বিষয়টি বিতর্কিত কিন্তু অকারণে। শুধু শুধু খুব সাধারণ একটি বিষয়কে যুগে যুগে আলোচনা, পর্যালোচনার মধ্যে দিয়ে জটিল করে তোলা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আমরা কমবেশি সবাই দায়ী এর জন্য। আমিও। এই যে সবকিছু ছেড়ে এই বিষয়টিই বেছে নিয়েছি লেখার জন্য। আসলে বিতর্কে জড়াতে আমাদের ভালো না লাগলেও বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে আমাদের বেশ ভালো লাগে।অনেকটা যেমন ঝগড়া করতে যত ভালো লাগে তার চেয়েও বেশি ভালো লাগে ঝগড়া দেখতে।
যাইহোক আমার আজকের আলোচ্য বিষয়বস্তুটি হল পোশাক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। জানি নারীর পোশাক নিয়ে আছে ঝুড়ি ঝুড়ি বিধান আর ফরমান। পুরুষদের পোশাক নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই কারণ পুরুষরাই তো সমাজের মাথা, আদিকাল থেকে। তাই তাদের পোশাক নিয়ে আবার কীসের কথা! বরং তারাই ঠিক করে দেবে নারীর পোশাক কী হবে, কেমন হবে। খুব একপেশে শুনতে লাগছে, তাই না? মনে হচ্ছে এই আলোচনায় নারী-পুরুষের মধ্যে একটি 'স্থুল' তুলনা টেনে, 'আমরা নারী, আমরা সব পারি' স্লোগান তুলতে চাইছি, তাই তো?
নাহ! আমার এই লেখাটির মূলে কোনো তথাকথিত 'নারীবাদী' অভিসন্ধি নেই, নেই 'ওরা-আমরা' তত্ত্বের অযথা অবতারণা। আমি পোশাক নিয়ে বলছি, লিঙ্গ- বৈষম্য নিয়ে নয়। আমার শুধু চেষ্টা কয়েকটি সহজ উত্তর খোঁজার, তদুপরি সহজ প্রশ্নের।
প্রথম প্রশ্ন - পোশাক কী?
খুব সাধারণ ভাবে বলতে গেলে পোশাক হল শরীর ঢাকার একটি আবরণ।
দ্বিতীয় প্রশ্ন- শরীর ঢাকার প্রয়োজন কী?
এই প্রসঙ্গে CBSE বোর্ডের তৃতীয় শ্রেণির পরিবেশ বিদ্যার ( Environmental Science) বইটির কথা উল্লেখ করব, যেখানে Clothes & House নামক চ্যাপ্টারে খুব সহজ শব্দে বলা আছে আমরা পোশাক পরি রোদ, জল, তাপ, শীত, ধূলো, বালি ইত্যাদি থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য। কোথাও কিন্তু লজ্জা নিবারণের কথা বলা নেই বা সুন্দর দেখতে লাগার বিষয়টিও নেই।
তাহলে কি ধরে নেবো যে পোশাক পরার সাথে লাজুক বা নির্লজ্জ, সুন্দর বা অসুন্দর কোনটাই হবার কোনো সম্পর্ক নেই? এটিই আমার তৃতীয় প্রশ্ন। উত্তর তাহলে কী হবে? উত্তর হল পরিবেশ বিদ্যার পাঠ্য পুস্তকে পরিবেশের (আবহাওয়া ও জলবায়ূ ভিত্তিক)সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য যেটুকু বলার প্রয়োজন ছিল সেইটুকুই বলা আছে। কিন্তু এটি বাদ দিলে সমাজ-বিদ্যা বলেও তো একটি বিদ্যা আছে। আর সমাজ বিদ্যার কাজ হল আমাদের সামাজিক করা। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের উক্তিটি মনে পড়ে যায়।উনি বলেছেন, "Man is, by nature, a social animal, আমরা মানুষেরা, স্বভাবগতভাবেই সামাজিক জীব।
আর তাই আমরা যখন সামাজিক জীব, তখন সমাজে প্রচলিত কিছু মার্জিনের মধ্যে আমাদের থাকতে হয়। কেউ চাইলে থাকতে নাই পারেন, পরিণামে কী হবে সে সব অন্য কথা। এখন এই সমাজেরও আবার রকমফের আছে, ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি মাপদণ্ডের উপর দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ বলা যেতেই পারে পোশাকও স্থানকালপাত্র অনুযায়ী পোশাক বদলায়। সমুদ্রে বা সুইমিং পুলে স্নান করতে হলে যা পরা যায় তা মন্দিরে নয়, আবার মন্দিরে যা পরা যায় তা সমুদ্র সৈকতে? হাস্যকর! অন্যদিকে যে বারমুডাটি মোটরসাইকেলে চেপে দিব্যি সবজি-ফলের বাজারে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সেই বারমুডাটি পুরোপুরি বেখাপ্পা লাগে ছেলে বা মেয়েকে মোটরসাইকেলে চাপিয়ে তার স্কুলের গেটে ছাড়তে গেলে।
ওহ! ভুলে গিয়েছিলাম পুরুষদের পোশাক নিয়ে তো বাদ-বিচার হয় না। কারণ পুরুষদের শরীর উন্মুক্ত হলে সমাজ বিপথগামী হয় না। পুরুষ তাই লোমশ উরু, খোলা ছাতি আর ঝোলা ভুঁড়ি দেখিয়ে বেড়াতেই পারেন। এমনকি খাঁজও ( cleavage) দেখাতে পারেন, ব্র্যাণ্ডেড অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপনসহ। কিন্তু নারীরা দেখালেই গেল গেল রব। কিন্তু কেন? নাহ! এটা আমার প্রশ্ন নয়, উল্টে আমার প্রশ্ন হল - কেন নয়? হ্যাঁ আমার চতুর্থ প্রশ্ন হল খাঁজ দেখানোর সত্যিই কি খুব প্রয়োজন আছে? অবশ্যই নারী পুরুষ নির্বিশেষে বলছি। Show Business বলে একটা জীবিকা আছে সেটা বাদ দিলে আর কোথাও কি খুব জরুরি খাঁজ show করার?
এইভাবেই বলা যায় প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা (যেগুলি জীবনের প্রাথমিক চাহিদা) সম্বলিত জনগণের মাঝে যেমন সাজে ঘোরা যায়, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে অভুক্ত-অর্ধশিক্ষিত -অর্ধনগ্ন জনগণের মাঝে সেই সাজে ঘুরে বেড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত? প্রশ্ন জাগে। যতই হোক স্থানীয় আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের সাথে পোশাকের নিবিড় সম্পর্ক আছে। কারণ পোশাক আমাদের ব্যক্তিত্ব বহন করে আর ব্যক্তি-সমূহের ব্যক্তিত্ব বহন করে সমাজের চালচিত্র।
জানি অতি-গণতান্ত্রিক আদর্শে বলীয়ান হয়ে কেউ উত্তর দিতেই পারেন, 'আমার শরীর, আমার স্বাধীনতা, যাকে বলে ব্যক্তি স্বাধীনতা। আর পোশাক নিয়ে অযথা কথা বলা মানে সেই ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা। আমরা কে কী খাবো সেটা কি কেউ বলে দিতে পারে! আমার মুখে যা রুচি হবে আমি তাই খাব। তেমনি আমরা কে কী পরবো সেটাও কেউ বলে দিতে পারে না। আমার রুচিতে যা ভালো লাগবে তাই পরবো।'
এবার এই উত্তরের ভিত্তিতে উত্তর দিই? আমরা যে খাদ্যটি খাচ্ছি তার প্রভাব শুধু আমাদের স্বাস্থ্যের উপরেই বর্তায়, তা সে ভালো হোক কী মন্দ। আমার ভালো স্বাস্থ্য বা মন্দ স্বাস্থ্যের সাথে সমাজের সরাসরি কোন যোগ সূত্র নেই। একেবারেই নেই বললে ভুল হবে। কারণ ব্যক্তির সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে সমাজের তথা দেশের সুস্বাস্থ্য। যাইহোক ঠিক তেমনি ভাবেই আমি কী পোশাক পরছি তার একটা ভালো-মন্দ প্রভাব সমাজের উপর পড়ে বৈকি!
এই প্রসঙ্গে আরও বলি, খাদ্য এবং খাদ্য পদ্ধতিও যেমন ইচ্ছা তেমন হতে পারে না। কারণ তা না হলে ইংরেজিতে Table Manners শব্দ দুটোর গুরুত্ব থাকতো না। লোকালয় অর্থাৎ সামাজিক স্তরে কী খাচ্ছি এবং কেমন ভাবে খাচ্ছি সেটা অবশ্যই বিচার্য। তাহলে ঠিক সেই রকম ভাবেই লোকালয় অর্থাৎ সামাজিক স্তরে কী পরছি এবং কেমন ভাবে পরছি সেটাও বিচার্য হবে বৈকি! ধরুন কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে খাবার টেবিলে আপনার সামনে বসে থাকা অপরিচিত ব্যক্তি এমনভাবে মাংস খাচ্ছেন যেন তিনি কোন মাংসাশী পশু। ভালো লাগে? লাগে না। সমালোচনা করি না? করি। তখন কেন ভাবি না এটা তার পেট, তার খাদ্য, আর এই নিয়ে কথা বলা তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা?
