তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় | খুঁজে বেড়াই


এক এক সময় মনে হয় কিছু একটা যেন জীবন থেকে খুব দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। খুব মূল্যবান কিছু। অথচ সেটার সন্ধান আমরা তেমন করে কেউ করছি কিনা জানিনা। প্রতিদিনের জীবন যাপনের পরতে পরতে যা জড়িয়ে থাকে, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে যত মানুষকে আর তার সম্পর্ক গুলোকে, নিরবচ্ছিন্ন ধারায় বয়ে যেতে দেয় অস্থির সময়কে, সেরকমই কিছু। যাকে শুধু একটা নির্দিষ্ট কোন নামে হয়তো সম্পূর্ণ চেনা যায়না। সেটা একটা বোধ। অন্যের প্রতি ভরসা, বিশ্বাস, ভালোবাসা আর দ্বিধাহীন সততা মিশ্রিত একটা অনুভব।

এই বোধটাই মানুষকে বেঁধে রাখতে পারে এক অদৃশ্য​সুতোর​ ​ বন্ধনে। যাতে আমরা হয়ে উঠতে পারি সামাজিক জীব। ভালো প্রতিবেশী। ​ একা একা কেউ কখনোই সম্পূর্ণ নয়। তাই একক মানুষের যতটুকু ঘাটতি তা পূরণ করতে প্রয়োজন হয় অন্যের সহযোগিতা। নির্ভর করতে হয় সেই অন্য আরও অনেকের উপরেই। এইটিই সামাজিক বিধান। তাতে যেমন ভারসাম্য রক্ষা হয় তেমনি পারস্পরিক ভরসার জায়গাটিও পোক্ত হয়ে ওঠে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক মজবুত হয় যা আসলে সুস্থ সমাজের প্রাথমিক শর্ত।

কিন্তু এর সুযোগ নিয়ে অনেক সময়েই কিছু মানুষ তাদের অসততা আর দুর্বুদ্ধির ফলে এমন কিছু করে বসে যে সেই জায়গাটা ভেঙ্গে পড়তে চায়। ​ যত এরকম ঘটতে থাকে তত বিশ্বাসে ভাঙ্গন ধরে। ​ বড় অসহায় মনে হয় তখন। 

মেয়ের বিয়ে বলে বা পরিবারের কারও চিকিৎসার কথা বলে সাহায্য চাইতে আসা কোনও আপাত দরিদ্র মানুষকেও তখন যেন অবিশ্বাস করতে শুরু করি। ​ এভাবে কারও কারও বিশ্বাস ভঙ্গের ফল ভুগতে হয় আরও অনেককে।

এটা একটা দিক। আর একটা দিকে যা প্রভাব পড়ে তা আরও মারাত্মক। কিছু কিছু অঘটন চিন্তা ভাবনার ভিত এমন নাড়িয়ে দিয়ে যায় যে তখন সবকিছুকে আবার নতুন করে বিবেচনা করতে হয়। তখন কোনও মহিলা কর্মী যদি অফিসের গাড়িতে একটু বেশি রাত্রে বা ভোর রাত্রে বাড়ি ফেরে, তার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হতে হয়। অনেক সময় ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে শুধু মাত্র একজন পুরুষ ড্রাইভারের ভরসায় কোন মহিলা যাত্রীকে রাত্রে একা ছাড়া যাবেনা এরকম একটা নিয়ম তৈরি হয়ে যায়। ​ হয়তো নিরাপত্তার স্বার্থে কখনও কখনও এধরনের কিছু ব্যবস্থা নিতেই হয়। কিন্তু এগুলোই যদি স্থায়ী সত্য হয়ে ওঠে, ভরসার জায়গাটা যদি এতটাই আলগা হয়ে যায়, তা যে একেবারেই সুস্থ সুন্দর সমাজের নিদর্শন নয় তা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকেনা। এরকম অবস্থায় পুরুষ ড্রাইভারকে বিশ্বাস করতে না পারা মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। কাম্য তো নয়ই। কেননা সেক্ষেত্রে শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার জন্য বাকি সবাইকেই অহেতুক ভাবে সম্ভাব্য অপরাধী ভেবে নেওয়া হয়। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। আরও অনেক ক্ষেত্রে এধরনের মনোভাব আসতে পারে। কিন্তু আবারও বলি, এরকম হওয়া একেবারেই কাম্য নয়।

এর বাইরেও সমাজের বৃহত্তর পরিমণ্ডলে আরও কত কিছু অবিরাম ঘটে চলে। বঞ্চনা, প্রতারণা, অনর্থক ​ রাজনৈতিক হিংসার শিকার হয়ে যাওয়া, এগুলোও তো কত ঘটছে প্রায় প্রতিদিন। আর আছে লাগামছাড়া দুর্নীতি, লোভ আর মিথ্যাচারের বলয়গ্রাস।​ কখনো কখনও এমনই একটা আবহ তৈরি হয়ে যায় যে মনে হয় মানুষ যেন খুব সস্তা আর হেয় করার যোগ্য হয়ে গেছে।

এইসব ভাবনাগুলো মাঝেমাঝে মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। খুব ক্লান্ত করে দেয়। যদিও পরক্ষণেই ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করি। কখনও বা কোনও কারণ ছাড়াই পায়ে হেঁটে শহর ঘুরতে বেরই। কখনও বড় রাস্তায় অনেকটা হেঁটে যাই। কখনও ঢুকে পড়ি একটা সরু গলিতে। কত কী-ই তো অদেখা থেকে গেছে। ঘুরতে ঘুরতে অনেক কিছু চোখে পড়ে যায়। কোথাও থমকে থাকা ইতিহাস, কোথাও চলমান উচ্ছল জীবনস্রোত। কোথাও অঢেল প্রাচুর্য, কোথাও চূড়ান্ত দারিদ্র। কেউ যেন কাউকে চেনেনা। এক একটা আলাদা আলাদা দ্বীপের মধ্যে যেন সবাই বসবাস করছে। সেখানে​কে কার জন্য কতটুকু ভাবে এই প্রশ্ন অবান্তর হয়ে ওঠে।

তখন মনে এসে যায় আর একটা প্রশ্ন। সভ্যতা তো অনেক কিছু শেখায়। আধুনিক হওয়া শেখায়, যুগোপযোগী হওয়া শেখায়। ভালো মানুষ হওয়া শেখায়না? ​ সহনাগরিকের কথা ভাবতে শেখায়না? উত্তর জানা নেই। ​ ​ তবু মন বলে ওঠে, পুড়ে খাঁটি সোনা হওয়ার জন্য​ আগুনের উপর ভরসা রাখতে হয়।

বুঝতে পারি অনেক কিছুর সজ্ঞা বদলে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে প্রতিযোগিতার নতুন নতুন ক্ষেত্র। তাই নতুন নতুন প্রত্যাশাও। বদলে যাচ্ছে অনেক শব্দের মানে। সৌজন্য, সম্মান, ভালোবাসা, সম্পর্ক, শ্রদ্ধা, মূল্যবোধ এইসব গুলোকে যেন আর সেরকম গুরুত্বপূর্ণ না ভাবলেও চলে। কী কথায় কার মনে কতটুকু কষ্ট হলো, সেদিকে ফিরে দেখার সময় নেই কারও।

তবু শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস রাখতে চাই। জীবন এক চলমান স্রোত। সেখানে ভালো আর সুন্দর যেমন থাকবে, তার পাশাপাশি হয়তো জেগে উঠতে চাইবে অবক্ষয়ের অসহিষ্ণুতার অসুন্দরের নতুন নতুন চর। কিন্তু সেগুলোই শেষ কথা নয়। শেষ কথা বলবে যা দিয়ে শুরু করেছি সেই ভরসা, বিশ্বাস আর ভালবাসা। সম্পর্কের বন্ধন। যেখানে প্রতিবেশীর জন্য হাতে দুদণ্ড সময় থাকবে। এখন সেই বন্ধনটাকে খুঁজে বেড়াই। পাড়াগাঁয়ে, নগর জীবনে, অন্য অনেক জায়গাতে। মানুষের মধ্যে। হয়তো ঠিক খুঁজে পাবো।
 ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ ​ 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