কলকাতা বইমেলা দুদিন আগে আরম্ভ হয়েছে। তন্দ্রা খবর নিয়েছে, মেঘমিত্রা রায় আজ বাদল প্রকাশনার স্টলে আসবেন। ও ঠিক করেছে মেলায় গিয়ে প্রথমেই বাদল প্রকাশনার স্টলে যাবে, মেঘমিত্রা রায়ের নতুন উপন্যাসের বই কিনবে, তারপর ওঁর সাক্ষর সংগ্রহ করবে। কিন্তু মেলায় গিয়ে তন্দ্রার মনটা দমে গেল। যেমনটা ভেবে গিয়েছিল, তত সহজে সবকিছু হওয়া অসম্ভব। অনেক বছর মেলায় আসা হয়নি, তাই প্রাথমিক ভীড়ের ধাক্কাতেই সবকিছু গুলিয়ে গেছে। নির্ধারিত প্যাভেলিয়ানের বাইরে বিরাট লাইন। এই লম্বা লাইন কাউন্টারে কখন পৌঁছাবে বলা মুশকিল, লেখিকার সাক্ষর তো অনেক পরের কথা। তবুও আশায় বুক বেঁধে সে দাঁড়িয়ে পড়ল লাইনে। পেমেন্ট হয়ে যাওয়ার পরে বইয়ের প্যাকেটকেও কাউন্টারের টেবিলে লাইন দিতে হচ্ছে। একজন প্রতিনিধি প্রত্যেকের কাছে নাম-ধাম জেনে নিচ্ছে ও লেখিকাকে সাহায্য করছে। কিছুক্ষণ পরে ঘোষণা করা হল, মেঘমিত্রা রায় মেলার ভীড়ে অসুস্থ বোধ করছেন। তিনি আর মাত্র আধঘণ্টা থাকবেন এবং তার মধ্যে যতগুলো বই সাক্ষর করা সম্ভব, তাইই করবেন। ঘোষণার ফলাফল হল মারাত্মক। হঠাৎ ভীড়ের মধ্যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দিল। প্রত্যেকেই প্রত্যেককে ঠেলে আগে যেতে চায়। কর্তৃপক্ষ সামনের কোলাপসিবল গেটে তালা লাগিয়ে দিলেন। বাইরে ততক্ষণে উত্তেজিত জনতা সামাল দিতে পুলিশ লাঠিচার্জ আরম্ভ করে দিয়েছে। তন্দ্রা এসব ভীড়ভাট্টা থেকে বহুদিন তফাতে আছে। ভয়ে তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। সে ভীড় থেকে আলগোছে সরে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভাবল, আর সই-এ কাজ নেই। বইই ভাল। হঠাৎ চোখে পড়ল, পিছনের গেট দিয়ে মেঘমিত্রা রায়কে বের করে ভিআইপি গ্যালারিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তন্দ্রার ভিতরে একটা ছোট্ট আশা জেগে উঠল। ও মানিব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরল বুকের মধ্যে। এর মধ্যে স্পেশাল পাস আছে। ডঃ বরুয়া তন্দ্রাকে খুবই স্নেহ করেন। ও বইমেলা যাবে শুনে নিজের পাসটা ওকে দিয়েছিলেন। তন্দ্রা সেটা ভুলেই গিয়েছিল। লাজুক তন্দ্রা একবার শেষ চেষ্টা করতে ভীরু পায়ে গ্যালারির দিকে গেল।
গ্যালারি প্রায় ফাঁকা। মেঘমিত্রা রায় একটা গদিওলা চেয়ারে বসে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছেন। তন্দ্রা ইতস্তত করে ভিতরে ঢুকল। ঢোকার মুখে একজন ভলান্টিয়ার দাঁড়িয়েছিল। পাস দেখাতে জিজ্ঞেস করল, “কার সঙ্গে দেখা করবেন?” “মেঘমিত্রা রায়” শুনে বলল, “ওই তো ম্যাডাম বসে আছেন, যান। কিন্তু ওনাকে বেশি বিরক্ত করবেন না।” তন্দ্রা কাছে গিয়ে লাজুক ভাবে বই এগিয়ে দিয়ে বলল, “ম্যাডাম, একটা সই করে দেবেন?” মেঘমিত্রা মুখ তুলে তন্দ্রার দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন, “এটা তো পুরনো বই!”
“হ্যাঁ, মানে ভীড়ের জন্য নতুন বই কিনতে পারিনি। এটা ব্যাগে ছিল, তাই...”
“আপনি প্লিজ বাইরে যান।”
“ম্যাডাম আমি আপনার লেখার ভক্ত অনেকদিন ধরে। ডিউটি অফ করে অনেক কষ্টে আজকে আসতে পেরেছি শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করব বলে...”
