পশ্চিমবঙ্গে সিপিআইএম আর আন্দোলনে নেই। কথাটি যাঁর তিনি যে সে ব্যক্তি নন। সর্বভারতীয় কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং সিপিআইএম পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হান্নান মোল্লা। নিজের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তিনি এও জানিয়েছেন, আন্দোলনে না থাকলে মানুষের আস্থা অর্জন করা যায় না। প্রসঙ্গত সেই সাথেই তিনি সর্বভারতীয় কৃষক আন্দোলনের দৃষ্টান্ত দিয়ে আন্দোলনে থাকা না থাকার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টাও করেন। রাজ্যে সিপিআইএমের আন্দোলনে থাকা না থাকা নিয়ে তাঁর মতো পোড় খাওয়া ব্যক্তিত্বের এই মত নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনা সমালোচনা হবে হয়তো। কিন্তু তাঁর এই মতের সাথে একেবারে সাধারণ রাজ্যবাসী, তিনি যে দলেরই সমর্থক হন না কেন। সহমত পোষন করবেন নিশ্চয়। তার একটাই কারণ। সর্বজন শ্রদ্ধেয় হান্নান মোল্লা নতুন কোন কথা বলেননি। পরিবর্তনের হাত ধরে নতুন মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের পর থেকে বিগত এক দশক ধরে এটাই রাজ্যবাসীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতায় কারা খুশি আর কারা ব্যথিত। কাদের কপাল খুলে গিয়েছে। আর কাদের কপাল পুড়েছে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে, রাজ্যবাসী মাত্রেই সত্যটা জানে। সেটি হান্নান মোল্লার মতো সর্বভারতীয় নেতা বল্লেও জানে। না বল্লেও জানে। বস্তুত হান্নান মোল্লা রাজ্যবাসীর সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকেই স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন মাত্র।
যাঁদের স্মরণশক্তির ধার একেবারে কমে যায়নি। তাঁরা দেখেছেন, পথ আর সিপিআইএম কিরকম ভাবে সমার্থক ছিল একসময়। আন্দোলন আর বামপন্থা কিভাবে পরস্পরের পরিপূরক ছিল একসময়। সত্তর দশকের উত্তাল সময় কিংবা তার আগে পরে। আশির দশকে রাজ্যেজুড়ে সর্বাত্মক ক্ষমতা বিস্তারের সাফল্যের সময়েও। সেই সিপিআইএম দলটিকে সারদা কেলেঙ্কারির মতো ভয়াবহ দুর্নীতিতে শত মানুষের মৃত্যুতেও পথে নামতে দেখা যায়নি। এক আধজন সুজন ভট্টাচার্য্যের নেতৃত্বে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সংঘবদ্ধ হওয়া, বিকাশ ভট্টাচার্য্যের আইনের দারস্থ হওয়া আর সামাজিক আন্দোলন এক কথা নয়। একথা রাজনীতি বিমুখ মানুষও জানে। ধরা যাক সারদা কেলাঙ্কারিতে শতাধিক মানুষের মৃত্যু। আর লক্ষাধিক মানুষের সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনাটি যখন বেআব্রু হয়। তখনো বাম শক্তিই রাজ্যের ক্ষমতায়। আর বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। কি হতে পারতো? ঘটনা ঠিক তেমনটি হলেই? না এই বিষয়ে কল্পনার কোন আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজনই নেই। সকলেই সহমত হবেন। হ্যাঁ অন্ধভক্ত শুধুই যে গেরুয়া রঙে বিশ্বাসী হয় তাও নয়। অন্ধভক্তি যেকোন রঙকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়ে উঠতে পারে। এবং বিকশিত হয়ে ওঠেও। সেইরকম অন্ধভক্তরা অবশ্য তর্ক করতেই পারেন। বাম আমলে সারদা কেলাঙ্কারি ঘটতোই না। ঘটেও নি। তাই এই নিয়ে তর্ক চলে না। বেশ। কথাটি যখন সত্যমূলক তখন ধরা যাক এই ঘটনা বাম আমলে না হয়ে কংগ্রেস আমলে ঘটলে কি হতো? ষাট সত্তর দশকে? কমিউনিস্টরা তখনো কি বিগত এক দশকের মতো ঘরে দরজা এঁটে বসে থাকতো রাজ্যজুড়ে? নিশ্চয়ই নয়।
