টারি করা। অনার্য ভারতবর্ষের চিত্র পাল্টে দেবার কোন অভিপ্রায় বা চেতনা নেই। বোধ নেই। তবে অহংকার আছে। পীযূষ সমীক্ষা করে জেলা নিয়ে। কীভাবে উন্নয়ন করা যাবে। সরকার যদি দৃষ্টি না দেয় তবে একটা গোষ্ঠীই ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ এঁদের শক্তি, ক্ষমতা ছিল। রাষ্ট্র এঁদের শক্তি ব্যবহার করেনি। গ্রোথ কমে যাচ্ছে, একদিন হয়ত বিলুপ্ত প্রাণী হয়ে যাবে। আসলে এগুলি লেখকের জীবনদর্শন। পুরুলিয়া নিয়ে নিজস্ব ভাবনা। খাদ্যের অভাব, পুষ্টির অভাব। মানুষ হারিয়ে ফেলছে সব। পীযূষকে আদর্শ চরিত্র হিসেবে ভাবা যেতে পারে। কিন্তু সে আদর্শের কোন মূল্য নেই। শরৎচন্দ্রের রহিমের মতো মহৎ ও পল্লি উন্নয়ন চরিত্র দুর্লভ। তবে রহিমের শেকড় কিন্তু গ্রামে। তাই চেতনাও গভীর। পীযূষদের শুধু ভাবনা ও মন্তব্য। আলগা সহানুভূতি আছে। সভ্যতার উন্নতি জন্য নির্দিষ্ট মাপকাঠি প্রয়োজন। একদিনে সব পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। শ্রমিকের শ্রমই মূলধন। এই শ্রমকে কাজে লাগাতে হবে। উন্নয়ন একদিনে অসম্ভব। গ্রামে একদিনেই সভ্যতার আলো ফেলা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে পাল্টাতে হবে। পীযূষ একটা দিক, সে গ্রাম নিয়ে ভেবেছে। এই ভাবাটা জরুরি।
শহর এগিয়ে চলেছে। এই অগ্রগতির কথা গ্রাম জানে না। অগ্রগতির সংবাদ গ্রামে এসে পৌঁছায় না। গ্লোবাল ভিলেজের ধারণা নেই। গ্রামে ফেসবুক নেই। রাষ্ট্রের দৃষ্টি ভিন্ন। উন্নয়নের নামে পক্ষপাতিত্ব চলে। গ্রামে উন্নয়ন প্রবেশ করেনি। কেন করেনি তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। শুধু রহস্যগুলি লেখক উসকে দিতে চান।
শুধু নলকূপ নয় সমস্যার তালিকা বৃহৎ, সেসব কেউ জানতে চায় না। তবে অজয় অনেকটা জেনেছে, আরও জানতে চায়। এও তো এক ভারততীর্থের অনুসন্ধান। এবার জল এসেছে। পীযূষের বয়ানে জানি গভমেন্ট এবার শুধু জল দেবে, অন্য কিছু নয় –
‘’অজয়ের এই স্পষ্ট এবং উদ্ধত জবাব পীযূষের অক্ষমতাকে প্রকট করে দেয়। তাৎক্ষণিক হলেও, সরকারের বিরুদ্ধে একটা আক্রোশে সে আনচান করে বলে ওঠে, ‘রাস্তা আমি বানিয়ে দিতে পারবো না, কিন্তু এই গ্রামের সমস্ত লোককে যদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিতে পারি ? যদি বুঝিয়ে দিতে পারি-এই গরমেট তোমাদেরকে শুধু জলই দিতে পারে, রাস্তা-স্কুল-হাসপাতাল-আলো কিচ্ছু দিতে পারে না ?’’ (তদেব, পৃ. ৪১ )
পীযূষের সমস্ত সত্তা নাড়া দেয়। অজয়কে জানিয়েছে সে আর কবিতা লিখতে পারবে না। আসলে বাউরি সম্প্রদায়ের জীবন দর্শন তাঁর হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। সব কিছু সে জানতে চায়। জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন তোলে। ভারতবর্ষকে দেখতে চায়। বাউরিরা অত্যন্ত ভীত। লক্ষণের চিন্তা এই যন্ত্র নিয়ে গভমেন্ট নতুন বিপদে যেন না ফেলে। কেননা গভমেন্টের চরিত্ররা তাঁরা জানে। আসলে গভমেন্টকে ভয় পায়। শুধু সে নয় গোটা বাউরি সমাজই ভয় পায়। তবে পরের প্রজন্ম অনাদিরা বেরিয়ে এসেছে। সরকার পুরুলিয়াকে দুইভাগে ভাগ করেছে –প্রবলেম ভিলেজ, নন প্রবলেম ভিলেজ। গ্রামে জনসংখ্যা ২৫০ এর বেশি হলে নলকূপ খনন হবে। পীযূষদের অসুবিধায় পড়তে হয় ফিল্ডে গিয়ে, জনরোষের সামনে পড়তে হয়। সাধারণ মানুষের ক্ষোভের জন্য দায়ী কে ? নিয়তি না গভমেন্ট ! গভমেন্ট উদাস চক্ষু বিশিষ্ট ভোলানাথ। প্রশ্ন আসে ফেরোসাস কে ? পাবলিক না গভমেন্ট। সাধারণ মানুষ গভমেন্টের আইন ভাঙতে সচেষ্ট হয়। একাধিক সমস্যা যেখানে সমষ্টিকে আঁকড়ে