“দেখুন আমি অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলি না। ভিআইপি গ্যালারিতে তারাই আসে দেখা করতে, যাদের আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। আপনাকে আমি চিনি না। এখানে ঢুকলেন কী করে? যান বাইরে যান, প্লিজ আমাকে বিরক্ত করবেন না।”
ওর উষ্মা মিশ্রিত উচ্চ স্বরে সিকিওরিটি ছুটে এল। তন্দ্রাকে সে পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়েই বের করে দেয়। বেরিয়ে যেতে যেতে তন্দ্রা শুনতে পেল, তার প্রিয় লেখিকা বলছেন, “কোত্থেকে আসে এরা? কী চেহারা দেখেছ? নির্ঘাত মেলায় চুরির মতলবে এসেছে। ব্যাগে একটা বইও রয়েছে দেখলাম। যাকে তাকে আর আমার কাছে পাঠিয়ে দিও না।”
তন্দ্রার কান দুটো জ্বালা করছে। মেলার গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে ঠাণ্ডা হাওয়ায় অনেকটা ভাল লাগছে। তার নিজের অসুন্দর চেহারার কথা সে ভুলতে বসেছিল। আজ অনেক বছর পর সেই কবেকার তাকে দেখতে আসা পাত্রপক্ষের কুঁচকানো ভ্রু ও মায়ের আক্ষেপ আবারও মনে পড়ে গেল। বিয়ে হয়নি তন্দ্রার। তবে নার্সিং ট্রেনিং করে এখন কলকাতার এক নামকরা হাসপাতালের অভিজ্ঞ নার্স তন্দ্রা সেন খুব ভালই আছে। “নাহ্, আর কোনদিন বইমেলায় আসব না”, মনে মনে ভাবে তন্দ্রা, লাইব্রেরিই ভাল। আর ভাল লিখলেই যে সে সুন্দর মনের মানুষ হয় না, এটাও আজ অনুভব করল। মেঘমিত্রা রায় তার স্বপ্নের জগতে রানী হয়েই তো বেশ ছিল, কেন যে তাকে বাস্তবে দেখতে চাইল? খুব আফসোস হচ্ছে তন্দ্রার। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে সে বাড়ির বাস ধরল।
পরদিন হাসপাতালে পৌঁছে সবে অ্যাপ্রন গায়ে গলিয়েছে, কেকা ছুটে এল। “ডঃ বোস তোমাকে এক্ষুণি যেতে বলেছেন। জানো, কাল অনেক রাত্রে একটা অ্যাক্সিডেন্ট কেসের পেশেন্ট এডমিটেড হয়েছে। খুব বড় সাহিত্যিক নাকি। ওই যে গো, তুমি যার লেখা পড়তে ভালবাস?”
“কি বলছিস? মেঘমিত্রা রায়?”
“হ্যাঁ, উনিই। গতকাল মেলা থেকে ফেরবার সময় নাকি ওঁর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। খুব সিরিয়াস, জানো? বাঁচবে কি না সন্দেহ। মুখটা এমন বিকৃত হয়ে গেছে, বেঁচে থাকলেও আর কেউ হয়তো চিনতে পারবে না!”
“হ্যাঁ, মানে ভীড়ের জন্য নতুন বই কিনতে পারিনি। এটা ব্যাগে ছিল, তাই...”
“আপনি প্লিজ বাইরে যান।”
“ম্যাডাম আমি আপনার লেখার ভক্ত অনেকদিন ধরে। ডিউটি অফ করে অনেক কষ্টে আজকে আসতে পেরেছি শুধু আপনার সঙ্গে দেখা করব বলে...”
“দেখুন আমি অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলি না। ভিআইপি গ্যালারিতে তারাই আসে দেখা করতে, যাদের আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি। আপনাকে আমি চিনি না। এখানে ঢুকলেন কী করে? যান বাইরে যান, প্লিজ আমাকে বিরক্ত করবেন না।”
ওর উষ্মা মিশ্রিত উচ্চ স্বরে সিকিওরিটি ছুটে এল। তন্দ্রাকে সে পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়েই বের করে দেয়। বেরিয়ে যেতে যেতে তন্দ্রা শুনতে পেল, তার প্রিয় লেখিকা বলছেন, “কোত্থেকে আসে এরা? কী চেহারা দেখেছ? নির্ঘাত মেলায় চুরির মতলবে এসেছে। ব্যাগে একটা বইও রয়েছে দেখলাম। যাকে তাকে আর আমার কাছে পাঠিয়ে দিও না।”
তন্দ্রার কান দুটো জ্বালা করছে। মেলার গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে ঠাণ্ডা হাওয়ায় অনেকটা ভাল লাগছে। তার নিজের অসুন্দর চেহারার কথা সে ভুলতে বসেছিল। আজ অনেক বছর পর সেই কবেকার তাকে দেখতে আসা পাত্রপক্ষের কুঁচকানো ভ্রু ও মায়ের আক্ষেপ আবারও মনে পড়ে গেল। বিয়ে হয়নি তন্দ্রার। তবে নার্সিং ট্রেনিং করে এখন কলকাতার এক নামকরা হাসপাতালের অভিজ্ঞ নার্স তন্দ্রা সেন খুব ভালই আছে। “নাহ্, আর কোনদিন বইমেলায় আসব না”, মনে মনে ভাবে তন্দ্রা, লাইব্রেরিই ভাল। আর ভাল লিখলেই যে সে সুন্দর মনের মানুষ হয় না, এটাও আজ অনুভব করল। মেঘমিত্রা রায় তার স্বপ্নের জগতে রানী হয়েই তো বেশ ছিল, কেন যে তাকে বাস্তবে দেখতে চাইল? খুব আফসোস হচ্ছে তন্দ্রার। মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলে সে বাড়ির বাস ধরল।
পরদিন হাসপাতালে পৌঁছে সবে অ্যাপ্রন গায়ে গলিয়েছে, কেকা ছুটে এল। “ডঃ বোস তোমাকে এক্ষুণি যেতে বলেছেন। জানো, কাল অনেক রাত্রে একটা অ্যাক্সিডেন্ট কেসের পেশেন্ট এডমিটেড হয়েছে। খুব বড় সাহিত্যিক নাকি। ওই যে গো, তুমি যার লেখা পড়তে ভালবাস?”
“কি বলছিস? মেঘমিত্রা রায়?”
“হ্যাঁ, উনিই। গতকাল মেলা থেকে ফেরবার সময় নাকি ওঁর গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। খুব সিরিয়াস, জানো? বাঁচবে কি না সন্দেহ। মুখটা এমন বিকৃত হয়ে গেছে, বেঁচে থাকলেও আর কেউ হয়তো চিনতে পারবে না!”
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন