পাপিয়া গাঙ্গুলি​ | আপোষে নয় বদলে থাকো



একটি ছোটো মেয়েকে এক অল্প বয়স্ক যুবক রোজ পড়াতে আসতো বাড়িতে। মেয়েটি তখন মেরেকেটে চতুর্থ শ্রেণী। যে সময়ের কথা বলছি তখন রোজ সন্ধেবেলা লোডশেডিং হতো।​ পড়তে বসলে কিছুক্ষণ পর ঝুপ করে অন্ধকার হয়ে যেত। বিদ্যুৎ মন্ত্রীকে গাল দেওয়া হতো।​ হ্যারিকেন জ্বালাতে একটু সময় দিতে হতো৷ এই মিশকালো অন্ধকারের সময়টুকুতে মাস্টারমশাই রোজ ছোটো মেয়েটিকে ভয় দেখাতো - "ঐ কে এলো! " এই বলে। মেয়েটি হ্যারিকেন না আসা পর্যন্ত গুটিসুটি মেরে বসে থাকতো এবং আলো যতক্ষণ না আসতো ততক্ষণ​ ভয়ে ভয়ে কাটাতো। মাস্টারমশাইয়ের সুবিধা। সে সহজে ভয় পাওয়া মেয়েটাকে বাগে আনতে পারতো। এমনি করে রোজ চলতো ভয় দেখানোর খেলা। বাগে আনার চালাকি। সাধারণ চিন্তায় বলে ছোটো মেয়েটি এরকম পরিস্থিতিতে আস্তে আস্তে ভীতু তৈরী হবে।আগত জীবনে সে ভয়ের শিকলে আটকে থাকবে।​ মেয়েটির স্বভাবের পরিবর্তন আসবে। মানে মেয়েটি ভয় পেয়ে থাকতেই অভ্যস্থ হয়ে যাবে।​

গল্পের পরের অংশ হলো এক সন্ধ্যায় মাস্টারমশাই লোডশেডিং হওয়ার পর যথারীতি মেয়েটিকে ভয় দেখিয়েছে। অল্পসময় বাদে​ বাড়ির কাজের মেয়ে হ্যারিকেন নিয়ে এসে ঠক করে টেবিলের ওপর রেখেছে।​ ওমনি পড়ুয়া মেয়েটি চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে পরে​ এবং হাতে একটা মোটা বই নিয়ে​ মাস্টারমশাইয়ের মাথার ওপর সপাটে মারে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

- রোজ রোজ আমায় ভয় দেখানো! অ্যাঁ!​ ​ বাবা বলেছে ভুত বলে কিছু নেই।​ আর কোনোদিন ভয় দেখাবেন? আমি ভীতু নই। বাড়িতে সকলে শান্ত মেয়েটির কান্ড দেখে তো অবাক।​ পাখির মতো মেয়েটা প্রতিবাদ করতে পারে!!​

সেই সময় থেকে মাস্টারমশাই বেপাত্তা হয়ে গেলো। মেয়েটির মুক্তি। মেয়েটি ভয়ের সাথে আপোষ করেনি।

গল্পটা কেন বললাম? কারণ এই ছোটো মেয়েটির সাথেে আজকে আমাদের জনসাধারণের মিল আছে। শাসক আমাদের প্রতিনিয়ত ভয় দেখিয়ে চলেছে। ওরে জনসাধারণ প্রজাগণ আমার কথা মেনে চল। আমাদের বেনিয়মের প্রতিবাদ করিস না। না হলে দেবো জেলে ঢুকিয়ে।​ ভাতা'র লিস্টি থেকে দেবো নামটি কেটে। পাড়া ছাড়া করতে​ বাড়িতে ঠিক দুক্কুরবেলা ঢিল পড়বে কিন্তু কেউ দেখবে না। ক্লাবের ছেলেরা ক্যারামে ব্যস্ত থাকবে। না হলে ওদের আবার পুজোর ফান্ডে টান পড়বে। প্রশ্ন হলো এমন পরিস্থিতি​ মানিয়ে নেওয়াটা কি সমীচীন?​ শীতের দেশের কুকুরের গায়ে লোম বেশি হয়। গরমের দেশে এসে থাকলে শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে মানিয়ে নিতে নিতে অভস্ত্য হয়ে যায়। কারণ সে পোষ্য।