ধরে সেখানে গভমেন্টকে পূজা করার প্রসঙ্গ আসে না। গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের বসবাস। নলকূপ বসানোর নামে সরকারি মাসতুতো ভাইরা দুর্নীতি শুরু করে। নলকূপ বসানো না হলেও খাতায় তালিকা তৈরি হয়। নলকূপ মেরামতির টাকা দালালদের পকেটে ঢোকে। পীযূষের চিন্তা এই সিস্টেমের পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব ! অজয়ের মতে সিস্টেমের পরিবর্তন সম্ভব নয়। কেননা সিস্টেমের সমস্তটাই গোলকধাঁধা। কেউ এগিয়ে এলে অন্যেরা ভাবে পাগল। সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। এই বেশ আছি। খামকা সচেতন হবার কী দরকার ! মধ্য থেকে সব টাকা চুরি হয়ে যায়। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কর্মচারীরা প্রতিবাদ করেনা। সরকারের সঠিক পথ দেখিয়ে দেয় না। কেউ কেউ করলে মনে হয় হুজুগ। ডিপার্টমেন্টের গাড়ি বসে থাকে। কোন গাড়ির চাকা থাকলে ইঞ্জিন নেই, কোনটির বিপরীত। ফলে কাজ দিতে হয় কোম্পানিকে। কোম্পানি মুনাফা লুট করে। নলকূপ থাকলেও জল ওঠে না। শুধু হতাশার শ্বাস বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কর্তৃপক্ষ কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত হতে চায়। সরকার চায় হিসেবের খাতা সঠিক রাখতে। বাউরিদের জীবনের সঙ্কীর্ণতা ধীরে ধীরে প্রসারিত হয় নলকূপ খনন কেন্দ্র করে-
‘’শুধু অধর-ই বা কেন ? পবন ঈশ্বর সনাতন মাগারাম-এরা ? একঘেয়ে জীবন-যাপনের মধ্যে শহরের এই সামান্য অনুপ্রবেশ তাদের ক্ষণস্থায়ী বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে। তারা কেবল উত্তেজিতই হয়নি, একটা কিম্ভুত যন্ত্রকে স্বচক্ষে দেখে অনুমান করেছে জীবনের ব্যাপকতা। সেই সূত্রে নিজেদের তুচ্ছ ও সঙ্কীর্ণ এই বেঁচে থাকার প্রসঙ্গে তারা এখন একেকজন কঠোর সমালোচকও।‘’(তদেব, পৃ. ৪৮ )
নলকূপ বসানো নিয়ে গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়েছে। উঠে আসে সমষ্টিগত অভিপ্রায়। নানা আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়। মানুষ ভাবে একদিন হয়ত ছাতাডাঙার মানচিত্র পাল্টে যাবে। গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। অধরের ছেলে গঙ্গাধর অসুস্থ। দরিদ্র মানুষের তেমন কোন নজর নেই। সারাদিন কিছু খায়নি। ওষুধ নেই, সেবা নেই, যত্ন নেই। ভীমের মেয়ে রাধারানি ধর্ষিত হয়েছিল। এ গ্রামে পুলিশ আসে না। সন্তান হারানোর জন্য ভীমের বেদনা প্রকাশ হয়ে যায়। মানুষের মৃত্যু এখানে অজান্তে ঘটে। যেন নিয়তি। প্রতিবাদ নেই, নালিশ নেই। শ্রেণি থাকলেও শ্রেণিসংগ্রাম নেই। কুসংস্কার আচ্ছন্ন জীবন। ধরে নেয় মৃত্যু অনিবার্য। সবই নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়ে কান্না জুড়ে দেয়। তবে কন্দনেরও তেমন মূল্য নেই। ভীমের আত্মযন্ত্রণা বড় হয়ে ওঠে। কন্যাহীন জীবনে সেও মরতে চায়। জীবনসংগ্রাম থেকে পালাতে চায়। যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। এখানে পৌঁছায় না-‘সখী যাতনা কাহারে কয়’। পীযূষের মনে হয়েছে এদের নিয়ে লেখা যেতে পারে। এরাই তাঁর দেশ, সময়, সমাজ, প্রান্তিক ভারতবর্ষ। পীযূষের আত্মচিন্তা রাধারানির কীভাবে মৃত্যু হল ! কেউ কোন তদন্ত করল না। কুসংস্কারযুক্ত সমাজ, জীবন, মানুষ। মৃত্যু এখানে তাই নিছকই প্রক্রিয়া। বেদনা আছে কিন্তু প্রকাশ নেই।
পীযূষ গ্রাম দেখেছে। কিন্তু গ্রামীণ জীবন দেখেনি। দূর থেকে গ্রামকে দেখে যা মনে হয় তা নয়। তার ক্ষত আরও গভীর। শহরের মানুষ গ্রাম বলতে শান্ত শিষ্ট ছায়া সুনিবিড় যে ক্ষেত্র বোঝে বাস্তবে তা বড় রুক্ষ। শহরের মানুষের গ্রাম দর্শন, ক্ষেত্র সমীক্ষা যে নিছকই বিনোদন তা লেখক জানেন। এই দর্শন ওপরে ওপরে। শুধুই দেখা। গভীরে প্রবেশের চেষ্টা নেই, মানুষ বোঝার তাগিদ নেই। নাগরিক মানুষ গ্রাম দেখে কবিতা লেখে। প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করে কিন্তু দৈন্যতার কথা ভাবে না। আসলে সে বোধ নেই। পীযূষের বন্ধু কবিতা না লিখতে পারলে কাঁদে। পীযূষ সরে এসেছে সে বোধ থেকে। পীযূষ দীর্ঘদিন কিছু লেখেনি। যিনি একশ শতাংশ লেখক তার পক্ষে না লেখা কী সম্ভব ? সে যন্ত্রণা উপভোগ করতে পারেনি। ভেতরে কোন বোধের জন্ম হয়নি। লেখকও ব্যঙ্গ করেন –
‘’শহরে বসে যারা গ্রাম গ্রাম করে, গ্রামে আসে তারা গায়ে জ্যাকেট চড়িয়ে। স্টিকার মারা বিদেশী ধাঁচের সস্তা প্যান্ট পরে। গ্রামের লোকেরা তাদের উঁচু উঁচু নাকের কাছে ঘেঁষতে সাহস পায় না। এমনই বাবু ! মানুষকে না দেখে তারা দেখে প্রকৃতি। ডায়েরি খুলে নোট করে নিয়ে যায় গুচ্ছেক ফুল আর গাছের গ্রাম্য নাম। তারা ভোরবেলায় পাহাড়ী বাতাসকে উপভোগ করে। দেখে হাজারো কিসিমের বুনো পাখি।‘’( তদেব, পৃ. ৬৩ )
নলকূপ খনন শুরু হয়েছে। জল উঠতেও পারে আবার নাও পারে। জল না উঠলে নানা কৈফিয়ৎ দিয়ে বাবুরা ফিরে যায়। কিন্তু সেসব তথ্য যাচাই হয় না। অনুসন্ধান নেই। গ্রাম যা তাই থাকে। সুনীল এখানে এসে বাউরিদের সঙ্গে মিশে যেত। বাউরিদের কাছে কন্যা হল মহাজন। কন্যার বিবাহ মানেই পিতার নিস্তার। ভীমের কন্যার বিবাহ। কন্যার বিবাহের জন্য পিতাকে সর্বস্ব হারাতে হয় –‘’মহাজনের টাকা মেটাতে না পারলে টুঁটি চিপবেক, তেমনই বিটি ডাগর হল কি বিদায় কর। আর আজকালকার দিনে বুঝেছেনেই ত ? একটা বিটি উদ্ধার করা মুহের কথা ? সব্বসান্ত করে দিবেক।‘’( তদেব, পৃ. ৬৮ ) বিবাহও নিম্নবিত্ত পরিবারে। আসলে জীবনই নিম্নবিত্ত। অল্পতেই সুখ। বৃহৎ জীবন আকাঙ্ক্ষা নেই। জীবন এখানে ভয়ংকর। সুখ নেই। সুখের ইতিবৃত্ত নেই। সুখ সন্ধানের জন্য ছলচাতুরি নেই। জীবন প্রবাহমান। জন্ম-মৃত্যুকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যায় বাউরিরা। নলকূপে জল উঠে আসাকে কেন্দ্র করে কাহিনি এগিয়ে যায়, ইতিহাস উঠে আসে। নলকূপ খননের ডিটেলিং এ লেখক যান। লেখক এসব গভীর ভাবে দেখেছেন, জেনেছেন। ডিটেলিং একজন লেখকের বড় গুণ, যা সৈকত রক্ষিত করেছেন। আসলে তিনি তো চান ডকুমেন্ট করতে।
গ্রাম মানেই বৃত্তিধারী মানুষের প্রাধান্য। এ গ্রামেও আছে। মাগরাম দড়ি পাকায়। দড়ি পাকানো যন্ত্রটির নাম ‘ঢ্যারা’। শহরের মানুষ এসবের নাম শোনেনি। গ্রামীণ জীবনবোধের সন্ধানে লেখক হেঁটে চলেন। জীবনের রন্ধ্রে প্রবেশ করে অন্ধকার গলিপথ আবিষ্কার করেন। জল ওঠার বদলে উঠে আসে পাথর। গঙ্গারাম ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে এলিয়ে পড়ে। এরজন্য দায়ী কে ? রাষ্ট্র না সাধারণ মানুষ ? গ্রামের আশেপাশে চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল নেই। মানুষ মৃত্যুকে ছেড়ে দেয় নিয়তির হাতে। কেউ প্রতিবাদ করেনি, প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। এ জীবন পীযূষের হাতে কলম তুলে দিল। সাহিত্য নিছক বিনোদন নয়, তা অন্তরের প্রেরণা থেকে উঠে আসে। জনজীবনের গভীরে যে ক্ষত লুকিয়ে আছে তা লেখক মনে অনুরণন তোলে। এই জীবনই পীযূষকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়-
‘’রাত্রে, সাতিসত্যিই পীযূষ একটা কবিতা লিখে ফেলে, ‘গঙ্গাধর, তোমার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী নই...