সুতরাং বোধহয় এটা ভুল বলা হবে না যদি বলা হয়, যে আমরা বলতে পারি না আমার শরীর আমার পোশাক অন্যের মন্তব্য নিপাত যাক! আমি যেমন কোনো পোশাক পরে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতে চাইবো তেমনি আমার সামনের মানুষজনও যেন সেই স্বাচ্ছন্দ্যই অনুভব করতে পারেন আমায় দেখে, সেটা বোধহয় একটা ভাববার বিষয়। যেখানে চামড়া প্রদর্শন কেবলমাত্র প্রদর্শন হয়ে ওঠে সেখানেই প্রশ্ন ওঠে।কিন্তু যেখানে চামড়া প্রদর্শন কোন প্রদর্শন নয় সেখানে কোন প্রশ্নও ওঠে না।
আমরা বোধহয় এই জায়গাটাই বুঝে উঠতে পারি না। আর না বুঝেই যা খুশি পরি আর যা খুশি বলি। যেখানে দেশীয় ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আমরা দায়বদ্ধ সেখানে সেটাই করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে কাজের সুবিধার্থে বা সাচ্ছন্দ্যের তাগিদে কেউ যদি বিদেশীয় পোশাক পরেন, পরুক না। শালীনতা বজায় রেখে পরুক। অসুবিধা কোথায়? কিন্তু এর মানে এই নয় যে যিনি আজীবন, সর্বত্র দেশীয় পোশাক পরেন বা পরেছেন তিনিই একমাত্র দেশপ্রেমী, অন্যেরা নন।
গত কয়েকদিন ধরে একটি ছবি আমাদের সকলের চোখের সামনে ঘোরাফেরা করছে। কয়েকজন স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক মহিলা দেশীয় পোশাক পরে এক সারিতে বসে আছেন। ছবিটি যিনি তুলেছিলেন তিনি কী উদ্দেশ্যে তুলেছিলেন জানি না। কিন্তু যাঁরা ছবিটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁদের মধ্যে কিছু জনের উদ্দেশ্য হলো এইটা প্রমাণ করার, যে অতি বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া সত্ত্বেও এই কৃতী মহিলারা কেমন দেখুন ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছেন।
এই ব্যাখ্যাটায় সামান্য আপত্তি আছে। বিজ্ঞানমনস্কতার সঙ্গে ঐতিহ্য বহন করার কোন সম্পর্ক নেই। উচ্চশিক্ষার সঙ্গেও পোশাকের কোন সম্পর্ক নেই। পোশাকই হোক বা আদব-কায়দা হোক বা চিন্তাভাবনা হোক, এসব কিছুর সাথে সম্পর্ক আছে সুশিক্ষার। যিনি সুশিক্ষিত তিনি জানেন কোথায় কী পরতে হয় এবং কীভাবে পরতে হয়। কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে বিজ্ঞানমনস্ক মহিলা বা পুরুষ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরছেন মানেই তিনি শ্রদ্ধেয়, আর যিনি পরেন না তিনি শ্রদ্ধেয় নন তা বলা ঠিক নয়। সেখানে কেউ যদি পাশ্চাত্য পোশাক পরে কাজ করেন তিনিও সমান ভাবে সুশিক্ষিত এবং সু রুচি সম্পন্ন হবার দাবীদার। কারণ বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার বাধ্যতামূলকভাবে ঐতিহ্য প্রদর্শনের জায়গা নয়, বরং ইতিহাস গড়ার জায়গা।
তবে হ্যাঁ ছবিটির ব্যাখ্যা যদি এটা হয় যে, 'দেখুন এঁনারা কীভাবে কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ ও শালীন জীবনশৈলীর মধ্যে দিয়ে আজ সাফল্যের চূড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন' তাহলে তা অবশ্যই উৎসাহ দেয়। কারণ কঠোর পরিশ্রমের সাথে সাথে শৃঙ্খলা, সংযম এবং শালীনতা, এগুলি প্রত্যেকটি অত্যন্ত আবশ্যক উপাদান, সাফল্য এবং প্রতিষ্ঠার জন্য। একইভাবে দেশীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা, অন্যের নিকট হতে শ্রদ্ধা অর্জনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি।
বক্তব্য শেষ করব সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উক্তিটি দিয়ে, "বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে"। এই আলোচনায় উক্তিটির প্রাসঙ্গিকতা হল যে, যে পোশাক যেখানে সমীচীন সেখানে সেই পোশাকই সুন্দর। এখন জানি প্রশ্ন উঠবে, কোন পোশাক কোথায় সমীচীন সেটা কে বলে দেবে বা সেটা কেউ বলে দিতেই বা পারে কী করে? উত্তর হল ওই যে বলেছিলাম সমাজ বিদ্যা বলে একটি বিদ্যা আছে।আর তার কিছু অনুশাসন আছে, যাকে আমরা প্রায়শই শাসন বলে ভুল করি। আর তখনই স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে স্বৈরাচারী হয়ে উঠি। শেষ করার আগে বলি, আমরা সামাজিক জীব, সামাজিক জন্তু নই।
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন