ইন্দ্রাণী সমাদ্দার | দ্বন্ধ



সারা শরীরে ব্যথা। বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু​ উঠতে​ হবেই। আজও মিছিল আছে। নাঃ নাঃ কোনও রাজনৈতিক মিছিল নয়। পাপড়ি রাজনীতি করে না।​ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে পাপড়ি সেই ছোট্টবেলার থেকে লড়াই দেখে অভ্যস্ত কিন্তু চোখে শিক্ষক হবার স্বপ্ন নিয়ে মেধা তালিকায় নাম বেরিয়েও যে নতুন লড়াই শুরু হবে সেকথা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।পাড়ার মুচির দোকানে শত ছিন্ন জুতোটাকে​ গতকাল ফেরার পথে পাপড়ি আবার সেলাই​ করিয়েছে। চারপাশে আলোর​ রোশনাইের​ মাঝে নিজেকে আজকাল​ বড্ড ম্লান লাগে। রাস্তায় বাইকে​ চড়ে কমবয়সীদের হুল্লোর উচ্ছাসের ভিড়ে নিজেকে বেমানান মনে হয়। জীবন থেকে সেকি​ ​ অনেক বেশী কিছু চেয়েছিলো । নিজের মেধার সাহয্যে স্বাবলম্বী হতে চাওয়া কী অন্যায়। সেই ছোট্টবেলা থেকে সে মায়ের কষ্ট দেখেছে।​ চাকরি পেয়ে সেই কষ্ট লাঘব করতে চেয়েছিলো কিন্তু কোথায় কী। সে শুধু একা নয় তার মতন অনেকে দিনের পর দিন আন্দোলন করছে। এদের মধ্যে কারো কারো আবার কোলে বাচ্চা। ভাগ্যিস অনেক চেষ্টা করে পাপড়ি বিয়েটা আটকাতে পেরেছিলো।​ ​