সে-রাত্রে ভালো করে ঘুম হল না পীযূষের। একটা সার্থক কবিতা লেখার উত্তেজনায়। সারারাত্তির তাকে তাড়া করে বেড়াল গঙ্গাধরের মৃতমুখ।‘’ (তদেব, পৃ. ৭৬ )
গঙ্গাধরের মৃত্যু পীযূষের সব চেতনাকে খুলে দেয়। সে সৌন্দর্যবোধের সন্ধান পায়। মৃত্যু তাঁকে এক অনন্ত শূন্যতায় যেমন নিয়ে যায় তেমনি জীবনবোধে উপনীত করে। জীবন বড় দুর্লভ। এখানে নয়ন খুলে হৃদয় দিয়ে সৌন্দর্য অনুভব করতে হয়। ধুলোমুঠি থেকে সৌন্দর্য উঠিয়ে আনতে হয়। সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে যায়। জল কোনভাবেই উঠে আসেনি। হতাশা দানা বাঁধে। এতদিন জল ছিল না, কোন প্রতিবাদও ছিল না। আজ সুযোগ এসেছে, এই সুযোগই যেন বাউরিদের চেতনাকে জাগিয়ে দেয়। আজ জল তাদের চাই-ই। শান্ত বাউরিরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী সত্তা জেগে ওঠে। নিজেদের দাবি আদায় করে নিতে চায়। আজ মৃত্যু অপেক্ষা বাউরিদের জলের আকাঙ্ক্ষা বড় হয়ে উঠেছে। যে পীযূষ সারাজীবন সরকারের বিরোধীতা করে এসেছে সে আজ সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া পরিত্রাণের উপায় নেই। সব ভিত্তিহীন পরিকল্পনা। সার্ভে, ওয়াটার লেভেল দেখা হয়নি। ফলে জলের সন্ধান নেই। ১৫০ ফিট বোরিং হয়ে গেছে। পীযূষ আর সরকারি অর্থ অপচয় করতে রাজি নয়। কেননা সিস্টেমটাই ভুল। গোটা জেলায় ২৫০ এর বেশি নলকূপ ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনার অভাব। অথচ পীযূষ, অজয়দের কিছু করার নেই। এবার পালাতে হবে। ভিন্ন গ্রামেও জল না উঠলে পালাতে হয়েছে। মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পালিয়েছে। এছাড়া পথ নেই। এঁরাও যেন প্রতারক হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পরিত্রাণ নেই। প্রতিরোধে পীযূষ, অজয়দের বয়ান পাল্টে যায়। তারা হয়ে ওঠে সরকারি লোক। কথার সুর কেটে যায়। পীযূষের চোখের সামনে প্রান্তিক ভারতবর্ষের এক অস্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। সমস্ত রোমান্টিকতা কেটে যায় –
‘’ভীমের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাজ্জব বনে যায় পীযূষ। এ-কোন ভীম বাউরি ? এখানে প্রথম যার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল ? যাকে সে ভালোবেসেছিল ? ধমক দিয়েছিল ? কাছে ডেকেছিল একান্ত সহোদর করে ? কাঁধে হাত রেখেছিল ? যার আচারণ ভাবভঙ্গি কথা বার্তায় আচ্ছন্ন ছিল গ্রামীণ মেটো কাব্যের সৌরভ ?
‘’অজয়ের এই স্পষ্ট এবং উদ্ধত জবাব পীযূষের অক্ষমতাকে প্রকট করে দেয়। তাৎক্ষণিক হলেও, সরকারের বিরুদ্ধে একটা আক্রোশে সে আনচান করে বলে ওঠে, ‘রাস্তা আমি বানিয়ে দিতে পারবো না, কিন্তু এই গ্রামের সমস্ত লোককে যদি সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিতে পারি ? যদি বুঝিয়ে দিতে পারি-এই গরমেট তোমাদেরকে শুধু জলই দিতে পারে, রাস্তা-স্কুল-হাসপাতাল-আলো কিচ্ছু দিতে পারে না ?’’ (তদেব, পৃ. ৪১ )
পীযূষের সমস্ত সত্তা নাড়া দেয়। অজয়কে জানিয়েছে সে আর কবিতা লিখতে পারবে না। আসলে বাউরি সম্প্রদায়ের জীবন দর্শন তাঁর হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে। সব কিছু সে জানতে চায়। জিজ্ঞাসা, প্রশ্ন তোলে। ভারতবর্ষকে দেখতে চায়। বাউরিরা অত্যন্ত ভীত। লক্ষণের চিন্তা এই যন্ত্র নিয়ে গভমেন্ট নতুন বিপদে যেন না ফেলে। কেননা গভমেন্টের চরিত্ররা তাঁরা জানে। আসলে গভমেন্টকে ভয় পায়। শুধু সে নয় গোটা বাউরি সমাজই ভয় পায়। তবে পরের প্রজন্ম অনাদিরা বেরিয়ে এসেছে। সরকার পুরুলিয়াকে দুইভাগে ভাগ করেছে –প্রবলেম ভিলেজ, নন প্রবলেম ভিলেজ। গ্রামে