তবে কি বামপন্থীদের প্রকৃতি বদল হয়ে গিয়েছে? পথে নেমে জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে গণ আন্দোলন সংগঠিত করার বাস্তব প্রয়োজন আর বোধ করছেন না তাঁরা? এমনকি জনগণের পক্ষে না থেকেও কিভাবে গণ আন্দোলনের মকশো করতে হয়। চোখের সামনে সেই ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাও তো বামপন্থীরা লাভ করেছেন ২০০৬’ এর পরবর্তী সময়ে। ফলে গণ আন্দোলনের গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায়ও যে নেই, সেই বিষয়ে নিশ্চয় তর্ক চলে না।
বিগত দুই দশকের রাজ্য রাজনীতিতে গণ আন্দোলন সংঘটিত হওয়ার বদলে গণ আন্দোলনের মকশো করার কাজ অনেক বেশি হয়েছে। সৌভাগ্যের কথা। রাজ্যের বামপন্থীরা সেই মকশো কর্মের সংস্কৃতিকে কোনদিন বরণ করেন নি। কিন্তু গণ আন্দোলন সংঘটনের মকশো করার এই নতুন সংস্কৃতির বিরুদ্ধেও তাঁরা আজ অব্দি কোন গণ আন্দোলন সংগঠিত করার কোন প্রয়াসই নেননি। অর্থাৎ কোনভাবেই তাঁদেরকে আর আন্দোলনমুখী হতে দেখা যাচ্ছে না। সারদার সময়েও নয়। নারদার সময়েও নয়। সিণ্ডিকেট রাজত্ব তোলাবজি কাটমানি টেট কেলঙ্কারি সাম্প্রদায়িক উস্কানি কৃষি আইন শ্রম আইন শিক্ষা আইন সরকারী সম্পত্তির হরির লুঠ, না কোন বিষয়েই জনগণের পাশে সিপিআইএমকে আর আন্দোলনে দেখা যায়নি। আর সেই কথাটিই অবশেষে স্বীকার করে নিয়েছেন বর্ষীয়ান হান্নান মোল্লা।
এখন গণ আন্দোলন বিমুখ সিপিআইএমকে দেখে যারা নিশ্চিন্ত। যারা খুশি’র উপরে খুশি। তাদের কথা থাক। আন্দোলন বিমুখ সিপিআইএম যাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। তাঁদের দিক থেকে বিষয়টি দেখার চেষ্টা করা যাক বরং। সাড়ে তিন দশক ক্ষমতায় থাকতে থাকতে ক্ষমতায় থাকাকেই যদি একটি দল অভ্যাসে পরিণত করে নেয়। ক্ষমতায় থাকাকেই যদি রাজনীতির অন্তিম বিষয় বলে বিশ্বাস করতে শুরু করে দেয়। তাহলে সেই দলের অস্থিমজ্জার ভিতরেই গণ আন্দোলনের শক্তি হারিয়ে যেতে বাধ্য। ক্ষমতার গদি থেকে নেমে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলা জনতার দাবিকে সে আর আপন দাবি বলে অনুভব করতে পারে না। পারার কথাও নয়। ক্ষমতায় থাকাই যখন একটি দলের কাছে অভ্যাসে পরিণত হয়ে রাজনীতির অন্তিম লক্ষ্য বলে স্থির হয়ে যায়। সিপিএমের মূল সমস্যা সেখানেই। ইতিহাসে এর একটি পূর্ব দৃষ্টান্তও রয়েছে। ব্রিটিশের কাছে পরাভুত মুসলিম শাসক সম্প্রদায়ের দশাও আজকের সিপিআইএম দলটির অনুরূপ হয়েছিল। ইতিহাসের সেই পর্বে মুসলিম সম্প্রদায় ক্ষমতা হারানোর শোকে দেশের মূল স্রোত থেকে এবং চলমান কাল থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। ভারতবর্ষ ও এই বাংলার ইতিহাস সেই সাক্ষ্য আজও বহন করে চলেছে। রাইটার্সের দখল হারানোর শোক সাময়িক। সেটি কাটিয়ে ওঠাও যেত। যদি না সিপিআইএম চলমান সময় ও জনতার থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়তো। এখন প্রশ্ন, জনতাই যে দলের উৎস ছিল। জনতাই যে দলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল। সেই দলটি কবে এবং কিভাবে জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাড়ে তিন দশকে সিপিআইএম দলটির রাজনৈতিক বিবর্তনের ধারাটিকে অনুসন্ধান করতে হবে। ক্ষমতায় গিয়ে ক্ষমতাকে ধরে রাখাই যখন একটি দলের মূল রাজনীতি হয়ে ওঠে। তখন থেকেই সে দিনে দিনে ধীরে ধীরে জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার দিকে ঝুকে পড়তে পারে। অন্ধভক্তরা অবশ্য সেকথা স্বীকার করতে রাজি থাকে না। সেটা স্বাভাবিক। পাড়ায় পাড়ায় নাগরিক কমিটি। ক্লাবে ক্লাবে দখলদারী। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে বাকি প্রতিটি ক্ষেত্রে পার্টির একছত্র আধিপত্য বিস্তার। এইগুলির কোনটিই জনস্বার্থে ছিল না। ভোটের স্বার্থে ছিল। ভোটের পর ভোট পার্টিকে জিতিয়ে নিয়ে আসার মেকানিজমেই এই নেটওর্য়াক গড়ে তোলা হয়েছিল। যে নেটওয়ার্কের সাফল্যেই ৩৪ বছর রাইটার্স দখল করে রাখা সম্ভব হয়েছিল।