মানুষ মেনে নেওয়ার অভ্যেস করে নিলে তার উৎকর্ষতা থাকেনা।​ চোখ বুজে অন্যায় গিলে নিলে জেলি লজেন্সের মত রূপ ধরে দিন গুজরান হয়ে যেতে পারে তবে বেশিদিন অন্যায়ের শিকার না হয়ে বেঁচে থাকা কঠিন হয়।​

গল্পের ছোটো মেয়েটি পরিস্থিতি মেনে নেয়নি,আপোষ করেনি উল্টে​ প্রতিবাদ করেছে। ভয় থেকে রেহাই পেয়েছে। নিজের ব্যক্তিত্ব সামলাতে পেরেছে। অন্যথা হলে শান্ত মেয়েটি ভীতু তৈরী হতো। মেয়েটি বদলে যায়নি বদল এনেছে।​

আগেই বলেছি সাম্প্রতিক রাজনৈতিক চালচলন হচ্ছে উপরোক্ত গল্পটার প্রথম পর্যায়ের ধাঁচে গড়া। গরু খেয়োনা।​ খেলেই বাঁশের আগায় ঝুলিয়ে বাপের বিয়ে দেখিয়ে দেবো।​ রানীমা চান​ তাই পার্কের ঘাসের রঙ আসমানী নীল হবে। সবুজের রঙ বড্ড বশংবদ লাগে। তোমার রক্ত আমার রক্তের রঙ লাল। চামড়ার তলায় লুকিয়ে রাখো বাপু। লাল রক্ত গরম হলে অধিকার বুঝতে লাইন পরবে। রাজপথে জোড়া পায়ের সমুদ্র আছড়ে পরবে। দেখছো না কেমন অনশন নামক নাটকে বসেছে অশিক্ষিত কতগুলো মানুষ।​ ওরা কি পড়েছে রানী কাহিনী!​ ওরা কি শিখছে বেসুরো গান!​ ​

​সামলানো মুশকিল।​ মন ঘুড়িয়ে দাও ভান্ডারের সবজে নোটে। অনুদানের মখমল চাদরে গুটিয়ে রাখো বঞ্চনা, বেকারত্ব, অনুশাসন।​ এসবই হলো গোলাপ গাছের ফুলের মতো। পাতার আড়ালে লুকিয়ে রাখো চোখ রাঙানীর মতো কাঁটা।​ দাসত্বের চোখের ভাষা বদল হলেই ভয়ের গান শোনাও। এমনি করেই তো বসে রাখা যায় প্রজাদের। ভয় পেতে পেতে ভীতু হবে। ভীতু হতে হতে শিরদাঁড়াহীন হবে। তারপর শীত ঘুম নিশ্চিন্তের।​ ঘুম ভেঙে মাথা তুললেই ডান্ডায় ঠান্ডা।​ একটা জাতি এমনি করে চোখ বুজে কুন্ডলী পাকিয়ে থাকতে পারেই। বদলে যেতেই পারে সময়ের প্রবাহে। শক্ত শিরদাঁড়া একদিন পুঁইশাকের মতো কোমল হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু তাতে ভালো থাকা বিষম দায় হয়ে ওঠে। লতিয়ে মাটি আঁকড়ে থাকলে পদপিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। আকাশের কাছ থেকে নীচে নেমে আসা।​ প্রগতির হাওয়ার সাথে মাথা দুলিয়ে খেলতে না পারা। কেউ তুলে ধরলে তবেই মাথা তুলে দাঁড়ানো। খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত মানুষ তো স্বভাবত তা নয়। তারা লড়াই লড়াই, লড়াই চায়। পতাকার রঙে মিশিয়ে দেয় ছিনিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার।​ প্রতিবাদের গানে পা মেলায় সূর্য ওঠা দিনের দিকে। বদল আনে অন্ধকার রাত থেকে দিনে। বদল আনে মসনদে। শোষন, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে​ প্রতিবাদ সংগঠিত হয় হাজার কন্ঠে " মানছি না। মানবো না। " মেহনতী মানুষ বদলায় না বদল আনে রঙীন ভবিষ্যতের আলোয়। মানুষ তুমি মানুষ।​ বদলে যেওনা, বদল আনো।​

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