পাপড়ির মা​ জল তুলতে গিয়ে শোনে ক্যামাক স্রীটে পুলিশ চাকরিপ্রার্থীদের​ কামড়ে​ দিয়েছে আবার​ গতকাল কালিঘাটে নাকি পুলিশ আঁচড়েও দিয়েছে। এরা কী মানুষ ! ছেলে-মেয়েগুলো নিজের যোগ্যতায় এত দূর পৌঁছেছে তারপর ও এই অন্যায়। পাপড়ি বাড়িতে এই নিয়ে কোনো কথা বলে না। তবে মায়ের মনতো মেয়ে কিছু না বললেও​ সবই বুঝতে পারে ।সেদিন ব্যানার্জী গিন্নী বলছিল মেঘে মেঘে​ বয়সতো মেয়ের কম হয়নি এবার বিয়ে দিয়ে দিতে। ছেলেও খুঁজতে হবেনা । ঘোষেদের ছেলে সেই কবে থেকেই পাপড়িকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে বসে আছে। তবে মুখে না বললেও পাপড়ির মা​ মনে মনে এই বিয়েতে কোনোদিনই রাজি নয়।পয়সার জোর না থাকলে​ নিজের বক্ত্যব্য ইচ্ছে থাকলেও প্রকাশ করা যায় না।​ ঘোষেদের​ ছেলে মাত্র বারোক্লাস পাশ। এই ছেলের কোনোদিন পড়ায় মন​ ছিলোনা।​ বাপের অনেক পয়সা কিন্তু এখনও​ পর্যন্ত ছেলে কোন কাজকম্ম​ করেনা। পাড়া- প্রতিবেশী থেকে আত্মীয়স্বজন সবার মুখেই এক কথা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও -যেনো বিয়ে দিলে মেয়ে আমার কোনো স্বর্গ্যের সিঁড়িতে পা​ দেবে। বিয়ে ঠিক না হলে সারাজীবন মেয়েদেরি কষ্ট। নিজে বিয়ের অভিজ্ঞতা থেকে পাঁপড়ির মা একথা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে। পাঁপড়ির মাকে তার বাবা-মা পছন্দ করে সুন্দর দেখতে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিলো। জমিজমা আছে –চিন্তা নেই মেয়ে তাঁদের সুখেই থাকবে। যতদিন শাশুড়িমা ছিলেন রোজগারের জন্য পাপাড়ির মাকে বাড়ির বাইরে যেতে হয়নি। প্রথমে মেয়ে হল । তারপর ছেলে হয়। টানাটানির সংসারে অভাব আরো বেড়ে গেলো কিন্তু পাপড়ির বাবা রোজ সকাল​ সকাল শার্ট প্যান্ট পড়ে কাজে যেতো না তাস পেটাতে​ যেতো। সংসারের হাড়ি ঠেলতে জমিজমা সব গেছে। এখন শুধু দুই কামরার বাড়িটাই যা সম্বল। শাশুড়ি মারা যাবার পর পাপড়ির মা বাড়ি বাড়ি ঠিাকে কাজে​ যায় অনেক দূরের এক আবাসনে। কাছেও ফ্ল্যাট বাড়ি আছে কিন্তু সেখানে যায়না । পাছে তার কাজের কথা পাঁচকান হয়। জমি নেই, টাকা নেই এখন পারিবারিক সম্মান যা আছে​ সেটাতো ধুলায় মেশানো যায় না । তাই রোজ হন হন করে একঘণ্টা সকালে হেঁটে কাজের বাড়ি যায়। আবার কাজ সেরে সন্ধ্যে বেলা​ অতটা রাস্তা হেঁটে আসে। ছেলে বাপের মত হয়েছে কাজকম্মে​ মন নেই । ক্লাস​ সেভেনের পর স্কুল মুখো হয়নি। এদিকে দুই বছর হল পাড়ার এক মেয়ের সঙ্গে পালিয়ে বিয়ে করেছে। প্রথমে মেনে না নিলেও বাচ্চা হবার পর ওদের মেনে নিয়েছে। পাঁপড়ি টিউশনি করে। নিজের যাতায়াতের টাকাটুকু রেখে বাকি সব টাকা সে তার মায়ের হাতে তুলে দেয়। পাঁপড়ি ও তার মায়ের টাকায় সংসার চলে।

যেদিন মেধাতালিকা বেরিয়েছিল পাঁপাড়ির সেদিন আনন্দ আর ধরে না। আনন্দের চোটে পাঁপড়ির মায়ের চোখে জল এসে যায়। মনে মনে বলেছিল ভগবান আছেন। এতদিন পরীক্ষা নিচ্ছিলেন ।এখন তারা সুখের দিন দেখবে। 

পাঁপড়ি তার মাকে বলে​ ​ –‘ অনেক হয়েছে প্রথম মাসের মাইনে হাতে পেলে তুমি আর কাজের বাড়ি যাবেনা । তোমার কতদিনের সখ সমুদ্র দেখার। এবার আমরা সমুদ্র দেখতে যাব’। সময় চলে যায় কিন্তু সুদিন আসেনা। এখন মেয়ে যতক্ষণ না আন্দোলন সেরে বাড়ি ফেরে ততক্ষণ ভয়ে বুক কাঁপে। পাঁপড়ির মা এই সেদিন টিভিতে দেখে লরি বোঝাই করে টাকা চলেছে। কার টাকা কোথায়​ চলেছে –কে জানে? জানে সবাই কিন্তু মানে কে ? যার হাতে ক্ষমতা ,যার হাতে শক্তি সেই সর্বশক্তিমান। শুধু মনের সঙ্গে সারাদিন নিজের দ্বন্ধ চলে পাপড়ি ও পাপড়ির মায়ের। কি করবে সব স্বপ্ন বিসর্জন দেবে। যাদের পয়সার জোর নেই শুধু মেধা আছে তাঁদের স্বপ্ন দেখা কী বিলাসিতা?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