রাইটার্সের দখল কার কাছে। সেই নিয়ে জনতার বিশেষ মাথাব্যথা থাকে না। জনতার মাথাব্যথা তখনই শুরু হয়। জনতা যখন কোন জালে আটকিয়ে যায়। সাড়ে তিন দশক জুড়ে জনতা দিনে দিনে সিপিআইএম এর তৈরী এই এক নেটওয়ার্কের দমবন্ধ করা জালে আটকিয়ে গিয়েছিল। ঘটনা হল। দলীয় নেতৃত্ব, জনতাকে এই নেটওয়ার্কে বেঁধে ফেলাকেই জনসংযোগ বলে মনে করতে শুরু করলেন। জনতার পাশে থাকা বলেই বিশ্বাস করতে চাইলেন। এবং সেই ভ্রান্ত ধারণাই তাঁদের চেতনায় অভ্রান্ত হয়ে দানা বেঁধে উঠল দশকে দশকে। সিপিআইএম দলটির জন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার সেটাই প্রধান কারণ। জনতাও প্রথম প্রথম ঘটনাটি ধরতে পারেনি। পারার কথাও নয়। কিন্তু যেদিন জনতার রাডারে সেটি ধরা পড়ে। সেদিন থকেই সিপিআইএম’এর ভিতের তলা থেকে মাটি সরতে থাকে। যার পরিণতি ২০১১। জনতা সিপিআইএমকে নিজের পাশে চেয়েছিল। দলের ভোট ক্যাপচ্যারিং মেশিনারীর নেটওয়ার্কে বন্দী হয়ে পড়তে চায়নি। রাইটার্সের দখল হারানো সিপিআইএমের কাছে প্রধান সমস্যা তাই, তিন দশকের গড়ে তোলা সেই একাধিপত্যকামী নেটওয়ার্কটি হাতছাড়া হয়ে যাওয়া। ক্ষমতার সুতো হাতে ধরা না থাকলে, এই ধরণের একাধিপত্যকামী নেটওয়ার্কের জাল ছিঁড়ে যেতে বাধ্য। শাসকের ক্ষমতাই এই নেটওয়ার্ক বিস্তারের একমাত্র চাবিকাঠি। ফলত রাইটার্সের দখল হারিয়ে সিপিআইএম দলের দশাও নিধিরাম সর্দারের মতোন। দলীয় নেতৃত্ব তাই আজ ঢালহীন তলোয়ারহীন হাতে নিজের অক্ষমতার বিষয়ে সচেতন বলেই আন্দোলনে নামার শক্তি অনুভব করতে পারছে না। আর এই নিধিরামের দশায় যা হয়। সিপিআইএম দলটিরও ঠিক সেটাই হয়েছে। যাদেরকে কাজে লাগিয়ে এই বিপুল নেটওয়ার্ক চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো। তাদের অধিকাংশই রাইটার্স ছেড়ে নবান্নের শরণাপন্ন হয়ে গিয়েছে। কারণ সেটাই তাদের পেশা। নয়তো সংসার চলবে কি করে? যার ভিতরে নেতা কর্মী সমর্থক সব ধরণের মালমশলাই রয়েছে। ফলে জমিদারী হারানো জমিদারের মতোন সিপিআইএম দলটি’র হাতে এখন বসত বাড়িটুকু বাদে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকার কথাও নয়।
তাই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে বসে তো আর গন আন্দোলন শুরু করা যায় না। ফলে গোটা দলটিকেই আজ আর কোন আন্দোলনে দেখা যায় না। যায়নি গত এক দশকেও। হান্নান মোল্লার কথায় রাজনৈতিক কর্মসূচী যে গণ আন্দোলনের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে না। তার ফলাফল তো নির্বাচনের পর নির্বাচনেই প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। ফলত সাড়ে তিন দশক রাইটার্সের দখল রাখা সেই সিপিআইএম দল ও তার নেতৃত্বকে নতুন করে জনতার দাবির পাশে দাঁড়াতে দেখতে পাওয়া যাবে। এমন আকাশ কুসুম কল্পনা করার দিন বোধহয় শেষ হয়েছে। তবুও সেই আশাটুকু নিয়ে যাঁরা রাতে ঘুমাতে যেতে চান। তাঁদের দশাও নেতাজী ফিরে আসবেন আশা নিয়ে ঘুমোতে যাওয়া বাঙালির মতোন। তবে কি রাজ্যবাসীকে এইভাবেই জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ নিয়ে ঘর করতে হবে? হবে কি হবে না। সেটি নিতান্তই রাজ্যবাসীর বিষয়। সময় সব কিছুর উত্তর দেয়। আবারও দেবে। নিশ্চিত ভাবেই।
১লা ফেব্রুয়ারী’ ২০২২
কপিরাইট সংরক্ষিত
0 মন্তব্যসমূহ
সুচিন্তিত মতামত দিন