জনসংখ্যা ২৫০ এর বেশি হলে নলকূপ খনন হবে। পীযূষদের অসুবিধায় পড়তে হয় ফিল্ডে গিয়ে, জনরোষের সামনে পড়তে হয়। সাধারণ মানুষের ক্ষোভের জন্য দায়ী কে ? নিয়তি না গভমেন্ট ! গভমেন্ট উদাস চক্ষু বিশিষ্ট ভোলানাথ। প্রশ্ন আসে ফেরোসাস কে ? পাবলিক না গভমেন্ট। সাধারণ মানুষ গভমেন্টের আইন ভাঙতে সচেষ্ট হয়। একাধিক সমস্যা যেখানে সমষ্টিকে আঁকড়ে ধরে সেখানে গভমেন্টকে পূজা করার প্রসঙ্গ আসে না। গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের বসবাস। নলকূপ বসানোর নামে সরকারি মাসতুতো ভাইরা দুর্নীতি শুরু করে। নলকূপ বসানো না হলেও খাতায় তালিকা তৈরি হয়। নলকূপ মেরামতির টাকা দালালদের পকেটে ঢোকে। পীযূষের চিন্তা এই সিস্টেমের পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব ! অজয়ের মতে সিস্টেমের পরিবর্তন সম্ভব নয়। কেননা সিস্টেমের সমস্তটাই গোলকধাঁধা। কেউ এগিয়ে এলে অন্যেরা ভাবে পাগল। সুখে থাকতে ভুতে কিলায়। এই বেশ আছি। খামকা সচেতন হবার কী দরকার ! মধ্য থেকে সব টাকা চুরি হয়ে যায়। সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কর্মচারীরা প্রতিবাদ করেনা। সরকারের সঠিক পথ দেখিয়ে দেয় না। কেউ কেউ করলে মনে হয় হুজুগ। ডিপার্টমেন্টের গাড়ি বসে থাকে। কোন গাড়ির চাকা থাকলে ইঞ্জিন নেই, কোনটির বিপরীত। ফলে কাজ দিতে হয় কোম্পানিকে। কোম্পানি মুনাফা লুট করে। নলকূপ থাকলেও জল ওঠে না। শুধু হতাশার শ্বাস বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কর্তৃপক্ষ কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিত হতে চায়। সরকার চায় হিসেবের খাতা সঠিক রাখতে। বাউরিদের জীবনের সঙ্কীর্ণতা ধীরে ধীরে প্রসারিত হয় নলকূপ খনন কেন্দ্র করে-
‘’শুধু অধর-ই বা কেন ? পবন ঈশ্বর সনাতন মাগারাম-এরা ? একঘেয়ে জীবন-যাপনের মধ্যে শহরের এই সামান্য অনুপ্রবেশ তাদের ক্ষণস্থায়ী বৈচিত্র্য এনে দিয়েছে। তারা কেবল উত্তেজিতই হয়নি, একটা কিম্ভুত যন্ত্রকে স্বচক্ষে দেখে অনুমান করেছে জীবনের ব্যাপকতা। সেই সূত্রে নিজেদের তুচ্ছ ও সঙ্কীর্ণ এই বেঁচে থাকার প্রসঙ্গে তারা এখন একেকজন কঠোর সমালোচকও।‘’(তদেব, পৃ. ৪৮ )
নলকূপ বসানো নিয়ে গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়েছে। উঠে আসে সমষ্টিগত অভিপ্রায়। নানা আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়। মানুষ ভাবে একদিন হয়ত ছাতাডাঙার মানচিত্র পাল্টে যাবে। গ্রামে চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। অধরের ছেলে গঙ্গাধর অসুস্থ। দরিদ্র মানুষের তেমন কোন নজর নেই। সারাদিন কিছু খায়নি। ওষুধ নেই, সেবা নেই, যত্ন নেই। ভীমের মেয়ে রাধারানি ধর্ষিত হয়েছিল। এ গ্রামে পুলিশ আসে না। সন্তান হারানোর জন্য ভীমের বেদনা প্রকাশ হয়ে যায়। মানুষের মৃত্যু এখানে অজান্তে ঘটে। যেন নিয়তি। প্রতিবাদ নেই, নালিশ নেই। শ্রেণি থাকলেও শ্রেণিসংগ্রাম নেই। কুসংস্কার আচ্ছন্ন জীবন। ধরে নেয় মৃত্যু অনিবার্য। সবই নিয়তির ওপর ছেড়ে দিয়ে কান্না জুড়ে দেয়। তবে কন্দনেরও তেমন মূল্য নেই। ভীমের আত্মযন্ত্রণা বড় হয়ে ওঠে। কন্যাহীন জীবনে সেও মরতে চায়। জীবনসংগ্রাম থেকে পালাতে চায়। যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। এখানে পৌঁছায় না-‘সখী যাতনা কাহারে কয়’। পীযূষের মনে হয়েছে এদের নিয়ে লেখা যেতে পারে। এরাই তাঁর দেশ, সময়, সমাজ, প্রান্তিক ভারতবর্ষ। পীযূষের আত্মচিন্তা রাধারানির কীভাবে মৃত্যু হল ! কেউ কোন তদন্ত করল না। কুসংস্কারযুক্ত সমাজ, জীবন, মানুষ। মৃত্যু এখানে তাই নিছকই প্রক্রিয়া। বেদনা আছে কিন্তু প্রকাশ নেই।
পীযূষ গ্রাম দেখেছে। কিন্তু গ্রামীণ জীবন দেখেনি। দূর থেকে গ্রামকে দেখে যা মনে হয় তা নয়। তার ক্ষত আরও গভীর। শহরের মানুষ গ্রাম বলতে শান্ত শিষ্ট ছায়া সুনিবিড় যে ক্ষেত্র বোঝে বাস্তবে তা বড় রুক্ষ। শহরের মানুষের গ্রাম দর্শন, ক্ষেত্র সমীক্ষা যে নিছকই বিনোদন তা লেখক জানেন। এই দর্শন ওপরে ওপরে। শুধুই দেখা। গভীরে প্রবেশের চেষ্টা নেই, মানুষ বোঝার তাগিদ নেই। নাগরিক মানুষ গ্রাম দেখে কবিতা লেখে। প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করে কিন্তু দৈন্যতার কথা ভাবে না। আসলে সে বোধ নেই। পীযূষের বন্ধু কবিতা না লিখতে পারলে কাঁদে। পীযূষ সরে এসেছে সে বোধ থেকে। পীযূষ দীর্ঘদিন কিছু লেখেনি। যিনি একশ শতাংশ লেখক তার পক্ষে না লেখা কী সম্ভব ? সে যন্ত্রণা উপভোগ করতে পারেনি। ভেতরে কোন বোধের জন্ম হয়নি। লেখকও ব্যঙ্গ করেন –
‘’শহরে বসে যারা গ্রাম গ্রাম করে, গ্রামে আসে তারা গায়ে জ্যাকেট চড়িয়ে। স্টিকার মারা বিদেশী ধাঁচের সস্তা প্যান্ট পরে। গ্রামের লোকেরা তাদের উঁচু উঁচু নাকের কাছে ঘেঁষতে সাহস পায় না। এমনই বাবু ! মানুষকে না দেখে তারা দেখে প্রকৃতি। ডায়েরি খুলে নোট করে নিয়ে যায় গুচ্ছেক ফুল আর গাছের গ্রাম্য নাম। তারা ভোরবেলায় পাহাড়ী বাতাসকে উপভোগ করে। দেখে হাজারো কিসিমের বুনো পাখি।‘’( তদেব, পৃ. ৬৩ )
নলকূপ খনন শুরু হয়েছে। জল উঠতেও পারে আবার নাও পারে। জল না উঠলে নানা কৈফিয়ৎ দিয়ে বাবুরা ফিরে যায়। কিন্তু সেসব তথ্য যাচাই হয় না। অনুসন্ধান নেই। গ্রাম যা তাই থাকে। সুনীল এখানে এসে বাউরিদের সঙ্গে মিশে যেত। বাউরিদের কাছে কন্যা হল মহাজন। কন্যার বিবাহ মানেই পিতার নিস্তার। ভীমের কন্যার বিবাহ। কন্যার বিবাহের জন্য পিতাকে সর্বস্ব হারাতে হয় –‘’মহাজনের টাকা মেটাতে না পারলে টুঁটি চিপবেক, তেমনই বিটি ডাগর হল কি বিদায় কর। আর আজকালকার দিনে বুঝেছেনেই ত ? একটা বিটি উদ্ধার করা মুহের কথা ? সব্বসান্ত করে দিবেক।‘’( তদেব, পৃ. ৬৮ ) বিবাহও নিম্নবিত্ত পরিবারে। আসলে জীবনই নিম্নবিত্ত। অল্পতেই সুখ। বৃহৎ জীবন আকাঙ্ক্ষা নেই। জীবন এখানে ভয়ংকর। সুখ নেই। সুখের ইতিবৃত্ত নেই। সুখ সন্ধানের জন্য ছলচাতুরি নেই। জীবন প্রবাহমান। জন্ম-মৃত্যুকে মেনে নিয়েই এগিয়ে যায় বাউরিরা। নলকূপে জল উঠে আসাকে কেন্দ্র করে কাহিনি এগিয়ে যায়, ইতিহাস উঠে আসে। নলকূপ খননের ডিটেলিং এ লেখক যান। লেখক এসব গভীর ভাবে দেখেছেন, জেনেছেন। ডিটেলিং একজন লেখকের বড় গুণ, যা সৈকত রক্ষিত করেছেন। আসলে তিনি তো চান ডকুমেন্ট করতে।
গ্রাম মানেই বৃত্তিধারী মানুষের প্রাধান্য। এ গ্রামেও আছে। মাগরাম দড়ি পাকায়। দড়ি পাকানো যন্ত্রটির নাম ‘ঢ্যারা’। শহরের মানুষ এসবের নাম শোনেনি। গ্রামীণ জীবনবোধের সন্ধানে লেখক হেঁটে চলেন। জীবনের রন্ধ্রে প্রবেশ করে অন্ধকার গলিপথ আবিষ্কার করেন। জল ওঠার বদলে উঠে আসে পাথর। গঙ্গারাম ধীরে ধীরে মৃত্যুমুখে এলিয়ে পড়ে। এরজন্য দায়ী কে ? রাষ্ট্র না সাধারণ মানুষ ? গ্রামের আশেপাশে চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল নেই। মানুষ মৃত্যুকে ছেড়ে দেয় নিয়তির হাতে। কেউ প্রতিবাদ করেনি, প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি। এ জীবন পীযূষের হাতে কলম তুলে দিল। সাহিত্য নিছক বিনোদন নয়, তা অন্তরের প্রেরণা থেকে উঠে আসে। জনজীবনের গভীরে যে ক্ষত লুকিয়ে আছে তা লেখক মনে অনুরণন তোলে। এই জীবনই পীযূষকে দিয়ে লিখিয়ে নেয়-
‘’রাত্রে, সাতিসত্যিই পীযূষ একটা কবিতা লিখে ফেলে, ‘গঙ্গাধর, তোমার মৃত্যুর জন্য আমি দায়ী নই...
সে-রাত্রে ভালো করে ঘুম হল না পীযূষের। একটা সার্থক কবিতা লেখার উত্তেজনায়। সারারাত্তির তাকে তাড়া করে বেড়াল গঙ্গাধরের মৃতমুখ।‘’ (তদেব, পৃ. ৭৬ )
গঙ্গাধরের মৃত্যু পীযূষের সব চেতনাকে খুলে দেয়। সে সৌন্দর্যবোধের সন্ধান পায়। মৃত্যু তাঁকে এক অনন্ত শূন্যতায় যেমন নিয়ে যায় তেমনি জীবনবোধে উপনীত করে। জীবন বড় দুর্লভ। এখানে নয়ন খুলে হৃদয় দিয়ে সৌন্দর্য অনুভব করতে হয়। ধুলোমুঠি থেকে সৌন্দর্য উঠিয়ে আনতে হয়। সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে যায়। জল কোনভাবেই উঠে আসেনি। হতাশা দানা বাঁধে। এতদিন জল ছিল না, কোন প্রতিবাদও ছিল না। আজ সুযোগ এসেছে, এই সুযোগই যেন বাউরিদের চেতনাকে জাগিয়ে দেয়। আজ জল তাদের চাই-ই। শান্ত বাউরিরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। প্রতিবাদী সত্তা জেগে ওঠে। নিজেদের দাবি আদায় করে নিতে চায়। আজ মৃত্যু অপেক্ষা বাউরিদের জলের আকাঙ্ক্ষা বড় হয়ে উঠেছে। যে পীযূষ সারাজীবন সরকারের বিরোধীতা করে এসেছে সে আজ সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া পরিত্রাণের উপায় নেই। সব ভিত্তিহীন পরিকল্পনা। সার্ভে, ওয়াটার লেভেল দেখা হয়নি। ফলে জলের সন্ধান নেই। ১৫০ ফিট বোরিং হয়ে গেছে। পীযূষ আর সরকারি অর্থ অপচয় করতে রাজি নয়। কেননা সিস্টেমটাই ভুল। গোটা জেলায় ২৫০ এর বেশি নলকূপ ব্যর্থ হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনার অভাব। অথচ পীযূষ, অজয়দের কিছু করার নেই। এবার পালাতে হবে। ভিন্ন গ্রামেও জল না উঠলে পালাতে হয়েছে। মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে পালিয়েছে। এছাড়া পথ নেই। এঁরাও যেন প্রতারক হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া পরিত্রাণ নেই। প্রতিরোধে পীযূষ, অজয়দের বয়ান পাল্টে যায়। তারা হয়ে ওঠে সরকারি লোক। কথার সুর কেটে যায়। পীযূষের চোখের সামনে প্রান্তিক ভারতবর্ষের এক অস্পষ্ট চিত্র ফুটে ওঠে। সমস্ত রোমান্টিকতা কেটে যায় –
‘’ভীমের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে তাজ্জব বনে যায় পীযূষ। এ-কোন ভীম বাউরি ? এখানে প্রথম যার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছিল ? যাকে সে ভালোবেসেছিল ? ধমক দিয়েছিল ? কাছে ডেকেছিল একান্ত সহোদর করে ? কাঁধে হাত রেখেছিল ? যার আচারণ ভাবভঙ্গি কথা বার্তায় আচ্ছন্ন ছিল গ্রামীণ মেটো কাব্যের সৌরভ ?
পীযূষের হুড়হুড় করে মনে এসে যায় একগাদা নিরবচ্ছিন্ন স্মৃতি। লোকটার দিকে তাকিয়ে, চোখ সে সরিয়ে নিতে পারে না। নিজেকে গড়ে-পিঠে, সব স্বাতন্ত্র্য ধুয়ে-মুছে সে কেমন দলের মধ্যে ঢুকে গেছে।‘’ (তদেব, পৃ. ৮১ )
বাউরিদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে মাস্টার নিত্যানন্দ। খরাপ্রবণ এলাকা এটা বুঝতে চায় না বাউরিরা। গ্রামীণ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। একদিকে নিত্যানন্দ অন্যদিকে পীযূষ, অজয়। একদিকে নিত্যানন্দের জল তুলে আনার নির্দেশ, অন্যদিকে সরকারি আইন। পীযূষ সরকারের নানা গাফিলতি, আইনি জটিলতা ও প্রশ্ন উত্থাপন করে। যা জানা, বোঝা ভীমদের পক্ষে সম্ভব নয়। ভীমদের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায়। ক্ষণিক প্রত্যাশা ও প্রত্যাশার মৃত্যু ঘটে যায়। খরাপ্রবণ এলাকায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তিতে সরকারের কিচ্ছু এসে যায় না। সহজ সরল গ্রাম জীবন পাল্টে গেল। গ্রামে পুলিস এল। যে গ্রামে কোনদিন পুলিশ আসেনি, মানুষের বিন্দুমাত্র উপকারে পুলিস লাগেনি অথচ জলের দাবিতে পুলিস এল। সরকারি কর্মচরী ও সম্পত্তি রক্ষা করতে পুলিস আসা স্বাভাবিক, কিন্তু লেখক তা সমর্থন করেননি –‘’পুলিশের নামে আরো মরিয়া হয়ে উঠল গ্রামের লোক। পিপাসাপীড়িত একটা গ্রামের মানুষ জলের দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে, সেখানে দাবির মোকাবিলা হবে পুলিস দিয়ে ? এ কেমন দেশ ? কেমন গরমেন্ট ? জল দিতে পারে না, গ্রামের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ ?’’(তদেব, পৃ. ৮৫ ) বাউরিরা আজ পুলিসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। একটি সমাজের আত্মজাগরণ ঘটে যাচ্ছে। বাউরিরা নিজেদের অধিকার আদায়ে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছে। রাষ্ট্রের চোখ রাঙানির কাছে হয়ত হেরেছে কিন্তু প্রতিবাদ করেছে। আপাত ভাবে হুট করে লেখক উপন্যাস শেষ করেন। ছাতাডাঙার সঙ্গে আশেপাশের গ্রামগুলিও জেগে উঠেছে। নিজেদের দাবি আদায়ের প্রশ্ন তুলেছে। সে দাবি মুছে দিচ্ছে পুলিস, বাউরি সমাজে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। সে পরিবর্তন চিহ্নিত করে চলেন লেখক।
রাষ্ট্র মানুষ ধ্বংসের কল আবিষ্কার করে। সে কলে জল ওঠে না। উঠে আসে নোনাবালি। পুরুলিয়া খরাপ্রবণ এলাকা, অথচ কোন বিকল্প ব্যবস্থা করা হল না সাধারণ মানুষগুলিকে বাঁচাতে। নমঃ নমঃ করে সরকার নিজের দায় সেরে পার্লামেন্টে আওয়াজ তোলেন। হারিয়ে যায় গঙ্গারাম, রাধারানিরা। এই গঙ্গারামদের জন্য রাষ্ট্রের কোন শোক নেই, বরং আনন্দ আছে। কিন্তু লেখকের গভীর মায়া। এক গভীর জীবনদর্শন ও আত্মবোধ থেকে ভীমদের কথা লিখে চলেন। পুরুলিয়ার প্রান্ত অঞ্চলকে দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে চান। যদি ভীমদের কোন উন্নতি হয়। আত্মভোলা মুখগুলির দিকে চেয়ে কলম তুলে নেন। রাষ্ট্রের অবহেলার সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে সচেতন করে তোলেন।
বাউরিদের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছে মাস্টার নিত্যানন্দ। খরাপ্রবণ এলাকা এটা বুঝতে চায় না বাউরিরা। গ্রামীণ প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। একদিকে নিত্যানন্দ অন্যদিকে পীযূষ, অজয়। একদিকে নিত্যানন্দের জল তুলে আনার নির্দেশ, অন্যদিকে সরকারি আইন। পীযূষ সরকারের নানা গাফিলতি, আইনি জটিলতা ও প্রশ্ন উত্থাপন করে। যা জানা, বোঝা ভীমদের পক্ষে সম্ভব নয়। ভীমদের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায়। ক্ষণিক প্রত্যাশা ও প্রত্যাশার মৃত্যু ঘটে যায়। খরাপ্রবণ এলাকায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তিতে সরকারের কিচ্ছু এসে যায় না। সহজ সরল গ্রাম জীবন পাল্টে গেল। গ্রামে পুলিস এল। যে গ্রামে কোনদিন পুলিশ আসেনি, মানুষের বিন্দুমাত্র উপকারে পুলিস লাগেনি অথচ জলের দাবিতে পুলিস এল। সরকারি কর্মচরী ও সম্পত্তি রক্ষা করতে পুলিস আসা স্বাভাবিক, কিন্তু লেখক তা সমর্থন করেননি –‘’পুলিশের নামে আরো মরিয়া হয়ে উঠল গ্রামের লোক। পিপাসাপীড়িত একটা গ্রামের মানুষ জলের দাবি নিয়ে সোচ্চার হয়েছে, সেখানে দাবির মোকাবিলা হবে পুলিস দিয়ে ? এ কেমন দেশ ? কেমন গরমেন্ট ? জল দিতে পারে না, গ্রামের ভেতর ঢুকিয়ে দেয় পুলিশ ?’’(তদেব, পৃ. ৮৫ ) বাউরিরা আজ পুলিসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। একটি সমাজের আত্মজাগরণ ঘটে যাচ্ছে। বাউরিরা নিজেদের অধিকার আদায়ে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছে। রাষ্ট্রের চোখ রাঙানির কাছে হয়ত হেরেছে কিন্তু প্রতিবাদ করেছে। আপাত ভাবে হুট করে লেখক উপন্যাস শেষ করেন। ছাতাডাঙার সঙ্গে আশেপাশের গ্রামগুলিও জেগে উঠেছে। নিজেদের দাবি আদায়ের প্রশ্ন তুলেছে। সে দাবি মুছে দিচ্ছে পুলিস, বাউরি সমাজে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। সে পরিবর্তন চিহ্নিত করে চলেন লেখক।
রাষ্ট্র মানুষ ধ্বংসের কল আবিষ্কার করে। সে কলে জল ওঠে না। উঠে আসে নোনাবালি। পুরুলিয়া খরাপ্রবণ এলাকা, অথচ কোন বিকল্প ব্যবস্থা করা হল না সাধারণ মানুষগুলিকে বাঁচাতে। নমঃ নমঃ করে সরকার নিজের দায় সেরে পার্লামেন্টে আওয়াজ তোলেন। হারিয়ে যায় গঙ্গারাম, রাধারানিরা। এই গঙ্গারামদের জন্য রাষ্ট্রের কোন শোক নেই, বরং আনন্দ আছে। কিন্তু লেখকের গভীর মায়া। এক গভীর জীবনদর্শন ও আত্মবোধ থেকে ভীমদের কথা লিখে চলেন। পুরুলিয়ার প্রান্ত অঞ্চলকে দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিতে চান। যদি ভীমদের কোন উন্নতি হয়। আত্মভোলা মুখগুলির দিকে চেয়ে কলম তুলে নেন। রাষ্ট্রের অবহেলার সঙ্গে প্রান্তিক মানুষের অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বরকে সচেতন করে তোলেন।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন